আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা ইচ্ছেবুড়ি থাকে। সে
নিজের মনে সুতো কাটে;
সুতো
দিয়ে বুনে আমাদের মস্তিষ্কটা ভর্তি করে
রাখে। আবার একটা সুতো ছিঁড়ে গেলে কি মজাদার ভাবে একদম দক্ষ কারীগরের মতো নতুন, রঙিন, চকচকে সুতো
দিয়ে সে জায়গাটা ভরিয়ে দেয়। তাঁর এই কাজ চলে সারাজীবন ধরে, সেই বুড়িটার
কাজ তখনই শেষ হয় যখন মানুষ তাঁর প্রিয় প্রাণপাখিটিকে খাঁচা থেকে মুক্তি দেয়। নতুন
খাঁচায় পাখিটি যাওয়ার আগে অবধি থাকে বুড়ির ছুটি, ছুটির পর
আবার বুড়ির কাজ শুরু হয়ে যায়।
আমার যে কখন কি ইচ্ছে করে আর কি ইচ্ছে করেনা, তা আমি
নিজেই বুঝিনা। একেক সময় নতুন একেক উদ্ভট, বিকট ইচ্ছে কোত্থেকে যে বুড়িটা তৈরী করে আনে, তা আমি
নিজেও বুঝিনা। তবে বুড়িটা মাঝেমাঝে ফাঁকি দেওয়া শুরু করেছে, কারণ আমার
মনটা মাঝেমাঝে ধু ধু করে ওঠে ইচ্ছেসূতোর অভাবে। আবার বুড়ি কাজে ভেজালও দিচ্ছে এমন
ভাবে যে,
মাঝেমাঝে
পুরোনো আমি,
আমার
ইচ্ছেগুলো যেন আগোছালো ভাবে জেগে ওঠে।
এমন সময় বাইরে কিসের একটা আওয়াজ। আমি দৌড়ে বাইরে
যেতেই দেখি এক বুড়ি তাঁর মালপত্র নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। বুড়ির পড়নে সাদা থান, গাল দুটো
তোবড়ানো,
মাথার
চুল সবই সাদা,
বয়সের
যেন গাছ-পাথর নেই আর মালপত্র বলতে একটা ঝুড়ি আর একটা পুঁটলি। আমি বুড়ির
মালপত্রগুলো তুলে দিলাম। বুড়িও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বুড়ী বলে উঠলো, “আর পারিনে, এই বয়সে কি
এতোও খাটুনি সহ্য হয়?
এই
চব্বিশ ঘণ্টার বেগার খাটা আর ভালো লাগেনা।”
- “চব্বিশ
ঘণ্টা কেন?
তোমার
কি ছুটি হয়না?”
- “না গো, দিদিমণি।
তবে মনিব ঘুমোলে পড়ে মাঝেমধ্যে ফাঁকি দিয়ে এদিক-ওদিক থেকে ঘুরে আসি। এই দেখো না, আজই তো
মনিবের চোখটা এট্টু লেগে গেল, তাই ভাবলাম ছেলেপুলেকে একটু দেখে আসি।”
- “আচ্ছা
বুড়িমা,
তুমি
কি কাজ করো?”
ফোকলা দাঁত বের করে বুড়ি একগাল হেসে বললো, “কাপড় বুনি গো, সুন্দর
চমৎকার কাপড়। সেই ছোটবেলা থেকে মনিবের হুকুম মতো কাপড় বুনে চলেছি। এই দেখো না আমার
ঝুড়িটা,
কতোও
রকমের সুতো।”
- “আচ্ছা, এই কাপড়
বোনার টাকায় তোমার সংসার চলে?”
মুচকি হেসে বুড়ি বলে চলে, “শুধু কাপড়
বুনে কি পেট চলে গো দিদিভাই? চলে না। তাইতো মাঝেসাঝে কাপড়ে ভেজাল দিই, নতুন সুতোর
বদলে পুরনো সুতো দিই জুড়ে। আর জিনিসপত্রের যা দাম, ভেজাল ছাড়া
উপায় কি গো! পেটে খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে তো।”
- “তাহলে এমন
কাজ করো কেন?
ও
কাজ ছেড়ে দিতে পারোনা?”
- “করবো না? এটা তো আমার
অনেক দিনের অভ্যাস গো। হ্যাঁ, মাঝেমাঝে একটু অসুবিধা হয় ঠিকই, যেমন ধরো
সুতো যখন ছেঁড়ে,
তখন
একটু ভালো ভাবে বুঝেসুঝে নতুন সুতো পড়াতে হয়, একটু ভুল
হলেই গোটা কাপড়টাই বাতিল করে দিতে হয়। তবে সব থেকে মুশকিল হয় তখন, যখন মনিব
নিজেই বোঝেন না তাঁর কি দরকার, কেমন কাপড় তাঁর পছন্দ। আচ্ছা দিদিভাই, তুমিই বলো, নিজের মনটা
ঠিক করে বুঝতে পারলে কি এমনতর অসুবিধা হয়?”
ঠিকই তো। নিজের মনটাকে বুঝলেই তো সব কিছু বোঝা
যায়। বুড়ি দেখি মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। ভালোই লাগছিল গল্প
করতে। তাঁকে বললাম,
“ওকি!
এই তো এলে,
এখনই
চললে বুঝি?”
ঈষৎ
ময়লা আঁচলখানী দিয়ে মুখটা আলতো করে মুছে বুড়ি বললে, “দু-দণ্ড বসে
জিরোবো,
তার
কি আর জো আছে গো,
দিদিভাই? মনিবের ঘুম
ভাঙ্গার সময় হয়ে এলো যে। আমায় না দেখলে উনি কুরুক্ষেত্র বাধাবেন’খন। আমি চলি গো।”
- “সময় পেলে
আবার এসো,
বুড়িমা।
ওই দেখো,
ভুলেই
গেছিলাম জিজ্ঞেস করতে। আচ্ছা, তোমার নাম কিগো?”
বুড়ি অদ্ভুত স্নেহাতুর ভাবে হেসে উত্তর দিলো, “আমার নাম
ইচ্ছে গো,
দিদিভাই।
কেন?
আমায়
তুমি চিনতে পারোনি বুঝি?”
হঠাৎ শুনি কে যেন আমায় ডাকছে, “কিরে, অনেক বেলা
হয়েছে তো! ওঠ! স্নান করবি না?” চোখ খুলে দেখি আমি টেবিলের উপর মাথা রেখে
ঘুমোচ্ছিলাম। মাথার তলায় নানান রঙের আঁকিবুঁকি কাটা আমার আঁকার খাতাটি আর তার পাশে
রঙতুলি পড়ে আছে। মা আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে চলে গেলেন।
আচ্ছা, যেটা দেখলাম সেটা কি শুধুই স্বপ্ন? নাকি অন্য কিছু? তবে একটা কথা ঠিক যে, নিজের মনটাকে আগে বুঝতে হয়, জানতে হয়। যাই হোক, ইচ্ছেবুড়ির কারবার বোঝা বড় দায়, মানুষের সারাজীবনটাও বুঝি এর জন্য কম। তাই তো বুঝি সে বারবার এই পৃথিবীর বুকে নতুন নতুন রূপে ফিরে আমায় স্বপ্ন দেখায়। এই পৃথিবীর মনিষীরা মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। কিন্তু মুক্তি কি আদৌ সম্ভব? যিনি মুক্তির জন্য ব্রত পালন করেন, তারও তো ইচ্ছে থাকে, যেন সে সৎভাবে সেই ব্রত পালন করে যেতে পারেন। তাই হয়তো ইচ্ছের শেষ হয়না, ইচ্ছেবুড়ি তাই মুক্তিও পায়না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন