পরিবার পরিকল্পনার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস
বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা আজ যথেষ্ট সহজ। মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে, দু’টি প্রজন্মের মধ্যেই যদি লক্ষ্য করা যায়, সে ক্ষেত্রে ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের এক চূড়ান্ত নিদর্শন। ‘যৌথ পরিবার বনাম দম্পতি কেন্দ্রিক পরিবার’ নিয়ে যতই তর্ক বিতর্ক চলুক না কেন, একথা অনস্বীকার্য যে অনিয়ন্ত্রিত জন-বিস্ফোরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং সমগ্র পৃথিবীর জন্য আজ এক অশনি সংকেত। একইসাথে একথাও স্বীকার করতেই হবে যে, এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে শিক্ষা ও সচেতনতার উন্মেষ অথবা ক্রমবর্দ্ধমান জনসংখ্যার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সকলকে ওয়াকিবহাল করার জন্য আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রচারের এক অগ্রণী ভূমিকা আছে। অন্যদিকে এই ক্ষেত্রেও সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই যে জন্মনিয়ন্ত্রন এবং পরিকল্পিত ভাবে পরিবার নির্মাণের পিছনে বিজ্ঞানের কৃতিত্ব কিন্তু সবথেকে বেশি। তবে, সব থেকে অবাক করার মতো বিষয় হল, এই গর্ভনিরোধ বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের ধারণার উন্মেষ কিন্তু এই শতক নয়, বরং ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে যীশু খ্রীষ্টের জন্মের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন গ্রন্থে জন্ম নিয়ন্ত্রনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের
সবথেকে পুরনো সূত্র পাওয়া যায় বাইবেলের
মতো পুরনো
ধর্মগ্রন্থে।
‘জেনেসিস’ গ্রন্থে
‘withdrawal’ বা
প্রত্যাহার পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে
শারীরিক সম্পর্কে স্থাপনের সময় পুরুষদের
‘coitus
interruptus’ এর মতো প্রক্রিয়া অনুশীলন করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। Coitus
interruptus জন্মনিয়ন্ত্রনের সবথেকে প্রাচীন এবং সহজ
উপায় যেখানে বীর্যপাতের আগেই পুরুষাঙ্গ নারী যৌনাঙ্গ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ৩৮৪ থেকে ৩২২
খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল প্রথম সিডার অয়েল বা
লেড
অয়েন্টমেন্টের মতো কিছু প্রাকৃতিক রাসায়নিকের সন্ধান দেন, যা
শুক্রাণু নাশক রূপে ব্যবহৃত হত। এরপরে, রোমান লেখক প্লিনি অথবা কাসানোভার মতো
বৈজ্ঞানিকেরা বিভিন্ন সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রের বিভিন্ন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন, এমন কি
সারভাইক্যাল ক্যাপের উপযোগিতার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা
উল্লেখ না করলেই নয়
যে,
১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দের আগে
ওভাম বা ডিম্বাণুর অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তাই
জন্মনিয়ন্ত্রনের সব পদ্ধতিই ছিল পুরুষ জননতন্ত্র কেন্দ্রিক। বলাই বাহুল্য, ডিম্বাণু আবিষ্কার ছিল মানুষের প্রজনন পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাপ্রাপ্তির প্রথম ধাপ। এর পরবর্তী প্রায় ৪০ বছর
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে ইউটেরাস বা জরায়ুর ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপিত হতে থাকে। ম্যাসাচুসেটের এক
প্রখ্যাত চিৎসক চার্লস নোল্টন লবণ, ভিনিগার, লিকুইড ক্লোরাইড, জিঙ্ক সালফাইট এবং পটাসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সালফাইট দিয়ে একটি দ্রবনের উদ্ভাবন করেন যা শারীরিক মিলনের পরে নারীদেহের জরায়ুতে ইঞ্জেক্ট করা
হয়,
যা
জন্ম নিয়ন্ত্রণের একটি প্রক্রিয়া হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ
করে।
এরপর ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথে
বিজ্ঞানের বহু ক্রোশ পথ
অতিক্রম করা হয়ে গিয়েছে। একদিকে যেমন জন্ম নিয়ন্ত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে মানুষ, অপরদিকে বহু গবেষকের নিরলস প্রচেষ্টা এবং
বিনিদ্র রজনীর বিনিময় আবিষ্কৃত হয়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণের নিত্য-নতুন পদ্ধতি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ততদিনে আবিষ্কার হয়েছে হরমোন। ফলস্বরূপ, ১৯৬০ সালে ফুড
এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) প্রথম গর্ভনিরোধক পীলকে বৈজ্ঞানিক ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। প্রাথমিক অনুমোদনের পর
প্রায় ১ থেকে ১.২
বিলিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলারা এই গর্ভনিরোধক বড়ির মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০০
মিলিয়ন বা তারও অধিক মহিলা গর্ভনিরোধক পীল
ব্যবহার করেছেন এবং জন্মনিয়ন্ত্রনের সবথেকে সহজ
এবং
নিরাপদ উপায় হিসাবে আজও
তা
সমান ভাবে জনপ্রিয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী এই সাফল্যের কাণ্ডারি হিসাবে যার
নাম
উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন মার্গারিটা স্যাঙ্গার, আমেরিকান বার্থ কন্ট্রোল লীগের প্রতিষ্ঠাতা।
জন্মনিয়ন্ত্রনের চাবিকাঠি
গর্ভনিরোধক বড়ি বা বার্থ কন্ট্রোল পিল আসলে বিভিন্ন হরমোনের সংমিশ্রনে তৈরী ট্যাবলেট। প্রধানত যে দুটি হরমোনের সমন্বয়ে এই ট্যাবলেট তৈরী করা হয়
তা
হল
ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টিন। সেই
ছোটবেলার জীবন বিজ্ঞান বইতে পড়া ‘স্ত্রী জনন
তন্ত্র’
অধ্যায়ের কথা মনে করা
যাক। নারীদেহের ডিম্বাশয়
বা
ওভারী থেকে ডিম্বাণু বা
ওভাম নিঃসরণের পরে তা
শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয়
এবং
নিষেক বা ফার্টিলাইজেশনের প্রথম ধাপই হলো শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর এই
মিলন। নিষিক্ত ডিম্বাণু এর
পর
জরায়ুর মধ্যে প্রোথিত হলে
তা
থেকে পর্যায়ক্রমে ভ্রুণ এবং সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত একটি শিশুর জন্ম হয়। জন্মনিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এই গর্ভনিরোধক ওষুধগুলি বিভিন্ন ভাবে ফার্টিলাইজেশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করতে পারে।
১.
গর্ভনিরোধক বড়িতে ব্যবহৃত হরমোন ওভ্যুলেশন বা
ডিম্বাণু নিঃসরণকে বাধা দেয়।
২.
সারভাইক্যাল মিউকাসকে এমন
ভাবে পরিবর্তন করে যার
ফলে
একটি শুক্রাণুর পক্ষে ডিম্বাণুকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে
যায়।
৩.
অথবা জরায়ুর আস্তরণকে এমন
ভাবে পরিবর্তন করে যার
প্রভাবে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর দেওয়ালে গিয়ে প্রোথিত হতে পারে না।
কার্যকারীতার দিক থেকে বিচার করলে, গর্ভনিরোধক পিল গর্ভাবস্থাকে প্রতিরোধ করতে প্রায় ৯৯%
সক্ষম। কিন্তু শর্ত একটাই যে প্রতিদিন নিয়ম করে এই ওষুধ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেয়ে যেতে হবে। তা না
হলে,
প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে। সমীক্ষা বলছে যে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯ জন নারী পিল খাওয়া সত্ত্বেও অনৈচ্ছিক ভাবে গর্ভ ধারণ করেন। তবে,
এ
কথা
ভুলে গেলে চলবে না
যে,
জন্ম নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য উপায় , অর্থাৎ কন্ডোম বা সারভাইক্যাল ক্যাপের মতো গর্ভনিরোধক পিল
কিন্তু কোনোভাবেই যৌন
সক্রামক রোগ বা সেক্সচুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ প্রতিরোধ করতে একেবারেই সক্ষম নয়।
সাধারণত এই গর্ভনিরোধক বড়ি দু’প্রকার হয়ে থাকে,
১. কম্বিনেশন পিল: অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টিন দু’টি হরমোনই উপস্থিত থাকে।
২. মিনি পিল : এক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রোজেস্টিন উপস্থিত থাকে। ব্রেস্ট ফিডিং অবস্থায় অথবা স্ট্রোক বা থ্রম্বোএম্বোলিজমের (রক্তের অস্বাভাবিক জমাট বাধা) মতো রোগের পূর্ব ইতিহাস থাকলে চিকিৎসকেরা ইস্ট্রোজেন না নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং এসব ক্ষেত্রে মিনি পিল ভীষণই কার্যকর। এই ধরণের পিলের ক্ষেত্রে একসাথে ২৮টি পিল থাকে যা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় খেলে উপযোগিতা পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানের লক্ষ্যভেদ
শুধুমাত্র গর্ভনিরোধের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য অনেক রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা এই ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
১.
মেন্সট্রুয়াল সাইকেল বা
মাসিক ঋতুচক্র নিয়মিত করতে,
২.
রক্ত প্রবাহের গতি কমিয়ে এনেমিয়া বা রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করতে,
৩.
হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে
ব্রণ বা হার্সুটিজমের প্রতিকার করতে,
৪.
ওভারিয়ান ক্যান্সার বা
কোলন ক্যান্সারের মতো
রোগের চিকিৎসায়,
৫.
এন্ডোমেট্রিওসিস, ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড, ইউটেরাইন ক্যান্সারের চিকিৎসায়,
৬.
প্রিমেনস্ট্রুয়াল ডিস্ফোরিক ডিসর্ডার এবং পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিসর্ডার নিরাময় সাহায্য করে।
ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, এর উপযোগিতার তুলনায় নেহাতই নগন্য। মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মেন্সট্রুয়েশন, স্তনের অত্যধিক কমনীয়তা এবং অনিয়ন্ত্রিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া খুব গুরুতর কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। তবে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস, হার্ট এটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ বা পালমোনারি এম্বোলিজমের মত রোগের পূর্ব ইতিহাস থাকলে অবশ্যই এই ধরণের ওষুধ অতি সচেতনতার সাথে এবং চিকিসকের পরামর্শ মেনে গ্রহণ করা উচিত।
তথ্যসূত্র:
www.mayoclinic.org
my.clevelandclinic.org
www.pbs.org
www.plannedparenthood.org
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন