জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়... - ডঃ শ্রীময়ী চক্রবর্তী

 




গল্প হলেও বিজ্ঞান


ছোটবেলা থেকেই আমরা একটা কথা প্রায়ই শুনে এসেছি যে “truth is stranger than fiction”। তবুও আমরা আমাদের জীবনে অনেক সময়ই এমন বিভিন্ন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হই, যার যথার্থ কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা খুঁজে না পেয়ে ‘অতিপ্রাকৃত’ তকমা এঁটে দিই সহজেই। কল্পনা এবং বিজ্ঞানের মধ্যে থাকা সেই অদৃশ্য সীমারেখাটাকে আমরা নিজেদের অজান্তেই কখন যে মুছে দিলাম তার আর খেয়াল থাকে না। অথচ জাদুকরের ম্যাজিক নিঃসন্দেহে কি অন্য কোনো মানুষের সৃষ্টি বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন নয়? চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এমন অনেক ঘটনা আছে যার বৈজ্ঞানিক যুক্তি না খুঁজে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা এবং অন্ধ কুসংস্কারের নেপথ্যে লুকিয়ে রেখে কৃত্তিম এক রহস্যের বাতাবরণ তৈরী করার চেষ্টা চালানো হয়। এমনই একটি ঘটনা হলো ল্যাজারাস সিনড্রোম, যা অত্যন্ত বিরল অথচ সম্পূর্ণ যুক্তিগ্রাহ্য এবং বৈজ্ঞানিক।

ঘটনা ১:

জ্যানিনা কলকিউইজ (Janina Kolkiewicz), ৯১ বছরের বৃদ্ধা এক মহিলা। বেশকিছুক্ষণ হল তাঁর হৃদস্পন্দনের গতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ারও আর কোনো লক্ষণ অবশিষ্ট নেই। চিকিৎসকেরা অবশেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করে দিলেন। ৯১ বছরের দীর্ঘ জীবনের আজ অবসান ঘটলো। কিন্তু তখনও কে জানতো যে তাঁর আরও বেশ কিছু বছর জীবনের পথে চলা বাকি পরে আছে। ঠিক১১ ঘণ্টা বাদে হাসপাতালের মর্গে যখন উঠে বসলেন বৃদ্ধা, ক্ষিদেয় পেট তখন চুঁইচুঁই করছে। চা আর প্যান কেক খাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে এদিক ওদিক মানুষের সন্ধান করতে লাগলেন সবেমাত্র মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এই বৃদ্ধা।

ঘটনা ২:

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ২০০১ সালে। ৬৬ বছরের এক প্রৌঢ় ব্যাক্তির অপারেশন চলাকালীন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। ১৭ মিনিটের Cardiopulmonary resuscitation (CPR) এবং ওষুধ ও অন্যান্য নানা চেষ্টার পরে ব্যর্থ হয়ে চিকিৎসকেরা অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন এবং রোগীর যে মৃত্যু হয়েছে সে ব্যপারে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যান। কিন্তু ১০ মিনিট বাদে হটাৎই এক চিকিৎসক মৃত ব্যক্তির পালস্ অনুভব করেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত ব্যক্তি পুনরায় বেঁচে ওঠেন। শুধু তাই নয়, এর পর তার বাকি অপেরাশনটাও সাফল্যের সাথে সম্পন্ন হয়।

ঘটনা ৩:

২০১৪ সালে মিসিসিপিতে একটি হসপিসে ৭৮ বছরের এক বৃদ্ধের মৃত্যু ঘটে। একই ভাবে একদিন পরে হাসপাতালের মর্গ থেকে তাঁকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

ল্যাজারাস সিনড্রোম: মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনে ফিরে আসার গল্প

আমাদের সকলের প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা না থাকলেও, ইন্টারনেটের দৌলতে এরকম বেশ কিছু এমন তথাকথিত ‘অতিপ্রাকৃতিক’ ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে উপরের প্রতিটি ঘটনাকে যে কোনো ভৌতিক সিনেমার প্লট হিসাবে ব্যবহার করা যেতেই পরে। কিন্তু প্রতিটি ঘটনা যতটা বাস্তব ঠিক ততটাই বিজ্ঞানসম্মত, এবং একেই ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ল্যাজারাস সিনড্রোম (Lazarus syndrome) ।

ল্যাজারাস সিনড্রোম কে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায় “Delayed return of spontaneous circulation (ROSC) after CPR has ceased.”

অর্থাৎ, কোনো ব্যাক্তির কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে পুনরায় তা শুরু হওয়া। এর ফলে আপাত ভাবে "মৃত" ব্যক্তি পুনরুজ্জীবন লাভ করেন।ল্যাজারাস নামকরণটি হয়েছে বেথানির ল্যাজারাস এর নাম অনুসারে। বাইবেল অনুযায়ী যীশু খ্রিস্ট ল্যাজারাস এর মৃত্যুর ৪ দিন পরে তাঁর নতুন জীবন দান করেছিলেন।

১৯৮২ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রথম যখন "Lazarus syndrome" এই নতুন শব্দটি সংযোজিত হয়, ততদিনে অন্তত ৩৮টি নথিভুক্ত কেস সামনে আসে যেখানে রোগী ল্যাজারাস সিনড্রোমের প্রভাবে মৃত্যুর কিছু সময় বাদে আবার পুনরায় বেঁচে ওঠেন।

CPR বা cardio-pulmonary resuscitation একটি লাইফ সেভিং পদ্ধতি, যা কোনো রোগীর শ্বাস - প্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দনের গতি বন্ধ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক ভাবে শুরু করা হয়। রেসকিউ ব্রিদিং (rescue breathing) এবং চেষ্ট কম্প্রেশন (chest compression) এই দুই পদ্ধতি অবলম্বন করেই মূলত CPR শুরু করা হয়। বলাই বাহুল্য, rescue breathing এর ফলে রোগীর ফুসফুসে অক্সিজেন প্রবেশ করে এবং chest compression সেই অক্সিজেন পূর্ণ রক্ত ব্রেনে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে পৌঁছাতে সাহায্য করে। রোগীর শ্বাস গ্রহণ এবং হৃদস্পন্দনের গতি স্তব্ধ হয়ে গেলে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্রেনে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়ে যায়। তাই হার্ট অ্যাটাক বা হৃদস্পন্দনের গতি বন্ধ হয়ে গেলে দ্রুত CPR শুরু করা রোগীর বেঁচে ওঠার পিছনে খুব গুরত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। ২০০৭ সালের একটি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৮২% ল্যাজারাস সিনড্রোমের ক্ষেত্রে CPR বন্ধ হওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে রোগী পুনরায় বেঁচে উঠেছেন এবং ৪৫% রোগী স্নায়ুতন্ত্র এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণ ভাবে ফিরে পেয়েছে।

ল্যাজারাস সিনড্রোমের কারণ হিসাবে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে, যদিও সঠিক কারণ এখনও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, CPR এর ফলে চেস্টে যে প্রেসার তৈরি হয় তার প্রভাবেই হৃদপিন্ড পুনরায় তার কার্যক্ষমতা ফিরে পায়। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে সমস্ত ওষুধ (যেমন অ্যাড্রেনালিন) CPR এর সময় শিরার মাধ্যমে ইনজেক্ট করা হয় তা প্রাথমিক ভাবে সার্কুলেশনে বা রক্তের সংবহনে যেতে পারে না। কিন্তু CPR এর মাধ্যমে দেহের সর্বত্র রক্ত প্রবাহের গতি স্বাভাবিক হলে তা সার্কুলেশনে প্রবেশ করে দ্রুত কাজ শুরু করে। আবার অনেকে হাইপারক্যালমিয়া “hyperkalemia” বা রক্তে পটাসিয়ামের অধিক্যকে ল্যাজারাস সিনড্রোমের জন্য দায়ী করেন।

কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই


বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একবার বলেছিলেন,

“In this world nothing is certain but death and taxes”.


কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমান চিকিৎসা পরিকাঠামোর প্রেক্ষিতে মৃত্যুও বোধহয় নিশ্চিত নয়। শুধুমাত্র ল্যাজারাস সিনড্রোমই নয়, হাইপোথারমিয়া, লকড ইন সিনড্রোম অথবা ক্যাটালেপ্সির মত আরও কিছু মেডিক্যাল কন্ডিশন আছে যার প্রভাবে জীবিত মানুষকেও মৃত বলে মনে হয়। চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাস ঘাটলে এরকম বহু ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে রোগীকে ভুলবশত মৃত মনে করা হয় কিন্তু পরে হাসপাতালের মর্গে অথবা রোগী তার মৃত্যুশয্যায় বেঁচে উঠেছেন। এমনকি ২০১৪ সালে, নিউ ইয়র্ক শহরে এক মহিলার ব্রেইন ডেড হওয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে সেই মহিলার বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য অপারেশন রুমে নিয়ে গেল সেখানে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। এই ঘটনার জন্য এই হাসপাতালের লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছিল। তাই শুধুমাত্র ক্লিনিক্যাল বা বায়োলজিকাল ডেথ মানেই মৃত ঘোষণা না করে, বর্তমান গাইডলাইন অনুযায়ী CPR বন্ধ করে দেওয়ার পরেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে তবেই ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।


মৃত্যু না বিভ্রম

অর্থাৎ খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্নটা জন্ম নেয় যে তাহলে ঠিক কখন এবং কীভাবে বলা সম্ভব রোগীর মৃত্যু হয়েছে। উপরের উদাহরণের মত রোগী যে পুনরায় বেচেঁ উঠবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? জন্ম থেকে যে জীবনের সুত্রপাত, বলাই বাহুল্য মৃত্যুতে তার পরিসমাপ্তি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় জন্মের মতোই মৃত্যু প্রতিদিনের এমন একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা যার সাথে সমাজ সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আমাদের আর্থ-সামাজিক এবং আইনী বিষয় অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে। তাই, প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার মৃত্যুর সময় এবং কারণ জানা ভীষণ ভাবে প্রয়োজনীয়। ক্লিনিক্যালি বলতে গেলে, মৃত্যুর সাথে সাথে আমাদের যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ সম্পূর্নরূপে স্তব্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে কার্ডিও - রেসপিরেটরি কার্যক্ষমতা সম্পূর্নভাবে এবং অপরিবর্তনীয় ভাবে বন্ধ হয়ে গেলেই চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে কোনো ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করার যাবতীয় প্যারামিটারগুলোও পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে।

বিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে হাসপাতালের আইসিইউ রোগীদেরকে বহু ক্ষেত্রে মেকানিকাল ভেন্টিলেশন এবং কার্ডিওভাসকুলার সাপোর্টে রাখা হতে থাকে। বিশেষ করে যে সমস্ত রোগীদের ব্রেইন চূড়ান্ত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (intracranial cause) অথবা ব্রেইনে রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে (extracranial cause) সেই সব ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় একজন ব্যক্তিকে বহুদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়। তাই মৃত্যুর সঠিক সময় সংজ্ঞায়িত করার জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু মানদণ্ড এবং বিশ্বব্যপী চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে একটি সমতা বজায় রাখা ভীষণ ভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

এরই ফলশ্রুতি হিসাবে ২০১৪ সালে ২২ এবং ২৩ শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিষেবা সরবরাহ এবং সুরক্ষা বিভাগ একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে যেখানে মৃত্যু নির্ধারণ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্যারামিটারকে ঠিক করা হয় যা যে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে এই আলোচনাকে বৈধতার সিলমোহর প্রদান করা হয়।

৬টি দেশের ২০ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে যে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল তাতে মৃত ব্যক্তি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে সর্বসম্মত ভাবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মান্যতা দেওয়া হয়:

১. মৃত্যুর কারণ যাই হোক না কেন এবং মৃত্যু নির্ধারণ করার জন্য যতই ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হোক না কেন, মস্তিষ্কের মৃত্যু (ব্রেইন ডেথ) এবং সঞ্চালনজনিত মৃত্যু (সার্কুলেটরি ডেথ) উভয়ই নিশ্চিত করবে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মৃত কি না। এছাড়া এই দুটি ক্ল্যাসিকাল পদ্ধতিকে কখনোই দুটি স্বতন্ত্র ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা যাবে না।

২. মৃত্যু নির্ধারণের একই পদ্ধতি সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও স্থান কাল ভেদে মৃত্যুর একই সংজ্ঞা হওয়া উচিত।

৩. কোনো ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত করতে যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হবে তা শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য।

৪. প্রতিটি অ্যালগরিদম এমনভাবে নথিভুক্ত থাকতে হবে যাতে অন্য কোনো গাইডলাইনের ক্রস রেফারেন্সের প্রয়োজন না পড়ে।

হৃদয় না মস্তিষ্ক: অ্যালগরিদমই শেষ কথা

এখন প্রশ্ন এই যে মৃত্যু ক্লিনিক্যালি নিশ্চিত করতে যে অ্যালগরিদম সর্বজনস্বীকৃত হলো তার মোদ্দা কথা কী? সহজ ভাবে বলতে গেলে, মৃত্যু নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুইটি বিষয় বিবেচ্য, নিউরোলজিক্যাল অ্যারেস্ট বা ব্রেন ডেথ এবং ক্যার্ডিও সার্কুলেটরি অ্যারেস্ট বা হার্ট অ্যাটাক।

ব্রেন ডেথ

প্রথমে আসি ব্রেন ডেথ সংক্রান্ত কথায়। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেনের উপস্থিতি, শরীরে অম্ল ক্ষার এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য, দেহের তাপমাত্রা (৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে কি না), রক্তে দূষিত পদার্থের উপস্থিতি এবং হিমোডাইনামিক্স স্ট্যাবিলিটি ( ব্লাড প্রেসার, রক্ত সঞ্চালন, অক্সিজেনের পরিমাণ, হৃদপিণ্ডের অবস্থা ইত্যাদি) নির্ধারণের মাধ্যমে ব্রেন ডেথ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এর পরের পদক্ষেপ হলো ক্লিনিক্যাল ডায়গনসিস, অর্থাৎ কোমায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি কোমার কোন পর্যায় আছে, তার শরীরে কোনো প্রতিবর্ত ক্রিয়া কাজ করছে কি না এবং শ্বাস প্রশ্বাস অবরুদ্ধ (অ্যাপনিয়া) কি না। এই প্রতিক্ষেত্রে যদি নেগেটিভ রেজাল্ট আসে তাহলে একদম চূড়ান্ত পরীক্ষা (কনফার্মেটারি টেস্ট) করা হয়। এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ, ইইজি, এবং অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেনের ঠিক কোন কোন অংশ গঠনগত ভাবে এবং কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে তা নির্ধারণ করে তার নিরিখে ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ কোমা বা ব্রেইন ডেথের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কিছু নির্ণায়ক হলো ,

১. আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যম্ভাবী অসচেতন (আনকনশাস) থাকতে হবে এবং যেকোনো বাহ্যিক উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হবে।

২. আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস প্রশ্বাস এবং হৃদ্স্পন্দন শুধুমাত্র ভেন্টিলেটর ব্যবহারের মাধ্যমে বজায় রাখা সম্ভব।

৩. মস্তিষ্কের গুরুতর কোনো আঘাত, যা নিরাময় যোগ্য নয় তার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমান থাকতে হবে।

তবে শুধুমাত্র ওপরের বিষয়গুলির মানদণ্ডের নিরিখে বিচার করলেই যে হবে তা নয়, বরং পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক যে অন্য কোনো কারণে এই সংজ্ঞাহীন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কি না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, কোনো অবৈধ ওষুধ, ট্রাঙ্কুলাইজার, বিষাক্ত পদার্থ অথবা অন্য কোনো রাসায়নিকের অতিরিক্ত মাত্রা বহু ক্ষেত্রে ব্রেন ডেথের মতো উপসর্গের কারণ হতে পারে। এছাড়াও দেহের তাপমাত্রা অতিরিক্ত হ্রাস পেলে (হাইপো থার্মিয়া) অথবা থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের কার্যক্ষমতা কমে গেলে ব্রেন ডেথের অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়।

তাই বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে ব্রেন ডেথ নিশ্চিত করতে চিকিৎসকেরা বেশ কিছু পরীক্ষা করে থাকেন, যেমন:

১. চোখের মধ্যে টর্চের আলো ফেললে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কি না তা পর্যবেক্ষণ করা।

২. চোখের মধ্যে অবাঞ্ছিত কোনো পদার্থ , যেমন তুলো, টিস্যু ইত্যাদি প্রবেশ করিয়ে চোখের সংবেদনশীলতা পর্যবেক্ষণ করা।

৩. কানের মধ্যে হিমশীতল জল প্রবেশ করা হলে চোখের তারারন্ধ্রের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় কি না তা পর্যবেক্ষণ করা।

৪. ভেন্টিলেশন সাপোর্ট ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তি শ্বাস প্রশ্বাস নিতে সক্ষম কি না।

৫. উইন্ড পাইপের নিচে খুব পাতলা কোন প্লাস্টিকের টিউব প্রবেশ করালে তা কাশি বা অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা।


কার্ডিয়াক ডেথ

কার্ডিও সারকুলেটারি অ্যারেস্ট এর ক্ষেত্রে ৩টি বিষয় বিবেচ্য :

১. রোগীর জ্ঞান বা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষমতা আছে কি না

২.শ্বাস প্রশ্বাস সম্পূর্নভাবে স্তব্ধ অথবা অস্বাভাবিক রকমের ধীর গতিতে ঘটছে কি না

৩. সার্কুলেশন বা রক্ত সঞ্চালন উপস্থিত না অনুপস্থিত।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোগী কোনো রকম আশানুরূপ ফলাফল না দেখালে CPR এর সাহায্য নেওয়া হয়। অনেক সময়ে বিভিন্ন কারণে CPR দেওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই ক্ষেত্রে অথবা CPR কাজ না করলে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের সাহায্য নেওয়া হয়। রোগীর পালস্, হৃদপিণ্ডের শব্দ এবং আলোর উপস্থিতিতে চোখের মণির প্রতিবর্ত লক্ষ্য করাই মূল উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রেও রোগী কোনরকম প্রতিক্রিয়া না দেখালে ইসিজি এবং পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। সমস্ত পরীক্ষার পরও অতিরিক্ত ৫ থেকে ১০ মিনিট সময় অপেক্ষার পরেই চিকিৎসক মৃত্যুর সংশাপত্র প্রদান করেন। এই সময়কালে রোগীর হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা পুনরায় ফিরে এলে অ্যালগরিদম এখানেই বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রথম থেকে বিবেচনা করা শুরু হয়।









তথ্যসূত্র:




· https://apps.who.int/iris/bitstream/

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন