অগ্রহায়ন শেষে পৌষ। ঝিনাই নদীর তীর সংলগ্ন ক্ষেত ফসল শূন্য। অনাদরে সেখানে পড়ে আছে ন্যড়া। শূন্যতা ভরা মাঠে এখন হাহাকার। উত্তরের হাওয়ার সাথে ঝিনাই এর হিমেল হাওয়া গাছের শুকনো পাতা ঝড়ায়। পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে পূব আকাশে। রাত গভীর হয়। কুয়াশায় মিশে থাকে জ্যোৎস্না । অস্পষ্ট ঘোলা ঘোলা সেই জ্যোৎস্নায় ডানা মেলে পেঁচা উড়ে যায়। বাঁশবাগানে বাদুর ডানা ঝাপটায় ।সারা রাত ধরে হিমে ভিজে গাছেরা যেন স্নান করে ওঠে। দীর্ঘ রাত শেষ হয় এক সময়। পাখি ওড়ে। ঝিনাই-এর কাদা জলে গিয়ে শামুক, গুগলি, মাছ খোঁজে। দল বেঁধে শিউলিরা ঝরে যায়। খেজুর গাছ থেকে রস ভরা কলসি নামিয়ে আনে।
সকাল থেকেই আজ সরগরম ঘোষ বাড়ি। পৌষ সংক্রান্তি আসন্ন। দু’ তিনদিন আগে থেকেই তার আমেজ শুরু। কাকভোরে বাড়ির ঢেঁকি শাল গোবর দিয়ে নিকানো হয়েছে। সকাল থেকেই ঢেঁকিতে পাড় পড়ছে। আশেপাশের চার/পাঁচ ঘর থেকে বৌ - ঝিরা এসে অপেক্ষা করছে। কখন তারা ঢেঁকি ফাঁকা পাবে? তাদের হাসাহাসি, কথা বলাবলি – কোনও কিছুতেই মন নেই চাঁপার। ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে সে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চাঁপার শরীরে পৌষের শীতেও ঘাম। মুষলের আঘাতে ঢেঁকির গড়ের ভিতরে চাল ভাঙছে। আর অন্যদিকে চাঁপার মনের মধ্যে ভাঙ্গন। অতীতের স্মৃতির ভাঙ্গন।
এক সময় পৌষ সংক্রান্তিতে তাদের বাড়িতেও পিঠা হত। পৌষের শীতে সে আর তার দাদা মানিক উনুনের পাশে বসে তাপ শুষে নিত। উনুনের পাশে বসলেই মানিক মায়ের বারণ সত্ত্বেও উনুনের গর্তে থাকা খড়ি নাড়াত। ছোট ছোট হলুদ হলুদ আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসত। খুব মজা পেত চাঁপা। মা সরু চাকলি, পাটিসাপটা, ভাপা চিতই পিঠা বানাত আর নিজের ছেলেবেলার মামার বাড়ির গল্প বলত। কত উৎসব হত সেখানে - টুসু পরব, মকর স্নান। পৌষ আগালানো রীতিতে খুব ভোরে আমের সরা দিয়ে ঘট বসিয়ে ধানলক্ষ্মীর পূজা করা হত। তুলসী তলায় আল্পনায় আঁকা হত লক্ষ্মীর চরণ, চাষের যন্ত্রপাতি। এরপর চিরকাল লক্ষ্মীকে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে রাখার জন্য ঘরের আসবাবপত্র, জানালা সবকিছু খড় দিয়ে বেঁধে রাখা হত। কত পিঠা তৈরি হত। কি সব বাহারি নাম ! চন্দ্রপুলি, মোহন বাঁশি, চন্দন পাতা, ক্ষীর মুরলি- আরো কত কি ! মা বলত; চাঁপা শুনত।
জীবন চলছিল নিশ্চিন্তভাবে। অভাবহীন, শঙ্কাহীন উদ্বেগহীন। লাল সুড়কি বিছানো পথে, দুপাশের ফসলের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে সে আর মানিক স্কুলে যেত। সাথে থাকত রতন, মিনু, তনু, সালাম, অতসী। বেলা বাড়লে বাবা যেত মাঠে। বর্গা চাষীদের তদারকি করত। আর মা আসত এই ঘোষ বাড়িতে, রান্না করতে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে সামনের উঠোনে, ওই কদম গাছের নিচে কুমির ডাঙ্গা, কিতকিত, ইচিং বিচিং খেলা। রাতে বাতি চলে গেলে হারিকেনের আলোয় বই নিয়ে বসা। বছরে একবার পূজোর সময় নদী পাড় হয়ে শহরে গিয়ে জামা কেনা। ক্লাস এইটে ওঠার সময় তিন বিষয়ে ফেল করল মানিক। পড়া বাদ দিয়ে দিল। প্রাইমারি স্কুল শেষে চাঁপা উঠে গেল হাই স্কুলে। মাসে নিয়ম করে তিন দিন তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হল। একই সাথে ছেলেদের সাথে খেলাও বন্ধ। হঠাৎই ছন্দপতন। মায়ের বুকে ব্যাথা, জ্বর। সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারের কথামত মাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করা হল। জমি বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করা হল। কিন্তু মা বাঁচল না। এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। একদিকে শোক দুঃখ, অন্যদিকে অভাব। ঘরে চাল বাড়ন্ত। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল চাঁপার। কামলা খাটতে শুরু করল মুকুন্দ। আর মানিক পড়া তো আগেই ছেড়ে দিয়েছিল, এবার সিগারেটের নেশায় পেল তাকে। স্টেশনে, বাজারে চায়ের দোকানে সাতদিন কাজ করে, তো আবার দিন পনের বন্ধ। ঘোষ বাড়িতে কাজ নিল চাঁপা। মা চলে যাবার সময় চাঁপার কৈশোরটাও যেন সাথে করে নিয়ে গেল। এক লহমায় বড় হয়ে গেল সে। বুঝতে পারত তার শরীরের দিকে অকারনে অনেকেই তাকিয়ে থাকে। মা নেই বলেই কি? সে সব চাইনিতে লোভ ছাড়াও আরো কিছু থাকে। কি থাকে সেটা বুঝে ছিল মাস খানেক আগে। সেদিন সন্ধ্যায় ছাদে গিয়ে ছিল জামা কাপড় তুলতে। এবাড়ির ছোট কত্তাবাবু তাকে একলা পেয়ে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে দিয়েছিল। অথচ ঘরে তার লক্ষ্মী প্রতিমার মত বউ। রাগে, ঘেন্নায় শরীর রি রি করে উঠেছিল।
পাশের গ্রাম থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে অলকার জন্য। তার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চোখ, মুখের গঠনও ভাল। আজও সেই নীল রঙের শাড়ীটা পরে ছেলে পক্ষের সামনে বসে ছিল অলকা। মেয়ের স্বপক্ষে দুটো কথা বলতেই ছেলের বাবা বলে উঠল, ‘নিজের মেয়ের প্রশংসা সবাই করে। আর, তাছাড়া-লেখা পড়া দিয়েই বা কি হবে? সংসার করতে তো আর লেখাপড়া লাগে না।‘
চুপ করে গেল বিনয়। ছেলের জ্যাঠার গলার স্বর চড়া হল। পণের কথা শুরু হতেই বুকটা কেঁপে উঠল বিনয়ের। পণের পাল্লা ভারী হয়ে উঠতে লাগল সোনায়, নগদ টাকায়। এসবের সাথে ছেলের শখের একখানা মোটর সাইকেল। বিনয় ক্ষীন স্বরে শুধু একবার বলল, ‘বোঝেনই তো আমাদের অবস্থা, মোটর সাইকেলটা যদি বাদ দেওয়া যায়…।‘
- ‘মেয়ে তাহলে আপনাদের ঘরেই থাকুক। আমরা আজ উঠি তাহলে।‘ উঠেও দাঁড়াল দুই, একজন।
বিনয়ের কাতর কন্ঠে অনুরোধের পর পরিবেশ শান্ত। ছেলেপক্ষের হাসা-হাসিতে ঘর সরগরম হয়ে উঠল। শুধু বিনয়ের নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। ছেলেপক্ষের এই দাবির কাছে রাজী না হয়ে অন্য কোন উপায় তো নেই। আগে সাত সাতবার ছেলেপক্ষরা এসে ফিরে গেছে, সেও তো একই কারণ ছিল, পণের টাকা। বিয়ের যোগ্য আরো তিনটে মেয়ে যে তার ঘরে। মনে মনে হিসেব কষছিল সে। উত্তরের জমিটাও বন্ধক দিতেই হবে। দুধের গরু দুটো বিক্রি করলেও শেষ পর্যন্ত বিয়ের খরচ উঠবে কি?
বারান্দার সিঁড়ির মুখে বসেছিল চাঁপা। ফাল্গুনের শেষ। বাতাসে আমের মুকুলের গন্ধ। সূর্যের আলোয় যে পলাশ, শিমুলের লাল সারাদিন আগুনের মত উজ্জ্বল লাগে, সে রং এখন অনেক স্তিমিত। পশ্চিমের আকাশে অস্তগামী সূর্য। তবে সন্ধ্যা নামতে এখনো দেরী। আজ বিয়ের দিন ঠিক হল অলকার। পণের টাকাও দিয়ে দিতে হল আজ। তাই ওবাড়ীতে এখন উলু আর শঙ্খধ্বনি। দূর থেকে ভেসে আসা সেই শব্দ চাঁপার বুকের অনেক গভীরে গিয়ে আঘাত করতে লাগল। কি গভীর শূন্যতা! কি হাহাকার! ঘরে এল সে। বেশ অন্ধকার। তবুও আলো জ্বালাল না। পাশের ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মানিক। আজও কাজে যায়নি সে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেই স্টেশনের পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা দেয় আর মদ নিয়ে বসে। খাটের নীচ থেকে বড় ট্রাঙ্কটা বের করল চাঁপা। খুলতেই বিশ্রী গন্ধ। মায়ের শাড়ী ।হাত রাখল সে। মায়ের স্পর্শ মাখা সবকিছু। একটা পুঁটলি বের করল। তাতে একজোড়া মায়ের হাতের সোনার বালা। তার বিয়ের জন্য জমিয়ে রাখা। অসুখেও বিক্রি করতে দেয়নি মা। স্বামী, সংসার, সন্তানই তো তার জীবনের এখন একমাত্র স্বপ্ন। তবে তার মা নেই, দাদা নেশাখোর, পণ দেবার মত টাকাও নেই তাদের। তাই সে স্বপ্ন আজ যোজন, যোজন পথ দূরে।
ছোট কর্তাবাবুর ছেলের অন্রপ্রশান ছিল আজ। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীতে মুখরিত বাড়ী। অনেক খাবার দিয়েছে গিন্নিমা। পোলাও, ভাজি, মাছের কালিয়া, মাংস আরো কত কিছু। অনেক দিন ভালো খাবার জোটেনি। কলাপাতা দিয়ে ঢেকে নিয়ে ফিরছিল চাঁপা। তিনজনের একবেলা পেট ভরে খেয়েও বাকী থাকবে। রাতেও হয়ে যাবে এই দিয়ে। মনে মনে সেই কথাটাই ভাবছিল সে। পেটের ক্ষুধাটা, বারবারই মোচড় দিয়ে উঠছে। আকাশের দিকে তাকাল চাঁপা, আষাঢ়ের শেষ। অথচ বৃষ্টি নেই। মাঠ, ঘাট, ফসলের ক্ষেত সব শুকনো, জলহীন। মাঝে মাঝেই রাতের দূরের আকাশে বিদ্যুতের রেখার সাথে ক্ষীণ আলো দেখা দিয়ে সাথে সাথে মিলিয়ে যায়। জলহীন মেঘ, তাই বৃষ্টি হয় না। মসজিদ পার হবার পর পাকা রাস্তা শেষ। মাটির পথ ধরে হাঁটতে থাকে চাঁপা। নির্জন, নিরিবিলি দু’পাশে পাটক্ষেত। এই পথেই রতন মেম্বারের ছেলে তার দুই বন্ধুকে নিয়ে হিজল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়। এতক্ষন গুমোট হয়েছিল। এখন বাতাস বইছে। একঝাঁক টিয়া এসে বসল বাবলা গাছের মাথায়।
- ‘আমার পথ ছাড়েন আপনেরা। যেতে দেন।‘
ওরা পথ ছাড়ে না। আরো এগিয়ে আসে, ‘এত তাড়া কিসের সুন্দরী?’
- ‘আমি আপনাদের বোনের মত।‘
- ‘বোন না বিবি? ... তিনজনের এক বিবি।‘ ওরা সবাই একসাথে হাসে।
- ‘আমরা গরীব মানুষ। এই খাবারের জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে।‘
- ‘গরিব থাকবি না। কাল শহরে চল আমাদের সাথে। সারাদিন ঘুরব, বেড়াব। তারপর তোর যা পছন্দ শাড়ি, গয়না সব কিনে দেব।‘
- ‘দয়া করেন, যেতে দেন আমাকে।‘ ওরা পথ চাড়ে না। আরো এগোয়, চাঁপার হাত ধরে টানে।
- ‘চল, তোরে একটু সোহাগ করি।‘ অভূক্তের ক্ষুধার ভাত ছড়িয়ে পড়ে পথে। এর পরের ঘটনা –
অপ্রত্যাশিত, নির্মম, অবর্ণনীয়! পাট ক্ষেতে ওরা চারজন। কামড়ে, আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত চাঁপার নগ্ন শরীর। রক্তে ভেজে মাটি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। পশ্চিম আকাশের এক কোণে উজ্জ্বল হযে উঠে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার এক ফালি চাঁদ।
দেরীতে হলেও বর্ষা এসেছে। আকাশে মেঘ। সময়, অসময় নেই। সকাল, দুপুর, রাত মেঘের গর্জন। কখনো বৃষ্টি মুষলধারে। কখনো হালকা ভাবে। একটানা চার - পাঁচদিন পর আজ মেঘের আড়ালে সূর্য উকি দিচ্ছে। রোদ উঠল দুপুরে। বিকালের দিকে চাঁপাদের বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ায় মেম্বার। জানালা বন্ধ। অন্ধকার ঘরে ভ্যপসা গন্ধ, তেল চিটচিটে বিছানা বালিশ। চাঁপার বাবা চেয়ার এগিয়ে দেয়।
- ‘যা হবার তা হয়ে গেছে মুকুন্দ, মামলাটা তোমরা তুলে নাও।‘
পাশের ঘরে কাঁথা গায়ে শুয়েছিল চাঁপা। সেদিন রাত থেকে অপ্রকৃতস্থ সে। জ্বর, সাথে ভয়ের এক ঘোর লাগা অবস্থা। পরদিন সকালে কে কে যেন তাকে নিয়ে প্রথমে হাসপাতাল, পরে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। মামলা হয়েছে। তিনজনই এখন জেল হাজতে।
সময়ের সাথেসাথে সেই ঘটনার রেশ চাঁপার মনের মাঝে যেটুকু থিতিয়ে এসেছিল, অপরিচিত কন্ঠস্বরের এই কথা শুনে, তা যেন আবার জেগে উঠল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ধীর পায়ে চাঁপা এসে দাঁড়ায় এই ঘরে। মেম্বার হয়ত কোনদিন চাঁপাকে দেখেছে। কিংবা দেখেনি। কিন্তু তার মনে চাঁপার যে ছবি ছিল, সে এ চাঁপা নয়। তার সামনে দাঁড়ানো চাঁপার মাথার রুক্ষ এলোমেলো চুল, উদ্রভ্রান্ত চেহারা, গলায় – ঠোঁটে - গালে নখ আর দাঁতের আঁচড়ানোর ক্ষত দাগের শুকিয়ে যাওয়া চিহ্ন।
চাঁপার দিকে তাকিয়ে মেম্বার পুনরায় বলে, ‘ছোট মানুষ, বুঝতে পারে নাই, ভুল করে ফেলছে।‘
আগুন জ্বলে গেল মাথায়, শরীরে। চিৎকার করে উঠল চাঁপা, ‘ ছোট মানুষ? বুঝতে পারে নাই?
আমার জীবনের কি হবে এখন...?’ হাঁপাতে হাঁপাতে আবার বলে সে, ‘ আমি মামলা তুলব না। এই অন্যায়ের বিচার হবেই।‘
চাঁপার ভিতরের দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ চারিদিকের সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করতে চায়। আগুন জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। হু, হু করে কাঁদতে শুরু করে সে। তবে সেই কান্নাকে আমল দেয় না মেম্বার। উঠে চলে যাবার সময় বলে, ‘তুমি একবার বাড়িতে আমার সাথে দেখা কোরো মুকুন্দ।‘
বর্ষার আকাশ জুড়ে ছেয়ে থাকা মেঘ রাতের অন্ধকারকে গাঢ় থেকে গাঢ়তর করে। ঘুমে আছন্ন হয়ে থাকে সবাই। শুধু নির্ঘুম রাত কাটে চাঁপার। মরার মত বিছানায় শুয়ে থাকে সে। একাকী জেগে জেগে সে শুনতে থাকে ঘরের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। নতুন জলে উঁচু স্বরে ব্যাঙ ডাকার শব্দ। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকার শব্দ। যদিও বা একটু চোখ লেগে আসে। তখনই ভয়ঙ্কর, দুঃসহ সেই স্মৃতি ঘিরে ধরে। আঁচড়ায় কামড়ায়, ক্ষতবিক্ষত করে তাকে। নিজেকে মনে হয় উঠোনের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বজ্রপাতে পুড়ে যাওয়া তালগাছের মত। মাটি থেকে জল নিয়ে নিস্প্রাণ হয়ে শুধু বেঁচে থাকা। পাতা, ফুল, ফলহীন। অন্ধকার চিরে মাটি কাঁপিয়ে যন্ত্র দানবের মত আসে রাতের শেষ ট্রেন। চাকার সাথে রেল লাইনের ঘর্ষণের শব্দ কি তাকে ডাকে? না, তাকে ডাকে ভরা বর্ষার উন্মত্ত ঝিনাই-এর ঢেউ? দূর থেকে ফজরের আযানের সুর ভেসে আসে। পশ্চিম আকাশে চাঁদ ডোবে। অন্ধকার আরো গাঢ় হয়।
মেম্বারের বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি মুকুন্দের। আজ সন্ধ্যায় বাজারের পথে দেখা মেম্বারের লোকের সাথে। সে এক প্রকার জোর করেই মুকুন্দকে নিয়ে এল। সেগুন কাঠের দামী সোফায় বসে টিভি দেখছিল মেম্বার। সেখানে চলছে মেয়েদের উদ্দাম নৃত্য। চোখ সরিয়ে মুকুন্দের দিকে তাকাল মেম্বার।
- ‘শোন মুকুন্দ, মেয়েকে বোঝাও। মামলা তুলে নাও। ৫০ হাজার টাকা দিচ্ছি। কি যেন নাম তোমার ছেলের?’
- ‘মানিক।‘
- ‘শুনেছি পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে সে এখন জেলে। আমি বললেই ওকে বের করে দেবে। মামলাটা তোমরা শুধু তুলে নাও। পরে আরো ২০ হাজার। চাইলে আরো বেশী।‘
মেম্বারের কাছ থেকে টাকাটার কথা শোনার পর থেকেই মনের মধ্যে এক আনন্দের অনুভূতি। না, ভগবান একবারে নিষ্ঠুর না। সামনে আলোর দিশা। দৈনিক খেতে বসলে গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইত না। মুখে তিতা, বিস্বাদ লাগত। আজ, ভাত চেয়ে নিল মুকুন্দ। খাওয়া শেষে উঠে যাবার সময় কুপির হলুদ আলোয় মেয়ের শীর্ণ পান্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন সে বলে যায়, ‘ খেয়ে নে।‘
অথচ আজ কিছুই বলল না সে। এহেন পার্থক্যটা কি চাঁপার চোখে ধরা পড়ল? সে কি বুঝতে পারল তার বাবার মনের গভীরে আনন্দের এক চোরা স্রোত বয়ে চলেছে। রাতে বিছানায় শুয়ে একটা হিসাব কষছিল মুকুন্দ। ৫০ হাজার টাকার হিসাব। ঘরের চাল আগে বদলাতে হবে। বর্ষায় বৃষ্টির জল পড়ে ঘরে। একটা - দুইটা ছাগল কিনলে হয়। স্টেশনে যদি একটা পান বিড়ির দোকান দেওয়া যায়। আজ কাল শরীরটাও তো আর সায় দেয় না এত পরিশ্রম করতে। এতগুলো টাকা দেখলে চাঁপাও নিশ্চয় আপত্তি করবে না মামলা তুলে নিতে।
চাঁপার ছিন্ন দেহটা পড়ে ছিল রেললাইনের উপরে। ট্রেনের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে থেতলে আছে পেট। বিভৎস ! চোখে দেখা যায় না। আকাশ থমথমে। যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হবে। মরাকে ঘিরে থাকা জটলা কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। নির্বাক মুকুন্দ। তার আর্তনাদ নেই, বিলাপ করে কান্না নেই। শুষ্ক চোখে পরম স্নেহে গভীর মমতায় সে শুধু চাঁপার হাত ধরে বসে আছে। টাকাটা দেওয়ার তিন চারদিন পর মেম্বার আবার ডেকেছিল তাকে।
- ‘টাকাটা আমি তোমাগো এমনি এমনি দেয় নাই। মামলা তোলা কত দূর?’
দৈনিকই চাঁপাকে কথাটা বলতে চেয়েছে মুকুন্দ। কিন্তু পারেনি। আজ বিকালে বাড়ী ফেরার পথে মেয়ের প্রিয় পাবদা মাছ নিয়েছে বাজার থেকে। রাতে খাওয়া শেষে কথাটা তুলে ছিল সে।
- ‘যা হবার তা হয়ে গেছে। কোন কিছুই তো আর ফিরে আসবে না। মেম্বার ৫০ হাজার টাকা দিচ্ছে। বলছে মামলা তুলে নিলে পরে আরো বিশ হাজার দেবে। কাল পরশু চল। মামলাটা না হয় তুলেই আসি।‘
কথাটা শুনে কোন কথাই বলেনি চাঁপা। শুধু একদৃষ্টে চেয়ে ছিল তার বাবার দিকে। রাগ, দুঃখ, ঘৃনা, মিশে ছিল সে দৃষ্টিতে। তার বাবার প্রতি ঘৃণা। নিজের প্রতি ঘৃণা। জগৎ সংসারের প্রতি ঘৃণা। শুধু তখন সেই মূর্হূতেই নয়, তারপর কেটে গেছে আরো দুটো দিন। এই দুটো দিন ও মেয়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি মুকুন্দর। একবারও প্রশ্ন করেনি, মেয়েটা খেয়েছে নাকি না খেয়ে আছে?
স্টেশন মাষ্টার, থানার দারোগা, যমাদার আসে। যমাদার মরা সরিয়ে দেয় রেল লাইন থেকে। নিয়ম মত এই মরা এখন যাওয়ার কথা মর্গে। মেম্বারকে দেখা গেল দারোগার সাথে কথা বলতে। ছেলের জন্য জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে তার। অবশ্য ছেলের আর দোষ কি? তাদের বাড়িতে আশ্রিত গরীব ঐ বিধবার সাথে সেও তো...। বাপের রক্তই তো বইছে ছেলের শরীরে। তবুও আজ তার চোখে মুখে খুশির আভাস। পথের কাঁটা যেটুকু ছিল সবই তো শেষ এখন। ছেলেকে তো এখন সহজেই ছাড়িয়ে আনা যাবে।
মেম্বারের গলা শোনা গেল, ‘আমি আবার গরীব মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। মরাটা ছেড়ে দেন, শ্মশানেই নেওয়া হোক। কি দরকার অত ঝামেলার? পোড়ানোর তো একটা খরচ আছে। সেটুকুর সার্মথ্যও তো ওদের নেই। আমি ছাড়া আর কে থাকবে ওদের পাশে? মানিককে ছাড়ানোর ব্যবস্থা তো আমাকে করতে হবে। সব ঝামেলা মিটে গেলে আজ রাতে না হয় এই গরিবের বাড়িতে দুটো ডাল, ভাত খেয়ে যাবেন।‘
কিছুক্ষণ আগে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ দমকা হাওয়া উঠল। সেই দমকা বাতাসের তোড়ে মেঘ উড়ে গেল। ধান ক্ষেত বাতাসের দিকে নুয়ে পড়ে আবার সোজা হল। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতা একদিকে থেকে ছড়িয়ে গেল অন্যখানে। এর মাঝে তিন চাকার যানে চড়ে চাঁপা এল শ্মশানে। মানিকের আসতে আসতেও দুপুর গড়িয়ে গেল। চিতা সাজানো শেষে চাঁপাকে নিয়ে যাবার সময় মুকুন্দ চিৎকার করে উঠল, ‘তুই কেন চলে গেলি রে মা? ভাত নিয়ে কে বসে থাকবে আমার জন্য? আমাকে এখন থেকে কে খেতে দেবে রে মা?’
পাঠকাঠিতে আগুন দিয়ে চিতা প্রদক্ষিণ শেষে মুখাগ্নি করা হল। জ্বলতে লাগল সর্বগ্রাসী আগুন। আগুনের দিকে তাকিয়ে মুকুন্দ ফিরে গেল সাত বছর আগে। রবিবারের এক শীতের রাতে সেদিন জ্বলে ছিল বিথীর চিতার আগুন। শ্মশান যাত্রীরা সব দাঁড়িয়ে ছিল চিতার চারিদিকে। আগুনের আলোয় সকলের মুখ উদ্ভাসিত। শীত থেকে বাঁচতে সকলেই আগুনের সেই তাপ শোষণ করে নিচ্ছিল। আগুনে সেদিন পুড়েছিল অসমাপ্ত জীবনের দুঃখ, কষ্ট, আশা, ভালবাসা, স্বপ্ন । আজ আবার পুড়ছে সেই চিতা। আবার পুড়ছে আরো একটি দেহ। এক বাবার ভালোবাসা? না, অপমান, ঘৃনা, দুঃখে জর্জরিত -বিকৃত লালসা তার কামনার স্বীকার ধর্ষিত এক নারী দেহ?
জগত সংসার চলছে তার নিজস্ব লয়ে। প্রতিদিন সূর্য উদয়, সূর্য অস্ত, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, জোয়ার ভাটা সব নিয়ম মত। উঠোনের কদম গাছটাতে ফুল ফোটা শেষ। ও পাড়ার কুলসুম তালাক নিয়ে ফিরে এসেছে। স্বপ্নাদের গরুটা বকনা বাছুর বিইয়েছে। দুলাল কলেজ পাশ করে ডাক্তারি পড়তে শহরে গেছে। ব্যবসায়ী ছেলের সাথে কুসুমের বিয়ে ঠিক হয়েছে। দু’মাস আগে অলকাকে আনতে গিয়েছিল বিনয়। ওর শুশুর আসতে দেয়নি। বলেছে, ‘পূজার সময়, পূজার জামা কাপড়ের সাথে জামাইয়ের জন্য এক লক্ষ টাকা দিতে হবে। জামাই ব্যবসা শুরু করবে। পূজার সময় টাকা দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যাবেন।‘
কথাটা শুনে রক্ত শূন্য হয়ে গিয়েছিল বিনয়ের মুখ। অলকার মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলেনি, শুধু মাথা নিচু করে ছিল সে। রাতে খাবার পরে মেয়েটা একবার এসেছিল তার কাছে। তারপর নিচু গলায় বলেছিল, ‘আমি বাড়ি যাব বাবা, তোমাদের কাছে। আমাকে তুমি এখান থেকে নিয়ে চল।‘
বিয়ের পর মেয়েরা শাড়ী, গয়নায়, স্বামীর সোহাগে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে। অথচ একি চেহারা হয়েছে অলকার? ম্লান মুখ, চোখের নীচে কালি, কন্ঠীর হাড় উঁচু। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে। মেয়েটা সুখে নেই। এরপর আবার উঠেছিল টাকার কথা। অলকার অন্যায়, সেদিন সে বলেছিল, ‘ব্যবসা করার জন্য বাবা টাকা দেবে কেন? এমনিতেই বিয়ের সময় টাকা যোগাড় করতে ঘরের অনেক কিছুই বিক্রি করতে হয়েছে।‘
এরপর একদিন। রান্না করতে গিয়ে নাকি মেয়েটার শাড়ীতে আগুন লেগেছিল। প্রতিবেশী একজনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল। ওই যে ওরা হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে গেছে, তারপর একটা খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। বিছানায় শুয়ে পোড়া ঘা নিয়ে যন্ত্রনায়, কষ্টে কাঁদে অলকা আর হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে রাত কাটায় বিনয়। কোথা থেকে আসবে চিকিৎসার এত টাকা?
ভাদ্র মাস। উজানের ঢলে ঝিনাই এখন বড় অশান্ত। দুকুল উপচানো ঢেউ তার। রাতে জোৎস্নার আলোয় চিক চিক করে ঝিনাই । গভীর রাতের নিস্তবদ্ধা ভেঙ্গে শেয়াল ডাকে। নারকেল গাছের পাতায় রাত জাগা পাখি ডানা ঝাপটায়, খাটের তলায় ইঁদুরের খুট খুট শব্দ । ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত মুকুন্দর চোখ তন্দ্রা নামে । চাঁপার কন্ঠস্বর কানে ভাসে, ‘প্রতিদিন রাতে তুমি যে এভাবে উপোস দেও, তোমার শরীর যে ভেঙ্গে পড়বে বাবা।‘
চকিতে মনের মধ্যে আনন্দের আবেশ! চাঁপা এসেছে! বিছানায় উঠে বসে সে। নেশা করে এসে পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে মানিক। চাঁপার বিছানা শূন্য। ঘোর কেটে যায় মুকুন্দর। বাস্তব এসে দাঁড়ায় সামনে। মনে পড়ে বীথির মত চাঁপাকেও সে পুড়িয়েছে শ্মশানে। শেষচিহ্ন ছাইটুকু ভাসিয়ে দিয়েছে ঝিনাই-এর জলে। বুকের মাঝে কষ্ট! চাপ চাপ কষ্ট! একেক বার মনে হয়, টাকার নোটগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ঝিনাই-এর জলে ভাসিয়ে দেয়। মেয়েটার শ্রাদ্ধের সময় কিছু কিছু কথা এসেছিল মুকুন্দর কানে, ‘আত্মঘাতী হয়ে ভালই করেছে মেয়েটা। ভবিষ্যৎ বলে তো আর কিছু ছিল না। বাপটাকে মুক্তি দিয়ে গেল।‘
সত্যিই কি মুক্তি দিয়ে গেছে মেয়েটা তাকে? না অপরাধের বড় এক পাথর চাপিয়ে দিয়ে গেছে তার বুকের উপর। জানে না! কিছুই জানে না মুকুন্দ! শুধু হু হু করে কাঁদতে থাকে সে।
একই গ্রামে একই সাথে বেড়ে ওঠা ছাড়া মুকুন্দর সাথে তেমন কোন সখ্যতা বিনয়ের কোনদিনই ছিল না। অথচ আজ তার সামনে এ কোন মুকন্দ? কৃতজ্ঞতা জানানোর কোন ভাষা নেই বিনয়ের মুখে। শুধু মুকুন্দর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে আছে সে। আবেগে শুধু বিনয়ের চোখে নয়, জল মুকুন্দর চোখেও। হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে পথে পা বাড়ায় বিনয়। তার কাছে এখন মুকুন্দর দেওয়া ৫০ হাজার টাকা। বিনয়ের যাবার পথে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে মুকুন্দ। একটু আগের বিনয়ের বলা কথাটা মনে পড়ছে তার।
- ‘মেয়েটার শুশুর বাড়িতে লোকদের খিদে খুব বেশী।‘
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে সে, ‘খিদে কি শুধু শরীরের। মনের তো খিদে হয়। মনের মধ্যে লালসার খিদে, কামনার খিদে, লোভের খিদে, নেশার খিদে। শরীর বা মনের যারই হোক না কেন এই খিদেই তো সারা জীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মানুষকে। সেও তো পুড়েছিল লোভের খিদের আগুনে। স্বপ্ন দেখেছিল চায়ের দোকানের, টিনের দোচালা ঘরের। তাই তো মেয়েটা চলে গেল।
পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নার আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে চারিদিক। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা খুঁটিগুলোর আলোও আজ গুরুত্বহীন। মাঝে মাঝে জোনাকির সবুজ আলো। না হোক তার চায়ের দোকান, ভাঙ্গা ঘরেই আসুক বৃষ্টির জল, শীতের বাতাস। তবুও অলকা সুস্থ হোক। আর কোন বাবার বুক যেন খালি না হয়। বুকের উপর চেপে থাকা পাথরটা যেন আজ সত্যিই নেমে গেছে। অনেক দিন পর সে আজ ঘুমাবে। শান্তির ঘুম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন