অলীকের মাথার ওপর আকাশ। নীল চাদরে মোড়া। পায়ের নীচে ঘাস। ঠান্ডা, সবুজ, তুলতুলে। অলীকের চোখদুটো আজ ঝরঝরে। নেই কোনও ক্লান্তি । সারা শরীর তরতাজা। গত রাতের শরীরের বাসী গন্ধটা আজ নেই। সূর্যের রঙে সারা শরীর চিকচিক করছে। বড় ভালো লাগছে। আজ নন্দিনীর পরনে সেই কলাপাতা রঙের তাঁতের শাড়িটা। ওর খুব পছন্দের।অলীকেরও খুব প্রিয়। আলতো খোঁপায় ফুরফুরে চুল। চোখেমুখে সুখের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। এই শীতেও অলীকের চারপাশে বসন্ত খেলা করছে। একটা মিষ্টি গন্ধ চারিদিক ঘিরে রেখেছে। নন্দিনীর মুসুরির দানার মত নাকছাবিটা সকালের আলোতে অলীকের চোখদুটোকে ঝলসে দিচ্ছে। নন্দিনীর ঠোঁট টকটকে লাল। নান্দিনী লিপস্টিক দেয় না। দুজনার হাতে চায়ের কাপ। নন্দিনীর নিজের হাতে বানানো। মিষ্টি। এক অদ্ভুত মাদকতা গলা দিয়ে নেমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। দুজনের নিস্তব্ধতা যেন একে অপরকে অনেক কথা বলছে।
- “সকালটা বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, না?”
- “সকাল যে বড় সুন্দর, মিষ্টি।”
- “তাতে কি?”
- “মিষ্টির স্বাদ বেশিক্ষণ থাকে না।”
- “সে কিরকম?”
- “ধরো তুমি সন্দেশ খাচ্ছ খুব তরিবৎ করে। তারপর তোমার জল খেতে ইচ্ছে করবে। ঠান্ডা জল গলা দিয়ে নেমে গেল। দেখবে মিষ্টি ভাবটাও কোথাও হারিয়ে গেল।”
- “কিন্তু জল যদি না খাই?”
- “খেতে তোমাকে হবেই। নাহলে স্বাদের মজাটাই যে চলে যাবে।”
- “তুমি বেশিক্ষণ কাছে থাকলে সকালটাও ফুরিয়ে যাবে?”
- “হ্যাঁ মশাই! ঘাসের শিশির শুকিয়ে পায়ের তলা কুটকুট করবে আর সুয্যিমামা রেগে গিয়ে মাথায় চাঁটি মারতে আরম্ভ করবে।”
নন্দিনীর লাজুক হাসিতে কপটতার ছোঁয়া। সব কিছুকে ছুঁয়ে যায়। সম্পূর্ণা। একটুও কম নেই। একটুও বেশি নেই। অলীক ভয় পায়। যদি নন্দিনীর মধ্যে কিছু বেশি চেয়ে ফেলে কিম্বা কম?
আজ অলীক অনেকক্ষণ ধরে চান করল। প্যারাডাইস সাবানের গন্ধটা অন্যরকম। নেশা ধরে যায়। ঠিক নন্দিনীর মতন। শাওয়ারের জল বৃষ্টির ধারার মত অলীকের শরীরে নেমে আসছিল। জলের ফোঁটাগুলো সারা শরীরে খেলা করে বেড়াচ্ছে। একসময় অলীক বৃষ্টিতে ভিজত। ভেজা মাটির গন্ধটা খুব টানত। আজ সারা সকাল গন্ধটা পাচ্ছে। নন্দিনীও গন্ধটা খুব ভালোবাসে।
মানিনী ভাত বাড়ছে। কাঁসার থালা। গরম ভাব উঠছে। পাকা গমের রঙ। ঠিক শীতের কুয়াশার মতন। অলীক কুয়াশাটাকে ধরার চেষ্টা করল। মানিনীর মুখটা আজ গোমড়া। কোমরের ব্যাথাটা খুব বেড়েছে ওর।
- “আজ বিকেলে ফেরার সময় ডাক্তারের কাছে নাম লিখিয়ে আসবে। খুব কষ্ট হচ্ছে। কাল সারা রাত যন্ত্রণা হয়েছে।” মানিনীর শরীর খুব ভারী। এত ভার সে আর বইতে পারছে না।
- “সকাল বেলায় এত রান্না করতে যাও কেন? কানু আছে তো? ওকে দেখিয়ে দিলেই তো পারো।”
- “তাহলেই হয়েছে।ও কি জানে রান্নার? শুক্তোতে উচ্ছে দিতেই ভুলে যায়, ও করবে রান্না।”
মানিনীর রান্নার হাত ভালো। প্রথম প্রথম একটু ঝাল লাগত। পঁয়ত্রিশ বছরে সব অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। নন্দিনীর হাতের রান্না তুলতুলে। মশলা ছাড়া মাছের ঝোল খুব জমকালো হয়।
- “সকাল বিকাল ব্যায়ামগুলো করছো?”
- “অত সময় নেই আমার। কাজ গুছোনোর সময় পাচ্ছিনা তার ওপর আবার ব্যায়াম।”
- “তাহলে আর ডাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই। ওষুধে এই রোগ সারবে না। এখন তোমার বিশ্রামের সময়।”
- “আর বিশ্রাম! পঁয়ত্রিশ বছর তো অনেক বিশ্রাম নিলাম। এবার না হয় একটু কাজই করি।”
মানিনী চলে গেল। সত্যি ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। নন্দিনীর মুখে কোনোদিন কষ্টের ছায়া পড়েনি। না হাসলেও মনে হয় ও খুব খুশী। মানিনীর শরীর অনেকদিন আগেই শিথিল হয়ে গেছে। নন্দিনীর মুখে কোনো বলিরেখা ফোটেনি।
মানিনী কি নন্দিনীর কথা জানে? কিম্বা নন্দিনী মানিনী কে? আচ্ছা, নন্দিনীকে যদি মানিনীর কথা বলি? ও কি রাগ করবে? বুকটা ধক করে উঠল। অত নরম মুখে কালো ছায়া কি মানাবে? সেটাও যে অলীক সহ্য করতে পারবে না। নাহ! নন্দিনীকে কিছুতেই জানানো যাবে না।
মানিনী যদি নন্দিনীর কথা জানতে পারে? পঞ্চান্ন বছরের মানিনীর মুখে যন্ত্রণার ছাপ ছাড়া কিছু দেখতে পায় না অলীক। মুখে ভাবের লেশমাত্র নেই।
- “কে নন্দিনী? কি করে? তোমার সাথে? হতেই পারে না। বাড়ি আর অফিস ছাড়া তুমি জান নাকি? তোমার অত সাহসই নেই।”
প্রত্যাশিত। অলীক জানে। মানিনীর কল্পনায় আসবে না। দারুন ব্যাপার! রোমাঞ্চকর! কুড়কুড়ে হাসিটা অলীকের সারা শরীরে সুড়সুড়ি দিয়ে গেল। মানিনী আজ বেলেমাছের ঝাল রেঁধেছে।
- “তোমাকে আর একটা কথা বলতে এলাম।”
মানিনী তার যন্ত্রণা নিয়ে আবার ফিরে এসেছে।অলীক খাওয়া শেষ করেছে সবেমাত্র।
- “তোমার ওই গাদাগুচ্ছের কাগজগুলোর একটা ব্যাবস্থা করো।”
- “কেন?ওরা আবার কি ক্ষতি করল?”
- “একেবারে পাহাড় হয়ে গেছে। কখন যে মাথার ওপর ধসে পড়বে। কাল ওই জঙ্গল থেকে বিছে বেরিয়েছে। কানুকে প্রায় কামড়াচ্ছিল। হয় ওগুলো বেচবে নইলে আমি সব পুড়িয়ে দেব।”
খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, ক্যালেন্ডার। সব জমা করে রাখে অলীক। ছোটবেলায় কাগজের নৌকা, এরোপ্লেন তৈরি করত। নন্দিনীও খুব ভালবাসে। কাগজের কোলাজ তৈরি করে। পুরনোকে নতুন করে তোলে। হলদে হয়ে যাওয়া কাগজগুলোর ওপর খুব টান অলীকের। অনেকটা পুরনো দিনের বাড়ির মতন। লোহার গরাদ দেওয়া বড় বড় জানালা,কড়ি বরগার ছাদ,নোনা ধরা দেওয়াল, রোদে জলে হলদে হয়ে গেছে। ওদেরও হয়তো অনেক কিছু বলার ছিল। নন্দিনীরও অনেক কিছু বলার আছে।
- “না না, তোমাকে কিছু করতে হবে না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। তুমি বুঝতে পারবে না। আমি বেছে রাখব। ওগুলো বিক্রি করবে। তুমি আবার নোংরা ঘাটতে যেও না। কোমরে ব্যাথা। যা করার আমিই করব।”
- “তুমি আর করেছো। কবে থেকেই বলছি। কথা কানেই তুলছ না। কানু গজগজ করছে। বিছেটা যদি কানুকে হুল ফোটাত? কি হত বলতো? পরের বাড়ির মেয়ে। কাজ করে খায়। ওর কি দায়?”
অলীক পারেনা। অনেক কিছুই ফেলে দিতে পারেনা। বিয়ের সময় মানিনীর বাক্সে দেওয়া ন্যাকড়া হয়ে যাওয়া শাড়িটা যেদিন মানিনী পর্দা করেছিল সেদিনও অলীকের মনটা কেমন যেন খচখচ করে উঠেছিল। হলুদ জমির ওপর নীলচে ফ্যাকাসে ফুলগুলো দোল খাচ্ছিল। রাতে ছটফট করছিল অলীক। ঘুম আসছিল না ঠিকমত। ভোররাতে ফুলগুলো অলীকের চোখের সামনে মাথা দোলাতে লাগল। বারবার। অনেকবার। আচমকা দুলতে দুলতে ফুলেরা কেমন যেন নেতিয়ে পড়ল। পাপড়িগুলো শুকিয়ে অলীকের সামনে ঝরঝর করে ঝরে পড়ল। ধড়ফড় করছিল অলীক। মানিনী পাশ ফিরে শুয়েছিল। নিথর। অলীক ডাকতে পারেনি । ওর গায়ে হাত দিলেই কেমন যেন চমকে ওঠে। জানতে পারলে ও হয়ত খুব হাসাহসি করত। অথবা মুখ ভার করে বলত, “মনে হয় পেট গরম হয়েছে তোমার।”
নন্দিনীর মুখটাও শুকনো লেগেছিল সেদিন। অস্ফুট যন্ত্রণা দুজনকেই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। নন্দিনী ফুল দেখতে ভালোবাসে। পিটুনিয়াগুলো নন্দিনী তার সোনালী হাত বুলিয়ে দেয় নিজের আপনার মত। তুলতে গেলেই বারণ করে সে।
- “আমাকে যদি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেয় তোমার ভালো লাগবে?”
মানিনী প্রতিদিন সকাল বেলা ফুল তুলে সাজিতে সাজিয়ে রাখে। ঠাকুরের ছবিগুলো ফুলে ঢাকা পড়ে। কিছুদিন পর ফুলগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে পড়ে। শুকনো ফুল থেকে আবির তৈরি হয়। মানিনী সেকথা জানেনা।
আজও দেরি হয়ে গেল। স্কুল। নিত্যদিনের কাজ। তবু মাঝেমাঝে দেরি হয়। দশটা চল্লিশ। বত্রিশ বছরের স্কুল জীবনে বত্রিশটা লেট। চল্লিশের জায়গায় পঞ্চাশ। অলীকের বাড়ি ফিরতে রাত নামে। কালো ক্যানভাসে বাড়িগুলোর আলো তারার মত জ্বলে। স্থির,নিথর। মানিনীর মত। রাতে তার অনেক কাজ। তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বালায় সে। অলীকের জন্য রাতের খাবার তৈরি করে। সারা শহর চুপ। নিথর। মানিনীর মত। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দেরি করে সে। নন্দিনী মুচকি হাসে।
- “এত দেরি করলে কেন?”
- “রোজই তো হয়।”
- “আর করবে না।”
- “কেন?”
- “তুমি বুঝবে না।” মুচকি হাসে নন্দিনী। রাতের চাদরে হাজার জোনাকি জ্বলে ওঠে।
- “আর দেরি হবে না। এবার বিশ্রাম। তোমার সাথে। অখণ্ড সময়। কদিন পর অবসর নেব।”
- “আমারও সময় হয়ে গেছে।”
- “মানে?”
- “আমিও এবার বিশ্রাম নেব।”
- “তুমি চলে যাবে আমাকে ছেড়ে? না না ,আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। কিছুতেই নয়।”
- “তুমি খুব স্বার্থপর। মন বলে তোমার কিছু নেই।”
- “আপনাকে হেডস্যার ডাকছেন।”
সুমিত। নতুন। সদ্য জয়েন করেছে। বেশ চটপটে,করিৎকর্মা ছেলে। মাঝেমাঝে গাল ফুলিয়ে মানিনীর কাছে অলীকের নামে অভিমান জানিয়ে আসে।
- “স্যার,এমনিতে খুব ভালো। কিন্তু আমাকে খুব জ্বালায়। শুধু কাজ দেয়। একটুও বসতে দেয় না।”
- “আর তো ক’দিন সুমিত। এরপর তো ওনার অবসর নেওয়ার সময় হয়ে এল। আর জ্বালাতন করবেন না।”
মানিনীর কথায় অলীকের মত সুমিতও বিষাদগ্রস্ত হয়ে যায়। কিন্তু বিকেলবেলাতেও অলীকের সকাল শেষ হচ্ছে না। বয়স যেন আজ থমকে গেছে। চনমনে মনে হচ্ছে নিজেকে। নিজের ক্লাস ছাড়াও দুটো প্রভিশনাল ক্লাস করেছে। অফ পিরিয়ডে নিজেই ইউনিট টেস্টের প্রশ্নগুলো সর্টিং করে নিয়েছে। ক্লান্তি যেন কিছুতেই দমাতে পারছে না অলীককে। সমরেশ এইচ এমের দায়িত্ব নিলেও মনটাকে এখনো খালি রেখেছে। ছেলেটা স্বপ্ন দ্যাখা ছাড়েনি। কাজের ফাঁকেই ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়তে দেখেছে অলীক। স্বপ্নের ছায়ায় থাকলে মনটা বেশ তাজা থাকে। ছেলেটা আবার লেখালেখিও করে। সমরেশকে দেখে আবার হাল্কা হতে ইচ্ছে করে অলীকের। হাত দুটোকে আরও লম্বা করতে ইচ্ছে করে,যেন অনেক কিছুকেই বেশি করে জড়িয়ে ধরা যায়।
- “ডাকছিলেন?”
- “আসুন, আসুন। শরীর ফিট তো?”
- “একদম। কোনো অসুবিধা নেই। আজকাল অনেক বেশি ফ্রেস লাগে।”
- “তাই?”
- “অনেক তো মাধুকরী,এবার হোক সারা।
জীবন রথের বাঁকে বাঁকে, ছড়াক মুঠো স্মৃতির তারা।
ফেলে যাওয়া টুকরো আশার, স্বপ্ন তৃষা আনে ঘুম।
সুপ্ত হৃদয় দিচ্ছে ধরা , বিষণ্ণতার মরশুম।”
মিটিমিটি হাসে অলীক।
- “আজকাল লেখালেখি করছেন নাকি?”
- “কই না তো!সেরকম কিছু বুঝলেন নাকি?”
- “হ্যা,এই তো। বেশ ছন্দ মিলিয়ে বললেন।”
- “কখন ? আমি শুধু বললাম এই সময় হাসিখুশি না থাকলে মনের ওপর চাপ বাড়ে।”
- “ঠিকই বলেছেন অলীকদা । আসলে যতই বলি ধরাবাঁধা নিয়ম থেকে মুক্তি, অনেক কিছু ফিরে পাওয়ার সময় এখন, আমাদের কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের সাতটা ঘন্টাকে কখন যে নির্জনে এসে অঙ্গহানির মত কেড়ে নিয়ে চলে যাবে, জানতেই পারব না। আঘাতটা আমাদের চির জীবনের জন্য রয়ে যাবে। সবকিছু অনুভব করি। স্বীকার করি না।”
দার্শনিকের চিন্তা নিয়ে ছেলেটা এত দায়িত্ব সামলাচ্ছে কি করে ভেবে পায় না অলীক। কিংবা এর জন্যই হয়ত এত চাপ নিতে পারে।
- “সবই তো বুঝলুম। কিন্তু ডেকেছিলেন কেন?”
- “কাগজপত্র তো সব রেডি। সার্ভিস বুকে কতকগুলো সই লাগবে আপনার। তারপর এ আই অফিসে জমা দেব।”
- “এই ব্যাপার! দিন পেপারগুলো। আসলে আমার অত আবেগ আসে না ভায়া। বেশ থাকব, জানেন। ছাদে বাগান করেছি। বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড মাঠ। সকাল বিকাল দু’বেলা মর্নিং ওয়াক, নন্দিনীর সাথে।”
- “কার সাথে বললেন?”
কিছুটা চমকে গেল সমরেশ। চমকালেন অলীকও।
- “কেন কি বললাম?”
- “এই তো, এক্ষুনি বললেন।”
- “কি?”
- “নামটা!”
- “কি নাম? কার নাম?”
- “ওই তো! কি যেন! হ্যাঁ। নন্দিনী। ঠিক। নন্দিনীই তো! সে রকমই তো শুনলাম। কিন্তু বৌদির নাম তো মানিনী। মানিনী সামন্ত। আপনার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে ওই নামটাই তো রয়েছে। কিন্তু..”
- “না না। আপনি ওই নামটাই শুনেছেন। মানিনী । আমি মানিনীর কথাই বলেছি। সইগুলো হয়ে গেছে স্যার। আমি আসছি।”
- “তুমি একটা যা তা!” নন্দিনীর ঠোঁট দুটো ফোলাফোলা। গোলাপের পাপড়িতে জলের ছিটে।
- “আমি কিছু বলতে চাইনি। কি করে যে নামটা……।”
- “তুমি একটা ছেলে মানুষ। আমি যাই।”
নন্দিনী চলে গেল। ওর শরীর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। সে ফিরে তাকালো না। মুচকি হাসল না। আকাশের দিগন্ত রেখায় নন্দিনী মিলিয়ে গেল। সত্যি? ও কি রাগ করল? না কি অভিমান? নন্দিনী কি আর ফিরবেনা? অলীক আজ এই প্রথম উষ্ণতার অভাব টের পেল। মোটা পুলওভার পেরিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার চোরা স্রোত অলীকের শরীরটাকে টলিয়ে দিল। দীর্ঘ সকালটা এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হল কি করে?
বাড়ির সামনে আসতেই অজানা আতঙ্কে মন কেঁপে উঠলো অলীকের। বাড়ির সামনে আগুন লকলক করছে। অসংখ্য আগুনের শিখা পতঙ্গর মত আকাশকে আলিঙ্গন করছে। ছুটে গেল সে। এ কি করছে কানু? অলীকের জমানো ম্যাগাজিন,খবরের কাগজের ছেঁড়া পাতাগুলো জড়ো করে আগুন ধরিয়ে বহ্নুৎসব পালন করছে। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে মানিনী। মুখ তার আগুনের আঁচে লাল। হাসি হাসি মুখ। এ হাসি অনেক দিন দ্যাখেনি অলীক।
- “রাবিশ কাগজগুলো বাড়িময় নোংরা করছিল। কানু ঝাঁট দিয়ে জড়ো করেছে। আমিই বললাম ধরিয়ে দে। ঠিক করিনি? আজ প্রচণ্ড ঠান্ডা। এসো, আজ এখানে বলে হাত পা সেঁকে নিই। হ্যাঁ গো, তোমার মনে আছে? সেই সেবার শীতে বরন্তিতে। আমরা দুজন বনফায়ারের সামনে কত রাত পর্যন্ত বসেছিলাম। আজও বসব। দাঁড়াও চা নিয়ে আসি। বাঁধাকপির পকোড়া ভেজেছি। চায়ের সঙ্গে যা জমবে না! কানু, দুটো চেয়ার নিয়ে আয়।”
অলীক স্থির। নিশ্চল। পলকহীন। দাউদাউ করছে শিখাগুলো। আরও বড় হচ্ছে । শিখাগুলো সবকিছু গিলে নিচ্ছে। বছর দুয়েক আগে দেশ পত্রিকায় দেখেছিল বিজ্ঞাপনটা। প্যারাডাইস সাবানের । মডেলের নাম জানা ছিল না। অদ্ভুত টান অনুভব করেছিল সে ছবিটাতে। এমন আটপৌরে রূপ আগে কোনো ছবিতে দ্যাখেনি। মুগ্ধ হয়েছিল। নাম রেখেছিল নন্দিনী। চুপিচুপি বই থেকে ছিড়ে কাটিং করে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল তার নন্দিনীকে। আজ সে ধরা পড়ে গেল। মানিনী অন্য কাগজগুলোর সঙ্গে নন্দিনীর ছবিটাকেও আগুনে আহুতি দিয়েছে। নন্দিনীর ছবিটা আগুনে পুড়ে দুমড়ে গেল। নন্দিনির মুখ চোখ তার হাসি হলুদ বিবর্ণ হয়ে উঠল। শেষ মুহূর্তে সে কি অলীকের দিকে তাকালো? মুহূর্তে গোটা ছবিটাকে আগুন গ্রাস করল। নন্দিনী পুড়ছে। সত্যি পুড়ছে। মানিনী হাসছে। পুড়তে পুড়তে নন্দিনীর ছবিটা কালো ছাই হয়ে গেল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন