প্রায়শ্চিত্ত - সুদীপ




সি.টি. জেড্. কোম্পানির ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস্ পার্টনার মিট্ সেরে মুম্বই থেকে কোলকাতা ফিরছি। আমাদের কোলকাতার রায় কন্সট্রাকশন কোম্পানির একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসাবে সি.টি.জেড্. কোম্পানির সাথে ব্যবসা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ের দায়িত্ব আমার উপর।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি শেষ করে আমি চার বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে অবশেষে কোলকাতায় এই বাঙালি কোম্পানিতে এসে জয়েন করলাম। যা হয়, হোম টাউনে ভাল অফার পেলে ঘরের বাইরে আর কে থাকতে চায়? তাছাড়া বাড়িতে আমি একমাত্র ছেলে, বাবা মায়ের বয়স হয়েছে, তাই রায় কোম্পানির অফার আমি ফিরিয়ে দিইনি। এরা আমাকে যথেষ্ট ভালো প্যাকেজ দেয়, আর তার সাথে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধাও পাই। তবে কোলকাতায় আসার আরো একটা কারণও আছে। আমার বান্ধবী দিয়া। আমাদের কলেজ থেকে প্রেম। ও আমার দুই বছরের জুনিয়র। ও এখন সেক্টর ফাইভে আই টি সেক্টরে আছে। দুই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেছে।

বর্তমানে আমাদের প্রধান ক্লায়েন্ট হল সি.টি. জেড্ কোম্পানি। আমাদের অনেক ক্লায়েন্টই আছে, কিন্তু বিগত এক বছর বাজারে মন্দার জেরে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক টাকা পাওনা হয়ে গেছে, কিন্তু ক্লায়েন্টরা টাকা দিতে পারছে না। এদিকে আমাদের কোম্পানি ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ব্যাঙ্ক থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়ে ফেলেছে। যে টাকা পাওনা ছিল, সেগুলো পাওয়া গেলে কোনো অসুবিধা হত না, কিন্তু সে টাকা কবে পাওয়া যাবে তা কেউ জানে না। এখন আমাদের একমাত্র ভরসা হল সি.টি. জেড্. কোম্পানির অর্ডার। সি.টি. জেড্ কোম্পানি অবশ্য অর্ডার পেয়েছে পোর্ট ট্রাস্ট থেকে। কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট ও হলদিয়া বন্দরের উন্নয়ন এবং সেই সঙ্গে কুলপিতে নতুন বন্দর নির্মাণ। পুরোপুরি সরকারি পরিকল্পনা, যার উদ্দেশ্য হল পূর্ব ভারতের প্রধান পণ্য পরিবহনের মাধ্যম হিসাবে কোলকাতা বন্দরকে আরো বড় করা। তবে শুধু বন্দর নয়, কোলকাতা-কুলপি- হলদিয়াতে পণ্য পরিবহণের জন্য সড়ক ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানো হচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য কুলপি বন্দরের পাশে পণ্যবাহী বিমান ওঠা নামার ছোট বিমানবন্দরও নির্মাণ হচ্ছে। আর এই সম্পূর্ণ প্রজেক্টের সিংহভাগ অর্ডার পেয়েছে সি.টি.জেড্. মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি। এই সম্পূর্ণ প্রজেক্টে তারা বিভিন্ন কোম্পানিকে সাব-কন্ট্র্যাক্ট দিচ্ছে। সেই কারণেই আমার মুম্বই এসে ওদের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলোচনা করার দরকার ছিল। আমরা কোটেশন প্রায় তৈরি করে ফেলেছি। ফেরার পথে বিমান টেক অফের পর ল্যাপটপ্ খুলে সে ব্যাপারেই একটু কাজ শুরু করলাম। আমাদের কোম্পানির কাছে এই অর্ডার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বড় অঙ্কের অর্ডারই নয়, এই অর্ডার আমাদের ভবিষ্যতে বড় কাজ পেতেও সাহায্য করবে।

“আপনাকে সি.টি.জেডের অফিসে দেখলাম না? “

প্রশ্নকর্তা আমার পাশে বসে থাকা একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক।  রঙ মাঝারি, বুদ্ধিদীপ্ত  ছিপছিপে চেহারা। আমি বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক……"

“আরে, আমিও একই কাজে গিয়েছিলাম।  আমাদের পার্ট হচ্ছে এই প্রজেক্টের ইলেক্ট্রিকালের কাজ। আপনার?”

“আমাদের কন্সট্রাকশন্”l


“কোন কোম্পানি?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।


“এস্. আর.  প্রাইভেট লিমিটেড্।“


ভদ্রলোকের সাথে দু একটা সৌজন্যমূলক কথা বলে আমি আমার কাজে মন দিলাম।

রাতে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে আমি চললাম অফিসে। সি.টি. জেডের সি.ই. ও-র সাথে যে মিটিং হল তার ড্রাফ্ট এবং সেই অনুযায়ী কোটেশনে কিছু পরিবর্তন করে ডিরেক্টর ম্যাডামের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অফিসে পৌঁছাতে আধ  ঘন্টা পর যথারীতি ডাক পড়ল ম্যাডামের ঘরে।

আমি ম্যাডামের ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ম্যাডামের একটা ফোন এল। ম্যাডাম্  আমাকে ইশারায় বসতে বলে ফোনে কথা বলতে লাগলেন।  আমি টেবিলে পাশে রাখা চেয়ারে বসতে যাব, কিন্তু এ কি!  এটা কি দেখছি আমি! ম্যাডামের টেবিলের পাশে সাইড টেবিলে  ওটা কার ছবি! একটা বড় সাইজের ছবিতে মালা-ধূপকাঠি দেওয়া, সামনে প্লেটে কিছু মিষ্টি ও গেলাসে জল, আর ছবির ব্যক্তিটি আর কেউ নন, গতকাল রাতে মুম্বই থেকে কোলকাতা ফেরার বিমানে আমার সফরসঙ্গী। পার্থক্য শুধু বয়সে। আমার সফরসঙ্গীর বয়সটা ছবির ভদ্রলোকের থেকে বেশি। বাকি চেহারায় একেবারে হুবহু মিল।

আমি   ঐ ছবির দিকে তাকিয়ে হতভম্বের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ম্যাডামের ঘরে এর আগে বহুবার এসেছি, কিন্তু এই ছবি তো কখনো দেখিনি।

মিনিটখানেক হয়তো ঐভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ম্যাডামের কথায় আমার সম্বিত ফিরল। উনি নিশ্চয় আমার ওরকম ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকাটা লক্ষ্য করেছেন।

“বল, কাল মিটিংয়ে কি হল?”

আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে “হ্যাঁ  ম্যাডাম্”  বলে চেয়ারে বসে ল্যাপটপ্ খুলতে লাগলাম। প্রায় লাঞ্চ টাইম অবধি মিটিং চলল। ম্যাডাম্ এর মাঝে আরো পাঁচ জনকে মিটিংয়ে ডেকে নিয়েছেন।

মিটিং শেষ হলে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু আমার মনে মিটিংয়ের বিষয়বস্তু ছাড়াও অন্য একটা ব্যাপার সমানে তোলপাড় করে চলেছে।  মনের কৌতুহল নিবারণ করার জন্য অ্যাকাউন্টসের দাশগুপ্তদা কে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম যে ম্যাডামের ঘরে যে ফটোতে মালা দেওয়া আছে সেটি কার?

“ওটা ম্যাডামের স্বামীর।  আজ ওনার মৃত্যুদিন। রায় কন্সট্রাকশন কোম্পানির আজ এত নামডাক তার পিছনে প্রধান ভূমিকা ছিল ওনার। প্রতি বছর ম্যাডামের ঘরে আজকের দিনে ওনার ছবিতে মালা দিয়ে সাজানো থাকে।“

আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। কাল রাতের ঘটনা কাউকে বললাম না।  এখানে  আমার দু বছর চাকরি হল।  গত বছর অবশ্য এই দিনে আমি ম্যাডামের ঘরে আসিনি, তাই নজরে আসেনি।

আমি অফিসে কাজ করতে লাগলাম। আমরা যেভাবে কোটেশন বানিয়েছি, বা আমাদের এর আগে এই ধরনের কাজে যে অভিজ্ঞতা আছে, তাতে সীমিত কিছু কোম্পানির মধ্যে বলতে গেলে আমরাই এগিয়ে আছি।  আমরা কোটেশন জমা দিলাম এবং এবং যেদিন টেন্ডার খোলা হবে সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কিন্তু এসবের মধ্যে আমার মনের খচখচানি গেলনা।  বিমানযাত্রায় আমার সহযাত্রী আর ম্যাডামের মৃত স্বামীর হুবহু সাদৃশ্যের আসল রহস্য না জানা অবধি শান্তি পাচ্ছিলাম না। অবশেষে আমাদের কোম্পানির বহুদিনের পুরানো বয়স্ক বেয়ারা লোকনাথ দাকে ধরলাম। শুনেছি ম্যাডামের বাবা মিঃ বীরেশ্বর রায় অর্থাৎ যিনি এই কোম্পানির জন্মদাতা , তাঁর সময় থেকে লোকনাথদা আছে। মিঃ রায় অবশ্য এখন শারীরিক অবস্থার কারণে আসতে পারেন না ।  এখন তাই ব্যবসা দেখেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেবযানী ম্যাডাম্।

একদিন সন্ধ্যাবেলা লোকনাথদা বাড়ি যাবার সময়  ওর পিছু নিলাম।  কিছুদূর গিয়ে লোকনাথ দাকে পিছন থেকে ডেকে কথাবার্তা শুরু করলাম। সামনে একটা চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খেতে খেতে ম্যাডামের স্বামীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম।

লোকনাথ দা বলল, “সে এক গল্প বাবু। দু হাজার সালের গোঁড়ার কথা। তখন আমাদের কোম্পানির অফিস  এই পার্ক স্ট্রীটে ছিলনা। বাবু যেখানে চাকরি করতেন সেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে হাতিবাগানে ছোট একটা এক কামরার ঘর নিয়ে বড় সাহেব ব্যবসা শুরু করেন। বাবুর অত পুঁজি ছিলনা। তাই ব্যবসা সেরকমভাবে দাঁড় করাতে পারছিলেন না। মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। এই সময় তাঁর সঙ্গে  এসে যোগ দিলেন বাবুর বন্ধু রবীন সাহা। রবীন বাবু বিদেশে ছিলেন, তাঁর পয়সাও প্রচুর।  তিনি বাবুর সাথে যোগ দিয়ে ব্যবসায় টাকা ঢাললেন। ওনার শেয়ার বেশি ছিল। বছর দুয়েকের মধ্যে তাদের ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে তাদের আরো  লোকসংখ্যা বাড়ানোর দরকার হয়ে পড়ল। আরো দু তিনজন লোক আমাদের কোম্পানিতে যোগ দিল। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং চৌকস ছেলে ছিল সত্য। পুরো নাম ছিল সত্যরঞ্জন মৈত্র। গরীবের ছেলে হলেও খুব মেধাবী এবং পরিশ্রমী ছিল। যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার। অনেক বড় কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল, কিন্তু আমাদের কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার কারণ ছিল এই কোম্পানি তখন চারাগাছ, আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে।  এরকম কোম্পানিতে তাঁর মত ছেলের কাজের সুযোগ প্রচুর এবং সে এটাই চাইছিল। ছেলেটির নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও বুদ্ধির জোরে কোম্পানি তখন দৌড়াতে শুরু করছে। পার্ক স্ট্রীটে এই অফিস নিয়েছে, লোকসংখ্যা আরো বেড়েছে , সেই সাথে অর্ডারও প্রচুর। আমাদের সাহেব আর রবীন বাবু সত্যকে মাথায় তুলে রেখেছে। সত্যি কথা বলতে আমি তাঁকে নিজের চোখে দেখেছি তো, যেমন ভদ্র, তেমন কর্মঠ ও কাজে পারদর্শী। সে ছিল আমাদের কোম্পানির ভগবান। আজ আমাদের কোম্পানির এই বাড়-বাড়ন্ত, এত নাম, এসবের পিছনে তাঁর অবদান।“

এই বলে লোকনাথদা একটু থামল।  চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “কিন্তু ভাগ্য ছিল বিরূপ। অল্প বয়স, যা হয়, প্রেমে পড়ল। আর পড়তে হল আমাদের দিদিমণির প্রেমে।“

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “মানে আমাদের দেবলীনা ম্যাডামের প্রেমে”!

“হ্যাঁ গো বাবু। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে আমাদের বড় সাহেব কিছুতেই মেনে নিলেন না। কারণ, তিনি তাঁর বন্ধু  রবীন বাবুর ছেলের সাথে দেবলীনা দিদিমণির বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন। সেটার পিছনে ব্যবসায়িক কারণ যেমন ছিল তেমনই একমাত্র মেয়ের বি্য়ে কোম্পানির একজন কর্মচারির সাথে হবে সেটাও তিনি মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। আবার তখন কোম্পানির কথা ভাবলে সত্যকেও অস্বীকার করার উপায় কারো নেই।

এই অবস্থায় দিদিমণি জেদ ধরে বসলেন যে, তিনি বি্য়ে করলে সত্যকেই করবেন, অন্য কাউকে নয়। যদি দুই পরিবারের মধ্যে আর্থিক অবস্থা  তাদের বিয়ের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে  সত্যকে যেন তাদের ব্যবসার অংশীদার করে নেওয়া হয়। তাতে যদি অসুবিধা থাকে, তাহলে সত্য অন্য জায়গায় চাকরির যোগাড় করবে এবং তারপর দেবলীনা তাঁকে বিয়ে করে এখান থেকে চলে যাবে।  একমাত্র মেয়ের কথা ভেবে আমাদের সাহেব কি করবেন বুঝতে পারলেন না। এই সময় চতুর বুদ্ধি নিয়ে তাঁকে সাহায্য করলেন রবীন বাবু।

সাইটে ঠিকা শ্রমিকদের টাকা পয়সা মেটানোর কাজ করত সত্য বাবু। ঠিকাদারদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সেখানে সত্যবাবুর বিরুদ্ধে টাকা চুরির অভিযোগ করে ফাঁসানো হয়। সত্যবাবুর জেল হয়। সমস্ত ঘটনা এমনভাবে সাজানো হয় যে দিদিমণিও সত্যবাবুকে ভূল বোঝেন। আমি জানতাম, সত্যবাবু চুরি করতে পারেনা। তাঁকে সম্পূর্ণ ফাঁসানো হয়েছে।  কিন্তু তাঁকে মিথ্যা অপবাদের হাত থেকে বাঁচতে গেলে প্রমাণ করতে হবে সে নির্দোষ আর তাঁর হয়ে মামলা লড়তে গেলে দরকার টাকার। সত্যবাবুর পরিবারের সেই আর্থিক ক্ষমতা ছিলনা। অবশেষে  মিথ্যা অপবাদ ও দিদিমণির কাছ থেকে অপমান সহ্য করতে না পেরে সত্যবাবু একদিন জেলের মধ্যে আত্মহত্যা করেন।  আত্মহত্যা করার আগে তিনি জেলে দিদিমণির উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে যান। সেই চিঠিতে কি লেখা ছিল তা আমরা জানিনা।  তবে কানাঘুষো শোনা যায়, সেই চিঠিতে নাকি সত্যবাবুকে কিভাবে ফাঁসানো হয়েছে এবং রবীন বাবু কিভাবে অত্যন্ত চালাকি করে পুরো ব্যবসা নিজের দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, তা লেখা ছিল।

এই ঘটনার পর কোম্পানির টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়।  আমাদের সাহেব অতিরিক্ত টাকা দিয়ে,  আইন-আদালত করে অনেক কষ্টে  এই কোম্পানির সমস্ত অংশীদারিত্ব কিনে নেন। তবে সত্যবাবুর দেখানো রাস্তাতে ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগেনি।  তারপর থেকে ম্যডামই এই ব্যবসা দেখভাল করেন। উনি এরপর আর বিয়ে করেননি। প্রতি বছর সত্যবাবুর জন্মদিন আর মৃত্যুদিনে তাঁর ছবি  অফিসের টেবিলে সাজিয়ে  রাখেন,  অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের সাথে সময় কাটান, তাদের  খাবার-দাবার ও জামাকাপড় দেন।

আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে। এই অবধি শুনে আমার মাথা কেমন ঝিমঝিম্ করছে, সত্যবাবু যদি এই পৃথিবীতে নাই থাকেন, তাহলে মুম্বই থেকে কোলকাতাগামী বিমানে আমার সহযাত্রীটি কে? কিন্তু এই কথা লোকনাথদাকে বলতে পারলাম না, কারণ সে বিশ্বাস করবেনা।

 এই ঘটনার পর তিন মাস কেটে গেছে। সি.টি. জেড্. কোম্পানির টেন্ডারটি বলতে গেলে অলৌকিকভাবে আমাদের হাতছাড়া হয়েছে।  আমাদের জায়গায় টেন্ডারটি পেয়েছে এস্. আর. কন্সট্রাকশন নামক একটি নতুন কোম্পানি।

আমাদের কোম্পানির অবস্থা শোচনীয়।   একদিকে ঋণ জর্জরিত, অন্যদিকে সবচেয়ে বড় অর্ডার হাতছাড়া হওয়া। অনেকে অন্য জায়গায় চাকরি পেয়ে পদত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। যারা এখনো কোথাও  কিছু পায়নি তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আর আমার নিজেকে আরো বেশি ব্যর্থ মনে হচ্ছে এই কারণে যে, সি.টি. জেডের অর্ডার পাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব ছিল আমার উপর। যদিও ম্যাডাম্ আমাকে কখনো দোষারোপ করেননি, কিন্তু  আমার মনে হয়,  আজকের এই অবস্থার জন্য আমার ব্যর্থতাই দায়ী।

একদিন সকালবেলা অফিস পৌঁছে নিজের ডেস্কে বসতে যাব, এমন সময় ম্যাডামের ঘর থেকে আমাদের সবার ডাক এল। সবাই বলতে   এখনো যারা এই কোম্পানিতে চাকরি করছি, মানে আমি, দাশগুপ্তদা, অয়ন, সৌভিক ও দীপাঞ্জন।

‘গুড্ মর্নিং …..’।


একি!

আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। মুম্বই থেকে কোলকাতাগামী বিমানের আমার সেই সঙ্গী বসে  আছেন ম্যাডামের ঘরে।

‘বোসো তোমরা’।

ম্যাডামের কথায় আমরা যথারীতি চেয়ারে বসলাম।

তারপর ম্যাডাম্ বলতে শুরু করলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে জানো,  সি.টি.জেড্ কোম্পানির অর্ডার আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। আমাদের জায়গায় এই   অর্ডার পেয়েছে এস্. আর. কন্সট্রাকশন্। কোম্পানির যা অবস্থা তাতে এই মুহূর্তে ব্যবসায়িক কাজকর্ম চালানো অসম্ভব হয়ে উঠছে। আমরা কিছুদিনের মধ্যে নোটিশ জারি করে  আমাদের কোম্পানির কার্যকারিতা এবং  এই অফিসটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য  বন্ধ রাখব।  তবে বেশিদিন বন্ধ থাকবেনা, কারণ  এখানে এস. আর. কন্সট্রাকশন্ তাদের অফিস খুলবে।‘

এবার ম্যাডাম্  বিমানে আমার সেই যাত্রাসঙ্গীর সাথে আমাদের পরিচয় করালেন।  ‘ইনি হলেন এস্. আর. কন্সট্রাকশনের মালিক মিঃ শুভ্রকান্তি মৈত্র।   ওনার কোম্পানি কোলকাতায়  এখানেই  ওনাদের অফিস খুলবেন।  আর তোমাদেরকেও উনি ওনার কোম্পানিতে নিতে ইচ্ছুক।  কিছুদিনের মধ্যেই উনি তোমাদের সাথে কথাবার্তা বলবেন।‘

কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। দাশগুপ্তদা বলল ,’নিজের দেওরই কিনা অবশেষে ম্যাডামের প্রতিযোগী হয়ে উঠল’।

এবার আমি আর কৌতুহল চেপে রাখতে পারলামনা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিজের দেওর মানে’!

‘আরে ম্যাডামের স্বামীর যমজ ভাই। ঠিক  অর্ডারটাকে কব্জা করে রায় কোম্পানিকে পথে বসালো। ম্যাডাম আবার তাকেই ভালোমানুষি দেখিয়ে এই অফিসে ডেকে এনেছে’।

আমি বললাম, ‘দ্যাখো, এটা নিতান্তই তাদের পারিবারিক ব্যাপার। কিন্তু একটা ভালো ব্যাপার ঘটছে যে, আমাদের চাকরি ছেড়ে বসে থাকতে হবেনা’।

অয়ন বলল, ‘তা ঠিক, আমাদের আর কি? আমরা মাইনে পেলেই হল। মালিক পক্ষের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলিয়ে লাভ নেই’।

কয়েকদিনের মধ্যে রায় কোম্পানির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল।   সেখানে নতুন কোম্পানি সেজে  ওঠার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। আর   আমরা যেমন এই পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে রইলাম, তেমন এই পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলাম।  কিছুদিনের মধ্যে  আমরা নতুন কোম্পানির অধীনস্থ হতে চলেছি, তাই মনে একটা টেনশন কাজ করছে।

এর মধ্যে আমাদের নতুন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মানে মিঃ শুভ্রকান্তি মৈত্র আমাদের প্রত্যেকের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাইলেন। নির্দিষ্ট দিনে উনি এসে ম্যাডামের ঘরে বসলেন। ম্যাডাম্ সেদিন আসেননি। দাশগুপ্তদা, অয়ন  এরা ঘুরে এলে  আমার ডাক পড়ল।   আমি দরজা ঠেলে  জিজ্ঞেস করলাম, ‘মে আই কাম ইন্ স্যার’?

‘আরে, এসো এসো ইয়ং ম্যান্, বোসো’। এই বলে উনি বেল বাজালেন। লোকনাথদা এলে বললেন, ‘দুটো কফি দেবেন প্লিজ’।

আমাকে এতটা  উষ্ণ অভ্যর্থনার কারণ কি ?  আমার সাথে বিমানে ক্ষণিকের আলাপই কি তার কারণ! নাকি অন্য কিছু?  ওনার মোবাইলে   একটা ফোন  আসাতে উনি কথা বলছেন ।  আর আমার মনের মধ্যে  তোলপাড় হয়ে চলেছে নানা প্রশ্ন।

‘তোমাকে আর কি ইন্টারভিউ নেব? তোমাকে আমাদের কোম্পানির তরফ থেকে ভালো প্যাকেজ দেওয়া হবে। আগের কোম্পানির থেকে  আর্থিক সুবিধাও কিছুটা বেশি পাবে। তোমার মেল আইডি লিখে দাও। দু একদিনের মধ্যে সবকিছু মেল করে দেওয়া হবে।‘

আমি ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ্ স্যার’ বলাতে উনি বললেন, আরে আমার তোমাকে থ্যাঙ্ক ইউ জানানো উচিৎ। তোমার জন্যই তো এত কিছু হল।

আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললাম, ‘মানে আমি কি করলাম স্যার? আমি তো এখনো  এস্. আর কন্সট্রাকশনে জয়েনই করিনি।‘

‘তোমার অজান্তে তুমি আমাদেরকে এই অর্ডারটা পাইয়ে দিয়েছ’।

আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম।

‘অবাক হলে? মনে করে দেখ, তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল মুম্বই থেকে কোলকাতাগামী বিমানে। তুমি ছিলে আমার সফর সঙ্গী। কিন্তু তুমি কাজে ব্যস্ত ছিলে। প্লেন্ টেক্ অফের পরেই তুমি ল্যাপটপ্ খুলে সি.টি.জেডের কোটেশন খুলে কাজ শুরু করেছিলে। আর সেই সময় তোমার পাশে বসে আমি দেখে নিই, তোমরা কত টাকায় কোটেশন করেছ। তোমাদের ঐ কোটেশনের আরো কিছু তথ্যও আমি দেখে নিই। যার ফলে আমার পক্ষে তোমাদের থেকে কম দামে কোটেশন করা সহজ হয়ে যায়’।

আমার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। আমার অজান্তে আমার অসতর্কতার জন্য আজ রায় কোম্পানি বন্ধ হতে চলেছে! ছিঃ  ছিঃ! ম্যাডাম যদি জানতে পারেন। আমি রায় কোম্পানির এত বড় ক্ষতি করে ফেললাম!

আমাদের কফি এসে গেছে। লোকনাথদা চলে যাওয়ার পর মিঃ মৈত্র ফের শুরু করলেন।

‘কি ভাবছ? আমি চুরি করেছি? হ্যাঁ, করেছি।  আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আমার যমজ ভাইয়ের সাথে যা হয়েছিল, তার কাছে এটা কিছুই না। আমার ভাইয়ের জন্য রায় কোম্পানি এই জায়গায় পৌঁছেছে। আর সেই ভাইকে চুরির দায়ে ফাঁসিয়ে জেলে পাঠাল। তোমাদের ম্যাডাম্ যাকে ভাই নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালবাসত তিনিও ভূল বুঝলেন। আর ভাই তা সহ্য করতে না পেরে জেলে আত্মহত্যা করল। বাবা ভাইয়ের এই অকাল মৃত্যু সহ্য করতে পারলেন না। কিছুদিনের মধ্যে তিনিও চলে গেলেন। মাকে নিয়ে আমার তখন পথে বসার উপক্রম।  আমি তখন স্ট্রাগল্ করছি।  সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন আমার মামা।দাদার নামে মামার সাহায্যে তখন এই এস্. আর. ইলেক্ট্রিকাল নামে কোম্পানি খুলে ব্যবসা চালু করলাম।  অনেক কষ্ট করে আজ এই জায়গায় পৌছেছি।আমার লক্ষ্য কি ছিল জানো? দাদার বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিশোধ নেওয়া। বোধহয় ভগবানও আমার পক্ষে ছিলেন। তাই তোমার সাথে প্লেনে দেখা হয়ে গেল, আর পরবর্তী কাজটাও অনেক সোজা হয়ে গেল’।

অর্ডার পাওয়ার পর ম্যাডাম্ খোঁজ নেন আমাদের কোম্পানি সম্মন্ধে।    ওনার ভাবতে পারেননি যে,রায় কোম্পানি ছাড়া অন্য কোম্পানি এই অর্ডার পাবে। যখন জানতে পারলেন এটা আমার কোম্পানি এবং আমাদের কোম্পানির নাম এস্.  আর. কন্সট্রাকশন আসলে দাদা সত্যরঞ্জনের নামে করা, তখন নিজে আমার সাথে যোগাযোগ করেন।  ম্যাডামের সাথে যোগাযোগ না হলে অবশ্য আমি জানতে পারতাম না যে  উনি পরে নিজেদের ভূল বুঝতে পেরেছেন এবং দাদার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার জন্য  অনুতপ্ত। শুধু তাই নয়, আমাদের কোলকাতায় অফিসের দরকার শুনে বৌদি নিজে আমাদের নামে এই অফিসটা লিখে দেন, আর তার জন্য একটা পয়সা নেননি।  আমি  টাকা-পয়সার কথা বলতে গেলে বলেন,  ‘এই অফিসটা তোমার দাদার নামে হবে, এর থেকে বড় পাওনা আমার কিছু নেই’।   ব্যবসা আর করবেননা। রায় কোম্পানির নামে যা সম্পত্তি আছে, সেসব বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাতে বাজারে যে বিশাল দেনা  আছে তা শোধ হবে এবং যা থাকবে সেটা ব্যাঙ্কে রেখে সেই সুদে  ওনার ও  ওনার বাবার বাকি জীবন ভালোভাবে চলে যাবে।  উনি নিজে অনেক সাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত। তাদের সাথেই বাকি জীবনটা কাটাতে চান’।

কফি শেষ করে আমি শুভ্র বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজের অনুশোচনা বারবার  কুরে কুরে খাচ্ছে। আমার জন্য এত বড় ক্ষতি হল ম্যাডামের! মানছি ম্যাডাম্ একটা সময় সত্যবাবুর প্রতি অন্যায় করেছেন, কিন্তু আমার মাধ্যমেই  তাঁর সাথে জীবন এত বড় প্রতিশোধ কেন নিল?

 দেখতে দেখতে রায় কোম্পানির জায়গায় এস্. আর. কন্সট্রাকশন সেজে উঠল। শেষ দিন ম্যাডামকে আমরা বিদায় সম্বর্ধনা দিয়ে একটা লাঞ্চ পার্টির  আয়োজন করেছিলাম। শেষবারের মতো ম্যাডাম্  এই অফিস থেকে চলে গেলেন।    একবার মনে হচ্ছে আজকের দিনের জন্য আমিই দায়ী, আবার  নিজের মনকে এই বলেও সান্ত্বনা দিচ্ছি-   নিজের কৃতকর্মের ফল সবাইকে পেতে হয়। সেটাই হয়তো ম্যাডামের ক্ষেত্রে ঘটল।  এইভাবেই তিনি তাঁর প্রায়শ্চিত্ত করলেন। উপরওয়ালা বলে যদি কেউ থেকে থাকে, এ হয়ত তাঁরই খেলা, আর আমি সেই খেলার একটা সামান্য ঘুঁটি।




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন