শূন্যতা - শুক্লা কর


 

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই চারিদিকের নিস্তব্ধতা যেন উদাস করে দিল সুপ্রতিমকে। একটা মানুষের শূন্যতা এত গভীর! বুকটা হু হু করে উঠল। মানুষ এমন করে চলে যায়! কেন যে সুপ্রতিম বোঝেনি। সত্যিই বুঝতে পারেনি। বুঝলে কি আর এমন কঠিন আচরণ করত মানুষটার সাথে?


বিছানায় বারকয়েক এপাশ ওপাশ করে উঠে বসল। পাশে নীতা তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। সন্তর্পনে মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল সুপ্রতিম। বাবার ঘরটা পাশেই। বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো এত তাড়াতাড়ি স্মৃতি হয়ে যায় আপনজন!


সেই শৈশবে মা হারা সুপ্রতিম। দেবেন্দ্র  আর বিয়ে করেননি। মাতৃস্নেহ- পিতৃস্নেহ দিয়ে বড় করেছিলেন ছেলেকে। বয়স একটু বাড়তেই ঈশ্বরের দিকে ঝুঁকেছিলেন। সুপ্রতিম বড় হওয়ার পর বিয়ে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করেছিলেন ঈশ্বরের কাছে। জপ-তপ-ধ্যান-কীর্তন এসব নিয়েই থাকতেন। সুপ্রতিম ততদিনে ঘোরতর সংসারী। পৈতৃক ছোটো বাড়িটায় ছেলে টুটুলের পড়াশোনার অসুবিধা হচ্ছিল বলে ভাগের অংশ বিক্রি করে এই বাড়িটা তৈরি করেছিল সুপ্রতিম। তিনখানা রুম, ডাইনিং হল, ফুলের বাগান। বাবার জন্য একখানা ছোটো ঠাকুর ঘর করিয়ে দিয়েছিল। মার্বেল বসানো ঝকঝকে-তকতকে। কয়েকটা বছর বেশ কাটল। টুটুল চাকরি পেয়ে বিদেশ চলে গেল। বাড়িতে মানুষ বলতে তিনজন। 


সমস্যাটা শুরু হয়েছিল কিছুদিন পর। টুটুল বিদেশ থেকে যখন প্রথমবার দেশে এল দাদাইয়ের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে এল একখান দামী সাউন্ড সিস্টেম। একগাল হেসে দাদাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তোমার জন্য একটা দারুণ জিনিস এনেছি। যত খুশি কীর্তন শুনবে এবার। সাউন্ড কোয়ালিটি খুব ভালো। 


কী খুশি দেবেন্দ্র! তার আদরের ছোট্ট টুটুল তার জন্য বিদেশি কোম্পানির জিনিস এনেছে!  চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়ছিল। বাবাকে এত খুশি হতে সুপ্রতিম কখনো দেখেনি। টুটুল সাউন্ড সিস্টেমের সবকিছু বুঝিয়ে দিল দাদাইকে। কিভাবে কোন গান সেট করতে হবে, কিভাবে সাউন্ড বাড়ানো কমানো হয়


 সারাদিন কীর্তন শোনা শুরু হল। 


সুপ্রতিমেরও বয়স হয়েছে। সামনের বছর অবসর গ্রহণ। তবে দেবেন্দ্রর মতো ঠাকুর দেবতায় ভক্তি নেই। বরং কিছুটা নাস্তিক গোছের। কীর্তন শোনা পছন্দ নয়। বিরক্তিই আসে। প্রথম ক'দিন চুপচাপ ছিল তবু। মনে মনে ভেবেছিল, বাবা বয়স্ক মানুষ। কীর্তন ভালোবাসেন। শুনুন এই ভাবনা দিয়ে নিজেকে সংযত করেছিল। কিন্তু দিন দিন যেন বিরক্ত আসছিল। দেবেন্দ্র আজকাল  কানে একটু কম শোনেন। ভোর থাকতেই শুরু হয়ে যায় উচ্চ স্বরের কীর্তনের শব্দ। একেই কত রাতে ঘুমোতে যাওয়া। তারপর আবার যদি ওই ভোররাত থেকে কীর্তনের উপদ্রব সহ্য করতে হয়....


একদিন সহ্য করতে না পেরে সটান দেবেন্দ্রর ঘরে হাজির হল সুপ্রতিম। বেশ ঝাঁঝ নিয়েই বলল, এই ভোররাত থেকে অত জোরে সাউন্ড দিয়ে কীর্তন শুনলে ঘুম হয় কোনো মানুষের? তুমি তো সন্ধে সাতটায় খেয়ে আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়। আমরা এত রাতে শুই। তারপর আবার ভোর থেকে আবার এই কীর্তনের উৎপাত।উফ্!


সুপ্রতিমের কথার উত্তরে একটি কথাও বলেননি দেবেন্দ্র। ঘোলাটে চোখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ছেলের দিকে! 


তারপর থেকে ভুলেও আর কীর্তন চালাতেন না। দিনকয়েক পর হঠাৎ স্ট্রোক। শরীরের ডান দিকের অংশ অসাড় হয়ে গেল দেবেন্দ্রর। বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না। নীতা এসে কীর্তন চালিয়ে দিতে। দেবেন্দ্র কানে কম শোনেন। জোরে সাউন্ড দিতে হত। দেবেন্দ্র ভয়ে ভয়ে বলতেন, অত জোরে কীর্তন চালিও না বৌমা। খোকা এসে বকবে


নীতা বলত, সে আমি দেখব। আপনি শুয়ে শুয়ে কীর্তন শুনুন তো কৃতজ্ঞতায় দু'চোখ ছলছল করে উঠত দেবেন্দ্রর।  দুটি মাস পেরোতে না পেরোতেই সেকেন্ড স্ট্রোক। চলে গেলেন দেবেন্দ্র। ছেলে বাইরে থাকে বলে শ্বশুর মশাইয়ের দেখভাল করেই সময় কাটত নীতার। মানুষটা চলে যেতেই কেমন যেন খা খা করছে চারধার। সুপ্রতিমের চেয়ে নীতাই যেন বেশি কষ্ট পেয়েছে দেবেন্দ্রর চলে যাওয়াতে। আত্মার সম্পর্ক কখনো কখনো রক্তের সম্পর্ককেও ছাপিয়ে যায়


এই এলাকাটা খুব নির্জন। শহরের হৈ হট্টগোল থেকে একটু দূরেই বাড়িটা। ইচ্ছে করেই এরকম ফাঁকা জায়গায় বাড়িটা করেছিল সুপ্রতিম। কম দামে অনেকখানি জায়গা।উঠোন, বাগান,পাশেই একটা বড় পুকুর- বেশ গ্রাম্য পরিবেশ। তবে ইদানিং অনেক বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। আগের মতো নির্জনতা আর নেই। তবু বেশ ভালো লাগে এখানকার পরিবেশ। কিন্তু দেবেন্দ্র চলে যাওয়ার পর এখানকার নির্জনতা যেন গ্রাস করে ফেলল সুপ্রতিমকে। একটা শূন্যতা যেন ঘিরে ধরেছিল। আপনজনকে হারিয়ে ফেলার শূন্যতা


প্রথম সকালের নির্জনতা বিষণ্ণ করে দিল সুপ্রতিমকে। নীতা এখনও ঘুমোচ্ছে। এই ক'দিন বাম পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে বলে রাতে ভালো করে ঘুম হয় না। ভোরবেলা তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। একবার ভাবল নীতাকে ডাকবে। চা খেতে ইচ্ছে করছে। পরমুহূর্তেই ভাবল, আহা বেচারী! আরেকটু ঘুমোক। একটু পরে দু'কাপ চা তৈরি করে নীতাকে ডাকবে


কিছুক্ষণ ব্যালকনির চেয়ারে বসে বাবার ঘরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুপ্রতিম। ছোটবেলার স্মৃতিরা এসে ভিড় করতে লাগল।কত স্মৃতি!  বাবার কোলের কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে যাওয়া, বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, বাবার সাথে প্রথম সাইকেল চালাতে শেখা... 


চোখ ঝাপসা হয়ে এল অজান্তেই। চেয়ার থেকে উঠে বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকতেই একটা আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ ঘিরে ধরল। ঘরটার চারিদিকে চোখ বোলালো সুপ্রতিম। সারা ঘরময়  বাবার স্মৃতি। শুধু মানুষটাই নেই। একদিকের দেওয়ালে বাবা মায়ের একটা সাদা কালো ছবি। বিবর্ণ হয়ে গেছে। ছবিটা বোধহয় বাবা মায়ের বিয়ের কিছুদিন পর তোলা। নতুন বৌয়ের লজ্জা রঙ মায়ের মুখে। মা'কে সুপ্রতিমের একটুও মনে পড়ে না। ছোটবেলা থেকে এই ছবি দেখেই সে মা'কে কল্পনা করতে করতে বড় হয়ে উঠেছিল। বাবা সবটুকু উজাড় করে ভালোবাসা দিলেও মায়ের জন্য মনকেমন করত সুপ্রতিমের। কিন্তু পাছে বাবার মনে কষ্ট হয়, তাই ভুলেও বাবার কাছে কখনো মায়ের কথা বলত না।আজ একদৃষ্টে বাবা মায়ের ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সুপ্রতিম। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হল, এখন সে অনাথ


ঘরের চারপাশে চোখ বোলালো। দেওয়ালে পেরেকে ঝোলানো দেবেন্দ্রর সাদা পাঞ্জাবি। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে পাঞ্জাবিতে নাক ঠেকালো সুপ্রতিম।বাবা বাবা সেই গন্ধ! ছোটবেলায় এই গন্ধ আঁকড়ে সারারাত ঘুমিয়ে থাকত সে। যতই বয়স হয়ে যাক না কেন, বাবা মায়েদের গায়ের গন্ধ কখনো পাল্টায় না


দেওয়ালের তাকে রাধা কৃষ্ণের ছবি। সামনে গীতা নামানো। এই প্রথম বার হাতজোড় করে প্রণাম করল সুপ্রতিম। অন্যদিকে আরেক তাকে নানান ধর্মগ্রন্থ। ডানদিকে একটা টেবিলে টুটুলের আনা সাউন্ড সিস্টেমটা নামানো। হলুদ তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। নীতা বোধহয় এত যত্ন করে রেখেছে। হয়তো ভেবেছে, এবার এটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকবে ঢাকাটা সরিয়ে সাউন্ড সিস্টেমের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সুপ্রতিম। তারপর স্টার্ট বোতামে চাপ দিল। সারা ঘরময় গমগম করে উঠল-

    জয় রাধে রাধে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ, গোবিন্দ গোবিন্দ বল রে....


এক আশ্চর্য আবেশ ছড়িয়ে পড়ল সুপ্রতিমের শিরা উপশিরায়। মনে হল, দেবেন্দ্র এই ঘরেই রয়েছেন কীর্তন চালু করে বাইরে বেরিয়ে এল সুপ্রতিম।ব্যালকনিতে এসে বাগানের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে অতীতে পৌঁছে দাঁড়িয়ে রইলকীর্তনের শব্দে ঘুম ভেঙেছে নীতার। অবাক হয়ে বিছানা থেকে নেমে এসে নিঃশব্দে সুপ্রতিমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুপ্রতিমের সম্বিত ফিরতেই নীতার দিকে তাকিয়ে দেখল বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে নীতা তাকিয়ে আছে। সুপ্রতিম একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। তাই...


নীতা কোনো উত্তর দিল না দেখে ফের বলল, রোজ সকালে উঠে সাউন্ড সিস্টেমটা চালিয়ে দিও তো। বেশ ভালো লাগছে এই সকালবেলায় কীর্তন শুনতে। নীতা ছোট্ট করে হুঁ বলল


কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যখন কথা কম বলতে হয়। নীরবতার স্বাদটুকু উপভোগ করতে হয়...





Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন