সেন্টারে এসে পড়েছে মালতী। একটা বসার টুল এগিয়ে দিয়ে ম্যানেজার বলল, “কি রে ফোন করার সাথে সাথেই হাজির হয়েছিস দেখছি? কাজ পারবি তো ? বড় বাড়ি, অনেক দায়িত্ব।“
-“কেন পারবো না?”
- “না না কোনো অভিযোগের সুযোগ দেব না। মালতীর গলায় আত্মবিশ্বাস ভেসে ওঠে। কি
করতে হবে ?”
-“মল্লিকপাড়া চিনিস তো ?”
- “হ্যাঁ।“
-“ওখানে রায়বাড়িতে এক বুড়িকে দেখাশোনা আর বাড়ির যাবতীয় কাজ করতে হবে। বুড়ির
ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলেটা কোলকাতার বাইরে কাজ করে, শনি রবি থাকে এখানে ওই দুদিন তোর ছুটি। ভালো করে মন দিয়ে কাজ কর, মাসে ছয় হাজার পাবি।“
- “কাল সকালে যাবি। ওর ছেলে থাকবে, তোকে বুঝিয়ে
দেবে সব।“
- “ঠিকআছে”, বলে উঠে পরলো মালতী। মনটা বেশ
খুশি। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল ওর পাড়ার মেয়ে কাকলির সাথে। কাকলিও সেন্টারে আয়ার কাজ করে।
কথায় কথায় নিজের কাজের কথা জানালো মালতী। মল্লিকপাড়ার কাজ শুনে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে
গেলো কাকলির। মালতী বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করলো,“কেন কি হয়েছে রে? শেষে ওই মল্লিকপাড়ার ভুতের বাড়ির কাজটা নিলি?”
- “শালা ম্যানেজারটা হেব্বী ঢ্যামনা! জানে নতুন মেয়ে, গছিয়ে দিলেই হল।“
- “আরে খুলে বল না।“
- “বলছি বলছি। ওই মল্লিকপাড়ার রায় বাড়ির বুড়ি গিন্নিটা কেমন যেন। কথা কম বলে, টেরিয়ে তাকায়। রাতে ওর ঘর থেকে কিসব আওয়াজ আসে। বাড়িটাও মান্ধাতা আমলের, কেমন যেন স্যাত স্যাতে আর অন্ধকার অন্ধকার। আগে একটা মেয়ে কাজ করতো ওর মুখেই শুনেছি মাঝে মাঝে নাকি বুড়ির চোখ রক্তজবার মতো লাল হয়ে যায়, গোঙায়, বিড়বিড় করে কি সব বলে।“ হো হো করে হেসে উঠলো মালতী।
- “বিশ্বাস করলি না? যা না, হাড়ে হাড়ে বুঝবি। তখন যেন এই কাকলিকে বলতে আসিস না।“
- “রাগ করছিস কেন ? এত গুলো টাকার কাজ ওসব ভূত ফুত ঠিক ম্যানেজ করে নেবো। চলি রে।“ কাকলিও মুখ হাঁড়ি করে নিজের
বাড়ির দিকে চলে গেল।
বাড়ি
এসে কিছু গোছগাছ করে নিল মালতী। মনে বেশ আনন্দ। পাশের ঘরে গিয়ে বাবার সামনে ঠক করে
চা এর কাপ নামিয়ে রাখল সে।
নিজের
ঘরে এসে মনে মনে একটা গান ধরল মালতী। মনের গান ঠোঁটের কোনে আসতে বেশি সময় নিল না।
বেশ ফুর্তি তার মনে।
সকাল সকাল রায় বাড়িতে উপস্থিত হল মালতী। কলিঙ বেলের আওয়াজ বিলীন হওয়ার আগেই দরজা খুলে দাঁড়ালো এক মাঝবয়সী ছেলে। এক নজরে বাড়ির ভিতরে চোখ বুলিয়ে নিল মালতী। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই বাড়ির ভিতরের জরাজীর্ণ অবস্থাটা। ছেলেটার চেহারাটাও বাড়ির অবস্থার সাথে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। একঝটকায় দেখে অপুষ্টির শিকার মনে হতে পারে। তবে গলাখানা বেশ ভারী। ভিতরে আসুন।
ছেলেটির পিছন পিছন বাড়িতে ঢুকল মালতী। পুরানো আমলের বেশ বড় বাড়ি। যত্নের অভাবে এদিক ওদিক ভেঙে খসে পরার চিহ্ন বিদ্যমান। নিচ আর ওপর মিলিয়ে ছয়খানা ঘর তো হবেই। বেশ বড় বারান্দা। তবে কাকলি ঠিকই বলেছিল, আলো বাতাস বড় কম। একটু যেন চুপচাপ আর নিরিবিলি। আসলে এদিকের অনেক গুলোই পুরানো বাড়িতে লোক থাকে না, সব ফ্ল্যাট হবে তাই হয়তো... মনে মনে ভাবছিলো মালতী, হুঁশ ফিরল ছেলেটির ডাকে।
- “আসুন ওপরে মায়ের ঘরে চলুন।“ বেশ খাড়াই আর অন্ধকার সিঁড়ি। দু’তলায় তিনটি ঘরের প্রথমটায় এক প্রকান্ড খাটে শুয়ে আছেন এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা মহিলা। চেহারা বেশ ভারী। বয়সের তুলনায় একটু বেশি বুড়িয়ে গেছে মনে হয়। তবে এককালে বেশ রূপসী ছিলেন বোঝাই যায়। খাটের পাশের টেবিলে বেশ কয়েকটা ওষুধ এর শিশি, জল ইত্যাদি। বৃদ্ধার ছেলে ইশারায় দেয়ালে একটা ছবির দিকে ইঙ্গিত করলেন। তাকিয়ে বেশ আশ্চর্য হোলো মালতী। ছবির ছেলে আর মা কে আজ বাস্তবের সাথে মেলানো যাচ্ছে না।
- “বুঝতেই পারছি অনেক প্রশ্ন আপনার মনে। সব বলছি আগে বলুন কাজটা করবেন তো ?” সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ল মালতী।
- “বেশ তবে শুনুন। মা এক বিরল রোগে আক্রান্ত। মা এর বয়স তেষট্টি বছর কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন বয়সের তুলনায় কেমন যেন বেশি বুড়িয়ে গেছেন। আসলে অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কিছু হয় নি। আসতে আসতে দেখা, শোনার, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছেন। হাঁটা চলার শক্তি তো অনেক আগেই গেছে। কথা বলার চেষ্টা করলেও কিছু এলোমেলো কথা বলেন। সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। ওষুধ আর খাবার সময় মত খাওয়াতে হয়। তাই আপনার কাজ হল মাকে সারাদিন চোখে চোখে রাখা। তবে দিনেই। রাতে নয় কিন্তু।“
- “রাতে নয় কেন ?” জানতে চাইলো মালতী।
- “আসলে রাতে মা ভয়ে মাঝে মাঝে চিৎকার করে ওঠে, এলোমেলো কথা বলে আর গোঙাতে থাকে।“
- “কিসের ভয়?”
- “এটাও রোগেরই অঙ্গ। আপনার ভয়ের কোনো কারন নেই। আগের কাজের লোক সবাই এই কারণেই কাজ ছেড়েছে। তাই বলছি যে, রাতে দোতলায় আসার প্রয়োজন নেই। সন্ধ্যে বেলায় খাইয়ে নিচে নেমে যাবেন আর আপনার ঘরেই থাকবেন। রাতে মায়ের সেবার কোনো কাজ রাখবেন না।“
মনে একাধিক খটকা নিয়েই ঘাড় নাড়লো মালতী। কিন্তু রাতেই যে মালতীর আসল কাজ থাকে! ছেলেটি সমস্ত বাড়ি ভালো করে দেখিয়ে দিল মালতীকে। “বিকালে আমি বেরিয়ে যাবো, সবই আপনাকে দেখিয়ে দিলাম। নিজের সুবিধা মত মানিয়ে নেবেন।“
বিকালে ছেলেটি বেরিয়ে গেলে মালতীর মনে এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূত হল। এত বড় বাড়িতে সে এখন একা। স্বাধীন। যা ইচ্ছা করতে পারে। তবে ইচ্ছাটা তার রাতেই দেখা দেয়। ভাগ্যিস দিনের বেলাটা সে আর পাঁচ জনের মতই থাকে ! না হলে যে কি হত। অনেক কথা ভিড় করে আসে মালতীর মনে। হাজার হোক বাইরে থেকে হলেও সে তো একজন মানুষ। বিধাতা যেমন সৃষ্টির সময় ছেলেদের দেহে মেয়ের মন আর মেয়েদের দেহে ছেলের মন পুরে দিয়ে থাকেন তেমন কিছু মানুষের দেহে পশুর হিংস্রতা, ক্ষুদা, তৃষ্ণা ও পুরে দিয়ে থাকেন। মালতীর মা বাবা বহু বছর নিঃসন্তান থাকার পর এক বেদেনীর থেকে দত্তক নেন মালতীকে। ফুটফুটে নিষ্পাপ মুখের পিছনে যে আদিম অন্ধকারের ভয়াবহতা লুকিয়ে আছে তা তারা দেখতে পান নি। ছোট থেকেই তার ঘ্রাণ আর শ্রবণ শক্তি বেশ প্রবল। একটু একটু করে বড় হয়েছে সে আর পাল্লা দিয়ে শক্তির সাথে তার খিদে, তেষ্টাও বেড়েছে। মা বাবারও বুঝতে দেরী হয় নি। মুখের ভিতরের লুকোনো দুটো তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁত অবলীলায় শরীর ভেদ করে সিরিঞ্জের মত রক্ত তুলে নেয়। প্রথম প্রথম রাস্তার কুকুর, বিড়াল দিয়ে কাজ চলে যেতো মালতীর। কিন্তু বেশিদিন তা দিয়ে কাজ চলে নি। পাশের বাড়ির ছোট্ট ছেলেটার রক্ত শূন্য লাশ যেদিন খালের ধারে পাওয়া গেছিল সেদিনই মালতীর মা বুঝে গেছিল মেয়ে বড় হচ্ছে। নিজের রক্ত দিয়ে মেয়েকে ঠান্ডা রাখতে রাখতে নিজেই ঠান্ডা ঘরে পৌঁছে গেছিল সে। মৃত্যুর কারন অবশ্য কেউ বুঝতে পারেনি। ঘাড়ের কাছে দুটো দাঁতের দাগ দেখে ডাক্তার আশ্চর্য হয়েছিল বটে তবে তাতে কিছু অসুবিধা হয়নি তার। মালতীর কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু পশুদের ওসব মানায় না। তাছাড়া যত সে মানুষের সাথে মিশেছে তত তার পশুদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে। মা মরতেই বাপটা আস্তে আস্তে বেঁকে বসতে শুরু করেছিল। অশান্তি লেগেই থাকত দুজনের। মালতীর হাতের চা তার খুব পছন্দের ছিল। তাই গত রাতে রক্তশূন্য তার বাবার লাশটার সামনে শেষবারের মতো চায়ের পেয়ালাটা রেখে এসেছে সে। লাশের গন্ধ বেরোলেই কাল পরশুর মধ্যেই পুলিশ তার খোঁজ শুরু করবে। তাই বেশী দেরী করবে না সে। আজ রাতেই এবাড়ির কাজ মিটিয়ে ভোর ভোর সে কেটে পরবে এই শহর থেকে। তারপর অন্য কোনো জায়গায় অন্য কোনো নামে জীবন শুরু করবে। এই তৃষ্ণা মেটাতে গেলে ভবঘুরে জীবনই ভালো। তাছাড়া পশুরাও তো শিকারের সন্ধানে জঙ্গল ত্যাগ করে নতুন জঙ্গলে আস্তানা গাড়ে।
পাশের বাড়ির সন্ধ্যার শাঁখের আওয়াজে হুঁশ ফিরলো তার। বৃদ্ধাকে খাওয়াতে হবে। তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে গিয়ে এক বাটি গরম ওটস বানালো সে। জলের বোতল আর ওটের বাটি নিয়ে ওপরে উঠলো। সিঁড়িতে কোনো জোড়ালো আলো নেই। বেশ গা ছমছমে ভাব। মনে মনে ভাবলো মালতী, এই বুঝি বুড়ির শেষ খাবার। বেশ মজা লাগল ভেবে। আধভেজানো দরজা খুলেই শরীরটা কেঁপে উঠলো ওর। খাটের কোণে একটা লম্বা কালো ছায়া যেন হঠাৎ দেয়ালে মিলিয়ে গেল। সিঁড়ির আলো আঁধারিতে চোখের ভুল ভাবলো সে।
- “গিন্নিমা খেয়ে নিন। রাতে তো আবার ওঠা যাবে না।“ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধা। তবে ওর দিকে নয় খাটের কোণে। কি যেন অস্বস্তি হল মালতীর। তাড়াতাড়ি করে বৃদ্ধার মুখটা তুলে নিয়ে বেশ যত্ন করেই ওট খাইয়ে দিল সে। জলের বোতলটা ভরে দিয়ে ওষুধগুলো একে একে দিয়ে দিল। বৃদ্ধা মালতীর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মালতীও কিছুক্ষন যেন স্থির হয়ে গেছিল। ঘড়ির কাঁটা তখন সবে সাতটার ঘরে মাথা ঠুকছে। পাশের কোনো বাড়ি থেকে বাংলা সিরিয়ালের আবহ সংগীত ভেসে আসছে। মশারি খাটিয়ে সব গোছ গাছ করে দরজা দিল মালতী। তবে বেশি চেপে দিল না কারন রাতে তো তাকেই খুলতে হবে আবার। পাশের ঘরগুলো একনজর দেখে নিচে নেমে এল সে।
রাতে তার অনেক কাজ। শরীরের অসীম তৃষ্ণা মেটানোর পর পাশের ঘরগুলো দেখতে হবে। পুরানো অবস্থাপন্ন বাড়ি তাই গয়নাগাঁটি থাকবে নিশ্চয়ই। নতুন জায়গায় নতুন করে শুরু করতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। তার কাছে যা আছে বেশিদিন তাতে চলবে না। পাশের ঘরে একটা পুরানো তালা ঝুলছে। ওটা ভাঙতে বেশি বেগ পেতে হবে না। একটু চোখ বুজে আরাম করে নিল মালতী। যেদিন যেদিন রাতে শিকারে যায় সন্ধ্যেটা এই ভাবেই আরাম করে নেয় সে। এতে শরীর চনমনে থাকে তার। রাত এগারোটা নাগাদ ছটফটানি শুরু হল মালতীর। তেষ্টায় তার গলা ফেটে যাচ্ছে তবে এ তেষ্টা জলে তার মেটে না। রক্তের গন্ধ তাকে পাগল করে তোলে। বৃদ্ধাকে কাবু করতে তাকে বেশি বেগ পেতে হবে না এটাই যা রেহাই। এলোমেলো হয়ে থাকা চুল বেঁধে নেয় সে। সিঁড়ির কাছে আসতেই ওপরের ঘর থেকে একটা ছটফটানির আওয়াজ পায় সে। কেউ যেন গোঙাচ্ছে। কাকলি তাহলে ঠিক বলেছিল। কিছু আছে এখানে। তালা ভাঙার জন্য আনা হাতুড়িটা চেপে ধরে সে। চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে এখন। ভয়ের চেয়ে কৌতূহল হয় বেশি। মালতী ভয় পায় না। অনেকের চোখেই ও ভয় দেখেছে যখন ওর ধারালো দাঁত তার শরীর ভেদ করেছে। কিন্তু ও নিজে কোনোদিন ভয়ের সামনে দাঁড়ায়নি। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দরজা আস্তে আস্তে খুললো সে। আবার চমকে উঠলো মালতী।
“চিঠিটা আপনি যখন পেয়েছেন তখন নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটে গেছে। এতে লেখা প্রতিটা কথা সত্যি এবং বাস্তব। বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার। আমার মা বাসন্তী দেবী যখন এ বাড়িতে বিয়ে করে আসেন তখন জানতেন না আমার বাবা আদিত্য নারায়ণ একজন লম্পট ও মাতাল। জুয়া খেলে সর্বশান্ত। মায়ের গয়না একে একে বেঁচে সংসারের খরচ আর বাবার নেশা চলতে থাকে। একমাত্র ঠাকুমা চৈতালি দেবী ছিলেন মায়ের সহায়। সাহস দিতেন মাকে। একদিন মাকে ডেকে উনি বললেন বৌমা যত কষ্টই হোক খোকাকে ওই কোণের ঘরের সিন্দুক খুলতে দিও না। মা জানতে চাইলে ঠাকুমা জানালেন এই বংশের এক ভয়ানক অভিশাপের কথা। আমার বাবার পূর্ব পুরুষ সাত পুরুষের জমিদার ছিলেন। একবার একটা জমি দখল করতে গিয়ে এক ভয়ানক কাপালিকের আস্তানা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন তিনি। কাপালিকের আস্তানায় এক লোহার সিন্দুক ছিল। সেটাও নিয়ে আসেন। কাপালিক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ছিলেন। তিনি অভিশাপ দেন আমাদের বংশের সর্বনাশ হবে। ওই সিন্দুকে নাকি তার বশ করা চণ্ডাল আছে। সে মুক্ত হলেই দেখা দেবে ঘোর বিপদ। তিলে তিলে মারা যাবে সবাই তার হাতে। সে ছায়ার মতো এবাড়িতেই থাকবে। আমরা রোগগ্রস্ত হয়ে মৃত্যু ভিক্ষা করবো। সে রোজ রাতে একটু একটু করে আমাদের আত্মা থেকে শক্তি শুষে নেবে। বাড়ি থেকে পালিয়েও লাভ হবে না। সন্তান জন্মালেও সে হবে হয় পশু না হয় দুর্বল - জড়াগ্রস্থ মানুষ। মায়ের হাজার বারণ সত্ত্বেও বাবা একপ্রকার জোর করেই সেই সিন্দুক খোলেন। আর তারপর থেকেই শুরু আমাদের অভিশপ্ত জীবনের। বাড়িতে একটা লম্বা কালো ছায়া ঘুরতে থাকে রাতের বেলায়। পুজো, উপাচারে কোনো কাজ হয় নি। একদিন রাতে ঠাকুমা বাড়ির ছাদ থেকে পরে মারা যান। মায়ের প্রথম সন্তান আমি। আমি জন্ম থেকেই দুর্বল। ভারী কাজে অক্ষম। আমার জন্মের চার বছর পর আমার এক বোন পৃথিবীতে আসে। স্তন্যপান করাতে গিয়ে মা বুঝতে পারেন যে সে কোনো স্বাভাবিক মানুষ নয়। মুখের ভিতরে লুকানো দুটো পাশবিক দাঁত ছিল তার। পরে মা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে এক সাপের খেলা দেখাতে আসা বেদেনীকে কিছু টাকা দিয়ে বোনকে পালন করতে দেন। তার আশা ছিল এই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যদি ভালো থাকতে পারে সে। বাবা অজানা রোগে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে যান। রোজ রাতে ছটফট করতেন। চিৎকার করতেন। পরে মারা যান। আমি যতটা পেরেছি এই বাড়ি থেকে দূরে থেকেছি এত বছর, কিন্তু মায়ের টানে ফিরে আসি। তবে মায়ের এই কষ্ট আর চোখে দেখা যায় না। বুঝে গেছি মা আর কয়েক দিনের অতিথি। আমার খোঁজ করা বৃথা। আমার ভবিষ্যত আমি জানি। আমি আর ফিরতে চাই না। কাজের মেয়েটিকে দোষ দেবেন না। ও নির্দোষ, এসবের কিছুই জানে না। - ইতি হতভাগ্য সন্তান।“
চোখের
জলে চিঠির কাগজটা অনেকটাই ভিজে গেছে। পশুরাও কাঁদে ? যন্ত্রনায় মালতীর বুক ফেটে যাচ্ছে। গলার কাছে একরাশ কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে আছে।
যে রক্তের স্বাদ তার এত প্রিয়, তার গন্ধই আজ গা গুলিয়ে দিচ্ছে মালতীর। হঠাৎ ঘরের
আলোটা দপদপ করে উঠল। ঘরের কোণটায় নজর গেল ওর। একটা পুরানো
মরচে ধরা লোহার সিন্দুক রয়েছে আর তার ওপরেই এক ভীষণ কালো অবয়ব উবু হয়ে বসে তার
দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। চিনতে পেরেছে তাহলে। মালতী কালবিলম্ব না করেই ঘর থেকে ছুটে
বেরিয়ে আসে কিন্তু সিঁড়ির মুখে তখন সেই কালো ছায়া দাড়িয়ে রয়েছে। পিছনের দিকে ছাদে
ওঠার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে সে। চারিদিকে তখন রাত্রীর নীরবতা। আকাশে কালো মেঘের
চাদরে তারারা গা ঢাকা দিয়েছে। আলকাতরা মাখানো কালো অন্ধকারের মধ্যে তখন ছাদের
একপ্রান্তে আর একটা কালো ছায়া মালতীর দিকে একটু একটু করে এগোচ্ছে। প্রতিহিংসার
আগুনে তার চোখগুলো জ্বলছে। মালতী এখন ছাদের একবারে ধারে। একটু একটু করে যত
পিছোচ্ছে সে ততই এগোচ্ছে মৃত্যুর দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো সে নিজের
সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে চাইলো। কিন্তু তিনিও যেন আজ আত্মগোপন
করেছেন এই অন্ধকারের অন্তরালে। ধপ করে একটা আওয়াজ হল রাত্রীর নীরবতা ভেদ করে।
নিচে রাস্তায় মালতীর দেহটা যেখানে পরে রয়েছে আজ থেকে বহু বছর আগে আদিত্য নারায়ণের মা চৈতালি দেবীর দেহটাও সেখানেই পরে ছিল। কুকুরগুলো প্রথমটায় প্রচুর চিৎকার করলেও এখন অনেকটা চুপ করে গেছে। স্বজন হারানোর জ্বালায় বোধহয়। ছাদের ওপর তখনও একটা কালো ছায়া পায়চারী করছে। মালতীর তৃষ্ণা মিটেছে চিরতরে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন