১৯২৮ সালের ১৯শে ডিসেম্বরের সকাল। লাহোর স্টেশনে থিকথিক করছে পুলিশ। শ্যেণদৃষ্টি নিয়ে নজর রাখছে আগত প্রতিটি যাত্রীর ওপর। সন্দেহ হলেই বাক্সপ্যাঁটরা খুলে তল্লাশি চালাচ্ছে। এমন সময় স্টেশনের বাইরে এক টাঙ্গা এসে থামলো। সেখান থেকে নামলেন ইউরোপীয়ান পোষাকে সজ্জিত এক যুবা। সেদিন লাহোরে চলছিল তীব্র শীতল বাতাস। প্রবল শীত আর জোরালো বাতাসের জন্য সেই যুবকটির পরিধানে একটি ভারী কোট। মাথায় খানিকটা কাত করে বসানো ফেল্ট হ্যাট, তাতে মুখের কিয়দংশ আড়াল হয়ে রয়েছে। হাতে ছড়ি। পেছন পেছন নামলেন শিশুসন্তানসহ তাঁর মেমসাহেব স্ত্রী। পরিধানে ইংরেজী পোশাক, কোট, টুপি। বাক্স মাথায় তাঁদের এক পরিচারকও চলেছে সঙ্গে। অভিজাত এই বিলিতি দম্পতিকে সন্দেহ করা বাহুল্যতা ছাড়া আর কিছু নয়। পুলিশ এখন ব্যস্ত অন্য কাজে।
কেতাদুরস্ত
সাহেবী পোশাকের যুবাটি পরনের ওভারকোটের কলারখানি সামান্য তুলে মুখটা আড়াল করলেন
বলে যেন মনে হল। সে যাকগে, এসব নিয়ে পুলিশের এখন মাথা
ঘামানোর সময় নেই। দিন দুয়েক আগে দিনের বেলায় তাদের ডেপুটি সুপার সন্ডার্স
ভারতের বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন, তাও কিনা
আবার পুলিশ অফিসের সামনে। সেই কারণে পুলিশ এখন কুখ্যাত বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের
সন্ধানে রয়েছে।
স্টেশনের কাউন্টার থেকে দু'টো ফার্স্ট ক্লাস আর একটা থার্ড ক্লাসের টিকিট কেটে লাহোর ভাতিন্দা চেনাব এক্সপ্রেসে আধুনিকা স্ত্রী এবং ঘুমন্ত সন্তানসহ ফার্স্ট ক্লাসের কামরায় উঠে পড়লেন সেই যুবক। তাঁদের পরিচারকটি মনিবের মালপত্র তুলে দিয়ে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে নিজের কামরায় উঠে পড়লো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ট্রেন এসে থামলো হাওড়া স্টেশনে। শিশুসন্তান সহ সেই দম্পতি স্টেশনে পা রাখা মাত্র ছুটে এলো যুবতীটির "আসল" স্বামী। মৃদুস্বরে স্ত্রীর কানে কানে তারিফ করে বললেন, "দুর্গা, আজ সত্যিই তুমি ইতিহাস গড়লে!" আর ওদিকে পুলিশ ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না যাদের ধরার জন্য দু'দিন ধরে বসে আছে, নাকের ডগা দিয়ে তারা লাহোর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যুবকটি কে, সে তো সহজেই আন্দাজ করে ফেলা যায়। কিন্তু পরিচারক? সেও কিন্তু হেলাফেলার মানুষ নয়।
কিন্তু কে এই দুর্গাদেবী? দুঃখের বিষয় হলো, দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিলেও কেউ মনে রাখেনি তাঁর কথা। শুধু কী আর নিজের জীবনের ঝুঁকি! নাহয় সেজেছিলেন নকল বউ। কিন্তু কোলের শিশুটি যে তাঁর নিজেরই সন্তান ছিল। পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়ে নিজের এবং সন্তানের জীবনকে বাজি রেখে দেশের স্বার্থের কথা ভেবেছিলেন তিনি। তিনি দুর্গাদেবী।
জন্ম ও
বিবাহ :
১৯০৭ সালের ৭ই অক্টোবর এলাহাবাদের এক গুজরাতী পরিবারে দুর্গাদেবীর জন্ম হয়। শৈশবেই তিনি মাকে হারান। কিছুদিন পর সংসারবিমুখ হয়ে তাঁর বাবাও সন্ন্যাসী বেশে গৃহত্যাগ করেন। বাবা মাকে হারিয়ে একলা হয়ে যান ছোট্ট দুর্গা। অবশেষে মাসীর কাছে বড়ো হন তিনি। মাত্র বারো বছর বয়সে ভগবতীচরণ বোহরার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর চলে আসেন লাহোরে। ভগবতী তখন লাহোর ন্যাশনাল কলেজের পড়ুয়া এবং ইতালির ম্যাতসিনির আদর্শে উদ্বুদ্ধ। সহপাঠী ভগৎ, সুখদেব, রাজগুরুদের নিয়ে বাড়িতে প্রায়ই জমায়েত বসে। সুবক্তা ও মিশুকে হওয়ার কারণে তাঁর স্ত্রীও বন্ধুমহলে শীঘ্রই দুর্গাভাবী নামে পরিচিত হতে শুরু করেন। বন্ধ হয়ে যাওয়া পড়াশোনা পুনরায় শুরু করেন বাড়িতেই।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ড :
দুর্গার স্বামী ভগবতীচরণকে একপ্রকার ধনী পরিবারের সন্তান হিসাবেই আখ্যা দেওয়া যায়। তাঁর পিতা ইংরেজদের দেওয়া "রায়সাহেব" উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু লাহোরে বিশাল স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও অর্থের লোভে বিপ্লবের পথ ভোলেননি ভগবতীচরণ। পাশে পেয়েছিলেন দেশোদ্ধারে ব্রতী উপযুক্ত অর্ধাঙ্গিনীকে। দিল্লীর সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি হলে বোমা মারার পর ভগৎ সিং যখন গ্রেফতার হয়ে লাহোর জেলে বন্দী, তখন দুর্গা বহু মিটিং মিছিল সংগঠন করেছিলেন। লাহোর জেলে ৬৩ দিন অনশনের পর বাংলার দধিচী যতীন দাশের মৃত্যু হলে তাঁর নশ্বর দেহ ট্রেনযোগে নিয়ে আসেন বাংলায়। হাওড়া স্টেশনে দেহ তুলে দেন নেতাজীর হাতে।
মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ভগবতীচরণ নিজের নামে ওয়ারেন্ট বের হতে পারে আশঙ্কায় যখন ফেরার ছিলেন, তারই মধ্যে একদিন স্ত্রীর সাথে দেখা করে বলেন ব্যাঙ্ক থেকে তিনি যেন পাঁচশ' টাকা তুলে রাখেন। দরকার লাগতে পারে। সুখদেব একদিন এসে সেই টাকা দুর্গাদেবীর কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ সেইসময় লাহোরের গোপন আস্তানা থেকে বিপ্লবীদের একে একে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। সমস্যা বাঁধলো রাজগুরু আর ভগৎ সিংকে নিয়ে। পুলিশ তাঁদের শিখ যুবকের বেশভূষায় যেভাবে চিনতো, চুল কেটে সাজসজ্জা বদল করার পর সহজে চেনা কঠিন হলেও মুখের আদলে তাঁদের সন্দেহ করতে পারে। তখন মুশকিল আসানের ভূমিকা পালন করেছিলেন দুর্গাদেবী, নিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
ভগৎ সিংয়ের সাথী সুখদেব দুর্গাদেবীকে বলেছিলেন এক বিপ্লবীকে বাঁচাতে লাহোরের বাইরে তাঁকে যেতে হবে এবং সেই লোকটির স্ত্রী হয়েই যেতে হবে৷ তখনকার সামাজিক পরিকাঠামোয় এহেন প্রস্তাব শুনে একজন নারীর পক্ষে চমকে ওঠা স্বাভাবিক। দুর্গাদেবীও সেদিন ওই প্রস্তাব শুনে চমকে উঠেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন কে ওই লোকটি। সুখদেব বলেছিলেন, "সে যেই হোক"। কিছুমাত্র বিলম্ব না করে দৃঢ়কণ্ঠে দুর্গাদেবী বলেছিলেন, "ঠিক আছে, আমি যাব"।
তখন সুখদেব তাঁকে জানান, লোকটি সেদিন রাতে তাঁদের বাড়িতে থাকবে৷ ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা। দু'জন লোককে নিয়ে সুখদেব ঢুকলেন ভগবতীচরণের বাড়ি। একজন লম্বা চওড়া সাহেবমার্কা যুবক, আরেকজন সাদামাটা চেহারায় সাহেবের পরিচারক। ভগৎ সিংকে দুর্গাদেবী চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু চিনতে পারেননি পরিচারকবেশের রাজগুরুকে৷ তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ কাঁসার থালায়। রাতের বিছানা জোটেনি, বেঞ্চের গদিতে রাত কাটাতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে শহীদ রাজগুরুর প্রতি অনিচ্ছাকৃত অবহেলার আক্ষেপ দুর্গাদেবীর মনের গভীরে চিরকাল রয়ে গিয়েছিল।
সেইমতো পরিকল্পনামাফিক সাজসজ্জা করে সকাল সকাল রওনা হয়ে যান তাঁরা। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নির্বিঘ্নে ট্রেনে ওঠার পর ২১শে ডিসেম্বর কানপুরে যাত্রাবিরতি করে পৌঁছে গেলেন লক্ষ্ণৌ। পলায়ন পরিকল্পনার অঙ্গ সেটাই, কারণ লাহোর থেকে আসা সব ট্রেনের যাত্রীদের ওপর পুলিশের বিশেষ নজরদারি থাকবে। লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় দলের সমর্থক সুশীলাদিদির কাছে টেলিগ্রাম পাঠানো হল। লক্ষ্ণৌ স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ভগৎ সিং ও দুর্গাদেবী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। রাজগুরু এখান থেকে পালিয়ে গেলেন বারাণসীর পথে।
পুনরায় পোশাক বদল হল৷ ভগৎ সিং ও দুর্গাদেবী এবার বিহারী গোয়ালাদের পরিচ্ছদ নিলেন, রওনা হলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। দলের নেতা চন্দ্রশেখর সকলের নিরাপদে পালানোর ব্যবস্থা করে সুখদেবের মায়ের সাহায্যে হিংওয়ালা ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে লাহোর থেকে পুলিশের চোখের আড়ালে চলে গেলেন৷ ওদিকে ঝঞ্ঝাটহীন ভাবে হাওড়া পৌঁছে গিয়েছেন ভগৎ সিং, দুর্গাদেবী আর তাঁর শিশুপুত্র। স্টেশনে অপেক্ষারত দুর্গাদেবীর স্বামী ভগবতীচরণ স্বাগত জানান তাঁদের।
সেই বছরই কলকাতা থেকে ফেরার পর দুর্গাদেবী রাজধানী দিল্লীর বুকে ‘হিমালয়ান টয়লেট’ নামে এক প্রসাধন সামগ্রীর কারখানা স্থাপন করেছিলেন। সেই নামের আড়ালে সেটি ছিল বোমা তৈরির কারখানা। অ্যাসোসিয়েশনের এক সক্রিয় সদস্য বিমল প্রসাদ জৈনকে দিয়ে সেই বোমার কারখানা চালাতেন তিনি। দুর্গার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, রাজধানীর বুকে জনবহুল প্রকাশ্য রাস্তার ধারে এমন কাণ্ডকারখানা চলতে পারে তেমনটা কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। তাঁর এই বিশ্বাস সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। ইংরেজ শাসকরা এই বিষয়ে কখনও সন্দেহ করতে পারেনি।
দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে কাজকর্ম ঠিকঠাকই চলছিল। এমনসময় ঘটে যায় এক অঘটন। ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরা তখন কারাগারে বন্দী। আদালত যাওয়ার পথে তাঁদের ছাড়ানোর জন্য বিপ্লবীরা ইরাবতী নদীর ধারে শক্তিশালী বোমা বানাচ্ছিল। সেখানে আচমকাই এক বিস্ফোরণে দুর্গার স্বামী ভগবতীর জীবন যায়। এহেন দুঃসংবাদেও মুষড়ে পড়েননি দুর্গাদেবী। দলের কাছে আবেদন করেন, তাঁর স্বামীর ভাগের কাজের দায়িত্বও যেন তাঁকে দেওয়া হয়। ১৯৩০ সালের ৮ই অক্টোবর, ভগবতীর মৃত্যুর মাত্র চার মাসের মাথায় সাউথ বোম্বের ল্যামিংটন রোডে চলন্ত গাড়ি থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর টেইলার ও তাঁর স্ত্রীর ওপর গুলি চালান দুর্গা। বোম্বে প্রভিন্সে এটি সম্ভবত মহিলা দ্বারা সশস্ত্র হামলার একমাত্র ঘটনা। এরপর প্রায় দু'বছর ছেলে সচিকে নিয়ে দুর্গা পালিয়ে বেরিয়েছেন সারা উত্তর ভারত। ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশ তাঁকে লাহোর থেকে গ্রেপ্তার করে এবং বিচারে দুর্গার তিন বছরের জেল হয়।
অবশেষে আসে ১৯৪৭ সাল। দেশভাগের পর অসহায় অবস্থায় ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন দুর্গা। এক আত্মীয়ের লক্ষ্ণৌয়ের বাড়িতে আশ্রয় পান। পরবর্তীতে কয়েকজন প্রাক্তন বিপ্লবীর সহযোগিতায় গাজিয়াবাদে মাথা গোঁজার একটি স্থানের ব্যবস্থা করা হয়। স্বাধীন ভারতের সরকারের কাছ থেকে কোন সাহায্যই পাননি তিনি। পাননি "মহান বিপ্লবী"র সম্মাননাও। তিনি বাড়িতে একটি মন্তেসরী স্কুল খোলেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯৯৯ সালের ১৫ই অক্টোবর এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান হয়।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে অনেক মানুষকে আমরা হারিয়েছি। অনেকেই থেকে গেছেন অজানা, নাম গোত্রহীন হয়ে। স্বাধীনতার ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও দুর্গাদেবীর মতো মনুষ্যরূপী দুর্গারা চিরকাল রয়ে যাবেন আমাদের মনের মণিকোঠায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন