সন্তানের খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে প্রত্যেক অভিভাবকই সর্বদা সজাগ থাকেন। কোন খাবারে বাচ্চার যথাযথ ওজন বৃদ্ধি হবে, কোনটা খেলে বাচ্চা উপযুক্ত পুষ্টি পাবে, কোন খাবার মস্তিষ্কের বিকাশে অধিক সাহায্যকারী এসব বিষয়ে সদাসচেষ্ট তাঁরা। চিন্তার ব্যাপার তখনই হয়, যখন কোনো শিশু খাবারদাবারের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। শিশু বিশেষজ্ঞরা সবসময় বলেন, বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ানো একেবারেই অনুচিত। কিন্তু মায়ের মন মানতে চায় না। ফলস্বরূপ, বাচ্চার খাওয়া নিয়ে প্রতিদিন বাড়িতে প্রায় ছোটখাটো যুদ্ধ চলে বলা যায়। কিন্তু শিশুকে জোর করে খাওয়ানোর পরিবর্তে যদি তার খিদে বাড়ানোর উপায়গুলি অবলম্বন করা যায়, তাহলে আর এতো কাণ্ড করার প্রয়োজন পড়বে না। অনীহা ছেড়ে শিশু নিজেই খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখাবে।
খাবারের প্রতি শিশুদের বিরূপতার কারণ :
নিজেদের ছোটবেলার কথা মনে করুন। স্কুল থেকে ফেরার পর কোনরকমে নাকেমুখে গুঁজে দু'টো খেয়েই খেলার মাঠে ছুট। এখন আর সেসব দিনকাল কোথায়! ছুটোছুটি করে খেলার জায়গা দখল করে নিয়েছে বর্তমানের বিভিন্ন অ্যাপের গেম এবং অত্যাধুনিক ভিডিও গেম। শারীরিক সক্রিয়তার অভাবে খাবার হজম হতে চায় না, ফলে খিদে কমে যায়। পেট ভার থাকলে খেতে কারই বা ভালো লাগে!
একই পরিস্থিতি ছোট্ট শিশুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দৌড়াদৌড়ি করার পরিবর্তে তারা মোবাইল ফোনে কার্টুন ভিডিও দেখতে ব্যস্ত। শিশুদের খিদে না হওয়ার আরেকটি কারণ পরিবারের লোকজনদের অতিরিক্ত স্নেহ ভালোবাসা। সমস্যাটা সেখানেই, যখন বাড়ির বড়রা নিজেদের খাবার থেকে শিশুর মুখে টুকটাক খাবার দিতে থাকেন এবং শিশু সেগুলি খেয়ে নেয়। তাদের ছোট্ট পেট এতেই মোটামুটি ভরে যায়। এবার যখন তার জন্য আলাদা করে খাবার আনা হয়, সেটা আর সে খেতে চায় না। সেই নিয়ে সকলে চিন্তায় আকুল হয়ে যায় যে বাচ্চা খেতে চাইছে না কেন!
শিশু একটু বড় হলে তার মধ্যে যখন বোধবুদ্ধি জন্মায়, তখন অধিকাংশ সময় বাইরের লোকজন বা বন্ধুবান্ধবদের কথা শুনে সে নিজেই খাবারের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। সব বাচ্চার শারীরিক গঠন সমান হয় না। কেউ গঠনগত ভাবে একটু স্বাস্থ্যবান হলেই তার দিকে ধেয়ে আসে "মোটা / মুটকি", "হাতি", "হোঁৎকা" ইত্যাদি নানান ব্যাঁকা মন্তব্য। এর ফলে ইচ্ছে না থাকলেও বাচ্চারা খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দেয়।
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য শিশুদের ক্ষুধা বৃদ্ধি না হওয়ার অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়।
শিশুদের ক্ষুধা বৃদ্ধিতে করণীয় :
আমাদের সকলের দৈনন্দিন জীবনই রুটিনে চলে। ঠিক সেইভাবে শিশুদের খাওয়াদাওয়ারও একটি নির্দিষ্ট রুটিন থাকা বাঞ্ছনীয়। যখন তখন খাবার দেওয়ার কারণে যথাসময়ে তার খিদে পাবে না, আর পরিপূর্ণভাবে খিদে না পেলে শিশুরা খেতে চায় না।
শিশুকে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা অতি বড় ভুল। এর ফলে খাবারের প্রতি তার আগ্রহ কমে যাবে এবং ভীতি জন্মাবে।
শিশুর পছন্দসই খাবার বানানো একটা ভালো উপায়। প্রতিদিন একই ধরণের খাবার না দিয়ে খাদ্যতালিকায় ভিন্নতা আনতে হবে। বাইরের মুখরোচক খাবার সব বাচ্চা পছন্দ করে। সেইসব খাবার মাঝেমধ্যে বাড়িতেই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করে দিলে সে খাবারের প্রতি আগ্রহ পাবে।
সাধারণত দুই থেকে তিন বছর বয়সী বাচ্চাদের প্রত্যেক বেলায় খাবারের মাঝে দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিরতি থাকা উচিত। বিরতির এই সময়ে যদি অন্য কোনো খাবার সে না খায়, তবে যথাসময়ে তার ক্ষুধা লাগার কথা। তিন থেকে চার বছর বয়সীদের জন্য তিন থেকে চার ঘণ্টা বিরতিতে খাবার দেওয়া উচিত। এভাবে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিশোর বয়স পর্যন্ত প্রতিবেলা খাবারের মাঝের বিরতি একটু করে বাড়বে। এরপর বড়দের সঙ্গে তিন বেলা খাবারের অভ্যাস গড়ে উঠবে।
ভারী খাবার খাওয়ার অন্তত আধ ঘণ্টা আগে বাচ্চাকে জল খাইয়ে ফেলতে হবে। খেতে খেতে বারবার জল খেলে পেট ভরে যাওয়ায় সে আর মূল খাদ্যটি খেতে চাইবে না।
ভারী খাবার দিনে দু'বার খেলেও মাঝে ২-৩ বার হালকা ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য টিফিন বা স্ন্যাক্স হিসাবে বাচ্চাকে দেওয়া যায়। এতে মেটাবলিজম বাড়ে, হজম ভালো হয় এবং খিদেও বাড়ে। তবে এসব খাবার চিপস, জুস বা চকলেট হওয়া কোনোমতেই বাঞ্ছনীয় নয়। বরং দেওয়া যেতে পারে চীনাবাদাম। চীনাবাদাম মেটাবলিজম বাড়ায়। খাবার দ্রুত হজম হয় বলে বাচ্চার খিদেও পায়। এছাড়া বেদানা ও অ্যাভোক্যাডোর মতো ফল বা পিনাট বাটার স্যান্ডউইচ বা চিজ স্যান্ডউইচ দেওয়া যায়।
কিছু কিছু খাবার শিশুদের ক্ষুধা বৃদ্ধি করতে বেশ কার্যকরী। পূর্বে উল্লেখিত চীনাবাদাম এরকমই একটি খাদ্য। আবার মুরগির মাংসে জিঙ্কের পরিমাণ পর্যাপ্ত হওয়ায় এটি বাচ্চার খিদে বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও রয়েছে টক দই। এতে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও ভিটামিন বি থাকে যা বাচ্চার খিদে বাড়াতে ও খাবার হজম করতে সাহায্য করে। মেথি জল বা জোয়ান জল বাচ্চাদের খিদে বাড়ায়। পরোটাতেও ছড়িয়ে দেওয়া যায় জোয়ান। এর ফলে খেতে বেশ মুখরোচকও লাগবে।
খিদে বৃদ্ধি করার জন্য শুধুমাত্র খাবারদাবারের দিকে নজর দিলেই চলবে না। এর সাথে শারীরিক পরিশ্রমও জরুরী। বাচ্চাকে নিয়মিত একটু হলেও শরীরচর্চা করাতে হবে, খেলতে নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির কাছাকাছি কোনো মাঠ বা পার্ক না থাকলে কোনো খেলাধূলায় তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ভুললে চলবে না, শারীরিক পরিশ্রম হজমক্ষমতা ও পাচনক্রিয়া ঠিক রাখে।
উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়াও কোনো সংক্রমণে আক্রান্ত হলে শিশুর ক্ষুধামান্দ্য দেখা যায়। জ্বর, কাশি বা অন্য কোনো অসুখের কারণে তার খাদ্যগ্রহণের ইচ্ছা কমে যায়। সেক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুর দেখভাল করতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন