ঝুমঝুমি - অপরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


 



১ ||

সহসা ঘুমটা ভেঙে গেল সাবিত্রীর। পাশ ফিরে দেখল বিছানায় মেয়ে নেই। এপাশ ফিরে দেখলো পার্থও অঘোরে নাসিকা গর্জনে ব্যাস্ত। সারাদিনের পরিশ্রমের পর এই কয়েক ঘন্টাই তো রেস্ট পায় মানুষটা। তাই বরের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইল না সাবিত্রী।

নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে, ধীর পায়ে কিচেনের দিকে এগোল সে। ভাবল হয়তো মাঝরাতে খিদে পেয়েছে বলে রান্নাঘরে গিয়েছে সে। কিন্তু না, রান্নাঘর ও সম্পূর্ণ অন্ধকার ও ফাঁকা।

"ঝুমঝুমি... মা কোথায় গেলি এতো রাতে"- দুশ্চিন্তায় স্বাভাবিকভাবেই মায়ের মন কেঁদে উঠল।

হঠাৎ খেয়াল হলো ছাদের দিক থেকে কাদের যেন ফিসফিস শোনা যাচ্ছে।

"ঝুমঝুমি, তুই ছাদে কি করছিস মা?" - অতি সন্তর্পনে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগোলো সাবিত্রী।

দেখল ছাদের দরজাটা অর্ধেক খোলা। এতো রাত্রে ছাদে কি করছে ঝুমঝুমি? আর কার সাথেই বা কথা বলছে সে? ফোনে? তা তো অসম্ভব কারণ তাঁর ও পার্থর দুজনেরই ফোন বিছানার পাশেই রাখা রয়েছে, আর ঝুমঝুমির তো পার্সোনাল ফোনও নেই। একছুটে ছাদের ওপর যেতেই এক হাড়হীম করা দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠল সাবিত্রী।

তাঁর একমাত্র মেয়ে ঝুমঝুমি, ছাদের কার্নিশের একেবারে ধারে সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক পা এদিক-ওদিক হলেই সর্বনাশ।

"ঝুমঝুমি....", ছুটে গিয়ে মেয়েকে পেছন থেকে জাপটে ধরল সাবিত্রী। টাল সামলাতে না পেরে দুজনেই ছাদের মাটিতে পড়ে গেল। এখনও সারা শরীর আতঙ্কে কাঁপছে সাবিত্রীর।

"তুই, ওখানে কি করছিলিস মা?"

"ও ডেকেছিল যে, খেলতে ডেকেছিল..." , এই বলেই মায়ের কোলেই কেমন যেন অচেতন হয়ে পড়ল ঝুমঝুমি।

২ ||

"আপনাদের এই ফ্ল্যাটের সম্বন্ধে অনেককিছুই শোনা যায়, সাবিত্রীদি ", সকালের চায়ের কাপ হাতে ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন শালিনী মুখুজ্জে।

"এই এক কথা তো সেই প্রথম দিন থেকেই শুনে যাচ্ছি গো। দারোয়ানটাও সেদিন কি যেন বেশ বলছিল, থানা পুলিশ করে কিছু ঝামেলা হয়েছিল কয়েক বছর আগে...। ব্যাপারটা কি গো?" চায়ের পেয়ালায় একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল সাবিত্রী।

"আমিও তো এখানে এসেছি মাত্র তিন বছর হল। ঘটনাটা ঘটেছে তারও আগে। শুনেছি আপনাদের ফ্ল্যাটটায় আগে এক দম্পতি বাস করতেন। তাঁদের একটা মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটাকে নিয়েই কিছু একটা ঝামেলা হয়েছিল। তারপর ফ্ল্যাটের বাকি লোকেদের তাড়না খেয়ে এই বাড়িছাড়া হয়েছিল তারা। এর বেশি কিছু জানা নেই গো।" হঠাৎ পাশের ফ্ল্যাট থেকে সনাতন মুখুজ্জের গলা ভেসে এল," কই গো, আমার জলখাবরের ব্যবস্থা করো। বেরোতে হবে যে। "

"যাই গো, আমার ডাক পড়েছে ", এই বলে বিদায় নিলেন ভদ্রমহিলা।

একরাশ হতাশা নিয়ে বিছানায় মেয়ের কাছে গিয়ে বসল সাবিত্রী। চোখ রগড়ে ঘুম থেকে উঠে বসল সে। ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে চেয়ে রইল ঝুমঝুমি।

"কি হয়েছে মা?"

দুশ্চিন্তায় গতরাতে ভালোভাবে ঘুম হয়নি সাবিত্রীর। সারারাত মেয়ের পাশটিতে বসেছিল সে।

"কাল অতরাতে ছাদে কেন গিয়েছিলে মা?"

"কাল রাতে!!!" দু হাতে মাথা চেপে ধরে মনে করতে চেষ্টা করল ঝুমঝুমি।

একটা চাপা অস্বস্তি যেন হঠাৎই চেপে ধরেছে ঝুমঝুমি। বহু চেষ্টা করে কোনোরকমে বলল সে, "সে তো ডাকল আমাকে, ঘুম থেকে তুলল আমাকে। খেলতে যাবে বলল, ছাদে নিয়ে গেল আমাকে.... তারপর... আহঃ!" হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলো তাঁর।

"কি হয়েছে মা? মাথা ব্যাথা করছে? শুয়ে থাক মা, আমি ওষুধ নিয়ে আসছি। আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই ", এই বলে ওষুধ আনতে পাশের ঘরে ছুটলো সাবিত্রী।

তবে ওর বেশি ঝুমঝুমির কাছ থেকে আর কিছু জানা গেল না।

৩ ||

"আজ অফিসে,শ্যামলদার মুখে অদ্ভুত একটা খবর শুনলাম জানো। অবশ্যই ব্যাপারটা নিছক রটনাও হতে পারে ", অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ঘামে ভেজা শার্টটা খুলতে খুলতে বলল পার্থ।

"কি শুনি?" সাবিত্রী উত্তর দিল।

"আমাদের ফ্ল্যাটে নাকি বছরখানেক আগে একটা খুন হয়েছিল... একটা বাচ্চা মেয়ের। মেয়েটার বাপ-মা নাকি বেশ অত্যাচারী ছিল। হয়তো এমনই বকা ঝকা করতে গিয়ে, ভুলবশত..."

"ওমা সেকি! সকালেও মুখুজ্জে গিন্নি এরকমই একটা ঘটনার কথা বলছিল ", হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল।

"ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে দাঁড়াও তো। ঐ শালা দালাল, রাজুকে একবার পাই। ব্যাটা জোড় করে ফ্ল্যাটটা কেনা করালো, অথচ এসব জানায়নি অবধি।”

"হ্যাঁ গো, মেয়েটারও এসে থেকে জ্বর-জ্বালা লেগেই আছে। আবার দুদিন থেকে নিজে নিজেই এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে, আপন মনেই যেন কার সাথে কথা বলছে, স্কুল যাচ্ছেনা। কিছু একটা করো।" কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল সাবিত্রী।

"দাঁড়াও দেখছি, অন্য ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করা যায় কিনা । আর হ্যাঁ, ঝুমঝুমিকে ততদিন একটু চোখে চোখে রেখো।" এই বলে বাথরুমে ঢুকে গেল পার্থ।

সাবিত্রী অবশ্য ভেবেই রেখেছিল আজ রাত জেগে ঝুমঝুমিকে পাহারা দেবে। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে একটা উপন্যাসের বই খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সাবিত্রী। আজ কোনোমতেই ঝুমঝুমিকে কোথাও যেতে দেবে না। বই পড়তে পড়তে কখন যে চোখটা লেগে এসেছিল তা বুঝতেই পারেনি। ততক্ষণাৎ পাশে চেয়ে দেখল মেয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

কিন্তু ও কি? সিঁড়ির দিক থেকে একটা শব্দ আসছে না? পায়ের শব্দ, নুপুর পরে কেউ যেন সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছে...

৪ ||

সাবিত্রীদের ফ্ল্যাটটা বিল্ডিংএর সবচেয়ে ওপর তলায়। সুতরাং তাঁদের বেডরুম ঘেঁষে ছাদে ওঠার সিড়ি উঠে গিয়েছে ওপরে। নূপুরের শব্দের পিছন পিছন ইতিমধ্যে সাবিত্রী পৌঁছে গিয়েছিল সিঁড়ির মুখে। ধীর পায়ে ওপরে উঠতে থাকল সে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সাহস প্রচুর। তাও যেন, কোনো এক অজানা আশঙ্কায় বারবার গায়ে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছিল তার। ছাদের দরজার কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ নূপুরের শব্দ থেমে গেল। দরজার বাইরে পা দিতে যাবে এমন সময় হঠাৎ ঝুমঝুমিরই বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে বেড়িয়ে এল দরজার আড়াল থেকে। কিন্তু এ কি? এটা তো ঝুমঝুমি, অবিকল এক মুখ? কিন্তু সে তো এখন বিছানায়! তবে?

"কি গো, খেলতে দেবেনা বুঝি তুমি আমাদের?" অতিপ্রাকৃতিক একটা স্বর বেরিয়ে এল মেয়েটার গলা দিয়ে।

"কে? কে তুই? কি চাস?" কাঁপা স্বরে জবাব দিল সাবিত্রী।

"ঝুমঝুমিকে। ও খেলবে যে আমার সাথে। ওকে ডাকো... ডাকো বলছি। " হঠাৎ মেয়েটার মুখে একটা হিংস্রতা ও ক্রুদ্ধতা ফুটে উঠল।

"ছেড়ে দাও... ছেড়ে দাও ওকে...", আর পারল না সাবিত্রী। হোঁচট খেতে খেতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সটান বিছানায় উঠে ঝুমঝুমিকে জড়িয়ে ধরল সে। চ্যাঁচামেচিতে পার্থরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

না, সেই রাতে আর কিছু হয়নি। বাকি রাতটুকু জেগেই কাটিয়েছিল দুজন।

৫ ||

"সেকি, এর মধ্যেই নতুন ফ্ল্যাট পেয়ে পেয়ে গেলে নাকি?" মুখুজ্জে গিন্নি জিজ্ঞেস করলেন।

ইতিমধ্যেই পার্থ ফ্ল্যাটের কয়েকটা মালপত্র নিচে নামিয়ে ফেলেছিল। একটা ট্যাক্সি আগে থেকেই বুক করে নিয়েছিল সে। আর যাই হয়ে যাক, এই অভিশপ্ত ফ্ল্যাটে আর একদিনও নয়।

"গড়িয়াতে ওর বাবার পিসির বাড়ি। ওখানেই গিয়ে উঠব। ততদিনে বোধহয় একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। " বলল সাবিত্রী।

ততক্ষনে ফ্ল্যাটের বাকি বাসিন্দারাও সমস্ত ঘটনা জেনে গিয়েছিল। চারিদিকে শুধুই ঐ বাচ্চা মেয়ে এবং তাঁর মৃত্যু নিয়ে আলোচনা। রাজু নামক দালালটিকেও সকালে ধরে এনেছিল পার্থ। তাঁর মুখেই আসল ঘটনাটা জানতে পারে সকলে।

বছরখানেক আগে এক বদমেজাজি ও অত্যাচারী দম্পতি এসে বাসা বেঁধেছিল এই ফ্ল্যাটে। লোকটাও নাকি ছিল জেল ফেরত আসামী। তাদের একমাত্র মেয়ের ওপরে যারপরনাই অত্যাচার চলত রোজ রাতে, ফ্ল্যাটের বাকিরাও ভালোভাবেই জানত এসব তবে কেউ টু শব্দটিও করেনি। একরকম ভয়ই পেতো সকলে সেই দম্পতিকে। একদিন শাস্তির নাম করে বাচ্চা মেয়েটাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে অত্যাধিক মারধোর করা হয়েছিল। শোনা যায়, ছাদের কার্নিশে তাকে দাঁড় করিয়ে নিচে ফেলে দেবারও ভয় দেখায় তারা। এবং সম্ভবত সেই আসামীর হাতের ঈষৎ ধাক্কায় ছ’তলার কার্নিশ থেকে নিচে পরে মৃত্যু হয় বাচ্চাটির। বয়স কতই আর হবে, ঐ পাঁচ কি ছয়।

"এখানে আর থাকবোনা আমরা?" সকাল থেকে কেবল এই এক প্রশ্ন করে করেছিল ঝুমঝুমি। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে মেয়েটা সকাল থেকেই , গোমড়া মুখ করে কেবল ছাদের সিঁড়ির দিকে চেয়ে আছে। যেন কারোর অপেক্ষায় আছে সে, যেন কিছুক্ষন পরেই কেউ নেমে আসবে সেই সিঁড়ি বেয়ে। তাঁকে নিয়ে যাবে বিস্তৃত ছাদের প্রান্তে, তাঁর সঙ্গে মেতে উঠবে ছোঁয়াছুঁইর খেলায়।

"বললাম তো ওখানে কেউ নেই। কারোর সঙ্গে খেলবে না তুমি।" ধমক দেয় সাবিত্রী।

"আমার যে আর কোনো বন্ধু নেই মা, রিমিই আমার একমাত্র বন্ধু। ওকে ওর মা বাবা খুব মারে, ওরও কোনো বন্ধু নেই। যেতে দাও না মা।" ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল ঝুমঝুমি।

"রিমি? ঐ নামে কেউ নেই এখানে। চুপচাপ নিচে চলো ঝুমঝুমি। এবার বেরোবো আমরা।" মায়ের ধমকে মুখ বন্ধ করে সে। তাঁর হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে আসে সাবিত্রী।

তবে তার দৃষ্টি কেবল ছাদের সেই কার্নিশের দিকেই আটকে থাকে। ঐ তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে, রিমি কার্নিশের ধারে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তাকে। না, আর খেলতে ডাকছেনা তাকে। কারণ সেও জানে এই ঝুমঝুমির সঙ্গে তার শেষ দেখা। অজান্তেই ঝুমঝুমির চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে কি ঠিক দেখছে? রিমি ও যেন কাঁদছে, তার গাল বেয়েও অশ্রুধারা ঝড়ে পড়ছে অঝোরে। ছলছল চোখে যেন সে বারবার বলছে "বিদায় বন্ধু, ভালো থেকো।"

রিমির মুখের শিশুসুলভ হাসিটা কোথাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে, সাথে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে তার অবয়বটাও।

ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিল। কমপ্লেক্সের গেট পেরোতেই আবার পেছনে ফিরে তাকালো ঝুমঝুমি। না, ছাদ একেবারেই ফাঁকা... কেউ নেই সেখানে।।

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন