ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা সাম্মানিক স্নাতক: কামিনী রায় - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

কামিনী রায় 
 

পিতা-মাতা যদি শিক্ষার যথোপযুক্ত সমাদর করার মানসিকতা রাখেন, তাহলে তাঁদের সন্তানও অধ্যয়নের সঠিক মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। ছেলে হোক বা মেয়ে, একজন মানুষের জীবনে পড়াশোনার গুরুত্ব যে কতখানি তা দ্বিধাহীনভাবে জানতেন বাকেরগঞ্জ নিবাসী চণ্ডীচরণ সেন যিনি একাধারে ছিলেন একজন বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক। সেই কারণেই নিজ কন্যার প্রাথমিক শিক্ষার ভার তিনি স্বয়ং গ্রহণ করেছিলেন। কন্যার বারো বছর বয়স সম্পূর্ণ হতে তাকে স্কুলে ভর্তি করে বোর্ডিংয়ে প্রেরণ করেন। যথাযোগ্য সঙ্গ দিতেন কন্যাটির মা। গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন মেয়েকেকারণ সে যুগে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাকে একান্তই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। থেমে থাকেননি মেয়েটির ঠাকুরদাদাও। একরত্তি নাতনিকে পরম যত্নে শেখাতেন কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি। সেই মেয়েই পরবর্তীকালে ভারতের প্রথম নারী হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় সাম্মানিকসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছিল। সেই মেয়ে কামিনী রায়

 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন :

 

কামিনী রায় ছিলেন একজন প্রথিতযশা বাঙালী কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা। ১৮৬৪ সালের ১২ই অক্টোবর পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) বাকেরগঞ্জের বাসণ্ডা গ্রামে (বর্তমানে যা বরিশাল জেলার অংশ) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা চণ্ডীচরণ সেন ছিলেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী এবং ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট একজন নেতা। ১৮৭০ সালে চণ্ডীচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লাভ করেন এবং পরের বছর তাঁর স্ত্রী-কন্যাও কলকাতায় তাঁর কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। চণ্ডীচরণের ভগিনী যামিনী সেন লেডি ডাক্তার হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন

 

কামিনী রায়ের পরিবারের সকলেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। স্কুলের পড়াশোনা সম্পূর্ণ হওয়ার পর ১৮৮০ সালে তিনি কলকাতা বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) পরীক্ষা ও ১৮৮৩ সালে এফ.এ বা ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পর বেথুন কলেজ থেকে তিনি ১৮৮৬ সালে ভারতের প্রথম নারী হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় সাম্মানিকসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন

 

বিবাহ ও কর্মজীবন :

 

১৮৮৬ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর কামিনী রায় ওই বছরই বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে শিক্ষিকার পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি ঐ কলেজে অধ্যাপনাও করেছিলেন। এর সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্য চর্চা। যে যুগের সমাজে মেয়েদের শিক্ষা অত্যন্ত বিরল ঘটনা ছিল, আর এমন সময়েই কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাস রেখে নারীশক্তির স্ফুরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধে এর প্রতিফলন ঘটেছে। একসময় তিনি "জনৈক বঙ্গমহিলা" ছদ্মনামে লিখতেন। শুধু তাই নয়, তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্যা ছিলেন

 

কামিনী রায়ের নানাবিধ প্রতিভা বিকশনের ক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। পিতা চণ্ডীচরণ সেন তো ঐতিহাসিক লেখক ছিলেনই, পিতামহের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায়ের মধ্যে কবিত্ব-শক্তির বিকাশ ঘটে এবং তিনি সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন। মাত্র আট বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন তিনি। রচিত কবিতাগুলিতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। পনেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আলো ও ছায়া" প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে। তবে এতে রচয়িতা হিসেবে কামিনী রায়ের নাম প্রথমে প্রকাশিত হয়নি। গ্রন্থটি প্রকাশ পাওয়ার পর তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত "মহাশ্বেতা" ও "পুণ্ডরীক" তাঁর দু'টি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য "গুঞ্জন" নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ "বালিকা শিক্ষার আদর্শ" রচনা করেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে :

 

  • আলো ও ছায়া (১৮৮৯)
  • নির্মাল্য (১৮৯১)
  • পৌরাণিকী (১৮৯৭)
  • মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩)
  • অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪)
  • অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫)
  • দীপ ও ধূপ (১৯২৯)
  • জীবন পথে (১৯৩০)
  • একলব্য
  • দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন
  • শ্রাদ্ধিকী

 

কামিনী রায়ের রচনার অসংখ্য গুণগ্রাহী পাঠক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কেদারনাথ রায়। স্টাটুইটারি সিভিলিয়ান ছিলেন কেদারনাথ। কামিনী রায়ের লেখা কবিতা পড়ে তিনি বিমোহিত হয়ে পড়েন। ১৮৯৪ সালে কামিনী ও কেদারনাথ বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন

 

একজন প্রকৃত শিল্পী অন্য শিল্পীর যথাযোগ্য সম্মান করতে জানেন, এ আমাদের অজানা নয়। কামিনী রায়ও ছিলেন ঠিক এরকমই। তিনি সবসময় অন্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। ১৯২৩ সালে বরিশাল সফরের সময় তিনি কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে বলেছিলেন

 

স্বীকৃতি ও পরলোকগমন :

 

১৯০৯ সালে কামিনী রায়ের স্বামীবিয়োগ ঘটে। স্বামীর অকালমৃত্যু তাঁর ব্যক্তিজীবনের মতো সাহিত্যিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। তবে তিনি যেহেতু সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন, সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয় অবলম্বনে রচিত তাঁর কবিতাগুলি ছিল অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট মানের

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২৯ সালে কামিনী রায়কে "জগত্তারিণী স্বর্ণপদক"প্রদান করে সম্মানিত করে। ১৯৩০ সালে তিনি বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও সহ-সভাপতি ছিলেন কামিনী রায়। জীবনের শেষ ভাগে তিনি হাজারীবাগে বসবাস করতেন। ১৯৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর অমৃতলোক যাত্রা করেন তিনি



ইংরেজি ক্যালেন্ডারে আমাদের দেশে সেপ্টেম্বর মাস স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কারণ ৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষকদিবস। নবপ্রজন্ম গড়ার কান্ডারী প্রত্যেক শিক্ষক শিক্ষিকা সকলের কাছে প্রণম্য। ঠিক সেভাবেই প্রণম্য কামিনী রায়ও। একাধারে সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক, জনহিতকর ও নারীকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগকারী কামিনী রায় নিজ জীবনে একজন শিক্ষিকাও ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র বাঙালি বা ভারতীয়দের কাছেই আপনার জন হয়ে নেই, তাঁর কথা পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। গুগল (Google) বাঙালি কবি কামিনী রায়ের ১৫৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর স্মরণে একটি ডুডল (Doodle) উৎসর্গ করেছিল। মহীয়সী নারী কামিনী রায়ের প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম

 




কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন