শুধাময়ীর পুতুল - স্বপন বিশ্বাস



শুধাময়ী পুতুল নিয়ে খেলে। ঝিনুক দিয়ে আমের গুটি কেটে খাওয়ার বয়স হয়নি তবু তার ছুরির শখ। মা বলেছে চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় কিনে দেবে। মেয়ের তর সইছে না। তার আজই চায়। এখনি চায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। যতটা না চোখ গলে তার চেয়ে দু’হাতে ডলে বেশি। অগত্যা পারুলের কোলে দিয়ে কামার বাড়ী পাঠাতে হয়।


- ও পারুল, গনেশকে বলিস ছুরিতে যেন ধার না দেয়। মেয়ের যেন হাত না কাটে।


বৌদিমনি পারুলকে ডেকে বলে দেয়। বৌদিমনি মানে শুধাময়ীর মা। সবাই যাকে বৌদিমনি বলে ডাকে। পারুল মেয়েটা বেশ বোকাসোকা। উত্তর অঞ্চলের দিকে বাড়ী ছিল। ওর স্বামী হারাণ যে গৃহস্থের বাড়ীতে কাজ করত তার গরু হারাল। হারাণ গরু খুঁজতে খুঁজতে মহাদেবপুর হাটে এল। এখন যার নতুন নাম হয়েছে মহাম্মদপুর হাট। সেখানেই দা’ঠাকুরের সাথে দেখা। দা’ঠাকুর সবকিছু শুনে বলল, এক মাস আগে তোমার গরু হারিয়েছ আর এখনও তুমি হাটে হাটে ঘুরে মরছ? মানুষ হলেও কথা ছিল, খোঁজ পেলে টাকা পয়সা দিয়ে ছাড়ানো যেত। তোমার গরু কি আর আস্ত আছে? সে এতো দিন ছুরির নিচে চলে গেছে। যার যা গতি। বেচারা হারাণ দা’ঠাকুরের কাছে কেঁদে পড়ল। গরু না পেলে যে আমায় কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেবে। নতুন বিয়ে করেছি বউকে খাওয়াবো কি? দা’ঠাকুরের দয়ার শরীর। বলল, কাঁদছিস কেন? বউ নিয়ে চলে আয়। আমার জমিতে ঘর তুলে থাকবি। আমার বাড়ীতেই দু’জন মিলে কাজ করবি। সেই থেকেই হারু আর পারু দুজনেই এ বাড়ীতে আছে। এক ঘর পড়শি বেড়েছে। দেশ ভাগের পরে সুড় সুড় করে পাড়ার লোক সব ওপারে পাড়ি জমিয়েছে।


ধীরেন মন্ডল মানে শুধাময়ীর দা’ঠাকুর এখন এই ভাবে পাড়ায় বসতির সংখ্যা বাড়াচ্ছে। ধীরেন মন্ডল প্রভাবশালী মানুষ। এক সময় হাঁক দিলে একশ’ লাঠি বের হত। হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না। যোগেন মন্ডল তখন তাদের নেতা, দেশের মন্ত্রী। তার কথাতেই ধীরেন মন্ডলরা দেশ ছাড়েন। শরনার্থীর জীবন দুর্গতি আর অসম্মানের জীবন। তাই সম্মান নিয়ে বাঁচার জন্যই যোগেন মন্ডল লোকজনকে দেশ ছাড়তে নিষেধ করেছিল। কয়েক বছর যেতে না যেতেই যোগেন মন্ডল নিজেই লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। দেশ ভাগের পর ভিতরে ভিতরে যে তুষের আগুন জ্বলছিল তিন বছরের মাথায় এসে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সারা দেশে। তবে দাঙ্গার সময় সব মানুষ তো আর খারাপ হয় না। ধীরেন মন্ডলের শ্বশুর বাড়ী ছিল বরিশালে জেলার আগরপুর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণদিয়া গ্রামে। সুধাময়ীর ঠাকুমা আন্নাকালী তখন ছোটবোনের আঁতুড় সারতে বাপের বাড়ী । আশেপাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার হিন্দুরা এসে আশ্রয় নেয় সেখানে। ধীরেন মন্ডলের বিশেষ বন্ধু আলতাফউদ্দীন মোহাম্মদ নামে একজন মুসলমান, যিনি বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি তার দলবল নিয়ে পাহারা বসান। নিজের বন্দুক থেকে গুলি ছোড়েন দাঙ্গাকারীদের দিকে তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। হাজার হাজার আশ্রিত মানুষের সাথে আলতাফউদ্দীন নিজেও নিহত হন। তারপর থেকেই ধীরেন মন্ডল বিপত্নিক। আন্নাকালীসহ শ্বশুর বাড়ীর কারোরই কোন হদিস পাওয়া যায়নি। শুধাময়ীর বাবা কানুবাবুর তখন সবে কলেজ পাশ করে খুলনা শিপইয়ার্ডে নতুন চাকরি । সে বছর ধীরেন মন্ডলের গ্রাম রামনগর, এখন যার নতুন নাম হয়েছে আমনগর, সেখান থেকে অনেক লোকজন দেশ ছেড়েছে। লোকজন কমতে কমতে গ্রামটা একেবারে কামার-কুমোর ধোপা নাপিত শূন্য হয়ে গিয়েছিল। এখন এখান ওখান থেকে দু’এক ঘর ছিন্নমূল মানুষ এসে বসায় পাড়ার খাঁ খাঁ ভাবটা একটু কমেছে।


গনেশ কামারও এ গ্রামে নতুন। আগে যেখানে বাস করত সেখানে লোকজনকে বড় বড় তরবারি ফলা বর্শা বানিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে গ্রাম থেকে তুলে দিয়েছিল। গনেশ বলে, পঞ্চাশের রায়টের সময় সবাই আমার বানানো অস্ত্র দিয়েই আমাদের মারতে আসে। আমি আর মানুষ মারা অস্ত্র বানাব না। লাঙ্গলের ফাল বানাব, ধান কাটা কাঁচি বানাব। দরকার হলে খোন্তা কোদাল বানাব। কিন্তু ছুরি চাকু তরবারী বানাব না। তারপর থেকে গনেশ কামারও এই গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামে বাস করতে গেলে ঠাকুর নাপিত ধোপা মুচি সবই লাগে। এক সময় সবকিছু দিয়েই গ্রামটা সাজানো ছিল। এখন হারাতে হারাতে সবই হারিয়ে যাচ্ছে। জাত ধর্মও সব উঠে যাচ্ছে। এখন কে চুল কাটে আর কে জুতা সেলাই করে তার কোন ঠিক নেই। শোনা যায় শহরে নাকি এখন গৃহস্থ ঘরের ছেলে বউরা মেথরের চাকরি পর্যন্ত নিচ্ছে।


পারুল গনেশ কামারের চালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শুধাময়ীকে কোল থেকে নামিয়ে দুজনের পরনের শাড়ী ঠিক করে নিল। গনেশ কামার তখন হাপর টানা বন্ধ করে একটা লাঙ্গলের ফাল আগুন থেকে তুলে রেলের ওপর সাঁড়াশি দিয়ে ধরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। একবার গনেশ মারে তো আরেকবার নিমাই মারে। নিমাই গনেশের ছেলে। বাপ বেটায় হাতুড়িতে বেশ তাল তুলেছিল। হঠাৎ অসম বয়সের দুই মেয়েকে দেখে হাতুড়ি পেটা বন্ধ করে।


- কি চাইগো মা সগল?

- ছুরি। পারুল উত্তর দেয়।

- ছুরিতো আমি বানাই নে।

- বানাইনি বললি হবে? শুধাময়ীর ছুরি। বৌদিমনি পাঠিয়েচে। দেখ বাপু, ছুরিতে ধার যেন না হয়। মেয়ের যেন হাত না কাটে।

- কলার ছাড়া জামা বানাব কি ভাবে বাপু। গনেশ হাসতে হাসতে উত্তর দিল।

- জামা না। জামা না। আম কাটা ছুরি। শুধা আর পারু দুজনেই চেঁচিয়ে ওঠে।

- ওই একই কথা। কলার ছাড়া যেমুন জামা হয় না তেমুন ধার ছাড়া কি ছুরি হয়?

- অতশত বুজিনে, বৌদিমনি পাটিয়েচে শুধাময়ীর আম কাটা ছুরি। হাত যেন না কাটে।

- আচ্ছা মা সগল, বাড়ীর ভেতরে গিয়ে বস। আমি হাতের কাজটা শেষ করে আসি।

কামার বাড়ীর ভেতরে ঢুকতেই দেখে বারান্দায় একজন মাঝ বয়সী লোক শুয়ে আছে। মাথায় চুলের ঝুঁটি, মুখ দাঁড়ি গোঁফে ঢাকা। হাতে লোহার বালা। পাশে একটা একতারা। পারু দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কে গা তুমি? তোমারে তো এ গাঁয়ে আগে কখনও দেখিনি।

কামার বউ উত্তর দেয়, ও ভিন গাঁ’র মানুষ, বোরগী। তারপর পারুর কানের কাছে মুখ এনে বলে, বোরগীর বউ হারাইচে। তাই বউ খুঁজতে এয়েচে। কথাটা শুধাময়ীর কানে যেতেই হেসে আট খানা। বলে, বউ আবার কারও হারায়? বউ কি পুতুল, যে কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে? কামার বউ শুনে বলে, হারায় রে মা হারায়। মেয়ে হয়ে জন্মেচ এদেশে, বড় হও সব জানতি পারবা।

- তো, কোন খোঁজ পেয়েচ? কে নিল, কোতায় গেল? পারু কামার বউকে জিজ্ঞাসা করে।

- খোঁজ পেয়েই তো এয়েচে এ গাঁয়ে। ও পাড়ার সুলতান কবিরাজের বাড়ী আচে। কবিরাজের শালা বোষ্টমীকে তুলে নিয়ে এয়েচে। ওই বেটার ঘরে আরও দুটো বউ আচে। কবিরাজরা হল ডাকাত মানুষ। এখন কে যাবে ওই বোষ্টমীরে উদ্ধার করতে?

- তো, ধীরেন কাকারে যেয়ে বলুক। কাকা যদি কিচু করতি পারে।

- সেই কতাই তো কচ্চি। যে যাও, বৌদিমনিরে গিয়ে ধর। সে যদি ধীরেন কাকারে বুজয়ে বলে তো সে নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা নেবে। কবিরাজরা শুনলে একমাত্র ধীরেন মন্ডলের কথাই শুনতি পারে। আর কাউরে বলে তো কোন লাভ নেই। সকাল থেকে গুতচ্চি যাও যাও। তা না, মন মরা হয়ে শুয়ে আচে। পারু, তুই একটু বোরগীরে সাথে করে নিয়ে যা তো বৌদিমনির কাচে।

শুধাময়ী তখন চিৎকার দেয়, আমার ছুরি? আমার ছুরি বানায়ে দেও আগে। গনেশ কামার কাজ ফেলে উঠে আসে। ঘর থেকে একটা পুতুল নিয়ে এসে শুধাময়ীর হাতে দিয়ে বলে, ভালো ছুরি বানাতে তো সময় লাগে। এখন এই পুতুলডা নিয়ে যেয়ে খেল। ছুরি বানানো শেষ হলে আমি গিয়ে দিয়ে আসব। শুধাময়ী পুতুল পেয়ে মহাখুশি। বলে, ওর বউকি এই পুতুলডার মতো সুন্দর? ওর বউয়ের কি এমন শাড়ী পরা ছিল? কামার বউ বলে, হ্যাঁ গো হ্যাঁ, বউ তো শাড়ী পরাই ছিল। ওই পুতুলের মতোই সুন্দর বলেই তো পোড়ামুখীর মুখ পুড়ল। শুধাময়ী বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করে, বউডা কি আগুন নিয়ে খেলা করত যে ওর মুখ পুড়ে গেল? কামার বউ বলে, মা রে, মেয়ি মানুষ পরের হাতে গেলি কি আর মুখ থাকে। মুখ যে আমাদের সবারই পুড়েচে। এসব কথার মানে হয়তো শুধাময়ী বোঝে না। তবে তার খুব রাগ হয়। বলে, চোরডা তো খুব পচা। বাউ চুরি করেচে, শাড়ী চুরি করেচে আবার মুখও পুডায়চে। আমি এখনি দা’ঠাকুরকে বলব চোরডারে ধরে পিটু দিতে।

বোরগীর নাম নিতাই। পারুর সাথে এসে সরাসরি ধীরেন মন্ডলের সাথেই কথা বলে। সে সব কিছু শুনে বলল, দেখ বাপু সময় পাল্টেচে। এখন তো কেউ কারো কথা শোনে না। তবু তুমি যখন বলচ চেষ্টা করে দেখব। তা তোমার বউ কি তোমার সাথে থাকতে চায় নাকি নিজের ইচ্ছায় ওই লোকটার সাথে গেছে। কি যেন নাম বললে লোকটার?

- কর্তা মশাই, ওর নাম রহিম। ডাকু ধরণের মানুষ। দিনে দুপুরে খুন খারাপি করতি পারে। সে বলেচ, আমার বোষ্টমি যদি তার সাথে না যায় তো সে আমারে খুন করবে। এখন তো এসব কতই হচ্ছে। ছেলেরে খুন করবে, স্বামীরে খুন করবে, এই সব ভয় দেখায়ে বাড়ী থেকে বউ ঝিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ভোলা নোয়াখালির ওদিকে নাকি রাতে নিয়ে যায় আবার সকালে ফেরত দিয়ে যায়।

- তা হলে তুমি বোষ্টমীরে ফেরত পেলেও তো তোমার গাঁয়ে ফিরে যেতে পারবে না।

- আপনি যদি একটু আশ্রয় দেন তো এখানেই থেকে যাব। না হলে ইন্ডিয়া চলে যাব। গ্রামে আর ফিরে যাব না ।

ধীরেন মন্ডল আনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত রেণু বোষ্টমীকে সুলতান কবিরাজের বাড়ী থেকে উদ্ধার করে। গ্রামে আরেক ঘর মানুষ বাড়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বোরগীর বাড়ীতে কীর্তনের আসর বসে। সেখানে হিন্দু মুসলমান অনেকেই আসে। যদিও সবার উদ্দেশ্য এক নয়। কেউ আসে সময় কাটাতে। কেউ আসে পান তামাক খেতে। কেউ আসে সুন্দরী বোষ্টমীর সাথে একটু রঙ-তামাশা করতে। শুধাময়ী আর পারু তার নিয়মিত শ্রোতা। শুধাময়ীর জন্য একটি করতাল কেনা হয়েছে। গানের তালে তালে সে করতাল বাজায়। মাঝে মাঝে গানের সাথে গলা মেলায়। তারপর এক সময় পারুর কোলে ঘুমিয়ে গেলে বাড়ী ফিরে আসে। ভোরে রেণু বোষ্টমী প্রভাতফেরী করে।


রাই জাগো রাই জাগো

শুকশারী বলে

কত নিদ্রা যাও গো রাধে

শ্যাম নাগরের কোলে

শুকশারীর রব শুনি

জাগিলো রাই বিনোদিনী

আপনি জাগিয়া রাই

কানুরে জাগাইলে।




এই পর্যন্ত গাওয়া পর বোষ্টমী শুধাময়ীকে ডাকে। কই গো মা জননী ঘুম থেকে ওঠ। এই যে তোমার জন্য ফুল এনেছি গো। উঠে দেখ। শুধাময়ী তখন ঘুমে কাতর। বৌদিমনি বলে, ও রেণু ফুলের সাজি পূজোর ঘরের বারান্দায় রেখে যা। ও বেলা এসে চাল ডাল নিয়ে যাস। বোষ্টমী গানের বাকি অংশ গাইতে গাইতে অন্য বাড়ীর পথে পা বাড়ায়।


নিদ্রার আবেশে রাধে

ঢুলুঢুলু করে

হেলিয়া ঢলিয়া পড়ে

শ্যাম নাগরের কোলে

শুক বলে ওগো শারী

কি কার্য করিলে

তমালে কনকলতা

কেন ছাড়াইলে।




ঘুম থেকে উঠে বৌদিমনি সেই গানের সাথে গলা মেলায় আর শ্যাম নাগরের কথা ভেবে নিজের স্বামীর জন্য ব্যাকুল হয়। কোন কোন দিন বোষ্টমী আসার আগে ঘুম ভেঙে গেলে নিজেই গুনগুন করে গাইতে থাকে, ‘হেলিয়া ঢলিয়া পড়ে শ্যাম নাগরের কোলে ....। আর ভাবে, ইস্ এখন যদি শুধাময়ীর বাবা বাড়ী ফিরে আসত।

একদিন ভোরে শুধাময়ীর বাবা কানুবাবু সত্যি সত্যি বাড়ী ফিরে এল। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা। পোশাকে কাদা মাটি লেগে আছে। সেদিন রেণু বোষ্টমী আর গান গাইতে এল না। বেলা বাড়লে পারু হন্তদন্ত হয়ে খবর নিয়ে এল, রেণু বোষ্টমীকে সুলতান কবিরাজের লোকজন তুলে নিয়ে গেছে। তখন ধীরেন মন্ডল আর কানুবাবু বাবা-ছেলে ঘরে বসে কি যেন শলা পরামর্শ করছিল। বৌদিমনি ঘরে ছুটে গিয়ে বলল, শুনেছেন বাবা? কথা শেষ না হতেই ধীরেন মন্ডল বলল, শুনেছি মা, দেখছি কি করা যায়। কানুবাবু বলল, কিছু দেখার নেই বাবা। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। যত তাড়াতাড়ি পার গুছিয়ে নাও। আমাদের আজই রওনা হতে হবে। কথা শুনে বৌদিমনি কানুবাবুর পাশেই বসে পড়ে । বাবা-ছেলের আলোচনা শুনে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে।




কয়েকদিন আগে ভারতের এক দরগাশরীফে রাখা হজরত মুহাম্মদের চুল চুরি হয়ে গেছে। সেই নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয়েছে ভারতে আর তা ছড়িয়ে পড়েছে পূর্ব পাকিস্থানের বিভিন্ন জেলায়। কানুবাবু খুলনা শিপইয়ার্ডে যেখানে কাজ করে সেখানে শত শত মানুষ খুন হয়েছে। সে কোন রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে। ঢাকা নোয়াখালী ভোলা সর্বত্র দাঙ্গা চলছে। রাজশাহীতে ট্রেন থামিয়ে শত শত মানুষকে মারা হয়েছে। ধীরেন মন্ডল বিমর্ষ হয়ে বললেন, জমিদার খানচৌধুরীর সাথে একবার কথা বলে দেখি সে কি বলে। শুনে দেখ, তবে কোন ফল হবে না। ভরসা করাও ঠিক হবে না। এখন তো আর তার সেই জমিদারিও নেই। সেই দাপটও নেই। তাছাড়া তাদের নেতা সবুর খান সাহেবই তো এই দাঙ্গার মূল হোতা।


ধীরেন মন্ডল যখন জমিদার খানচৌধুরীর বাড়ী পৌঁছাল তখন তিনি সবে মাত্র সবুর খানের ভাইয়ের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছেন। খুব ক্লান্ত আর চিন্তিত চেহারা নিয়ে বললেন, এতদিন আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে মিলেমিশে ছিলাম। এবার বুঝি তা আর সম্ভব হবে না। স্বয়ং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান সাহেব ঘোষণা করেছেন, হজরতবাল ঘটনার কারণে পাকিস্তানের মুসলিমরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালে তার কোন দায় নেই। সেখানে আমার কথা কে শুনবে বল? ইসলামিক বোর্ডের উপদেষ্টা আব্দুল হাই সাহেব তো রীতিমত জিহাদের ডাক দিয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে মোনায়েম খান, সবুর খান সবার সাথেই কথা হল। কেউ কোন দায়িত্ব নিতে রাজী না। আমার মনে হয় কোন নিরাপদ জায়গা দেখে কিছুদিনের জন্য তোমাদের সরে যাওয়া উচিত।

ধীরেন মন্ডল বিমর্ষ হয়ে ফিরে এসে ছেলে-ছেলেবৌকে সব কথা খুলে বললেন। মাঝি পাড়ায় নরেন মাঝিকে খবর দেয়া হল। তার দুটো বড় নৌকা আছে। এসময় নদীপথই কিছুটা নিরাপদ বলে মনে হল। সন্ধ্যায় তুলসি তলায় প্রদীপ দেয়া হল। অন্ধকার ঘন হলে নৌকার বৈঠা গাঙের জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলল। সেই শব্দে শুধাময়ীর কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। বুঝতে পারল তারা নৌকায় করে কোথাও যাচ্ছে। চোখ খুলে বলল, আমার পুতুল? কানুবাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, কৃষ্ণনগরে অনেক সুন্দর সুন্দর পুতুল পাওয়া যায়। তোমাকে নতুন পুতুল কিনে দেব। শুধাময়ী মায়ের বুকের মাঝে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নৌকা তখন মাঝ গাঙ ধরে এগিয়ে চলেছে। ঘন অন্ধকার নদীতে দূরে দুয়েকটা মিটি মিটি আলো দেখা যাচ্ছে।



                                                                    

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন