‘আবার এসেছ? কতবার তো বলেইছি এসব কবিতা তো কবিতাই হয়নি। কেমন ছ্যাতড়ে গেছে। না আছে ছন্দ, না আছে অন্য কিছু।‘
এসব কথা উগরে দিয়ে ‘ইচ্ছে’ পত্রিকার সম্পাদক বললেন, ‘আরও
লেখো, লেখা
অভ্যাস করো।‘
কথাগুলো ঝাঁঝালো শ্লেষ মেশানো। এই পত্রিকার সদস্যমন্ডলী গরীব লেখকদের প্রতি করুণার হাত বাড়ান মাঝে মাঝে। এ খবরটি সনাতন রুইদাস কোন কবির কাছে শুনেছিল। তাই এই অ্যাকাডেমির চৌকাঠে পা রাখা। রুইদাস ফুটপাতে জাত বৃত্তি করে। জুতা ছাড়া এখন ছাতাও
সেলাই করে। গুনগুন গান গায় আর
ছেঁড়া কাগজ পেলে কবিতা লেখে। তাকে নাকি খুব কবিতায় পায়।
একদিন মুদির দোকানে সওদা করতে
গিয়ে দেখে দোকানি পুরানো ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে দিচ্ছে। দেখে
রুইদাস বলে, 'ওই ডায়েরীটা দেবেন, পয়সা দিয়েই নেব।‘
শুনে দোকানী জানতে চায়,
'কেন তুই কি ডায়েরি লিখবি?
তা’লে
ফুটপাতে বসবি কখন?'
‘কেন রাতের বেলা।‘
হো হো করে হেসে দোকানী সনাতনের হাতে ডায়রি দেয়, ‘যা, তোকে পয়সা দিতে হবে না।‘
আনন্দের বাতাস মেখে রুইদাস
কবিতা লেখে,
'আমি যদি মুচি হই কে তবে শুচি,
জবাবটা চাই আমি কার নামে রুচি।‘
হাটবারের পরের দিন আবার রুইদাস সম্পাদকের
দরবারে দাঁড়ায় কবিতার খাতা নিয়ে।
'আবার এসেছ বড় বড় কবিরাই কলকে পায়নি,
বই উইয়ে
কাটছে।'
‘এজ্ঞে আমি চলে যাব?’
হেলাফেলার মত ডায়েরিটা নিয়ে সম্পাদক
বললেন,
‘রাখছি। দেখব। ক’মাস পরে এসো ।'
একথা শুনে খুশির ঢেউ ছুঁয়ে গেল। কৃতজ্ঞতায় মাথা বারবার নুইয়ে দিল সনাতন রুইদাস! বারচারেক প্রনামও সেরে ফেলল।
তিনমাসের মাথায় হাজির সনাতন, ‘স্যার কিছু কবিতা কি মানুষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। তোমার বই বেরোবে,
তোমার তো ফোন নাম্বার ছিল না, ছাপতে প্রেসে গেছে,ওই একুশে ফেব্রুয়ারিতে হবে, তুমি এসো।‘
একথা শোনার পর বাবা মা তেত্রিশ কোটি দেবতাকে প্রনাম করে রুইদাস বলে,
'আপনি ভগবান! আমার কবিতাকে ছেপেছেন
!’ চোখে জল। একবার সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে পা ছুঁয়ে।
'পাটা ছাড় সনাতন।‘
সময়ের আগেই মঞ্চের এককোণে চুপ করে সনাতন রুইদাস! কখন ঘোষনা হবে,
আনন্দে ময়লা জামাটা ভিজে যায়। পত্রিকার সম্পাদক ঘোষনা
করলেন,
‘সনাতন রুইদাসের কবিতার বই, আকাশের মন প্রকাশিত হচ্ছে।এই উপলক্ষ্যে কবি নিজের
কবিতা পাঠ করবেন।‘
শোনার
পর সনাতনের মাথা ঘুরছে,
চোখও ঝাপসা, এক পা এক পা করে মঞ্চে ওঠে, জড়ানো গলায় মাইক্রোফোনটাকে ধরে বলতে থাকে,
'গুনী আমি নই তবু কবিতায় পায়,
ছেঁড়া ডায়েরীর…’
হৃদপিন্ডের দ্রুত চলনটা থেমে যায়, আর অনুরণন চলতে থাকে, ‘আমাকে খালি কবিতায় পায়।‘
পরের বছর একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান, মঞ্চের পর্দায় কবিদের পেছনে জ্বলজ্বল করছে - 'কবি সনাতন রুইদাস মঞ্চ'।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন