রঙিন চশমা - ভীষ্মদেব সূত্রধর


 

সেদিনও দেখেছি আমাদের চোখের সামনে দিয়ে রঙ বেরঙের অলীক স্বপ্ন দৌড়াত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ফোয়ারার মতো ঊর্ধ্বে উঠে হঠাত্‍ নিম্নে এসে আছাড় খেল। আমরা বিষন্ন চিত্তে অপেক্ষা করছিলাম। সে উঠুক, উড়ুক। খুব কর্তব্য পরায়ণ না হলে বোধকরি এমন সাহস আসেনা। যেদিন জ্বলজ্বল অলৌকিক তত্ত্বের উদঘাটন হল, সেদিন সবাই মুখ ভার করে অভিসম্পাত ছুঁড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মরীচিকার পেছনে বেহুঁশ দৌড়ে ক’জনাই বা জল পেয়েছে! তড়িত্‍ গতিতে মুঠো ভরে এক গপ মুড়ি মাখা মরমর করে চিবোতে চিবোতে সুজয় বলল, "খবিশ না হলে কেউ এমন হয়না। শালা ভন্ড।"


-"ত্যানা পেঁচিয়ে লাভ কী? মাস্টার মশায় তো আর কালেভদ্রে শেখান না!", অগ্নিশর্মা হয়ে জবাব দিল ভট্টাচার্য


সুজয় আরেক মুঠ নিয়ে চুপ করে রইল। ঘরের মধ্যে ব্যাবাক বস্তা ভর্তি বই খাতা নথি পত্তর, তেলাপোকা ইঁদুর কেটে কেটে টুকরো করতে ফাই ফরমাশ খেটে চলেছে। সেসবের তোয়াক্কা করেনা। ঝড়ের দিনে বিহারীপল্লীর চাঁদ তারার পতাকা ছিঁড়েছুড়ে একাকার হয়ে যায়, যেন পাকিস্তান প্রতিনিয়তই পরাজিত। চোখে মুখে ডগমগে ভাব নেই কারো।


এলাকার ছাত্র নেতারা মোড়ে দাঁড়িয়ে চিত্‍কার করে বাহান্ন হতে পঁচাত্তর টেনে আনেন। চাঁদ তারা দেখে তাদের মনে অনুভূতির উদয় হয়নাআমরা ছাতের উপরে গোল হয়ে বসি, একের পিঠের অন্যের কথা জুড়ে ইতিহাস তৈয়ার করি, পৃথিবীর এক ক্ষুদ্রস্থলে আলোচনাটি তীব্র হতে হতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। দু'একজন ফিসফিস করে বলে, “ভাই সাবধান। জামাত আছে।"

 

এই স্বাধীন দেশে কিরকম পরাধীনতায় ভুগছি! সুজয় পত্রিকা মুড়ে বাইরে ফেলে দিয়ে যুৎ হয়ে বসে ঢগঢগ করে জল খায়, ভট্টাচার্য্য কেশে শুরু করে, "ভাবগতি দেখ, আস্তানা গেড়েছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কবে ছেড়েছে, পাক বাঞ্চোত হঠে গেল, জম্ম দিয়ে গেল কুলাঙ্গার।"

- “বলিস না! গায়ে গতরে বীজ কার?”


- “মরি। আবার শুরু হলে দুটো ভাগে বিভক্ত হবে


- “সময় আসবে, রাস্তায় নামার


- “বদ হজম বলে তো কিছু আছে!


-“তাই?“


অন্যায় আবদার নয়। প্রেম হল নেশার মতো, যতক্ষন নেশা আছে, ভাল আছে, নেশা কেটে গেলে অন্ধকার। তাব সংস্থা ধ্বসে পড়ে, অট্টালিকায় ফাটল ধরে,  বিকর্ষণে ছিটকে পড়ে অলৌকিকতা


ভারী ভেজাল বিজ্ঞান নিয়ে, বিজ্ঞামনস্ক, কে বা 'জনা বোঝে বিজ্ঞান।বরফ জলে ভাসে, লৌহ কেন ভাসে না। ইহা বিজ্ঞান, মনস্ক বিবর্তন


বিবর্তন নিয়েও তর্কের কমতি নেই, বিবর্তনের প্রবক্তা ডারউনও কম হেনস্থা হননিচিত্রকর মশাই 'বাঁদর ডারউন'- ব্যঙ্গচিত্র এঁকে প্রমাণ করেছিল মৌলবাদ এবং মৌলবাদীরা বিবর্তিত কিন্তু বিবর্তন সম্পর্কে গর্দভ সম্প্রদায় অজ্ঞানী। এই চিত্রের চেয়ে বহুমূল্যবান চিত্র কামরুল হাসানের আঁকা আইয়ুব খানের ব্যঙ্গচিত্র- "এই জানোয়ারদের..হত্যা করতে হবে"


অথবা তারেক মাসুদের মাটির ময়না সিনেমাটি সব রঙিন খসরা পাতা উবে গেল, কিন্তু আমরা মুখ ভার করবার কিছু কাল পরেই মুখ ফুটে বলতে শিখেছি, “ফাক ফান্ডামেন্টালিজম। ভাঁওতাবাজি এবং অলৌকিক মনগত ভাব।"

 

যারা আর এগোতে পারেনি তারা আলোতে অন্ধকার দেখে পাথরে ঘষাঘষি করছে। রঙিন চশমা পরলে পৃথিবীটা অদ্ভুত রঙিন লাগে। আসলে কী তাই? যদি কেউ প্রকৃতির রঙের কথা বলেন তো দুঃখিত। রঙ আলাদাআদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করুন

 

মশারির ফুটো দিয়ে মশা হুল ফুটোয়, ভেতরে আসবার ক্ষমতা নেই, আজ তার বৈপরীত্য কিছুই ঘটছে না, অলীক স্বপ্ন দেখিয়েই চলছে কিছু ধুরন্দর বদমাশ

 

ভট্টাচার্য হাই তুলে কিছু বলবার উদ্যোগ নিয়েছিল বলল নাবিরক্তি লাগছিল, সুজয় মোবাইলে বারংবার একই রেকডিং বাজিয়ে চলছে,

-   "হ্যালো"

-   "বলো"

-   "খাইছো?"

-   "নাইছো?"

 

- “কি কান্ড! থামা। কত বাজাস! ভট্টাচার্য  আবার রেগে গিয়ে বলল

 

সুজয় বলল, "ক্লান্তি দূর কর।"


- “ক্লান্তি নেই


- “তাইলে কি?”


- “অশান্তি


- “বাহ, বাহ!


- “কেন?”


- “এমনি


- “এমনি কেন?”


- “জানিনা


-“বাল


হাবাগোবা শহর হঠাত্‍ মস্তান সেজেছেআনাচে কানাচে টইটুম্বুর বাতিকগ্রস্থের ভিড়ে সহিংস। আমি কিন্তু আদৌ গান্ধীর নীতিকে সমর্থন করিনি, আমি ক্ষুদিরাম মাস্টারদার প্রিয় মানুষ, কিন্তু একালে মাওবাদী এক ত্রাস, উজাড় হয় ঘরবাড়ি, রক্ত আর মৃত্যু, মাও সে তুং বেঁচে থাকলে আত্মহত্যা করতেন, কি বিকৃত!


আমি এতক্ষণ ভাবছিলাম, পন্ডিত মানুষ! ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে লাভ নেই, তার চেয়ে গান জুড়ি, সবাই বলে আমি নাকি অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করি ...


দরজায় কড়া পড়লে নিস্তব্ধ ঘরখানা থেকে তেলাপোকা ছপ ছপ করে বেড়িয়ে আসে। দরজা খুলে দেখি স্বয়ং আইয়ুব খান দাঁড়িয়ে


 - “কিছু বলবেন?”

- “এখনো লাইট জ্বালানো?“

- “পড়তেছিলাম

- “

-  বসেন“ 


টখট করে বসে পড়লেন, “আজকাল নৌকা মার্কার বড় টান পড়ছে, টাকায় হয়না", বলা শুরু করলে বাধা দেবার সুযোগ নেই

তা শক্তি আছে?”  ভট্টাচার্য টিটকারি মারে


আইয়ুব খান বলেন, “কি যে বলো, পুরুষের শক্তি আশিতেও শক্ত


- শালা কচু।“   (মনে মনে)


- “কিছু বল্লা


- “না


- আমাদের সময়ে এই যে মৌলভী সাব আছে না? ইনি সাহেবদের নৌকা মার্কা সাপ্লাই করতো


সুজয় কথার মাঝে কথা বলল, “নৌকা মার্কা কি?”


আইয়ুব খান দুষ্ট হেসে জবাব দিল, “নৌকা মার্কা চিনো না? দুই ধারে উঁচু তার পাড়ি, মাঝখানে খাড়ি।"


বমি এল। বলে, “বাঞ্চোত! এতো এভয়েড করি, তাও আসে


বিদেয় হল আধঘন্টা পরে। রাত্রি তখন দুটো, কাঁচা মরিচের ঝাল তখনও ঠোঁট জ্বালায়, প্রতিনিয়তই রঙ বদলাচ্ছে, এইসব মানুষদের অন্তরের কথা সমূলে পরপর করে বেড়িয়ে আসে, নষ্ট সমাজে নষ্ট মানুষ


সুজয় কখন গীতপদ্য বন্ধ করেছে খেয়াল করিনি, সেও এক পানে চেয়ে কি যেন ভাবছে। ঠেলা দিয়ে ভট্টাচার্যকে ইশারা করলাম, সিগারেট জ্বালা। ভট্টাচার্য দপ করে আগুন ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল, “এমন ঝাঝরায় কী আসে যায়! এদিন সেদিন হলেও রঙের তকমা দেয়ালে দেয়ালে, মাংসে হাড়ে রক্তে নোংরা পয়জন।“


সুজয় চোখ বুজেছে, অ্যাস্ট্রেতে ছাই ফেলে আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরে আছে, "রাষ্ট্র ধরে আছে কেউ, সমাজ ধরে আছে কেউ, ওরা শুষছে, শোষিত হচ্ছি, দুটো কথা কইলেই আমি কাফের, আমি অমুক তমুক।"


- বাঁচা কী আপনি শেখাবেন রঙ্গলীলা বাবু?”

- বাঁচতে জানি

চিন্তা ঠেকায় কে?”


অর্ধেক পুড়লে পরে ভট্টাচার্য হাত এগিয়ে নিয়ে নেয়। ওর ভীষণ টান, সিদ্ধি খেয়ে অভ্যস্ত, তাই অমন টানে বুক জ্বলে না। "রাত্রীবেলায় স্বস্তি ভেবে ভাবনায় থাকি, অলীক সমস্ত চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাই, বুঝি না কেবল আমি। বুঝিয়ে লাভ? শুধরোবে? সোনালি স্বপ্ন বুনবে? আহারে! স্বপন।"


- "আমিও চোখ বুজবার চেষ্ঠা করি, ঘুম আসেনাভিতরে ভিতরে কি সব আওড়াই ঠাহর করতে পারিনে কি সব!"

 




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন