রাগ থাকুক শতেক দূরে - পৌষালী ব্যানার্জী

 

 

আমরা প্রায়শই বলে থাকি, একটি শিশু ফুলের মতো কোমল। তার ন্যায় সরল ও নরম মনের অধিকারী এই জগতে আর কেউ হতে পারে না। সেই কারণে শিশুদের প্রতি সকলে স্নেহশীল ও যত্নশীল হয়ে থাকে। কিন্তু একটি শিশুর আচার ব্যবহারের মধ্যে যখন প্রতিনিয়ত রাগ ও জেদ প্রকাশ পায়, তখন তার আশেপাশের লোকজনরাই বেশি বিরক্ত বোধ করে। ঘরের মধ্যে তো তাও পরিবারের লোকজন, কিন্তু বাইরে কোথাও শিশুরা অত্যধিক রাগ জেদ চিলচিৎকার কান্নাকাটি ইত্যাদি জুড়ে দিলে তাদের অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়েন। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, হাসি কান্না ভয় ইত্যাদির মতো রাগও মানুষের একটি স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। তাই বাচ্চার ব্যবহারে কখনও সখনও ক্রোধ ফুটে উঠলে সেই নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে এমন ঘটনা বারংবার ঘটলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত


শিশুর রাগের কারণসমূহ :

শিশুরা বড়দের মতো পরিণতমনস্ক হয় না। সেই জন্য অনেকসময়ই তারা তাদের অনুভূতিগুলোকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি শিশু "সামান্য" (বড়দের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী) ব্যাপারে রাগ দেখাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সে হয়তো তার কোনো খেলনা অন্যকারুর সাথে ভাগ করতে চাইছে না। বড়রা তাকে "ম্যানার্স" শেখানোর জন্য তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে সেই কাজ করাতে গিয়ে শিশুটির মনে ক্রোধের উদ্রেক করে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, বড়দের কাছে যেমন তাদের দামী ঘড়ি, ব্র্যান্ডেড পার্স, বহুমূল্য কানের দুল অত্যন্ত মূল্যবান, ঠিক তেমনি একটি শিশুর কাছে তার খেলনারও সেরকম গুরুত্ব। আমরা যেমন যে কারুর সঙ্গে আমাদের প্রিয় জিনিসটি ভাগ করে নিতে দ্বিধা বোধ করি, ঠিক সেভাবে শিশুটির ক্ষেত্রেও সেই ঘটনা ঘটে। বাচ্চারা তখনই রেগে যায় যখন তাদের উপর অকারণে জোর খাটানো হয়। আচ্ছা, আমরা বড়রাও কি এমন হলে রেগে যাবো না? 


শিশুদের রাগের অন্যতম কারণ হলো তার যেকোনো কথায় "না" বলে দেওয়া। সে বারংবার অনুরোধ বা বায়না করলে "না বলেছি মানে হবে না" ঘোষণা করে দেওয়া। বাচ্চাদের বায়না সর্বক্ষণ শোনা নিশ্চয়ই অনুচিত এবং পরিস্থিতি ও কারণ অনুযায়ী তাকে "না"ও শুনতে হবে। কিন্তু আমি বড়ো বলে আমার ইচ্ছেমত তার মতবিরোধ করে যাবো, এমন ব্যবহার শিশুর মনে অসহায়তা থেকে রাগের সঞ্চার ঘটায়


মাঝেমধ্যে পারিপার্শ্বিক থেকে আসা লোকজনের ব্যবহারও শিশুর রাগের কারণ হিসাবে দেখা দেয়। একটি বাচ্চাকে সকলের সামনে তার অপছন্দের নামে ডাকা, তাকে হেয় করা, পড়া না পারলে স্কুলে সকলের সামনে তার প্রতি অপমানজনক মন্তব্য শিশুমনে আঘাত হানে। ছোটরা তো বড়দের মুখের উপর যা খুশি বলে উঠতে পারে না। তাদের মনে মনে তখন খুব রাগ হয়। কখনও নিজের উপর, কখনও সেই ব্যক্তির উপর


ঘরের মধ্যেকার এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অশান্ত ও ঝগড়া বিবাদ কোলাহলপূর্ণ হলে শিশুর মানসিকতায় তার প্রভাব পড়ে। ঘরে বাবা মা অথবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া গালিগালাজ তাদের শিশুমনে ক্রোধের বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ করে দেয়


একই পরিবারের একাধিক বাচ্চার প্রতি ভিন্ন আচরণও সমস্যার উদ্রেক করে। একটি বা দু'টি শিশুর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহশীল ও যত্নশীল হলে বাকি শিশুরা নিজেদের অবহেলিত রূপে দেখে এবং তা থেকে তাদের আচার ব্যবহারে রাগ ফুটে ওঠে


বাচ্চাকে সঠিক অনুশাসন দিতে গিয়ে অত্যধিক কঠোর হয়ে বাবা মায়েরা নিজেদের অজান্তেই সন্তানদের ভয়ভীতি এবং ক্রোধের অভিমুখে ঠেলে দেন। নিতান্ত তুচ্ছ ভুল করলে শিশুটিকে কঠিন শাস্তি পেতে হলে সে তার মনে রাগ পোষণ করতে থাকে


রাগ কমানোর প্রতিকার :


প্রতিকার জানার আগে আমাদের একটা প্রশ্ন নিজেদের করা উচিত। উপরের যে কয়টি ব্যবহার আমরা ছোটদের সাথে করে থাকি সেসবের একটিও কি আমরা কোনো পূর্ণবয়স্ক, সপ্রতিভ, মুখের উপর জবাব দিয়ে দিতে পারে, এমন ব্যক্তির সাথে করি? উত্তরটি কিন্তু আমরা সকলেই জানি। আমরা এমন করি না বা বলা ভালো, করার সাহস দেখাই না। প্রশ্নটা হলো, কেন? কারণ সেই ব্যক্তি ঘুরিয়ে আমাদের অপ্রীতিকর কোনো কথা বলে দিতে পারে যেটা করার ক্ষমতা শিশুদের নেই। আমরা নিজেদের অজান্তেই ঘরে বাইরে বাচ্চাদের bully করে আসছি। বড়দের bully এর জবাব দিতে না পেরে সেইসব বাচ্চারা তাদের মনে জমানো রাগ অন্য ক্ষেত্রে অন্য পরিস্থিতিতে প্রকাশ করে ফেলে। তাই সবচেয়ে আগে নিজেদের আচার ব্যবহারের দিকে বড়দের দৃকপাত করা উচিত। তবে তো ছোটদের ঠিক ভুল শেখানো যাবে।

বাচ্চা কোনো একটা জায়গায় যেতে না চাইলে বা কোনো নির্দিষ্ট একটা কাজ করতে অনিচ্ছুক হলে বা নিজের কোনো খেলনা অন্য কারুর সঙ্গে ভাগ করে নিতে না চাইলে তাকে জোর করার পরিবর্তে ধীরেসুস্থে কারণসহ বুঝিয়ে বলতে হবে। আমরা যে ভেবে থাকি বাচ্চারা অতো কারণ বুঝবে না, তা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ভুল। Sharing এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্টুন ভিডিওর সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে।

কথিত আছে, ভালো কাজ ঘর থেকেই শুরু হয়। আচার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সেই কথাটি সমানভাবে প্রযোজ্য। বাড়ির বড়দের মধ্যে রাগারাগি ঝগড়াঝাঁটির পরিবর্তে ভালোবাসা ও সহনশীলতা লক্ষ্য করলে শিশুর মধ্যে বদমেজাজি হওয়ার প্রবণতা ক্ষীণতর রূপ ধারণ করবে


অন্য বাচ্চার সাথে তুলনা করে নিজের সন্তানকে প্রতি পদক্ষেপে হেয় প্রতিপন্ন করা আগে বন্ধ করা উচিত। আমরা বড়রা যেখানে আমাদের থেকে শ্রেয় কারুর তুলনা নিজেদের সাথে প্রতিনিয়ত মেনে নিতে পারি না, বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও কিন্তু এমনটা হয়। স্কুলের কোনো পরীক্ষায় সন্তান অসফল হলে তার অতি সফল কোনো সহপাঠীর সঙ্গে তার তুলনা করলে বাচ্চাটির কোনো উপকার হবে না, বরং তার শিক্ষকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলে সুফল মিলবে। আবার ঠিক সেইভাবে, সন্তান ভালো কাজ করলে তার অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে


কোনো কারণে বাচ্চা রেগে গেলে তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উল্টো গণনার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। বহু সমীক্ষায় দেখা গেছে, রেগে গেলে ১০ থেকে ১ পর্যন্ত রিভার্স কাউন্ট করলে ও গভীর শ্বাস নিলে ধীরে ধীরে রাগ প্রশমিত হয়ে যায়


একটি শিশু রেগে গিয়ে চিলচিৎকার জুড়লে তাকে তৎক্ষণাৎ শান্ত করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় পিঠে হাত বুলানো। শিশুদের শান্ত করতে স্পর্শ অত্যন্ত কার্যকর। জড়িয়ে ধরা বা আদর করা মানসিকভাবে শান্ত করতে সহায়তা করে


শিশুর রাগ কোনোভাবেই সামাল দেওয়া না গেলে anger management এর জন্য তাকে শিশু মনোবিদের কাছে অবশ্যই নিয়ে যাওয়া উচিত। বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে বকাঝকা অথবা মারধোরের মাধ্যমে সমাধান করার উপায় ভাবলে এতে শিশুটির ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হওয়া সম্ভব নয়। ছোটবেলা থেকে বাচ্চারা তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বড় হয়ে তাদের মধ্যে পাকাপাকিভাবে আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেটির প্রভাব তার জীবনে দেখা দেবে সর্বত্র, তার কর্মজীবনে এবং ব্যক্তিগত জীবনে


কথায় বলে, রাগ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই শিশুর আচরণে অত্যধিক রাগ প্রকাশ পেলে দেরি না করে সেই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করাই ভালো। বহু ক্ষেত্রে সমস্যা শুরুতেই অতি সহজে নির্মূল হয়ে যায়। তবে একটি শিশুও একজন মানুষ। তাই তার স্বাভাবিক রাগ অভিমানকে তার হাসি কান্নার মতো অন্যান্য অনুভূতিগুলি থেকে আলাদাভাবে দেখে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার একেবারেই কোনো কারণ নেই। কোমলস্বভাবা সরলমনা শিশুরাই আগামী পৃথিবীকে দিতে পারে একটি সুন্দর ও সহনশীল সমাজ।  








 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন