রতনপুর
স্টেশন থেকে প্রায় দু কিলোমিটার দূরে পুরোনো বাড়িটা পছন্দ হয়ে যায় আমাদের
সকলের। শহর ছেড়ে শুনশান ছায়া ঘন গ্ৰাম্য প্রকৃতি। বাড়িটার একটু দুরেই বয়ে
চলেছে শীর্ণ নদী, নাম কানা নদী। কেন এই নাম কে
জানে , নাম শুনেই অরিত্র পিয়াঙ্কা হেসে ওঠে নিজেরা বলাবলি
করে , জানিস দিদি এই নদীটা বোধহয় চোখে ভালো দেখতে পায় না।
অরিত্রর কথায় পিয়াঙ্কা বলে না রে নদীটার নামই কানা। নদী বাঁধ বরাবর যতদুর চোখ
যায় সবুজ গাছগাছালি। চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছে ওরা। এবারতো এখানেই থাকতে হবে, ভর্তি হতে হবে এখানকার স্কুলে। অরিত্রর ফাইভ আর পিয়াঙ্কার এবছর সেভেন হবে।
বাড়িটার পূব দিক বরাবর পায়ে পায়ে তৈরি হয়ে গেছে ঘাস মাটির একটা রেখাপথ।
সেই রেখাপথ ধরে নদী বাঁধে উঠে ইট বেছানো রাস্তা চলে গেছে স্টেশনের দিকে , কিছুটা হাঁটলেই রতনপুর হাইস্কুল।উচু বাঁধের রাস্তার ওপর থেকে বাড়িটা পরিস্কার দেখা যায়। দীপার মন্দ লাগে নি। বাবা তো খুবই খুশি। শহরের শব্দ ধোঁয়া ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে। নির্মল প্রকৃতির মধ্যে প্রাণ ভরে পাওয়া যাবে মুক্ত বাতাস। এতএব সবার পছন্দের কথা ভেবে ঐ বাড়িটাই কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দেবেশ।
কাগজে
বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছিল সে, বাড়ির মালিক বীরেশ্বর ঘোষ রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে কলকাতায়, জামাই কসবর এক স্কুলের শিক্ষক। ছেলে কোন এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আর সেই
ছেলের শোকে বীরেশ্বরবাবুর স্ত্রীও বাঁচেননি বেশিদিন। স্ত্রী ছেলেকে হারিয়ে একা
হয়ে যান তিনি। এক বয়স্ক মহিলা দেখাশোনা
করত। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না আর এই বাড়িতে। অনেক রাত জেগে বসে কাটান
বীরেশ্বর বাবু। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই বাড়ি লাগোয়া জমি বিক্রি করে চলে যাবেন
মেয়ের বাড়ি। মেয়েও বলে আসছে সে কথাই।
উপর নীচে দোতলা, পাঁচ কামরা ঘর, রান্নাঘর ডাইনিং খোলা বারান্দা। সামনে ফুলের বাগান, পিছনে আম আতা পেয়ারা নারকেল সুপারি গাছ সহ আরো নানান গাছপালা। ডানদিকে ছোট একটা জলাশয় ও কিছুটা ফাঁকা জায়গা চারদিকে উঁচু প্রাচীর, এই সবই আট কাঠা জমির ওপর কাছাকাছি আর কোন বসতি নেই। নির্জনতা ভেঙ্গে চলে নানান পাখপাখালি। সত্যিই প্রকৃতি যেন এখানে সেজে উঠছে তার নিজস্ব ছন্দে।
বীরেশ্বরবাবু সেসব ছেড়ে চলে যেতে পারলেই যেন মুক্তি পান। আর এত অল্প মূল্যে এই বাড়ি সম্পত্তি তিনি বিক্রি করবেন, তা ভাবেনি দেবেশ। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় দেবেশ। এবাড়ি কোনমতে হাতছাড়া করতে চায় না। পুরনো বাড়িতে পড়েছে নতুন রঙের প্রলেপ, শুভদিনে নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হলো ধূমধাম করে। বিকেলে দোতলার বারান্দাটা বেশ লাগে। সূর্য ডোবে দুরের ঝোপে। সন্ধ্যে নামলে বদলে যায় সেই রূপ।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে যতদুর চোখ যায় ধোঁয়াশায় ঢাকা চারপাশ ভেসে আসে ট্রেনের শব্দ। নতুন জায়গায় নতুন বাড়িতে বেশ আনন্দেই কাটছিলো। কিন্তু সেদিনের এক ঘটনা যেন সব কিছু বদলে দিয়ে গেল। সেদিন ছিল এক পুর্ণিমার রাত, দিনটা ছিল শনিবার। কার্তিকের গা শিরশির করা হিম পড়া রাত। নীচের ঘরে টিভি দেখছিল দেবেশ। পাশের ঘরে বাবা ছিল গল্পের বই নিয়ে। পিয়াঙ্কা, অরিত্র পড়া শেষ করে বাবার ঘরে। দীপা রান্না ঘরে ব্যস্ত, রাত তখন এগারোটা ছুঁই ছুঁই। কি একটা দরকারে দোতলার ঘরে গিয়েছিলো দীপা, হঠাৎই এক ভয়ার্ত চীৎকারে কেঁপে উঠল সারা বাড়ি। মনে হলো দীপা চীৎকার করতে করতে ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে নীচে পড়ছে। কি হল, কি হল! হতবাক সকলে। হুড়মুড়িয়ে দেবেশ সহ সবাই উপরে উঠতে থাকে।
দেবেশ দেখে দীপা বারান্দায় পড়ে জ্ঞান হারিয়েছে। চোখে মুখে জলের ঝাপটায় একসময় জ্ঞান ফেরে। দীপার চোখে মুখে একরাশ ভয় আতঙ্ক। কেটে গেছে অনেকটা সময়। খাওয়া দাওয়ার পর বাবা জিজ্ঞেস করে , “কি হয়েছিল বউমা? কেন এভাবে ভয় পেলে?”
দীপার চোখে মুখে তখনো ভয় কাটেনি। কাঁপা গলায় দীপা যা বলল তা সত্যিই ভয় পাওয়ার বিষয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দায় তাকাতেই দেখতে পায় অদ্ভুত এক ছায়া মূর্তি। সারা শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা, মাথা শরীরের তুলনায় বড়। নাড়ছে লম্বা দুটো হাত।
দীপার এই বর্ণনায় খানিক হেসেই দেবেশ বলে, “ও তোমার দেখার ভুল। ভূত টুত বলে কিছু হয় না।“ বাবাও সাহস দিয়ে বলে, “হাঁ বউমা, এ তোমার মনেরই ভুল।“ কিন্তু এসব বলার মাঝেই কোথায় যেন একটা সংশয় উদ্বেগ থেকেই গেল। বাবা সেকেলে মানুষ, মুখে মনের ভুল বললেও ভৌতিক দিকটাও উড়িয়ে দিতে পারলো না। পরদিন বাবা চাপা গলায় বলল, “বলি কি খোকা, এই বাড়িটা নিয়ে একটু খোঁজ খবর নে। একটা জ্যোতিষ ডেকে বাস্তুটা গণনা করা। বীরেশ্বর বাবুর স্ত্রী ছেলে যখন এ বাড়িতেই মারা গেছে তখন আতঙ্ক তো একটা থাকেই। তাছাড়া বউমা যখন এতটা ভয় পেয়েছে তখন কিছু ঘটনা তো আছে।“
দেবেশ মনে মনে বোঝে বাবাও ভয় পেয়েছে। তাই বাবাকে শান্তনা দিয়ে বলে, “ঠিক আছে বাবা, বীরেশ্বর বাবুকে ফোন করে দেখবো।“
আর সেদিনের ঘটনার পর থেকে সন্ধ্যে হলেই ওপরের বারান্দাটা হয়ে উঠেছে আতঙ্কের। ওপরে উঠতেই গায়ে কাঁটা দেয়। দেবেশ সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে পুরো ভয়টাই মনের। কোন কাজই হচ্ছে না। সারাদিন কাটলেও সন্ধ্যে হলেই ভয়টা দানা বাঁধে। আর সে রাতের দৃশ্যটা ভাবলে আতঙ্কে গুটিয়ে নেয় দীপা। ভর দুপুর বেলা ওপরে উঠতেও গা ছমছম করে তার।
এই ক’দিনে নতুন বাড়ির সেই উচ্ছাস আনন্দ উবে গেছে। বাড়ি জুড়ে একটা থমথমে ভয়ের পরিবেশ। এ যেন কোন ভুতুড়ে বাড়ি। দেবেশ নানা ভাবে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেও, তার কথায় সাহসী হতে পারছে না কেউই। প্রত্যেকেরই একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে বাড়িতে কোন অশরীরির অস্তিত্ব আছে। গভীর রাতে আরো কিছু শব্দ শুনেছে বাবাও। দেবেশের চিন্তা বাড়ে, শেষমেশ কি এ বাড়ি বিক্রি করতে হবে! বাবা দীপা ইতিমধ্যেই বলাবলি শুরু করেছে, অশরীরীর বিষয়টা টের পেয়েই বীরেশ্বরবাবু তড়িঘড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ছেলে মেয়েদের মধ্যেও হারিয়েছে সেই চঞ্চলতা। বাড়ির কোথাও একা চলাফেরা করতেও তাদের তৈরি হয়েছে আতঙ্ক।
হাজার কাজের মাঝে বাড়ির চিন্তাটাই মাথায় ঘুরছে দেবেশের। কতদিন আর বুকে ভয় নিয়ে থাকা যায়। সে জানে মনে একবার ভুতের ভয় বাসা বাঁধলে তা দুর করা মুশকিল। তাই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আর একটু ভাবতে হবে। সে যদি একবার সেই অদ্ভুত চেহারার ছায়ামূর্তির মুখোমুখি হতে পারত। শুনেছে, অশরীরী সবাইকে দেখা দেয় না।
সে রাতটাও ছিল এক পূর্ণিমার, পৌষের বিস্তৃর্ণ চারপাশে কে যেন রূপো গলিয়ে ঢেলে দিয়ে গেছে। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। দীপা, অরিত্র - পিয়াঙ্কাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে, বাবা পাশের ঘরে।
উঠে বসে
সে শুনশান রাত, টুপটাপ শব্দে শিশির পড়ছে কোথাও।
হাওয়ায় পাতার ঘর্ষণের শব্দ যেন কেউ কথা বলছে ফিসফিস শব্দে। কোন এক রাত প্রাণী
ডেকে উঠলো দুরে কোথাও। মোবাইলে সময়টা দেখলো সে রাত একটা কুড়ি। সুপ্ত ভয়টাকে
মনের মধ্যে পশ্রয় না দিয়ে শক্ত করে। সে রাতের দৃশ্যপট দেখতে চায় সে নিজে। মনে
মনে প্রার্থনা করে অশরীরি দেখা
দাও। চুপি চুপি দরজা খুলে দালানে আসে। আবছা আলোয় সিড়ি দিয়ে ওপরে ঊঠতে থাকে, বাকি রাতটা বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেবে। উঠতে উঠতে হঠাৎই দমকা একটা ঠান্ডা
হাওয়া সারা শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় সে। ওপর ঘরের দরজা
খুলে ভেতরে ঢোকে,পশ্চিম দিকের জানলাটা খুললেই
দেখা যাবে বারান্দাটা। কান পাতে কোনও দিক থেকে কোনও
শব্দ আসছে কিনা। বন্ধ জানলায় মাথা ঠেকিয়ে কিছু শুনতে চেষ্টা করে। হালকা কিছুর
একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎই কিসের ছপছপ শব্দ, না আর অপেক্ষা করে না দেবেশ মনে সাহস এনে খুলে দেয় জানলাটা। সাদা জ্যোৎস্নায়
ভরে আছে বারান্দা, এরপর হঠাৎই চমকে ওঠে সে ,হ্যাঁ ওই সেই ছায়ামূর্তি। হুবহু মিলে যাচ্ছে দীপার দেওয়া
বর্ণনা।
কালো মূর্তিটা খানিকটা দেওয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ ভালো করে লক্ষ্য করে, একসময় হো হো হেসে উঠে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। বারান্দার প্রায় ধার ঘেঁষে উঠে গেছে দোতলা সমান সুপারি গাছ , ঝুলে পড়েছে তার শুকনো পাতা। হাওয়ায় সেই পাতা নড়ছে অনেকটা হাতের মত, লম্বা শরীরে গোল ঝোপানো মাথাটাও দুলছে হাওয়ার ছন্দে। হঠাৎ দেখলে কার না ভয় লাগে !
আর সেই
ছায়া মূর্তির রহস্য
উদঘাটন হওয়ায় চীৎকার করে সকলকে ডেকে ওঠে দেবেশ, “দীপা বাবা
বারান্দায় এসো দেখে যাও।“
সে রাতে সবাই দেখলো সেই ছায়া। এতদিন ভয় পেয়ে এসেছে সবাই, অথচ ভাবেনি কেউ সুপারি গাছটার কথা। বাবা রেগে গিয়ে বলল, “ওই গাছটাই আমাদের ভয় ধরিয়েছে। কালই কাউকে ডেকে কাটার ব্যবস্থা কর খোকা।“
দেবেশ বলে, “না বাবা, ও আমাদের বারান্দায় ছায়া হয়েই থাকুক।“
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন