শ্যামা - শ্রীমতি সুপ্রিয়া গঙ্গোপাধ্যায়


 

বেলেঘাটা মেন রোড ধরে এগোচ্ছিলাম। ফুটপাথে একটি বৃত্তাকারে গাঁথা বৃক্ষধারকের উপরে স্থিত গাছটির তলায় শায়িতা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা শ্যামা। কালো আর লাল চুলে নিম্নস্তরের বাঁধুনিতে হর্স-টেল। যানবাহন আর লোকালয়ের দিকে পিছন ফিরে শুয়ে আছে। মুখশ্রী আন্দাজ করবার উপায় নেই। বয়স এই তেরো থেকে ষোলো হবে,বোধহয়। সালোয়ারের  অবস্থা আগাগোড়া ফর্দাফাই। দিবালোকে অনেক পথচারী লজ্জায় চোখ সরাচ্ছে। আমার মায়া লাগে। ওর ঘর কোথায়? ওর বাবা-মা, অভিভাবক ...! ওর জীবিকা! পড়াশোনা কি করত কখনও!


শুরু হল খোঁজ-খবর। পাশেই ফুল বিক্রি করে মালিয়ামাসীতারই বোনঝি। মালিয়ার বোন মারিয়ার সন্তান না হওয়ার কারণে বিয়ের বছর পাঁচেকের মাথায় তার স্বামী স্মিথ তাকে ছেড়ে পালায়। এরপর মারিয়া কাজ নেয় বাবুদের বাড়িতে


পরদিন কাজের বাড়িতে বিশাল ককটেল পার্টি। মালকিন মারিয়াকে ভালো পোশাক দিয়েছিলেন পার্টিতে পরে আসবার জন্য। খুবই আনন্দে দিন কাটতে লাগল। কিছুদিন পর ধীরে ধীরে মাতৃত্বের চিহ্ন ফুটে উঠতে থাকে মারিয়ার মধ্যে। অন্তঃসত্বা হল সে। কাজটি চলে গেল। এই মালিয়া তখন তাকে আশ্রয় দেয়। নিজের বোনের মতন দেখে। যত্ন করে। জন্ম নিল শ্যামা। গায়ের রং ফর্সা হলে নাম হত দুর্গা! এক বছরের শিশুটিকে ভালোভাবে মানুষ করবার ইচ্ছেয় এক অনাথ আশ্রমে দিল তারা। মালিয়ামাসীর সঙ্গে গিয়ে প্রথম প্রথম মারিয়া দেখা করত তার মেয়ের সঙ্গে


বছর আস্টেক বয়সে শ্যামা আশ্রম ছেড়ে পালিয়ে আসে তার মায়ের কাছে। সে নাম লিখতে জানে; টাকা পয়সা চেনে। কিন্তু তত দিনে তার মা গালে চড়া করে রুজ লাগিয়ে পটের বিবি সেজে দাড়িয়ে থাকে সাঁঝের আঁধারে  আহিরীটোলার আশে পাশে। মেয়েকে বলে,' আর চার বছর পর তোকে আমার কোম্পানিতে কাজে লাগিয়ে দেব। এখন  যা বাবুর বাড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছিমন দিয়ে কাজ কর।' চেনা এক বাবুর কাছেই দিল। ভালই কাজ করছিল। বাধ সাধল যেদিন বাবুর শ্যালক আর তার স্ত্রী এলেন তাদের আয়নাকে নিয়ে। আয়নার সঙ্গে এই শ্যামার চেহারা ও বয়সের এতটাই নৈকট্য যে তাদেরকে যমজ বললেও অত্যুক্তি হয় না। শুধু পড়াশোনায় তফাৎ। আয়না পড়ে সেন্ট কুইন্সে,আর শ্যামা মূর্খ।আয়না তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। মজা করে মিলিয়ে ওকে 'চায়না' বলে  ডাকে। গৃহকর্ত্রী তো রণরঙ্গিনী ! ' ব্যাপারখানা কি ?' 


ছলে বলে দুর দুর করে তাড়ালেন চায়না ওরফে শ্যামাকে। সেই থেকে মালিয়ামাসীর ফুলের ব্যাগের পাশে ঐ উচুঁ জায়গাটায় শোয়। আশেপাশে রাস্তার কিছু ঘেঁয়ো সারমেয়কেও শুতে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। মায়ের কাছে যাবার জন্যে আবদার করে চায়না। মালিয়া এই পাতানো বোনঝিটাকে ফেলতেও পারে না। ওর মাও তাকে কাছে নেবার ঝুঁকি নেয় না। এমনকি, এতটাই ব্যস্ত যে মেয়ের সঙ্গে দেখাটুকু পর্যন্ত করতে চায় না মারিয়া। নিজের সাজ - সজ্জা, কাজ আর মেকি ফুর্তি নিয়ে সদাব্যস্ত শ্যামার পার্থিব জননী। কিন্তু বয়স তো থেমে নেই


শ্যামা এখন ষোড়শী। ওর মায়ের জায়গা ওকে নিতে হচ্ছে। তবে ওর জীবিকার কেন্দ্রস্থল চলমান। আজ এখানে, কাল সেখানে,পরশু দীঘা, পরের দিন দিল্লী, আবার কলকাতায় মালিয়ামাসীর ডেরায়


কিন্তু ওর পরনের জামাকাপড় এমন শতচ্ছিন্ন হল কি করে! গতরাত্রে কি ফুটপাথের নেড়ি কুত্তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির কারণে নিদ্রা যাবার ফুরসৎ মেলেনি ওর! তাই এই বেলা সাড়ে দশটা পর্যন্ত ঘুমে অচেতন,অবিন্যস্ত!


'পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে' সংলগ্ন নগরের নন্দিনীর এই করুণ অবস্থা কাম্য নয়। রাশি রাশি অপবিত্রকে ব্যবহার্য করে তুলেছেন মা তাঁর পুণ্য ছোঁয়ায়। শ্রীরামচন্দ্র প্রবর্তিত অকালবোধনের দেবী দুর্গার আশীষ ঝরে পড়ুক এরূপ ষোড়শীদের উপর। গঙ্গা মাইয়া ও মা দুর্গার ন্যায় মহীয়সী দেবীদের নজরে বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠানাদির আশ্বাসে শ্যামা হয়ে উঠুক পবিত্র,ব্যবহারিক,শ্যামলী-  সম্পূর্ণা।






 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন