অর্ক
পুজোয় কলকাতায় ঠাকুর দেখতে বেরোবে, এটা
বিস্ময়কর নয়। কিন্তু সে রাস্তায় হইচই করবে বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মানুষকে এটা অবগত করতে চাইবে যে - সে সুখী, এটা সত্যিই কল্পনাও করা যায় না ! এই যে অর্কর ভাব-প্রকাশের পদ্ধতিগুলো বদলে
গেল, এর পিছনে নানা কারণের জটিল একটা মনস্তত্ত্বিক খেলা
চললেও, মূল কারণটি সম্পর্কে অর্ক নিজে প্রায় নিশ্চিত। একদা
এক সন্ধ্যায় এক পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘ভূমি’-র অনুষ্ঠান চলছিল। কলেজের বাৎসরিক
বিচিত্রানুষ্ঠান। কিন্তু যাদের জন্য এই অনুষ্ঠান, সেই ‘তারা’ অর্থাৎ কলেজ-পাঠরত ঘি ও আগুনের দল, তাদের ওই পরম প্রাপ্তি অর্থাৎ উত্তেজনা-মুখর হট্টগোলের চরম সহাবস্থানে যে পুলক ও
রোমাঞ্চ অনুভব করছিল, তাতে জনপ্রিয় গানগুলি জাস্ট
ব্যাক গ্রাউন্ড স্কোরে পরিণত হয়েছিল । “ফাগুনেরও মোহনায়.... ফাগুনেরও মোহনায় --
মন মাতানো মহুয়ায়... রঙ্গীন এ বিহুর নেশা কোন্ আকাশে নিয়ে যায়...” — গানের
সুরে ছেলে-মেয়েদের পরস্পরের শরীরে শরীর লাগার আনন্দে যেন সেদিন প্রেমের ভিয়েন
বসেছিল । সেদিন অর্ক যার জন্য পাঞ্জাবী পরে গিয়েছিল, সেই শাড়ি-টিকে সে একটু একলা পেতে চেয়েছিল । তার মনে হয়েছিল, এটাই সেই শুভদিন। সেটা মনে হওয়ার জন্য কোনো পাঁজি দেখার প্রয়োজন নেই । অর্ক
শুধু চেয়েছিল, তাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা
বলতে — কথাগুলোর এতই ভার যে তার চাপে অর্কর তখন দম বন্ধ হয়ে আসছে, বুকের ভিতরে ধুকপুক শোনা যাচ্ছে । কিন্তু চাবুক পিঠে এসে তখন লাগল, যখন অর্ক দেখল লোলুপ কিছু প্যান্ট-শার্ট ও দামী দামী পাঞ্জাবীরা তার 'শাড়ি'-কে ঘিরে ফেলেছে । এরাই না ট্রেনে তার শাড়ি সম্পর্কে
বিশ্রী সব ইঙ্গিত করে ! এরাই না ওর সম্পর্কে নিজেদের অবচেতনের বিষ আড়ালে আবডালে যখন-তখন উগড়ে দেয় ! ঠিক তখনই গিটারিস্টের ইলেকট্রিক গিটার একটা
পিলে চমকানো শব্দ তোলে। অর্ক মুহূর্তের জন্য নিজেকে ফিরে পেলেও আবার যেন
পরমুহূর্তেই ভার্চুয়াল চাবুকের আঘাতে বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট হয়ে শিউরে ওঠে । তার শাড়ি, হঠাৎ দু-হাত তুলে লোলুপ-স্পর্শাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে মৃদুমন্দ নাচতে শুরু করেছে।
একটা পোড়া পোড়া গন্ধ অনেকক্ষণ থেকেই টের পাচ্ছিল অর্ক। হঠাৎ চমকে উঠে দেখে, তার অক্ষত শরীরের ভিতরে সুগোপন ক্ষতস্থানটিতে ভয়ংকর আগুনের দাপাদাপি ।
দুনিয়ার কোনো রেইন্ মেশিনের সাধ্য নেই, সেই আগুন
নেভায় ।
সেদিন অর্ক প্রথম বুঝেছিল, গোটা প্রেক্ষাগৃহে এতগুলো মানুষের ভিড়েও সে ভয়ংকর একা । সেখানে কেউ দর্শক, কেউ কুশীলব, কেউ কেউ-বা উদ্যমী । আর অর্ক একা — তীব্র ভাবে — নিবিড়ভাবে একা। একটা অসহায় হাহাকার তাকে সর্বক্ষণ সেই থেকে তাড়া করে ফেরে । ভিতরে ভিতরে হঠাৎ হঠাৎ কুঁকড়ে দেয় তাকে। আবার মনে পড়ে যায়, তখন প্রোগ্রাম শেষের পথে, বিশেষত মেয়েদের বাড়ি ফেরার তাড়া । অজস্র চেয়ার ফাঁকা পড়ে আছে । ‘ভূমি’ গাইছে, “তারে হৃদমাঝারে রাখিব --- ”, আর তার বিহ্বল বন্ধুরা ব্যান্ডের সুরজিৎ, সৌমিত্রদের আরো কাছে গিয়ে নাচতে চাইছে । ভল্যান্টিয়ার অর্ককে স্যার তখন খুঁজছেন । কিন্তু অর্ক তখন দুচোখের নোনা জলে মিশে ফাঁকা চেয়ারের ভিড়ে একা তলিয়ে গিয়েছে।
(২)
আজ আবার
একইরকম একাকীত্ব । দেশপ্রিয় পার্কে রূপম-সন্ধ্যা । রূপম মানেই রক্, রূপম মানেই ফসিলস্ । বিজ্ঞাপনী
প্রচারে সর্বত্র লেখা ‘Stay Raw’ । ষষ্ঠী-র পুজো সন্ধ্যা । রূপম গানের দুটো লাইন উচ্চারণ করে থেমে গিয়ে দর্শকের
দিকে নাটুকে আগ্রহ আর নিশ্চিত প্রত্যয়ের সাথে কান-পাতার একটা ভঙ্গি করেন । আর ওমনি
গোটা মাঠ জুড়ে তাঁর অগণিত ভক্তরা গানের পরবর্তী লাইনগুলি গেয়ে ওঠে, মর্যাদা রাখে প্রিয় গায়কের আস্থার । অর্ক এই গানগুলো আগে এত মন দিয়ে কখনও শোনে
নি । কিন্তু এখানে অনেকেরই সব গান মুখস্থ। ইয়াং ক্রাউড তাদের প্রিয় রকস্টারের অনুকরণে মাথা
ঝাঁকাচ্ছে, তাদের হাতের আঙুলের ইশারা জানান
দিচ্ছে তারা গোটা শরীর দিয়ে অনুভব করছে একটা অদৃশ্য গীটার । অবিরাম লাফ-ঝাঁপের
ফাঁকে কেউ-কেউ চিৎকার করে উঠছে, ‘রূপম ইজ দ্য বেস্ট’ । কেউ কেউ
আচমকা চেঁচিয়ে ওঠে, "অ্যাসিড অ্যাসিড" বলে, কারণটা অর্কর বোধগম্য হয়
না । একদল
যুবক-যুবতী গোল হয়ে উদযাপন করছে, তাদের বন্ধুত্বের মুহূর্তগুলো ।
আর এক ঝোলা জিন্স, থুতনির নীচে দাড়ি, হাতে সিগারেট নিয়ে মাঠের ঘাসের ওপর রসিয়ে বসে পড়ে । বান্ধবীর হাত থেকে ছোট্ট
পাতলা একফালি কাগজ নিয়ে নাকের কাছে ধরে টেনে নেয় গুঁড়ো গুঁড়ো মাদক । তারপর ছোট্ট
টয়ট্রেন বানিয়ে ফেলে একে অপরের পিঠে পিঠে হাত রেখে । তারপর অর্কর পাশ দিয়ে ভিড়ের
ফাঁকে ফাঁকে ছুটে বেড়ায়!
স্টেজে পরপর দুটো লাইভ জীবনমুখী গানের ডায়নামাইট পরিবেশনের পর রূপম দশ মিনিটের বিরতি চান। রূপম ব্যাকস্টেজে চলে যেতেই মিউজিসিয়ানেরা অতিসক্রিয় হয়ে উঠে ইনস্ট্রুমেন্টে তুফান তোলে। অর্ক অনুভব করে, গান্ডু জনতা এমন একটা ভাব করে উচ্ছ্বাসে মাতাল হয়ে যায়, যেন কী দারুণ একটা মিউজিক্যাল নোট শুনছে !
অর্ক জানত একটা নতুন দৈনিক সংবাদ পত্রের প্রচারে কলকাতার সবক’টি ব্যান্ড মিলে একটা মিউজিক্যাল ভিডিও বানিয়ে, ইউটিউবে আপলোড করেছে । ঐ পত্রিকাটিই নিজেদের প্রচারে আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজক — ষষ্ঠীর ভিড়ে প্রচার জমে ক্ষীর । জীবনমুখী রূপম স্টেজে উঠে প্রচারমুখী বক্তৃতা শুরু করেন — “আজ মহাষষ্ঠীর দিনে এই যে আপনারা বা তোমরা, আনন্দ পাচ্ছেন বা পাচ্ছো, এর পিছনে আছে.... ” অর্ক নিশ্চিত, সবারই পিছনে আজকাল কিছু না কিছু থাকে — এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই তার ! রূপমের গলায় আবেগ ভর করে, “এই কাগজটিকে একটু সাপোর্ট করার অর্থ আগামী বছর আবার তাদের অনুষ্ঠান । আবার আমাদের আশা সম্ভব হতে পারে । শুধু দরকার ওদের জন্য একটু সাপোর্ট । আর সেটা আমরা কীভাবে করবো ? হ্যাঁ - ঠিক ধরেছো — অন্য কারোর ওপর থেকে সাপোর্ট-টা একটু তুলে নিয়ে, সেটা ওদের দেওয়া । না না -- এতে বিরাট কোনো দায়িত্ব বা, রাজনীতির গন্ধ নেই । বরং একটা সোজা হিসেব আছে । ওদেরকে সাপোর্ট করা মানে একটা নতুন উদ্যম, একটা নতুন প্রচেষ্টা-কে স্বাগত জানানো । আর ওরা এই এক বছরে আরো প্রতিষ্ঠিত হলে, কথা দিয়েছে, রূপমকে তোমাদের সামনে পরের বছর আবার এনে দেবে । কি ! তোমরা সেটা চাও তো ?” জনতা তুমুল উৎসাহে তাদের আগ্রহের উৎসমুখ খুলে দেয় হাততালিতে । আর সমবেত করধ্বনির মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে অর্ক আবার ভাবে, এই ছেনালি মেয়েদের মতো ভাষণবাজির পর এই হাততালি ! যারা আজ প্রচার করছে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে, সেইজন্যে রূপমকে এনেছে, পরের বছর দাঁড়িয়ে গেলে থোড়ি তারা আবার রূপমকে ডাকবে ! তখন আসবে শান বা নিদেনপক্ষে কুণাল গাঞ্জাওয়ালারা । অর্কর চোখের সামনে সহসা জনতা সংযত হয় — উপরে নীচে আশেপাশে রঙিন আলোর সম্মোহিনী বিচ্ছুরণ ও বন্টনে রূপম হয়ে ওঠেন জাদুকর — মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটা তুলে নিয়ে স্টেজে এলোমেলো ঘোরেন । জনতা মন্ত্রমুগ্ধ — রূপমের গলায় তখন —
“জীবন চলছে না আর সোজাপথে
দ্যাখো আজও হাসি কোনওমতে
বেঁচে
গেছি বলি হ'তে হ'তে...” !
তারপর স্ট্যান্ডটা কাঁধে তুলে দর্শকদের দিকে ঝুঁকে পড়েন রূপম। জনতা পাগলের মতো লাফাচ্ছে। অর্ক ভাবে, প্যান্ডেলে বসে মা দুর্গাও বোধহয় শুনছেন আর মাপছেন হুজুগপ্রিয় মর্ত্যবাসীদের ।
অর্ক প্রোগ্রামের শেষে পার্কের ঘাসের অমসৃণ ফরাসে বসে পড়ে । অমনি তার দু-চোখের ক্যামেরা মাটির সমান্তরালে নেমে আসে। প্রিয়া সিনেমাতে ‘পাঁচ অধ্যায়’ চলছে । শান্তনু মৈত্রের গানগুলো খাসা। দেখতে হবে একদিন ! মাঠে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে আছে লম্ফঝম্পের পরে ক্লান্ত ছেলে-মেয়েরা । একটি মেয়ে সিগারেটে টান দিয়ে, খুকখুক করে কাশতে থাকে । একটি মেয়েলি ছেলে মেয়েটির পোশাকের আড়ম্বর থেকে বেরিয়ে থাকা অন্তর্বাসটা ঠিক করে দেয়। একটা ফড়িং অনেকক্ষণ ওড়াউড়ি করে, কিন্তু ঘাসে বসবার মতো নিরাপদ জায়গা খুঁজে পায় না। অর্ক আজকে আরেকটা মজা দেখেছে। একডালিয়ার পুজো মন্ডপের কাছেই একটা টিভি চ্যানেলের কোনো প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং হচ্ছিল। মজার ব্যাপার দিনটা ষষ্ঠী হলেও, অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিদের জানানো হয়েছিল যে, সম্প্রচার হবে নবমীর দিন। মঞ্চে দুজন বিচারককে চিনতে পারে অর্ক। শিবাজী চট্টোপাধ্যায় ও শকুন্তলা বড়ুয়া। আরেকজন লাস্যময়ী জাজকে চেনা যায় না। কে কত ভালো প্রেম নিবেদন করতে পারে, তারই রাউন্ড চলছিল, ‘পুজোর প্রেম’ নামে। একটা স্ট্যান্ড করা বাইকে ঠেস দিয়ে অর্ক দর্শক হয়ে যায় । দুই অ্যাঙ্করের একজন ছেলে, একজন মেয়ে। ছেলেটা চালু, মেয়েটা ক্যাবলা মতো। প্রতিযোগীদের মধ্যে এক এক করে তিনজন মেয়ে অ্যাঙ্কর ছেলেটিকে প্রপোজ করে অন ক্যামেরা। মেয়েটিকে কেউ পাত্তা দেয় না। তার বিরক্তি, তার ছটফটানিতেই প্রকাশ হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ প্রতিযোগীই সেই চির পুরাতন সাধারণ কথা বলে, “আমি তোমায় অনেকদিন ধরে ভালোবাসি, শুধু বুঝতে পারছিলাম না, কীভাবে জানাবো !” প্রতিযোগীদের মধ্যে একটা ছেলে একটা মেয়েকে প্রপোজ করতে গিয়ে অমিতাভ বচ্চনের সংলাপ বলে গলা নকল করে। মেয়েটা হাসতেই থাকে। তার কেমন লাগলো জিজ্ঞেস করায় মেয়েটা হাসি মুখে বলে, “এটা স্পোর্ট। আমার মা নীচে বসে আছেন। সুতরাং ... আর কে না জানে যে, পুজোর প্রেম বিয়ে অব্দি গড়ায় না।” অর্কর মনে হয়, এই মেয়েটাও বোধহয় অ্যাঙ্করিং করে। দারুণ কন্ঠস্বর। হাসি মুখে শক্ত কথা বলার অভ্যাস আছে। খানিকটা চেনা চেনাও লাগে মুখটা। টিভিতে দেখেছে কি! এদিকে আরেকটা মেয়ের জন্য তখন দুবার রি-টেক নেওয়া হয়েছে — অ্যাঙ্কর যুবতী বিরক্ত। শিবাজী বাবু অর্ককে চমকে দিয়ে মেয়েটার জন্য গেয়ে ওঠেন অর্কর প্রিয় গান, “খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে, মনটা কেন এত কাছে টানলে ?”
মাঠে লোক কমছিল। ওদিকে অর্ক ভাসমান সময়ের ধুলোবালি ঘাঁটতে ঘাঁটতে অপসৃয়মান বর্তমানে ফেরে। নাকে সস্তা বিরিয়ানির গন্ধ ভেসে আসে, মেলার কোনো ফাঁকা স্টল থেকে। অর্ক তৃণশয্যা থেকে উঠে পড়ে। পার্ক থেকে বেরিয়ে একটা ত্রি-সি-বাই-ওয়ান বাস ধরে। সিট পেতেই জানালার ধারে বসে পড়ে। রাত এগারোটা পনেরো। মৃদু বাতাসে অর্কর চোখজোড়া বুজে আসে । শহর কলকাতা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আলোয় আর জনতায় ভাসছে। অর্কর ঘুম পায়। পাশের ফাঁকা সিটটায় যেন কেউ এসে বসে ! অর্কর মনে হয়, খুব চেনা কেউ। আধ-ঘুমে অর্কর কাঁধ একটা হাত স্পর্শ করে। অর্ক বাঁ হাতটা দিয়ে ঠোঁটের কোলটুকু মুছে নিয়ে তাকায়। আরে এ যে অর্কর শাড়ি ! আজ কতদিন পর — আজও সেই একইরকম হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে ! হাতের মালিক সাবধানী গলায় অবিশ্বাসী অর্কর দুই চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “কী রে ! চিনতে পারছিস না বল্ ?”
অর্কর মনে হয়, টাইম মেশিনে চেপে বসে আছে ও, যার কন্ট্রোল বাটনটা ও খুঁজে পাচ্ছে না । ওর শাড়ি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “আমি জানতাম তোর সঙ্গে একদিন ঠিক আবার দেখা হবে ।”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন