সায়ন্তনের দুর্গা দর্শন - গৌতম রায়

  সায়ন্তনের মনটা আজ ভাল নেই। ভেবেছিল এবারে পূজোয় বন্ধুদের সঙ্গে সারারাতের ঘোরার প্ল্যান করবে। সপ্তমীর মধ্যে কোলকাতার পূজোগুলো দেখে নিয়ে অষ্টমী থেকে ম্যাডক্স স্কোয়ারে বসে আড্ডা মারবে। কিন্তু কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল! রমেনের বাবা মা দক্ষিণ ভারত ঘোরার প্ল্যান করে ফেলল। সুজয়ের বাবাও অফিসের গ্রুপের সঙ্গে আন্দামান যাচ্ছে। মন্দারের তো আবার বিদেশ ভ্রমণ। এবারেরটা আবার নাকি অফিসের পয়সায়। ওর বাবা অবশ্য প্রায়ই বাইরে অফিস ট্যুরে যান

  খবরটা জানতে পেরে পড়ার ঘরে বসে আনমনে একটা ছবি আঁকছিল। সায়ন্তনের এটা একটা অদ্ভুত সমস্যা বলা যেতে পারে। অবচেতন মনে যে ছবিগুলো আঁকে, সেগুলো প্রায়ই দেখা যায় আতি প্রাচীন দুস্প্রাপ্য কিছু বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। গত বছরই তো এরকম একটা ঘটনা হয়েছিল। স্কুলের ড্রয়িং খাতায় একটা বদখত জন্তুর ছবি এঁকেছিল। স্যার দেখে হেডস্যারকে রিপোর্ট করতে গিয়ে সেবারে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। ওটা নাকি কনডন্টস। ট্রায়াসিক যুগের মাঝামাঝি সময়ে হারিয়ে গিয়েছিল। হেডস্যার জানতেন বলে সায়ন্তনকে ওটার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কিন্তু ওর যে জন্তুটার সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই, সেটা জেনে আরও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন

  এবারের পূজোয় যে মামাবাড়িতে যাওয়া ঠিক হয়েছে, সেটা সায়ন্তন রাতে খাবার টেবিলে জানতে পারল। অবশ্য উপায়ও কিছু ছিল না। অফিসে ছুটি না পাওয়ায় বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান আগেই ক্যানসেল হয়ে গিয়েছিল। এদিকে বন্ধুরা না থাকায় সায়ন্তনও কোলকাতায় থাকতে চাইছিল না। তবে পূজোর সময়টায় গ্রামে থাকাটাও সায়ন্তনের মন চাইছিল না। কিন্তু কি আর করা যাবে? তবে বাড়িতে পূজো হওয়ায় আরও অনেক আত্মীয়স্বজন আসার আশায় মনটা কিছুটা ভাল হল

  সায়ন্তন যেখানেই যায় সঙ্গে আঁকার খাতাটা রাখে। মন ভাল না থাকলে আঁকতে বসে যায়। এবারেও তাই নিজের ব্যাগে খাতা আর আঁকার সরঞ্জামগুলো ঢুকিয়ে নিল। তবে কয়েকদিন আগে খাতায় যে মূর্তির ছবিটা এঁকেছিল, সেটা আর স্মৃতিতে সেরকম ভাবে উঁকি দেয় না

  ষষ্ঠীর দিন মামাবাড়ির সামনে এসে প্যান্ডেল দেখে মনটা আবার ভাল হয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে ঠাকুর দালানে একচালার মূর্তিটা দেখে হটাৎ কেন যেন নিজের আঁকা ছবিটার কথা মনে এসে গেল। বীথি এসে চেঁচামেচি না করলে হয়ত ওখানেই আঁকার খাতাটা বার করে ফেলত। বীথি মামার মেয়ে। সায়ন্তনের চেয়ে দু ক্লাস নিচে পড়ে। ওরা আগের দিনই এসেছে। চারিদিকের হৈচৈয়ের মধ্যে সায়ন্তনের সুপ্ত ইচ্ছাটা হারিয়ে গেল

  ছোটবেলায় মামাবাড়িতে এলেই সায়ন্তন দাদুর কাছ থেকে গল্প শোনার জন্য আশেপাশে ঘুরঘুর করত। সেই সন্ধ্যেবেলায় যতক্ষণ না এসে নিজের পড়ার ঘরে বসেন ততক্ষণ সবাইকে অস্থির করে রাখত। এখন অবশ্য ভাল না লাগলে ছবি এঁকেই সময় কাটায়। আজকের দিনটা অবশ্য আলাদা। দুপুরে খাওয়ার পর পাওয়া যাবে


  চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মনিশংকর বোস বলে উঠলেন, কি দাদুভাই, কি কি ছবি আঁকলে? সা্যন্তন খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তোমরা দুর্গাপূজো কেন শুরু করেছিলে? ড্রয়িং খাতাটা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা জায়গায় থেমে গিয়ে দাদু বলে উঠলেন, এই ছবিটা কেন এঁকেছিলে? আড়চোখে শেষ ছবিটা দেখে সায়ন্তন বলে উঠল, মনে পড়ছে না। তবে এরকম একটা ছবি আজ ঠাকুর দালানে দেখেছি। হ্যাঁ, ওটা চতুর্থ শতকের মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তি। অন্ধ্রপ্রদেশের পালনাড়ু জেলার গুরজালায় একটা ভেঙে পড়া মন্দিরে পাওয়া গিয়েছিল। ঐ চতুর্ভুজা মুর্তিটাই আমি কুড়ি বছর আগে স্বপ্নে দেখেছিলাম। জানিনা কি করে তুই এটা আঁকলি!

  সায়ন্তনের মাথায় একগাদা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। বুঝতে পারছিল না কোনটা আগে বলবে! পাশ থেকে বীথি বলে উঠল, দুর্গাঠাকুর কোথা থেকে এসেছিল? দাদু হেসে বলে উঠলেন, মনে হয় ভারতের বাইরে থেকে, কেননা প্রথম মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল সিন্ধুসভ্যতার হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরোতে। প্রাচীন কালে মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবী থেকেই সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররা প্রতিদিন ওঠে এবং আবার প্রবেশ করে যায়। তাই তাঁকেই দুর্গা রূপে পূজো করে এসেছে। দেবী দুর্গার দশ হাতও সম্ভবত দশ দিকের ধারণা থেকে এসেছে এই ঐশ্বরিক নারী শক্তির (দুর্গা) উৎপত্তি শিব পুরাণেও উল্লেখ আছে। মহাজাগতিক সৃষ্টির আগে, শিব তার বাম অর্ধেক থেকে তাকে আহ্বান করেছিলেন এবং তার সাহায্যে শিবলোক তৈরি করেছিলেন


  হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদরোতে চারহাজারেরও বেশি পুরনো পোড়ামাটির দুর্গামূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কোন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় নি। এরকমই কিছু মূর্তি দিল্লীর জাতীয় যাদুঘরে রাখা আছে। আস্কো পারপোলার মতে, কালিবঙ্গন থেকে একটি নলাকার সীলমোহর পাওয়া গিয়েছিল, যেটাতে বাঘের পিঠে যুদ্ধরতা এক দেবীমূর্তির প্রতিকৃতি ছিল। এটার সংগে এখনকার দুর্গার বেশ কিছু মিল পাওয়া গিয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরো উপত্যকায় পশুপতি বা শিব এবং উর্বরতার দেবী বা পৃথিবীকে পূজা করা হত। কারণ মাটিই শষ্য এবং অন্যান্য খাদ্য দিত। আর পৃথিবী অর্থাৎ অদিতিকেই মা দুর্গা বলা হয়ে থাকে

   মহেঞ্জোদরোতে পাওয়া দেবী দুর্গার মূর্তি তার মানে আর্যরা আনেনি, সায়ন্তন বলে উঠল! মনে তো হয় না। কারণ আর্যদের দেবতা ছিলেন ইন্দ্র, বরুণ, সূর্য আর অদিতি, ঊষা, সরস্বতী দেবী রূপে ছিলেন। বীথির অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে দাদু বলে উঠলেন, আনুমানিক ২০০০ থেকে ১০০০ খ্রীঃপূঃ এর মধ্যে বা তারও কিছু আগে ইরান এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের দিক থেকে স্টেপে যাযাবর উপজাতিরা ভারতে প্রবেশ করে। ইতিহাসে এদেরই আর্য বলা হয়ে থাকে। এইসময় থেকেই সিন্ধু সভ্যতার পতন দেখা দিয়েছিল। অবশ্য সেই সময় সিন্ধুবাসীরা ভারতের আরও ভেতরে ছড়িয়ে গিয়েছিল। তবে আর্যদের সময় দেবীর তুলনায় দেবতাদের প্রাধান্যই বেশি ছিল। পরবর্তী যুগে ভারতের আর্যরা আর প্রাচীন দ্রাবিড়রা মিলেমিশে ভারতীয় সংস্কৃতিকে আরও গভীর ভাবধারায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল

   তাহলে স্বর্গ থেকে দেবতারা আসেন নি? বীথি সরল প্রশ্নে দাদু বলে উঠলেন, এসব তো আমাদের ধারণা। কথায় বলে হিন্দুদের তেত্রিশকোটি দেবতা। তবে ঋকবেদের তৃতীয় মন্ডলে তেত্রিশ জন দেবতার কথা বলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এগারজন পৃথিবীর অর্থাৎ ভূলোকের, এগারজন অন্তরীক্ষের অর্থাৎ ভুবঃলোকের এবং বাকি ১১জন দ্যুলোকের বা স্বর্গের। কিন্তু পরবর্তীকালে পুরানে সেটাই ৩৩ কোটি হয়ে গিয়েছিল

   সুপ্রাচীন যুগে মানুষ গাছ পর্বত; এসবেরই পূজা করত। বৈদিক সাহিত্যেও আকাশ, সূর্য, অগ্নি, ইন্দ্র প্রভৃতির সঙ্গে বৃক্ষ, যূপ, স্তম্ভের পূজারও উল্লেখ আছে। এর একটা কারণ বড় বড় গাছ, যেমন বট, অশত্থ, নিম এইসব ঝাঁকড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে যেত। প্রাচীন মানুষ ভাবত এইসব গাছ সূর্যকে ধারণ করে থাকত। বৃক্ষপূজার পর ধীরে ধীরে যূপপূজা, স্তুপপূজা, প্রতীকপূজার প্রচলন হয়। মূর্তিপূজার প্রচলন সম্ভবত এর পরেই শুরু হয়েছিল। তবে মূর্তিতে হাতের সংখ্যা সম্ভবত শক্তির প্রকাশের তারতম্যে এবং রূপকল্পনার বৈচিত্র আনার জন্য হয়ে থাকতে পারে। তাই চতুর্ভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা এমনকি সহস্রভুজা রূপেও দেবীকে দেখান হয়েছে। তবে স্বামী প্রজ্ঞানন্দজী মহারাজের মতানুসারে, '' মানে দৈত্যনাশ, '' অর্থাৎ বিঘ্ননাশ, '' এর অর্থ রোগনাশ, '' অর্থাৎ পাপনাশক আর ''-কার হল ভয় বা শত্রুনাশ। তাই হয়ত দুর্গাকে মহাবিঘ্ননাশিনী দেবী হিসাবে বলা হয়ে থাকে

   তাহলে তুমি যে বললে দুর্গা বাইরে থেকে এসেছেন? সায়ন্তনের কথায় দাদু বলে উঠলেন, দেবী দুর্গা আসলে মহাশক্তি। এই মহাশক্তির পূজা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রাচীনকালে সিরিয়া গ্রীস, সাইপ্রাস, এথেন্স, ক্রিট প্রভৃতি দেশেও পূজিত হত। এর মধ্যে স্যাকসনদের মধ্যে দেবী ইস্তারা অর্থাৎ সৌরদেবীর পূজার কথা অনেকেই শুনেছে। ইস্তারাদেবীর দুপাশে সিংহ ও সর্প থাকে। সিংহ সূর্যের আর সাপ মেঘ বা বিদ্যুতের প্রতীক। যূপপূজার প্রচলন প্রাচীন ইজিপ্টেও ছিল। তাই মনেহয় এই সংস্কার দ্রাবিড় সভ্যতার অংশ নয়

   তাহলে রাম যে দুর্গার স্তব করেছিলেন, সেটা কি ঠিক নয়, সায়ন্তন বলে উঠল। এটা বলা মুস্কিল। তবে মনেহয় রাম সূর্যের স্তব করেছিলেন, কারণ সূর্যপূজার প্রচলন প্রায় সারা বিশ্বেই ছিল। তবে মহাভারতে দেবী দুর্গাকে অন্যরূপে দেখা গেছে। মহাভারতের বিরাটপর্ব ও ভীষ্মপর্বেও অর্জুন দ্বারা দেবী দুর্গার স্তববর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সেখানে দুর্গা কৃষ্ণবর্ণা, চতুর্ভুজা ও চারচোখ বিশিষ্ট কুমারী। তাই মহাভারতে দুর্গা শিবদুহিতা ছিলেন না। বৈদিক মতে রাত্রিদেবী কৃষ্ণবর্ণা হলেও পুরাণ মতে দেবী তপস্যায় ব্রহ্মার বরে গৌরবর্ণা হয়েছিলেন। তাইতো ওনার আরেক নাম কৌশিকী

   দুর্গার সঙ্গে শিবের সম্পর্কটা অনেক পরে এসেছিল। আদিতে শিব অনার্যদের দেবতা ছিলেন। দ্রাবিড়রা শিবকে একক ভাবেই পূজা করত। তাই প্রাচীন সমস্ত ভাস্কর্যতেই দুর্গাকে একাই দেখা গিয়েছিল। শিবের ন্যায় দুর্গাও আগে কিরাত, শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম সমাজের দেবী ছিলেন। তাই হয়ত দেবীকে কিরাতিনী, বিন্ধবাসিনী, পর্ণশবরী, বনদুর্গা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। এমনকি এখনও কিছু জায়গায় ষষ্ঠীতে দেবীকে শবর মতে পূজা করা হয়ে থাকে। পরে দুর্গাকে শিবের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে দেখান হয়েছে। অবশ্য লক্ষ্মী ও সরস্বতী অনেক পরে সংযোজন হয়েছিল। তবে কিছু মতে ওরা আসলে দুর্গার দুই যক্ষিণী, জয়া ও বিজয়া

  দাদু কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে উঠলেন, অক্সফোর্ডের লেকচারার বিহানি সরকারের মতে তৃতীয় শতাব্দীতে স্কন্দ রাজকীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপুজার প্রচলন দেখা গিয়েছিল, যা কুষাণ সাম্রাজ্যের উপরও আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কুষানদের দেবতা স্কন্দ কেন্দ্রিক রাজকীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে দুর্গা উপাসনাকারী ছোট বন-রাজ্যের আচার-অনুষ্ঠান ঢুকে পড়েছিল। তাই কুষাণ শিল্পে মহিষ বধকারী চার-বাহু দেবী মূর্তি দেখা গিয়েছিল। এই মূর্তিই অবশেষে দুর্গার রূপ হয়ে ওঠে যার সাথে আমরা এখন পরিচিত। সপ্তম শতাব্দীর পল্লব এবং চালুক্য শিল্পে এই মূর্তিই জনপ্রিয় হয়েছিল

  গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজতন্ত্র ভেঙে যাওয়ার পরেও ষষ্ঠ শতকের শেষের দিকেও এটি প্রাধান্য লাভ করেছিল। ওনার যুক্তি অনুসারে, তৃতীয় শতক থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত অ-ব্রাহ্মণ্যবাদী ‘অরণ্য (আটবিক) রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল এবং তাদের দুর্গাপূজা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ ছিল। সম্ভতবত এই সময়েই 'উপজাতীয়' আচার-অনুষ্ঠান থেকে দুর্গা-উপাসনাকে বিষ্ণু এবং শৈবের সংস্কৃত ধর্মে সংযোজিত করা হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দী থেকে উনি দুর্গাকে যুদ্ধের দেবী হিসাবে পূজার সূচনা চিহ্নিত করেছিলেন। বাদামীর চালুক্য রাজারাও এই পূজা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে, দেবী দুর্গার পূজার আচারগুলি রাজন্যবর্গের মধ্যেও চলে আসায় 11 শতকের মধ্যে, এইসব সম্প্রদায়ের আমূল রূপান্তর ঘটে। যার ফলে বলিপ্রথা ও আমিষ দেওয়ার প্রথা অবলুপ্ত হয়ে নিরামিষ পদ্ধতির অনুশীলনের দিকে চলে যায়

 


  গুপ্তযুগের সোনার মুদ্রাগুলিতে দেবীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এটাই আবার সাঁচি এবং বারহুতের বৌদ্ধ স্তূপে লক্ষ্মীর রূপে পাওয়া গিয়েছিল। আর সরস্বতীর প্রাচীনতম মূর্তি মথুরায় পাওয়া যায়। এটা অবশ্য জৈন ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত বলে মনে করা হয়। জৈন মন্দিরগুলিতেও বহু-সশস্ত্র দেবদেবীর মূর্তি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যেমন অম্বিকা, পদ্মাবতী এবং চক্রেশ্বরী। তান্ত্রিক উপাসনালয়েও তাদের যোগিনী এবং ডাকিনী হিসাবে দেখা গিয়েছিল। তবে এই দেবী দুইবাহু দেবী

  এছাড়াও ওড়িশায় সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত পরশুরামেশ্বর মন্দিরে আমরা দেবীকে তার স্ত্রী হিসাবে শিবের পাশে বসে থাকতে পাই। সেখানে অন্নপূর্ণারূপী দুর্গা ভিক্ষুকরূপী শিবকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। মুম্বাইয়ের কাছে এলিফ্যান্টা গুহাতেও শিবের অনুরূপ চিত্র পাওয়া যায়। সেই সময়কালে লক্ষ্মী, দুর্গা এবং পার্বতীকে দেখা গিয়েছিল। দ্বি-বাহু দেবীদের অপেক্ষাকৃত বড় চার-বাহুর শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মার সহধর্মিণী হিসাবে দেখান হয়েছে

  নবম শতাব্দীর বাংলার পাল শিল্পে, রাজাকে বিষ্ণু হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল এবং পাশে দুই স্ত্রী, লক্ষ্মী যিনি সম্পদ নিয়ে আসেন এবং সরস্বতী যিনি শিল্পকে মূর্ত করেন। দেবী ছাড়া কোন মানুষ রাজা হতে পারে না। তিনি ছিলেন রাজ্যের দেবী রাজরাজেশ্বরী। এই ধরনের ধারণাগুলি দেবীদের শক্তি এবং জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠা করেছিল

   দশম শতকের চামুন্ডা ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্র, মৃতদেহ এবং ভূতের দেবী। পরে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নিজেদেরকে ভারত মাতার সন্তান হিসেবে দেখে চামুন্ডা মূর্তির পূজা শুরু করেছিল। তবে মনেহয় নবদুর্গা নেপাল থাকে এসেছিল। নেপালে, নব-দুর্গার রূপে দেবী তালেজু, ভৈরব বা বিষ্ণুর সহধর্মিণী হিসাবে শহরের কেন্দ্রে আটটি দেবী দ্বারা বেষ্টিত দেখা যায়

   দাদু অনেক্ষণ বলার পর একটু থামতে সায়ন্তন বলে উঠল, মুসলমানরা আসার পর বোধহয় পূজো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই না! এটা ঠিক নয়, কারণ এত প্রাচীন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা মুস্কিল। প্রাক-ইসলামী যুগে মধ্য এশিয়ায় হিন্দু দেবতাদের উপস্থিতি স্থানীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতির উপস্থিতি প্রমাণ করে। এটি মধ্য এশিয়ার শুধুমাত্র পেনজিকেন্টের জেরাফশান উপত্যকাই নয় বরং ফারঘনার সির দরিয়া (তখন জাক্সার্টেস নামে পরিচিত) এবং আর্যতামের আমু দরিয়া (তখন অক্সাস নামে পরিচিত) উপত্যকাতেও দেখা গিয়েছিল

   তাজিকিস্তানের পেনজিকেন্টের রুদাকি জাদুঘর এবং দুশানবের জাতীয় জাদুঘরে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি আছে। মিউজিয়াম অফ অ্যান্টিকুইটিসে সিংহে চড়ে একজন দেবীর ছবি রয়েছে, সেইসাথে তৃতীয় চোখ সহ শিব এবং তিনটি মাথা বিশিষ্ট শিব এবং পার্বতীর মতো অন্যদের ছবি রয়েছে। রুদাকি মিউজিয়ামে, শিবকে তার পাশের ত্রিশুল বা ত্রিশূলের সাথে মরুভূমির মতো একটি বিস্তীর্ণ অঙ্গনে বসে থাকতে দেখা যায়। এমনকি প্রায় ২৫টি মার্বেল ভাস্কর্য এবং পঞ্চম এবং অষ্টম শতাব্দীর মধ্যবর্তী হিন্দু শিল্পের অন্যান্য নিদর্শন আফগানিস্তানেও আবিষ্কৃত হয়েছে

  তার মানে বাংলার পূজো অনেক পরে এসেছিল, সায়ন্তন বলে উঠতে দাদু বললেন, মার্কেন্ডেও পুরাণ অনুযায়ী রাজা সুরথ তাঁর রাজধানী বলিপুরে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলায় দেবী দুর্গার প্রথম পূজা ১৫০০ খৃষ্টাব্দের শেষের দিকে উদযাপিত হয়েছিল। লোককাহিনী বলে যে দিনাজপুর ও মালদহের জমিদার বা জমিদাররা বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। অন্য একটি সূত্র অনুসারে, তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার ১৬০৬ খ্রীস্টাব্দে বাংলায় প্রথম শারদীয় বা শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন

  শুধু তাই নয়, ইংরেজরাও এই পূজোয় জড়িয়ে গিয়েছিল। সুকান্ত চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, বৃটিশ ভারতে উচ্চপর্যায়ের ব্রিটিশ কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে প্রভাবশালী বাঙালিদের দ্বারা আয়োজিত দুর্গা পূজায় যোগ দিতেন এবং ব্রিটিশ সৈন্যরাও পূজায় অংশগ্রহণ করত। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হল, ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেই বাংলার দেওয়ানি প্রাপ্তির জন্য ও হিন্দু প্রজাদের সন্তুষ্ট করার জন্য দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল। অবশ্য এটা একটি রাজনৈতিক উদ্দেশে করা হয়েছিল। এমনকি কোম্পানির অডিটর-জেনারেল জন চিপস তার বীরভূম অফিসে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তবে ১৮৪০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিয়ম করে সরকারী অফিসারদের এইসব অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া নিষিদ্ধ করে একটি আইন জারি করেছিল

  সোমেন্দ্র চন্দ্র নন্দী লিখেছিলেন, প্রথম সম্প্রদায়ের পূজা বা বারোয়ারী পূজা স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় ১৭৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলির গুপ্তিপাড়ার বারোজন বন্ধু মিলে করেছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছিল 'বারো-ইয়ারি' পূজা বা 'বারো-পাল'এর অনেক পরে, ১৮৩২ সালে বারো-ইয়ারি পূজাটি কোসিমবাজারের রাজা হরিনাথ কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্য উনি ১৮২৪ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত এই মুর্শিদাবাদেই তাঁর পৈতৃক বাড়িতে দুর্গা পূজা করেছিলেন

  তবে প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপূজা হয়েছিল ১৯১০ সালে। বাগবাজারের সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা জনসাধারণের টাকায় এই পূজার আয়োজন করেছিল

  

বাইরে থেকে দিদিমা বলে উঠলেন, গল্প বন্ধ কর এবার। কাল নবপত্রিকার জন্য ভোরে ঘাটে যেতে হবে। বীথি ফিসফিস করে বলে উঠল, নবপত্রিকা কি জিনিস দাদু? দাদু নিচুস্বরে নববধূ রূপে কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু আর ধানের গাছ বলে হেসে, তবে গনেশের বৌ নয় বলে বেরিয়ে গেলেন।     








 চিত্র সৌজন্যঃ https://www.oldindianphotos.in/2009/01/durga-puja.html

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন