হেলাফেলার অসমাপ্ত কাহিনীঃ "বর্ষণ অধিক" - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 


 

বই – বর্ষণ অধিক

লেখক – রাজর্ষি দাশ ভৌমিক

প্রকাশনী – বৈভাষিক 

প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারী,  ২০২৩

প্রচ্ছদ আলোকচিত্র  – শৈবাল দাস

প্রচ্ছদ রূপায়ন – পিনাকী দে  

পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৮৪

মুদ্রিত মূল্য – ৩২০/-

 

লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক রচিত নবতম বই “বর্ষণ অধিক”। সাল ১৯৮৩। স্থান যাদবপুর, কলকাতা। মুষলধারে ভেসে যাওয়া কলকাতার এক রাত। খবর আসে যাদবপুরের মধ্যবিত্ত পাড়ায় এক মহিলার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সিনিয়র পুলিশ অফিসারের অনুপস্থিতিতে লালবাজারে কর্মরত প্রায় সদ্য যোগদান করা সাব ইন্সপেক্টর কানাইচরণের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় এই খুনের কেসের তদন্ত করার। অতএব বর্ষা ভেজা শহরের আনাচ কানাচ ঘুরে কানাইচরণের জীবনের প্রথম তদন্ত নিজের সমাধান খুঁজতে শুরু করে। একটি খুনের তদন্তের সূত্রপাত হতেই জানা যায় যে সেই একই সময় একই পাড়ায় অন্য একটি বাড়িতে মৃত মহিলার শাশুড়িও খুন হয়েছেন। অতঃপর দুটি খুনের মামলা দায়ের হয়। স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মীদের সাথে লালবাজারের তদন্তকারীর দল একসাথে সমাধান সূত্র খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেন সম্পর্কের জটিলতা, সন্দেহ, মানসিক দন্ধ, মানুষের ব্যবহারজনিত সমস্যার দুঃখজনক ফলাফলসহ বহুবিধ বিষয়। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ বিভাগের আভ্যন্তরীন বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। এরই সাথে পাশাপাশি ধনী পরিবারের কন্যার জন্য যোগ্য পাত্র উপস্থিত হওয়ায় ও প্রেমিকের পারিবারিক দায়িত্ব পালনের চাপ অগ্রাহ্য না করতে পারার ফলস্বরূপ কানাইচরণের প্রেমে বিচ্ছেদ নেমে আসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে।  সাথে সাথেই পাঠক কানাইচরণের ব্যক্তিগত জীবনের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পান। তাঁর পারিবারিক দায়িত্ব, বাড়ির পরিস্থিতি, প্রেম, প্রেমিকার পারিবারিক অবস্থান সমস্তই জানা যায়। সেই একই সময়ে কলকাতায় আগমন ঘটে বিগত শতাব্দীর কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার স্টোনম্যানের। কলকাতার পুলিশ বাহিনীর উপর সেই কাণ্ডের বিপুল কাজের চাপ ও এক মধ্যবিত্ত পাড়ার হত্যা একটি পেটিকেস যেন এক বৃত্তে আবর্তিত হতে থাকে। ফলত কুখ্যাত কেসটির তাড়নায় পেটিকেসটি ভেসে যায়। অর্থাৎ কানাইচরণ তাঁর প্রথম হত্যা রহস্যের সমাধান করতে ডাহা ফেল করেন। হত্যা রহস্যের সমাধান অমীমাংসিত থেকে যায়। রহস্য গল্পের ভাষায় যাকে ওপেন এন্ডেড বলা হয়। অর্থাৎ যাহা পারো পাঠক বুঝিয়া লও নিজ যোগ্যতা বলে। পুলিশ বাহিনী ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্টোনম্যানকে পাকড়াও করার উদ্দেশ্যে।

এর আগে গোয়েন্দা কানাইচরণকে নিয়ে দুটি বই পড়েছি। “কলকাতা নুয়া” ও “অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার”। যদি শুধুমাত্র রহস্যগল্প হিসাবে সেগুলির বিচার করা হয় তাহলে রুদ্ধশ্বাস, রোমহর্ষক, তাক লাগানো গোত্রের মধ্যে একেবারেই পড়বে না। বরং তুলনামূলক বিচারে বেশ সাদামাটা গল্প বলা যায়। কিন্তু গল্পের আকর্ষণ অন্য জায়গায় ধরা পড়েছিল, যা লেখকের লেখনীকে স্বতন্ত্র করে তুলেছিল। এই বইটিও সেই একই গোত্রীয়।

 

বাংলা সাহিত্যে নতুন গোয়েন্দা চরিত্র কানাইচরণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন মূলত তাঁর অতি সাধারণ বাস্তবধর্মী চরিত্র ও চেহারার জন্য। এই বইয়েও সেই একই ধারা অব্যাহত আছে। 

গল্প শুধুমাত্র খুন ও তার সমাধান সূত্র নিয়ে আবর্তিত হয়নি। এর সাথে জুড়ে গেছে কানাইচরণের ব্যক্তিগত জীবন। তাঁর পারিবারিক আভ্যন্তরীণ সমস্যা, দায়িত্ব, প্রেমে পড়ার সুত্রপাত, প্রেমযাপনের মুহূর্ত - অনুভূতি, বিচ্ছেদ।

রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের লেখনীর একটি বৈশিষ্ট হল গল্পের সাথে সাথে পরিবেশ ও পরিস্থিতির স্বচ্ছ ধারণা থাকে। বর্ষা ঋতুর একঘেয়ে বৃষ্টি, কাদা জলের ভেজা বিরক্তিকর পরিবেশে পুলিশ বিভাগের দায়বদ্ধতা অথচ একাধিক প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করতে বাধ্য হয়েও ক্লান্ত বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতেও খুনের মীমাংসার  জন্য কাজ করে যাওয়ার পুলিশ প্রসিডিওরালকে নিখুঁতভাবে পেশ করেন। সেই বর্ণনা এতই জীবন্ত যে পাঠক বই পাঠের মাধ্যমেই তা অনুভব করতে পারেন।

কিন্তু লেখনীর এত কিছু বলিষ্ঠ উপাদান থাকা সত্ত্বেও এই বইটি হতাশায় আচ্ছন্ন করে দেয়। অত্যন্ত সাধারণ মানের একটি খুনের ঘটনা। অথচ তা সত্ত্বেও তার সমাধান করা হয়নি। কারণ যা বলা হয়েছে তা অত্যন্ত জোলো। স্টোনম্যানের আগমনকে সমাধান অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে। গল্পের সময়কাল ১৯৮৩ সাল। অথচ স্টোনম্যান কলকাতাকে ত্রস্ত করেছিল ১৯৮৯ সালে। সেক্ষেত্রে ছয় বছর আগে তার কারণে অন্য কেস “হয়ত হতে পারে তিনিও” করে ছেড়ে দেওয়া মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এছাড়া ‘রেজিস্ট্রার’, ‘নোয়াপাতি’ প্রভৃতি ছোটখাটো হলেও চোখে লাগার মত ভুল চোখে পড়ল। 

রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের এর আগের বইগুলোর মধ্যে “পাইস হোটেল রহস্য” বাদ দিলে অন্য গল্পে রহস্য উপাদান কম বলে মনে হয়েছিল। বরং সামাজিক গল্পে যে লেখক বেশ পটু তার পরিচয় স্পষ্ট ছিল। “বর্ষণ অধিক” পড়ার পর এই ধারণা পোক্ত হতে বাধ্য কারণ রহস্যের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা অতিরিক্ত মাত্রায় দেওয়া হয়েছে।

'বর্ষণ সিক্ত কলকাতার পল্লীতে দুই গৃহবধূ খুন' বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত কাহিনীর প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা  অত্যন্ত সাধারণ মানের একটি ফটো দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া, বইটির প্রকাশের অযত্নকে আরও প্রকট করে তুলেছে। ফলে বইয়ের প্রতি আকর্ষণও কমে যেতে বাধ্য।  

প্রচুর পরিমাণ পরিবেশ পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়ার পর লেখক যেন হাঁপিয়ে গিয়ে দুম করে গল্প শেষ করতে ব্যগ্র হয়ে গেছেন। না হলে সম্ভাব্য সমাধান থাকা সত্ত্বেও অত্যন্ত বিরক্তিকরভাবে ওপেন এন্ডেড করে ছেড়ে দেওয়ার যুক্তি পাঠককে শুধু যে হতাশ করে তাই নয়, এরপর কানাইচরণ সম্পর্কিত অন্য গল্পের প্রতিও আগ্রহ নষ্ট করে দেয়।

অতিরিক্ত বাস্তব ঘেঁষা কাহিনী লেখার তাড়নায় নাকি অন্য কোনও তাগিদে একটি অত্যন্ত সাধারণ রহস্যের সমাধান অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়া এবং তার নেপথ্য কারণ হিসাবে একটি ভুল ঘটনাক্রমকে দায়ী করার প্রয়াসে বইটি শেষে এসে একটি জগাখিচুড়ি মার্কা বস্তুতে পরিণত হয়ে তীব্র বিরক্তি উৎপাদন করে, যা সময় ও অর্থের অপব্যয় বলেই মনে হতে থাকে।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন