সায়ন্তনের মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। আজই ICSE এর শেষ পরীক্ষা দিয়ে ঘরে এল। Geography এর paper ছিল। তবে main subject এর মধ্যের নয়, optional paper। এটা নেওয়ার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না। বরঞ্চ computer নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কলেজে Engineering এ IT নিয়ে পড়ার ইচ্ছাটা ওর স্কুলের বন্ধু সুরজের সঙ্গে কথা বলেই জেগেছিল। কিন্তু ওর দাদুই একরকম জোর করে এই subject টা নেওয়া করেছিল। বলেছিলেন, কটা টাকার জন্য মালিকের মন জুগিয়ে চলার থেকে দেশের হয়ে IAS হয়ে কাজ করা অনেক সম্মানের। তাছাড়া এই পরীক্ষায় Geography বা history নিলে ভাল score করা যায়।
প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও subject এর মধ্যে ঢুকে পড়ার পর সায়ন্তনের ইচ্ছা বেড়ে গেল। ভারতের ছোটনাগপুর, ওয়েস্টার্নঘাট, হিমালায়ান পর্বতমালা পড়তে পড়তে কখন যে আফ্রিকায় ঢুকে পড়েছিল বুঝতেও পারেনি। কত অসংখ্য পর্বতমালা গোটা আফ্রিকা জুড়ে আছে। ইথিওপিয়ার মাউন্ট আবুনা জোসেফ, টুল্ল্যু দিমটু, মাউন্ট চোকা, মরোক্কোর Mgoun Canyon, আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ক্যামেরুন, মাউন্ট করিসিম্বি, মাউন্ট স্ট্যানলি, মাউন্ট কেনিয়া, কিলিমানজারো। মাউন্ট স্ট্যানলি, মাউন্ট বেকার বা কিয়াঞ্জা এবং মাউন্ট স্পিকের সাথে একসাথে বুজুকু উপত্যকাকে ঘিরে একটি ত্রিভুজ গঠন করে। আর তাঞ্জানিয়া ও কেনিয়ার সীমানায় আফ্রিকার সর্বোচ্চ আগ্নেওগিরি কিলিমাঞ্জারোকে তো আফ্রিকার ছাদ বলা হয়। এর তিনটে শৃঙ্গ Kibo, Mawenzi, and Shira এর মধ্যে কিবো (৫,৮৯৫ মিটার) সবচেয়ে উঁচু।
মাউন্ট স্ট্যানলি নামটা দেখে সায়ন্তনের ছোটবেলায় দাদুর বলা গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল। কি যেন নাম ছিল! ও হ্যাঁ বিখ্যাত লেখক বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যের লেখা 'চাঁদের পাহাড়'। তাইতো, ওটাতো উগান্ডার রুয়েনজোরি রেঞ্জের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। এটাকে মাউন্ট এলগ্যানিমাও বলা হয়, যা কঙ্গো এবং উগান্ডা উভয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পর্বত এবং কিলিমাঞ্জারো এবং মাউন্ট কেনিয়ার পরে আফ্রিকার তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত। পূর্ব আফ্রিকার নীল নদীর এটাই তো উৎস। এটাও দাদুর কাছ থেকে শোনা। বিখ্যাত ভূগোলবিদ টলেমির লেখায় ছিল। ভূপর্যটক Diogenes circa ১১০ সালে রুয়েনজোরি রেঞ্জের এই অঞ্চলটার কথাই বলেছিলেন। ডায়োজেনিস পূর্ব আফ্রিকা দিয়ে ঢুকে কি করে যেন নীল নদের এই তুষার গলা উৎসে এসে পৌঁছেছিলেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে ওখানেই রাতের বিশ্রামের জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। রাতে ঘুম ভেঙে দেখেন চাঁদের আলোয় গোটা গ্লেসিয়ারটা ঝকমক করছে। মুহুর্তের জন্য ডায়োজেনিসের মনে হয়েছিল, তিনি বোধহয় চাঁদে চলে এসেছেন। তখন ক্যামেরার জন্মই হয় নি। সারা রাত মুগ্ধ হয়ে সেই আসাধারণ দৃশ্য মনেই এঁকে নিয়েছিলেন। সেইদিন থেকেই পৃথিবীতে চাঁদের পাহাড়ের জন্ম হয়েছিল।
রোয়েনজোরির পর্বতগুলি খাড়া, এবড়োখেবড়ো এবং মেঘে ঢাকা থাকে। এই পর্বত শ্রেনীটা অ্যালবার্টাইন রিফ্ট সৃষ্টির কারণে পৃথিবীর ভূত্বকের উপর তৈরী হয়েছিল, যা তাদেরকে ভূতাত্ত্বিকভাবে অন্যান্য উচ্চ পূর্ব আফ্রিকান আগ্নেয় পর্বতমালার থেকে আলাদা করে তুলেছে। এই আল্পাইন অঞ্চল তাই অনেক বিপন্ন প্রজাতির ঘর।
এখানকার বান্টু-ভাষী মানুষ বাকনজোরারা প্রায় 300 বছর আগে কঙ্গো থেকে ভ্রমণ করে এই জায়গায় এসেছিল। এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুসারে ব্রিটিশ অভিযাত্রী জেমস গ্রান্ট এবং জন স্পেক, 1862 সালে নীল নদের উৎস অনুসন্ধান করার জন্য রুয়েনজোরি পর্বতমালায় প্রবেশ করেন এবং ডায়োজেনের বর্ণনার মত বরফে ঢাকা শিখরগুলিকে দেখতে পান। তবে পর্বতারোহী স্কট এলিয়টের আলেকজান্দ্রা আর মার্গারিটার মাঝখানের পর্বত শিরা পেরিয়ে মাউন্ট স্ট্যানলীর সামিট করার বর্ননাও অসাধারণ। জায়গাটা বোল্ডার আর পেঁজা বরফ মিলে প্রত্যেক পদক্ষেপকে যেন মৃত্যুফাঁদ করে রেখেছে। এইজন্যই বোধহয় আফ্রিকাকে বলা হয় ভয়ংকর সুন্দরের দেশ। অবশ্য এর পাশাপাশি অন্ধকারের দেশ বলা হলেও কত অসংখ্য উপকথা এইসব অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার ঠিকানা নেই।
সায়ন্তন অজান্তেই কখন যে শংকর হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারে নি।
কলমে - গৌতম রায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন