সুবিনয়ের চাকরিটা নেই। তবু মুখ ফুটে মহুয়া কে কিছু
বলতে পারেনি। ও ভয় পেয়ে যাবে। প্রায় তিন মাস লক-ডাউনের পর সুবিনয় যেদিন
কারখানায় গেল, ম্যানেজার বাবু ডেকে বললেন, “ দ্যাখো…, এই মুহূর্তে আমাদের হাতে কোনো অর্ডার নেই। ইউরোপ, আমেরিকা সব শুয়ে পড়েছে।
আবার কারখানা খুললে তোমাদের জানানো হবে। এখন এই টাকা ক’টা রাখো।”
উত্তর দেবার জন্য মাথা যেটুকু কাজ করতে লাগে, কিছুক্ষণের জন্য সেটুকু
বুদ্ধিও লোপ পেয়ে গেল। সংবিৎ ফিরতেই দেখল, ম্যানেজার বাবু নিজের চেম্বারে ঢুকে গেছেন। তিনমাস পর
হাতে দেড় মাসের মাইনে। পা দুটো খুব ভারী লাগছে সুবিনয়ের। মাথা নীচু করে কারখানার
বড় গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। প্রতিদিনের মত দারোয়ান প্রণাম করল। শববাহী যান দেখলে, লোকে যেরকম করে, সুবিনয়ের সেরকম মনে হল।
চোখ জলে ভরে উঠেছে। কিন্তু আতঙ্কে, তা চিবুকের দিকে গড়াবার সাহস পাচ্ছে না। ঝাপসা চোখে
রাস্তাটা ঢেউ খেলছে। কুড়ি বছরের চাকরিটা, কুড়ি সেকেন্ডে শেষ!
খুব বড় চামড়ার ব্যাগের কারখানা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাগ যায়। স্টোরে কাজ করতো সুবিনয়। মাইনে খুব ভালো না হলেও, মহুয়া আর এক মেয়ে মলিকে নিয়ে মোটামুটি চলে যেত। বাবার করা মাথা গোঁজাটা আছে। এই চাকরি করেই, মেয়েকে কলেজ পার করেছে। খাওয়া-পরা ছাড়া আর বেশি কিছু সুখ দিতে পারেনি মহুয়া কে। মহুয়া মুখে কোনদিন কিছু না বললেও, সুবিনয় বোঝে, স্ত্রী হিসাবে আরও কিছু দাবী থাকে মেয়েদের। কিন্তু এখন তো আকাশটা ক্রমশ গভীর অন্ধকার হয়ে নীচে নেমে আসছে, আর মাটিটা অল্প অল্প দুলছে আর সরে যাচ্ছে। যে ক’টা টাকা পকেটে রয়েছে, পাড়ার মুদিখানায় ধার শোধ করতেই সব শেষ। তবু বাড়িতে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবেনা। জীবনে বড় আনন্দ কোনদিন দিতে পারে নি। শুধুই পরিবেশ আতঙ্কিত করে কোনও লাভ নেই।
বড়ি ফিরে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকল। মেয়েদের মন, ছেলেদের মুখের ভাষা পড়তে
পারে। মহুয়া জিগেস করল, “অফিসে সব ঠিক আছে? মাইনে-কড়ি কিছু দিয়েছে।”
- “অফিসই তো যাইনি তিনমাস। কিছু পেয়েছি। মুদিখানায় সব শোধ করে দিয়েছি।”
- “ঠাকুর, ঠাকুর, করে সব ঠিক হয়ে গেলেই
ভালো হয়।”
সুবিনয় কোনো উত্তর করল না। টিভিটা চালিয়ে, কথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে
দিল।
পরদিন সকালে যথারীতি একই সময়ে অফিসে বেরল। তবে
অজানার উদ্দেশ্যে। বাড়ি থেকে একটু দূরে এয়ায়পোর্টের মাঠে গিয়ে বসল। বসে বসে
ঘাস ছিঁড়ছে, আর আকাশ-পাতাল ভাবছে। সহকর্মীদের দু’চারটে ফোন করল। সবারই ঐ একই অবস্থা।
রফিকুল বলে একটা ছেলে ছিল, ব্যাগের কারিগর। বেশ করিতকর্মা। অবশেষে রফিকুলকে একটা ফোন করল সুবিনয়।
- “রফিকুল
ভাই, সুবিনয়দা
বলছি।”
- “বোলেন
দাদা, কী খবর
আছে? কেমোন
আছেন?”
- “আর
কিরকম থাকব? পুরো বেকার। একটা, যে কোন কাজ যোগাড় করতে হবে। তুমি কী করছ ভাই?”
- “আমি তো
বাস লাইনে ঢুকে গেছি দাদা, কন্ডাকটারি করছি। এতদিন বাস বন্ধ ছিল। অনেক বিহারী দেশে চলে গেছে। ওরা কবে
আসবে কে জানে? এ লাইনটা এখনও ফাঁকা আছে।”
- “আমরা
একাজ করতে পারব?”
- “যদি
রাজি থাকেন তো, আমাদের রুটে খালি আছে। আমি ইউনিয়ন কে বলে ঢুকিয়ে দেব।”
- “ধন্যবাদ
ভাই। আমি তোমাকে কাল জানাব।”
জগতে কোনো কাজই ছোট নয়। সৎপথে যে কোনো উপার্জনই
সম্মানের। তবু সুবিনয়ের মনে পড়ছে, অফিসটাইমে দেরি হয়ে গেলে, কত গালিগালাজ করেছে এই
কন্ডাকটারকে। কিন্তু তারা কোন উত্তর করে নি। অনেকরকম চামড়া চেনে সুবিনয়। নিজের
গায়ে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কতটা মোটা এই চামড়াটা। কাজটা করতে পারবে কি? তবুও দোটানার মধ্যেই
রফিকুলকে ‘হ্যাঁ’ বলে দিল। ‘এয়ারপোর্ট-বাবুঘাট’ রুটে কন্ডাকটার হয়ে গেল সুবিনয়।
তবে করোনায়, শাপে বর হয়েছে। মুখটা ভালো করে ঢেকে নেওয়া যায়, যাতে কেউ সহজে চিনতে না
পারে। মাঝেমাঝে বাবুঘাটে গঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়ালে, ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।
পুরোনো ভাড়া বাড়ির জানলার রড্ ধরে ‘বাস-বাস’ খেলতে খুব ভালো লাগতো। আর এখন
ভাগ্যের কী পরিহাস!
তবে মহুয়ার চোখ এড়ানো মুশকিল। ও আজকাল কিছু একটা
সন্দেহ করে। এত ভোরবেলা বেরিয়ে, এত রাত করে ফেরে। সুবিনয় অফিসে, কাজের চাপের অজুহাত দেয়।
মাইনে আর কমিশন নিয়ে আগের মাইনের থেকে কম হলেও, 'নেই মামার থেকে তো কানা
মামা ভালো'। লকডাউনের দিনগুলো ছাড়া কোনো ছুটি নেই। ছুটির দিন
বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না সুবিনয়।
মহুয়া কাছে এসে প্রশ্ন করে, “তোমার চেহারা এরকম হয়ে
যাচ্ছে কেন? আমাকে সত্যি করে বলতো, কী কাজ করছ তুমি?”
সুবিনয় হেসে বলে, “আরে… কারখানা এতদিন বন্ধ ছিল, সেইসব কাজ জমে আছে না? এখন খুব খাটুনি।”
- “তোমাকে একটা কথা বলবো, ভেবেও, আর বলা হয়ে ওঠেনি, জানো, মলি প্রেম করছে। আমি বলেছি, ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসতে। যদি দেখি ভালো, তাহলে ওর বাড়ির লোকের সাথে কথা বলে, বিয়েটা দিয়ে দেব।”
- “তোমার কী মাথা খারাপ! এই পরিস্থিতিতে তুমি মেয়ের বিয়ে দেবে?”
- “এখনই তো
সঠিক সময়। যেটুকু সোনাদানা ঘরে আছে, আর কিছু কাপড়জামা, আসবাবপত্র কিনে এখন
বিয়েটা দিয়ে দেব। দু-তিনশ লোক খাওয়ানোর ট্যাঁকের জোর আছে তোমার? এখন অল্পের ওপর দিয়ে হয়ে
যাবে। ”
সুবিনয় ভাবে এই হল নারীবুদ্ধি। না হলে দুটো
মহাকাব্যে, দুটো
যুদ্ধই শুধু নারীর জন্য হয়। এক ‘করোনা’ মানুষকে কত শিক্ষাই না দিচ্ছে!
প্রায় একমাস হয়ে গেল সুবিনয়ের নতুন কাজ। অন্যান্য
বাসের ড্রাইভার, কন্ডাকটাররা, এখন ওর সহকর্মী আর বন্ধু। মাঝেমধ্যে একদিন, রাত্রিবেলা পাল্লায় পড়ে নেশা করে ফেরে। একটা ছোট্ট
জীবাণু জীবিকার সন্ধানে মানুষকে নিজের জায়গা থেকে অনেক নীচে নামিয়ে দিচ্ছে। একটু
বাঁচার জন্য এই অবনমন। মহুয়া এখন বলে, “তুমি আগেও দুর্গাপুজো, কালীপুজো, দোলে মদ খেতে, কিন্তু এত উৎকট গন্ধ ছিল
না তাতে।”
সুবিনয়ের কোনো উত্তর নেই। কী বলবে! ওটা বেসরকারী কাজ
হলেও একটা চাকরি ছিল। আর এটা পেটের দায়ে মেনে নেওয়া। সবই কাজ, তবে স্তর আলাদা। তবে এখন ও
একা নয়। হাজার, হাজার মানুষ, মানিয়ে নিচ্ছে পরিবর্তিত জীবিকার সাথে। নিজের সাথে নিজের লড়াই।
এইতো সেদিন একটা ছেলের সাথে আলাপ হল সুবিনয়ের। বছর
সাতাশ-আটাশ হবে। দেখতে বেশ সুন্দর। দেখে মনে হয় ভালো ঘরের ছেলে। নিউটাউনের একটা
আই. টি. অফিসে চাকরি করতো। এপ্রিল মাসে ‘লে অফ্' হয়ে গেছে। মোদ্দা কথা, ছাঁটাই। এখন আমলকি, জোয়ানের শিশি বিক্রি করে।
আগে ট্রেনে এটা অনেক লোকের রুটিরুজি ছিল। ট্রেন বন্ধ ছিল যখন, তারাও কোথায় হারিয়ে
গেছে। তাই অনেকে এখন বাসেই এই কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেই সূত্রেই ছেলেটির সাথে
আলাপ। বেচার আগে, ওরা একটা লেকচার দেয়। এই ছেলেটির বক্তব্য পেশ করার ধরণ, সুবিনয়কে আকর্ষিত করেছিল।
শুনলে বোঝা যায়, পেটে বিদ্যে আছে। তাই দেখা হলে, মাঝেমধ্যে গল্প করে সুবিনয়। বোধহয় সমব্যাথী বলে।
সুখ-দুঃখের গল্প হয়। আর উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে বাসের পিছনের লেখাটার দিকে। ‘চেষ্টা করো, তোমারও হবে'। কিন্তু কবে হবে? কিভাবে হবে?
সংসারে আয়ের জোর না থাকলে, গায়ের জোরে সংসারের মাথা
হওয়া যায় না। মলির দুই মামাই সরকারি চাকরি করে। একজন কর্পোরেশনে আর একজন
ব্যাংকে। আপদে-বিপদে ছোট বোনের পাশে দাঁড়ায়। আর সুযোগ পেলে সুবিনয়কে জ্ঞান
দেয়। মহুয়াও ওদের অভিভাবকের মর্যাদা দেয়। সংসারের সব সিদ্ধান্তই দাদাদের সাথে
আলোচনা করে নেয়। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। মলির বিয়ের কথা দাদাদের সঙ্গেই
চলতে লাগল। যেটুকু খেতে বসে বলে, রাতে ক্লান্ত শরীরে, সুবিনয়ের মাথায় কিছু
ঢোকে না। সারকথা যেটা শুনে নিয়েছে, ছেলেটি চাকরি-বাকরি ভালো করে, মলি সব খবর জেনে নিয়েছে, আর দেখতে-শুনতেও বেশ ভালো।
মলির যখন খুব পছন্দ, সেক্ষেত্রে মতামত প্রকাশ করাটাই অবান্তর। কারণ, এ ছেলে ছাড়া, মলি কাউকে বিয়ে করবে না।
হঠাৎ একদিন, মহুয়া বলল, “এই রোববার রূপক আসবে। তুমি থাকতে পারবে?”
- “কে… রূপক?”
- “আরে
লোকটা কিছু বোঝেও না ছাই! মলির যার সাথে বিয়ের কথা চলছে।”
- “আরে আমি
কী করে বুঝব? রূপক কি জগতে একটা আছে নাকি?”
সত্যিই আজকাল আর সুবিনয়ের মাথা কাজ করে না। গেটে
দাঁড়িয়ে চিৎকার। আর পাবলিকের গালাগাল। হাজার লোকের নানারকম পাগলামি। যে যা পারছে, মন্তব্য করে নেমে যাচ্ছে।
তার মধ্যে কিছু লোকের টিকিট মারার ধান্দা। এই ভোঁতা কাজ করতে করতে মাথা ঘেঁটে, মোটা হয়ে যাওয়াই
স্বাভাবিক। এইসব ভাবতে ভাবতেই সুবিনয়ের মনে পড়ল, সেই বাসে জোয়ান বেচা
ছেলেটার কথা। দু’টো মনের কথা বলে হালকা হওয়া যেত। অনেকদিন ছেলেটার সাথে দেখা হয়
না। বোধহয় অন্যরুটে কাজ করছে। তবে ছেলেটার জোয়ান, আমলকি, বেশ ভালো ছিল। এমনিতে তো
দুপুরে হোটেলে খেয়ে, পেটের বারোটা একমাসেই বেজে গেছে। ও জোয়ান খাওয়াতো, ভালোই লাগত। আর একটা জিনিস
ওর কাছে ছিল, 'আনার দানা'। ভারি সুন্দর মুখসুদ্ধি।
মহুয়া আবার খোঁচাল, “দাদারা আসবে, তুমি একদিন তাড়াতাড়ি ফেরো না গো। ছেলেটাকে দেখতে পাবে।”
- “দাদারা
আছে তো। আমাকে তাহলে কামাই করতে হয়। এখন তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে না।”
লাফিয়ে উঠে, মাথায় এক বালতি জল ঢেলে, এক কাপ চা খেয়েই দৌড়ে
বেরিয়ে গেল সুবিনয়। এতক্ষণের যাবতীয় কথাবার্তা সব মাথা থেকে বেরিয়ে গেল।
ঘন্টার দড়িতে একবার হাত দিয়ে, ‘বাবুঘাট’ বলে চিৎকার শুরু করলেই, জীবনের বাকি সব ঘন্টাধ্বনি
মন থেকে হারিয়ে যায়। প্রতিটা মানুষ, তখন শুধু একটা দশ টাকার টিকিট। যত উঠবে, তত কমিশন। পতঙ্গের
পুঞ্জাক্ষির মত চোখ শুধু ঘুরতে থাকে। কখনও বাসের পাদানির দিকে, বা রাস্তার প্যাসেঞ্জারের
দিকে, অথবা
প্রতিযোগী অন্য কোনও বাসের দিকে। তখন বাকি বহির্বিশ্ব অর্থহীন। আঙুলের ফাঁকে
হাতপাখার মত ধরা টাকার পেখম, মুঠোয় ধরা টিকিট, আর চোখেমুখে সজাগ দৃষ্টি। এখন অনেক পরিণত কন্ডাকটার
সুবিনয়। সেখানে আবেগের কোন স্থান নেই।
সুবিনয়ের মাথা থেকে সব বেরিয়ে গেছে এই ক'দিনে। রবিবার রাত্তিরে
ফেরার পর মহুয়া শুরু করল রূপকের গল্প। ওকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে মহুয়ার। খুব ভালো
ছেলে। কথা আর শেষ হচ্ছে না ওর। এদিন ভাল-মন্দ রান্না হয়েছে। রূপক রাতের খাবার
খেয়ে গেছে। মহুয়া আনন্দ করে একটা আমলকির শিশি দেখাল। খুব সুন্দর খেতে নাকি ওটা।
রূপকের মা'ও রোজ
খায়। মহুয়াকেও একটা দিয়েছে। সুবিনয়ের কিছু খেতে ভালো লাগছে না। কারণ শিশির
গায়ের লেভেলটা বড্ড চেনা সুবিনয়ের। ‘ধন্বন্তরি আয়ুর্বেদিক, রানাঘাট'। মহুয়া হাতে কয়েকটা আমলকি দিল। খাবার প্রায় কিছুই খায়নি সুবিনয়। তবুও
মহুয়ার কথাগুলো কিছুতেই হজম হচ্ছে না সেই রাতে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন