"তোমার জন্মদিনেই ফোটে
পৃথিবীর সব গোলাপ
তোমার জন্মতিথির এই
কবিতা নয় আমার প্রলাপ।"
প্রতিটি দিনই নতুন দিন। নতুন ভাবনার দিন। নতুনের জন্মদিন।ইতিহাসে এমন কয়েকটি দিন থাকে সেদিনকে মৃত্যুর দিন বলেই মান্যতা দেওয়া হয়। আজকে আমার অর্থাৎ আমার জন্মদিন। ২২শে শ্রাবণ। রবিরামের জন্মদিন অথচ এদিন বিশ্বকবি রবির মৃত্যুদিন। সবাই ব্যস্ত মৃত্যুর
কথকতায়। কে আর খবর রাখে আমার জন্মদিনের। আমার জন্মক্ষণেই বিধাতা মনে হয় সব উল্টোপাল্টা লিখে দিয়েছে। শিশু
বয়সের কথা মনে পড়ে। মা পিলসুজ জ্বালিয়ে কপালে চন্দনের টিপ পড়িয়ে খাঁজকাটা কাঁসার
বাটিতে পায়েস দিত। মা মারা গেল। বাবা আবার বিয়ে করল। নতুন মা ভালোবাসত, কিন্তু নিজের মায়ের মত নয়। জন্মদিন পালনের চিন্তা ভাবনা কেউ করেনা। আমার এই বিষয়ে কোনো খেদ নেই।
আমার খেদ মোক্ষম জায়গার আঘাত পাওয়া। নিজের উপর অতিরিক্ত
আস্থা রাখাই কাল হয়েছিল। স্মৃতিপটে মাঝে মাঝেই জলছবি ভেসে ওঠে। স্নেহার মুখটা স্পষ্ট হয়ে ভাসতে থাকে। আমাদের ক্যানিং মফস্বলের গঞ্জ হলেও হৃদ্যতা ছিল। প্রায় এক একটা পাড়া এক পরিবার বলেই মনে করা হত। গুরুজনদের অধিকার ছিল পাড়ার যে
কোনো বাচ্চাকে শাসন করার। পাড়ার প্রাথমিক স্কুলের থেকেই আমি স্নেহা, মধু এক স্কুলের শিক্ষার্থী। আমাদের তিনজনের একটা ‘গাঁঠবন্ধন’ কি
ভাবে যে হয়ে গেছিল, তা আমরাও বুঝতে পারিনি। স্কুলের ছুটি হলে তিনজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। সিধে বাড়িতে ঢুকতাম না।
মিত্রদের আমবাগানের ভাঙা বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর খুঁজে বাগানের কাঁচামিঠে আমে কামড় দিয়ে দাঁত
টকিয়ে বাড়িতে ঢুকতাম। একই জুনিয়র হাইস্কুলে আমি আর স্নেহা। মধুকে স্টেশনের ধারের হাইস্কুলে ওর বাবা
ভর্তি করে দেয়। স্কুল আলাদা হলেও আমাদের প্রাইভেট মাস্টার কিন্তু সেই বিপিনমাস্টারই থেকে যান।
আমাদের গ্রামে বিপিন স্যারের খুব নাম ডাক।
স্নেহাকে স্কুলে গিয়ে না দেখতে পেলে কি একটা নেই, কি একটা নেই, মনটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা করতে থাকে।
কিছুই ভালো লাগেনা।
হরিস্যার আসেননি। টিফিনের
পরেই স্কুল ছুটি। আমরা দুজনে খাল পাড় দিয়ে বাড়ি ফিরছি। আমরা ভেবে পাইনা, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কি করে হয়। ঠিক পুজোর সময়েই আপনা আপনি কি করে গজিয়ে ওঠে ওই কাশফুলেরা। পুজোর আর দেরি নেই বুঝিয়ে দিচ্ছে খাল পাড়ের
কাশফুলের গাছের দুলুনি। বুড়ো বটগাছটার ঝুড়ি ধরে দোল খাচ্ছি। হঠাৎ এই আশ্বিন মাসের
রোদ সরে গিয়ে আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আমরা দুজনেই বট গাছের গোড়ায়। স্নেহা আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমার শীত
লাগছে আমাকে জড়িয়ে ধর’। আমি জড়িয়ে ধরলাম আমার শীত লাগলনা, আমার সারা শরীরে এক শিহরণ লাগল। আমি স্নেহাকে শিহরিত হওয়াটা বলেও ফেললাম। এইসব বিষয়ে মেয়েদের জ্ঞান অনেক আগেই আসে।
ও ঠোঁটে ঠোঁট রেখে নাকের পাটা ফুলিয়ে গরম নিশ্বাস আমার গালে ফেলে বলে এটাই তো নিয়ম। আজ আমার জন্মদিন। আমাকে একটু আদর কর। আমি বয়সের আগেই
প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলাম। আমি এখন স্নেহার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারি। ভালো ভালো খাবার নিজে না খেয়েও স্নেহাকে
দিয়ে দিই। স্নেহাও বুঝিয়ে দেয়, আমি ছাড়া ওর জীবন অচল। এই জীবনে
আর কেউ ঠাঁই পাবেনা।
ভালই চলছিল, কিন্তু সবাই জানে ভালো চিরদিন চলে না।
জীবনে ভালোর কাল অল্পকাল। কালোর কাল
দীর্ঘ। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সবাই যখন ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর নিয়ে পাশ করল, আমি তখন কোনোরকমে বেড়া ডিঙিয়েছি। যার
ফলে অখ্যাত কলেজে ঠাঁই
পেলাম। স্নেহা
কলকাতায় ওর মাসির বাড়িতে থেকে কলেজে ভর্তি হয়ে পড়েছে। মধু কলকাতাতেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়েছে। বছর দুইয়ের মধ্যেই সব প্রেমগাথা উধাও হয়ে গেল। স্নেহা
ভুল করেও যোগাযোগ রাখেনা। আমি অবশ্যই কবিতার মাধ্যমে ওর
আরাধনা করে যাই।
সময়কে ধরে রাখা যায়না এই বস্তা পচা বিষয়টা আমি মাথায় রাখিনি। বেঁচে থাকলেই কলকল করে নদীর জলের মতো সময় ও বয়ে যাবে।
নদীতে যেমন জোয়ার ভাঁটা খেলে সেই রকমই মানুষের জীবনেও কোন সময় জোয়ার কোনো সময়
ভাঁটা খেলবেই। এই নিয়ে যত ভাবাভাবি হবে, ততই মানসিক
চাপ বাড়বে। আমি তাই এই নিয়ে কখনো ভাবিনা। স্নেহার আঘাত সহ্য করে, কোনো পাত্তা না দিয়ে বিন্দাস
আছি। আমার চাহিদা নেই তাই মনে চাপ নেই। এই গঞ্জে মোটামুটি আমি কবি বলে পরিচিতি
পেয়েছি, সেই সুবাদে কবিতার কারণেই কলকাতা যাতায়াত করতে হয়।
এখানেও আমি মনে কোনো আশা পোষণ করিনা। বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছে রবিদা, আপনি কলকাতার কবি হলে এতদিনে অনেক পুরস্কারজয়ী হ’তেন। আমি মন খারাপের চক্করে পড়িনা। মেনে নিই শহুরে আর গাঁইয়ার মধ্যের পার্থক্য।
যেমন গায়ের রঙের ফর্সা আর কালোর পার্থক্য চিরদিন থেকেই যায়, যতই আমরা বলি “সব মানুষ সমান।“
আমি আমার সাফল্যের আসল চাবিকাঠি এদের সঙ্গে আলোচনা করিনা। ভুলেও ওদের কাছে খোলসা
করিনি। পরীক্ষা শেষ। আমি সাইকেল চালাতে চালাতে কবিতার কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গিয়ে রাস্তার পাশের
বট গাছে ধাক্কা মেরে গড়িয়ে
নয়নজুলিতে পড়ে যাই। হাত-পা ভেঙে যায়।
হাসপাতালে ভর্তি হতেই হয়। সেইসময় হাসপাতালের ডাক্তার
প্রণব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ হয়। সবাই যখন আমার কবিতা প্রীতি নিয়ে মস্করা করছিল, উনি আমাকে কবিতা লেখার উৎসাহ
দিয়েছিলেন। ক্রমশ
ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, বুঝতে পারলাম উনি কাব্য-কবিতা
নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেন, লেখেনও। আমি বলেই ফেলি, ‘আপনি
ডাক্তার না হয়ে লেখক হলে ভালো হত’।
উনি হেসে উঠে বলেন, ‘অনেক
ডাক্তার আছেন যারা পৃথিবীখ্যাত লেখক। আন্তন চেখভ যাকে সবাই গল্পের গুরুদেব মানে, তিনি এক সফল ডাক্তারও’। প্রণব ডাক্তার উপদেশের মোড়কে আমাকে কবিতা লেখার সময় কয়েকটি বিষয়ের
গুরুত্ব মনে রাখতে বলে দেন, ‘মহতি আবেগ মননের কল্পনা মনের সংকেত প্রকাশ হল
কবিতা। কিন্তু খেয়াল রাখতে
হবে কবির শব্দবন্ধন কখনো যেন স্লোগানে
পরিবর্তিত হয়ে না যায়। যে কবিতা কখনো কবির মাথার উপর মুঠো উঁচিয়ে রাখতে পারে না, সে কবিতা মানুষের স্মৃতিতে ধূসর হয়ে যায়। কবি তিনিই যিনি এই সাময়িকতাকে হৃদয়ে স্থানদিয়ে
হৃদয়বান হয়ে অনুরণনে শব্দের মালা গেঁথে ভবিষ্যতের দিকে তার রেশকে প্রসারিত করতে
পারেন, যা বহুকাল ধরে ভাবীকালের পাঠকদের কাছেও সমাদার পাবে।
তাই কবির প্রথম ভালোবাসা তাঁর ভাষার সঙ্গে,শব্দের
সঙ্গে। কবি কখনো সরাসরি কিছু না বলেও
কবিতায় তাঁর বিশেষ কিছু বলার আছে
বরং শব্দেরা নিঃশব্দে কি বলে তা শোনার জন্য, শোনাবার
জন্যই শব্দব্রম্ভর প্রয়োজন। সমকালকে দেখার শাব্দিক দৃষ্টিকোণে একজন কবিকে চেনা
যায়। নিজেকে উন্মোচনের তাগিদ ও নিরন্তর আত্ম খননে গড়ে উঠে একজন কবির কবিতার নিজস্ব
নিখিল ভুবন’।
শিয়ালদা ষ্টেশন থেকে কর্নওয়ালিশ লেন ধরে শর্টকাট
রাস্তায় কফিহাউসে কিছুটা সময় আড্ডা মেরে নন্দনে “সমস্বর”-এর কবিতা পাঠের আসরে যাব। ফেরার জন্য
রাত ৯ঃ০৫-এর লোকালটা ধরব। সাবওয়ে
পেরিয়ে বিদিশা শপিং সেন্টারের কাছে আসতেই কোথা থেকে কালো মেঘেরা এসে একসঙ্গে বোমা
বর্ষনের মতো বৃষ্টির বর্ষন শুরু করে দিল। নিরুপায়
হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শপিং মল থেকে
তাড়াহুড়ো করে একজন বেরিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আমার মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
না সবাই জানে সেই বস্তা পচা কথাটা দিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করব না-“আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি”। আমি জীবনানন্দের মতো ট্রাম লাইনের উপরের ইলেকট্রিকের
তার পার করে ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে- “রৌদ্র-ঝিলমিল উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল, অপার ঐশ্বর্য বেশে দেখা তুমি
দাও বারে-বারে নিঃসহায় নগরীর -প্রাচীরের পারে”। বুঝতে চেষ্টা করছি, এই বর্ষন যা আমার ভাবনায় এখন ধর্ষণের সঙ্গে তুল্য, কতক্ষণ চলতে পারে। বেশি বৃষ্টি হলই এখানে হাঁটু জল জমে যাবে। আমার নামটা বাতাসে ভেসে
উঠল, ‘রবিরাম না? কেমন আছিস’। ভদ্রলোকের মুখে চোখ ফেলে চিনতে পারলাম আমাদের সেই মধুসূদনকে। মুখের রঙ আরও ফর্সা হয়েছে। মাথার চুল আরও পাতলা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে যাবে ঈশ্বর যেমন টাকা
দিয়েছেন, টাকার চিন্তায় চিন্তায় মাথায়
টাকও দান করেছেন।
কথা শুরু হল। স্বাভাবিক নিয়মে “পুরানো সেই দিনের কথা” উঠে আসল। মধুর মনের কথা আমি বুঝতে
পারি। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলছে, ‘রবিরাম তুমি হেরে গেছ’। আমি
বুঝে গেছি এই গোত্রের মেয়েরা কাকে কখন হারাবে “দেবা ন জানন্তি”। মধুসূদনের থেকে সব বিষয়ে আমি পিছিয়ে বলে ওর মনের আনন্দদায়ক স্ফূর্তির প্রলেপ
মুখমণ্ডলে চিকচিক করছে। আমি কোনো লড়াইয়ে নেই। আমার দুঃখ নেই। রসিয়ে রসিয়ে ও বললো, ‘আমরা এখন গড়িয়াহাটে আনন্দ কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকি। স্নেহা তোর কথা
প্রায়ই বলে। হ্যাঁ, ভালো কথা এই ২১শে ডিসেম্বর
স্নেহার জন্মদিনে একটা পার্টি হবে। তুই চলে আয়। সবাই খুশী হবে’। মধু পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে
তার ভেতর থেকে টুক করে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে আমাকে ধরিয়ে দিল। বৃষ্টি থেমে গেছে, মধু আমাকে ‘বাই’ বলে চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল।
একুশে ডিসেম্বর “কবিতা এখন” পত্রিকার অনুষ্ঠানে আসতেই হবে। অবচেতন মন স্নেহাকে এখনো খোঁজে। দেখাই যাক না ও কেমন আছে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একটা সুবিধা, সবাই মিলে গলাগলি করে গলা মিলিয়ে সেই বস্তাপচা “ওই হ্যাপি বার্থডে টু ইয়ু” গাওয়া হবে। গানটির ইতিহাস না জেনেই গলা মেলায়। গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৩ সালে “গুড মর্নিং টু ইয়ু, গুড মর্নিং টু ইয়ু, গুড মর্নিং ডিয়ার চিলড্রেন, গুড মর্নিং টু অল”। মিলড্রেড জে হিল এবং তার বোন প্যটি স্মিথ হিল তাদের স্কুলের বাচ্চাদের জন্য লেখেন। ১৯১২ সালে এই গানের সুরেই প্রথম ছাপানো হয়। এই গান নিয়ে কত আইনী যুদ্ধ হয়েছে তার খবর কে রাখে। জন্মদিনে গলা ছেড়ে গান গায় সবাই কিন্তু মনের কথার খোঁজ কেউ রাখেনা। নিজেই নিজের মনে বলে উঠি, রবিরাম একটা জম্পেশ করে শুভেচ্ছা কবিতা লেখ। যা “হ্যাপি বার্থডে”-র সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
বাড়িতে এসে দরজা জানলা বন্ধ করে
মন প্রাণ দিয়ে খসড়া লিখলাম, ‘এইক্ষণেই বাতাসে সুবাসিত স্নিগ্ধতা, কোকিলের কুহ কুহ কলতান, কাকাতুয়া গাইছে গান, প্রকৃতি এবার নতুন রূপে হয়েছে রঙিন, রজনীগন্ধার সুগন্ধে পালন করবো
আমার সবচেয়ে প্রিয় স্নেহার জন্মদিন। আমার মনের মানুষের শুভ জন্মদিন। স্নেহা, তোমার জীবনে
সফল হোক তোমার স্বপনে দেখা দিন, শুভ জন্মদিন। স্নেহা তুমি অসীম সুখে সুখী হও সারা জীবন জুড়ে, প্রার্থনা
করি মনে প্রাণে তোমার শুভ জন্মদিনে’।
উপহার কি দেবো এই নিয়ে ধন্দে ছিলাম। সব দ্বিধা দ্বন্ধ কাটিয়ে ঠিক করলাম রজনীগন্ধার
স্তবক দেবো। রজনীগন্ধার গন্ধ ও খুব ভালোবাসে। যতটা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি
আয়োজন। কমপ্লেক্সের নিজস্ব কমিউনিটি হল। শ’দেড়েক অতিথি এসে
গেছে। সুসজ্জিত মঞ্চ। এক গোলাকার টেবিলের উপর সুন্দর বড় একটা কেক সাজানো আছে।
পিছনের পর্দায় সিনেমার মত প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটে উঠেছে। মঞ্চে কেউ নেই। আমি একা, একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লাম। মধুসূদন হঠাৎই উদয় হয়ে বলে, ‘এসে গেছিস ভালো হয়েছে। বোস, স্নেহা পার্লারে গেছে এই আসল বলে’। একজন বেয়ারাকে
ইশারায় আমাকে পকোড়ার প্লেট, কফির কাপ ধরাতে বলল।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকি স্নেহার সঙ্গে আমার
সম্পর্ক ফাগুনের রঙে রাঙা পলাশের রঙ নয়, হেমন্তের
ভোরে টুপটাপ শিশিরে ভেজা শিউলির মতো নয়। বসন্তের বিকালে শিমুলের ডালে নয়। শরতের
নীলাকাশে ছোট ছোট মেঘেদের সঙ্গে মাখামাখি করে দিন কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। আপশোষ হয়নি তা বলব না, হয়েছিল, কিন্তু ওই নেশায় চুড় হয়ে ‘পারো পারো’ করব সে বান্দা আমি নই। খেয়াল করিনি তিন-চারজন রমনী পাশের টেবিলে
বসে পিএনপিসি শুরু করেছে। কানে ধাক্কা দিল, ‘মধুসূদনের প্রমোশন কিছুতেই হত না, স্নেহা বৌদি
তো বস আহুজাকে কবজা করে প্রমোশন আদায় করেছে’। অন্য ললনার সরস উক্তি, ‘এখন আর কোনো
লুকোচুরি নেই। টিভিতে দেখিসনি তপ্ত বৈশাখীর সঙ্গে শোভন প্রেম’। অর্পণা সেনের গলায় একজন বলে উঠল, ‘এদের প্রেম কাহিনী লায়লা -মজনু,, সেলিম -আনারকলি, প্যারিস-হেলেন, অর্ফিয়াস-ইউরিডিস, ক্লিওপেট্রা-মার্ক অ্যান্থনি, শাহজান-মমতাজ, রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনী জোলো করে দেবে - এই শোভনের ঝোড়ো বৈশাখী
প্রেম’।
ফ্যঁশফ্যাঁশে কন্ঠের অধিকারিণী শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, ‘ওরা সব পানসে
হয়ে যাবে স্নেহা আর আহুজার প্রেমগাথা শুনলে। মধুসূদনের
প্রমোশন হওয়ার কথা নয়। সিনিয়র, উপযুক্ত
ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে, ওই স্নেহা মধুসূদনের জন্য আদায় করেছে। আজকের অনুষ্ঠান ওই প্রমোশন পেয়েছে সেটাই
জানাবার জন্য। কিন্তু প্রমোশনের জন্য অনুষ্ঠান প্রচার করলে বিষয়টাকে আরও মুচমুচে
মুখরোচক খবর যাতে করা যাই সেই জন্যই এই জন্মদিনের পার্টি’।
আমার মাথাটা চক্কর দিতে লাগল। মনে পড়ে গেল আশ্বিন
মাসের কাশ ফুলের দোলা, ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট মিলানো।
জন্মদিনের কথা। বুঝতে পারলাম স্নেহা নিজের স্বার্থে কোনও কিছু করতে পিছপা হয়না। প্রেমিক বদলের নজির আছেই। স্নেহা নজিরবিহীন ভাবে নিজের স্বার্থে নিজের জন্মদিন পাল্টে এক ইতিহাস
গড়ে রাখল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন