আহত - তুষার সরদার

 

 এক

প্রত্যন্ত গ্রামের বোকাটে রাত। বয়স খানিক বেশি হয়ে গেলেই সারা গায়ে খুব কালিঝুলি মেখে সব একাকার করে ফেলে। খোলা মাঠে হলে আকাশের তারার অতি কুণ্ঠিত আলোয় হয়তো একেবারে কাছাকাছি নজর একটু আধটু চলে। কিন্তু গ্রামের ভিতরের দিকে নিঃশব্দে একপায়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটোবড়ো নানারকম গাছ-পালার নীচে শুয়ে থাকা জলা বা ডাঙা বা পায়ের নীচে রাস্তায়, সব জায়গায় শুধু দলা পাকানো এক আজব অন্ধকার ছাড়া আর কিছু মালুম হয় না।

উপরের দিকের গাছের ঘন ডাল-পালা এবং নীচের জলা, নয়ানজুলি, রাস্তা বা অন্য রকম ডাঙা সবই অন্ধকারে ঘেঁটেঘুঁটে গিয়ে প্রায় একরকম দেখায়। তবে গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে যারা গভীর রাতে আলো ছাড়াই চলাচলে বরাবর অভ্যস্ত তাদের অন্ধকারের সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকা ঠিক রাস্তায় পথ চলতে অসুবিধা হয় না।

সেজন্য ওরা যখন থকথকে অন্ধকারের মধ্যে গ্রামে ঢোকার রাস্তাটা দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছিল, আলাদা করে ওদের চলন্ত অবয়বের কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই বলে একটা কথাও বলছিল না ওরা। ওদের শিক্ষিত পা অসমান রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কোনো শব্দও তুলছিল না।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা গ্রামে ঢুকল। গ্রামের প্রথম পাড়াটা ওরা পেরিয়ে গেল। তার পরের পাড়ায় ঢুকে একটা নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়ালো। বাড়িটা রাস্তার দিকে পিছন করে তৈরি করা। বাড়ির এই পিছনদিকে একটা বারান্দা আছে। ওরা সামান্য থমকালো। তারপর ঘুরে বাড়িটার সামনের বারান্দার দিকে এগোলো।

গভীর নিদ্রামগ্ন বাড়িটার সামনের দিকে একটা নির্জীব উঠোন চুপচাপ শুয়ে আছে। একদিকে তিন চার ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঁচুতে উঠলে একটা লম্বা বারান্দা। এটাই সামনের বারান্দা। সেই বারান্দার এক প্রান্তে একটা বন্ধ দরজা। সেই বন্ধ দরজার কাছে বারান্দার এক জায়গায় একটা কেরোসিনের টেমি ল্যাম্প জ্বালা আছে।

এই বাড়ির গৃহিণীর সংস্কারবশত বারান্দায় টেমি ল্যাম্পটা সারা রাত জ্বলে, আর সব রাতেই জ্বলে। ওরা এবার নিঃশব্দে সন্তর্পণে বারান্দার উপরে উঠে এগিয়ে গেল। টেমিটার ক্ষীণ আলোর কাছাকাছি এগিয়ে আসার পর তবেই ওদের সকলের লম্বা মজবুত চেহারার আদল আবছাভাবে বোঝা সম্ভব হল।

 

দুই

পৌষের একেবারে গোড়ার দিক। মাঠে মাঠে এখন আশ্বাসভরা পাকা ধানের সোনালি ঢেউ। সেই আষাঢ় মাস থেকে জলে-কাদায় দীর্ঘ হাড়ভাঙ্গা কঠোর পরিশ্রম, সযত্ন পরিচর্যা - নানা প্রাকৃতিক বিপদ আর ঝুঁকি কাটিয়ে এখন অবনত শস্যভারে সফল হয়ে আছে।

এবার কৃষকের শূন্য অঙ্গন এই সোনালি শস্যের আগমনের প্রতীক্ষারত। প্রচন্ড অকাল-বর্ষণ ছাড়া পাকা ধানের প্রাকৃতিক বিপদ এখন আর কিছু নেই বললেই হয়। কিন্তু অপ্রাকৃতিক বিপদ এক-আধটা আছে। সেসব বিপদ খুব বেশি না হলেও, কিছু তো থাকেই।

পাকা ধান চুরি অথবা ডাকাতি হয়। ডাকাতির ঘটনা ঘটলে সেটা স্বভাবতই গোপনে ঘটে না। কারণ ডাকাতিতে থাকে উদ্ধত শক্তির সশস্ত্র প্রকাশ্য আস্ফালন। সেজন্য ডাকাতির ক্ষেত্রে যেখানে বা যেথায় সম্ভব, সেখানে সরাসরি প্রতিরোধ হয়। ডাকাতির প্রতিরোধ হলে সে প্রতিরোধ সশস্ত্রই হয়। তখন মানুষের রক্তে ভিজে যায় নির্বিকার সোনালি ধানের অঙ্গ - মাখামাখি হয়ে যায় একেবারে।

আর চুরি হল নিঃশব্দ কৌশলের সংগুপ্ত ক্ষেত্র। পেশির হুঙ্কারের বদলে সেখানে থাকে নিপুণ হস্তলাঘবতা। চুরির ঘটনা ঘটে গহন অন্ধকারের গোপনে। পাকা ধান চুরির ক্ষেত্রে প্রতিরোধের কোনো ঘটনা না ঘটলেও অন্যভাবে মাঝে মধ্যে কিছুটা রক্তপাত হয়ে যায়।

ধান চুরি যখন হয় সেটা শীতার্ত রাতের অতি গভীরে ঘটে। দুর্দান্ত রকমের ভালো ফলন হয়েছে এমন ধানখেত দিনের আলোতে ভালোভাবে দেখে-শুনে আগেই বেছে রাখা থাকে। বুড়ি রাতের জট-পাকানো কুটিল অন্ধকারে দুটি বা তিনটি, বড়োজোর চারটি ছায়া ছায়া মূর্তি পৌষালি রাতের কুয়াশা মেখে ভেসে আসে সেই নির্বাচিত ধানখেতে। পাকা ধানের গোছা গোছা শীষ সুতীক্ষ্ণ ধারালো হেঁসো চালিয়ে কেটে কেটে বস্তায় ভরে নেওয়া হয়।

নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যেই চাপা হিসহিস শব্দ তুলে ধানের শীষের গলায় ক্রমাগত হুমড়ি খেতে থাকে বালি-শান দেওয়া ঝকঝকে ক্ষিপ্র হেঁসো। কখনও তা অসাবধানে ছুঁয়ে ফেলে দ্রুতগতিমগ্ন কোনো হাতের কোনো আঙুল। ফিনকি দেয় রক্ত। জমাটি শীতে মাখামাখি রাতের নিস্পৃহ আঁধারে তা ঠাহর হতে দেরি হয়।

ধান কাটা চলতেই থাকে যতক্ষণ সম্ভব। পরদিন সকালের আনকো আলোতে দেখা যায় কবন্ধ ধানগাছ নিতান্ত মূঢ়ের স্তব্ধতায় কোথাও কোথাও কালচে আধ-শুকনো রক্তের চিহ্ন বহন করে আছে। কখনও বা সেই পর্যুষিত শোণিতলেখার কাছাকাছি পড়ে থাকে মানুষের হাতের আঙুলের কাটা রক্তাক্ত টুকরো-টাকরা।


তিন


বারান্দার রাখা টেমির ফ্যাকাশে আলোর খুব কাছে আসতে এবার তাদের অবয়ব দেখা যাচ্ছিল। সেই নিদ্রিত বারান্দার প্রান্তে বন্ধ দরজাটার সামনে যারা এসে দাঁড়িয়ে আছে তারা সংখ্যায় মোট তিনজন। সামনে একজন। পিছনে আর দু’জন পাশাপাশি। পিছনের দুজনকে দেখলে মনে হয় একজন আর একজনকে ধরে আছে। ফিসফিসিয়ে পিছনের একজন বলে সামনের জনকে –

‘ডাকিস না, কোনো আওয়াজ দিস না – শুধু টোকা মার দরজায়।’

‘টোকা মারব? টোকা মেরে কী হবে? টোকা মারলে কি আর দরজা খুলবে?’

‘খুলতে পারে। আগে টোকা মেরেই দেখ না।’

‘টোকা মারলে যদি না খোলে দরজা?’

‘খুলবে। না খুললে তখন দরজা খোলার অন্য ব্যবস্থা করা হবে। এখন কথা বাড়াস না, দেরি হয়ে যাচ্ছে। টোকা মার।’

টোকা পড়ে দরজায়। প্রথমে আস্তে আস্তে কয়েকবার। তাতে ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তারপর একটু জোরে দুটো টোকা পড়তেই ভিতর থেকে সেই নির্ভাষ জিজ্ঞাসায় সাড়া দেয় একটি কচি পুরুষের ঘুম-জড়ানো গলা। বয়ঃসন্ধিক্ষণে আসার জন্য তার গলার স্বরে একটু মোটা ভাব এসেছে –

‘কে – এ – এ?’

সে জিজ্ঞাসার উত্তরে ওরা কেউ কোনোরকম সাড়া দেয় না। চুপচাপ একভাবে পাষাণ মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তারা অপেক্ষা করতে থাকে। ঘুমের খোলস ছেড়ে সেই প্রশ্নকর্তা পুরো জাগতে পারল, অথবা লেপ-কম্বলের আশ্রয়ে থেকে আবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল কিনা তা নিয়ে ওরা ভাবছিল না।



চার

ধানের ডাকাতি, চুরির মতো গভীর রাতে হয় না। ডাকাতি হয় ভোরের দিকে, দিনের আলো অল্প একটু উঁকি দিলে। সাধারণত কিছুটা বা ভালোরকম বিতর্কিত মালিকানার জমিতেই ধানের ডাকাতি হয়। ধানের ডাকাতি স্বভাবতই গোপনে হয় না।

ডাকাতি হচ্ছে বলে সেখানে অন্ধকারের বা শব্দহীনতার কোনো গোপনতার প্রয়োজনও থাকে না। সেখানে থাকে না হেঁসোর সন্তর্পিত মুহুর্মুহু হিস্‌হাস্‌ ছোবল। তার বদলে অতর্কিতে হানা দেয় বারো থেকে পনেরো জনের একটি দল। তাদের মধ্যে আট-দশ জন ধারালো কাস্তে হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকা ধানের উপর।

এখানেও সেই একইরকম শুধু ধানের শীষ কেটে নেওয়া। তবে শীষগুলো কাটা হয় অন্য পদ্ধতিতে। আঁধার-মোছা সকালে অনেকগুলো কাস্তে অনেক দ্রুত হারে, অনেকটা জায়গা জুড়ে ধানগাছের বুক থেকে সবলে ছিনিয়ে নিতে থাকে গুচ্ছ গুচ্ছ সোনালি সন্তান।

অবশিষ্ট থাকা চার পাঁচ’জন দাঁড়িয়ে থাকে অলস ভঙ্গিতে অকুস্থলের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাদের হাতে কাস্তে থাকে না। তবে ঝকঝকে কাস্তের মতোই তাদের শাণিত প্রতিরক্ষক দৃষ্টি চারদিকে ঘুরতে থাকে।

সে ধানের অন্য দাবিদার লোকটি বা লোকগুলো মুখে মুখে সেই ডাকাতির খবর ঠিক পেয়ে যায়, তবে হয়তো একটু দেরিতে। ডাকাতি প্রতিরোধ করার উপযুক্ত সশস্ত্র লোকজন জুটিয়ে আসতে আসতে তাদের আরও খানিকটা দেরি হয়। ততক্ষণে হয়তো ষাট-সত্তর ভাগ কাজ সারা। কেটে নেওয়া ধানের শীষ ঠেসে ঠেসে ভরা বড়ো বড়ো বস্তাগুলো গন্তব্যে রওনা দিতে শুরু করেছে। তবুও প্রতিরোধ শুরু হয়।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সেই ক’জন এতক্ষণে সক্রিয় হয়। এখন তাদের কাজের সময় এসেছে। আগে থেকেই ধানগাছের আড়ালে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র এবার যে যার হাতে তুলে নেয় তারা। লাঠি, সড়কি, কোঁচ, বল্লম ছিটকে ওঠে দু’পক্ষেরই হাতে। জলে-কাদায় সে রক্তাক্ত লড়াই চলে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে। কাদায় দলিত হয়, পিষ্ট হয়, নষ্ট হয় সে জমির বা আশে-পাশের অন্য জমির কত না কঠিন শ্রমপ্রসবিত সোনালি ফসল। সেসবের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে ফসলের সৃষ্টিকর্তা মানুষের রক্ত।

 

পাঁচ

বারান্দার প্রান্তের বন্ধ সেই দরজাটা একটু পরেই খুলে যায়। তেরো-চোদ্দোর একটি ছেলেকে দেখা যায় খোলা দরজার মুখে। তার হাতে একটা লণ্ঠনের আলো। এইসব অতি প্রত্যন্ত জায়গায় এখনও পর্যন্ত বিদ্যুতের কোনো সুবিধা বা অসুবিধা কিছুই নেই।

গহীন রাতের আগন্তুকদের ঠিকমতো চিনে উঠতে না পারলেও সে বারান্দায় বেরিয়ে আসে নির্ভয়ে। হাতের লণ্ঠন উঁচু করে ধরে আগন্তুকদের সামনের জনকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। তার সদ্য ঘুমভাঙা চোখ বুঝি একটু দেরি করে ফেলে বুঝে উঠতে। তারপর সবিস্ময়ে সে বলে ওঠে –

‘গণেশকাকু! – তুমি? এত রাতে? তোমার পিছনে ওরা কারা দাঁড়িয়ে?’

‘ডাক্তারবাবুর কাছে আমাদের বড্ড দরকার।’

‘বাবা তো এখন ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু তোমার পিছনে ওরা কারা?’

সরাসরি সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সামনের জন অর্থাৎ গণেশ এবার একপাশে একটু সরে দাঁড়ায়। ছেলেটি আর একটু এগিয়ে গেল। পিছনের দুজনকে দেখে তার বিস্ময় আরো বেড়ে গেল -

‘আরিফচাচা? যতীশকাকু? তোমরা? কার কী হয়েছে যে এত রাতে তোমরা এখানে এসেছ?’

ওরা সবাই ছেলেটির পরিচিত, তবুও সে খুব বেশি অবাক হয়ে গেছে। কারণ ওই তিনজনই হল অত্যন্ত বিখ্যাত বা কুখ্যাত ডাকাত!

‘হ্যাঁ, আমরা মানে, খুব বাধ্য হয়ে এত রাতে এখানে এসেছি। মানে, আমরা – আরিফভাইয়ের শরীর বড়ো খারাপ হয়েছে। ওকে একটু দেখাতে এসেছি, ডাক্তারবাবুকে কি এখন একটু ডাকা যাবে?’

‘আচ্ছা, দেখছি। কিন্তু তোমরা ভিতরে এস। আরিফচাচার শরীর খারাপ বললে, আগে ভিতরে এনে বসাও।’

ছেলেটি সেই ঘরের ভিতরের দিকের একটা দরজা খুলে ওপাশে কোথাও চলে যায়। ওরা এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। এবার ঘরের ভিতরে ঢোকে। ঘরে ঢুকেই পিছনের সেই খোলা দরজাটা বন্ধ করে দেয়। সে ঘরে বসার জায়গা ছিল। কিন্তু কেউ সেখানে বসল না।

 

ছয়

খানিক পরে ঘুমচোখে ভিতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তারবাবু। হাতে টর্চ। পিছনে লণ্ঠন হাতে সেই কচি পুরুষটি। গ্রামের সদাশিব ডাক্তার। বেশির ভাগ চিকিৎসাই অল্প-টাকায়, অতি অল্প-টাকায় বা মাঝে মধ্যে বিনা-টাকাতেও করে ফেলেন।

ডাক্তারখানার ঘরে বসার জায়গা থাকলেও তখনও ওরা কেউ বসেনি, সেই একভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘরে ঢুকে ওদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখে ডাক্তারবাবুও খুব অবাক হন -

‘কী ব্যাপার! এতরাতে একসঙ্গে একেবারে ত্রিরত্ন এখানে এসে হাজির যে! আরিফের নাকি শরীর খারাপ? কী হয়েছে?’

‘তেমন কিছুই হয়নি ডাক্তারবাবু আমার,’ - আরিফ খুব ক্লান্তস্বরে বলে ওঠে’ - এই দুই শালা হারামি, গণশা আর যতে, আমার বারণ শুনলই না। জোর করে এখানে নিয়ে এল, কত অসময়ে এসে তোমার ঘুম ভাঙালো।’

‘যথেষ্ট বিনয় হয়েছে। এবার চটপট বলে ফেল কী হয়েছে তোর?’

‘আজ্ঞে – ইয়ে, মানে আর তো কোথাও আমাদের যাবার কোনো উপায় নেই। সেইজন্য তোমার কাছে শেষ পর্যন্ত এসে পড়েছি ডাক্তারবাবু,’ – যতীশ খুব দ্বিধার ওপর পা ফেলে ফেলে বলতে থাকে – ‘আরিফ ভাই এর খুব চোট হয়ে গেছে। যদি একটু দয়া হয় –’

‘কী হয়েছে আরিফের সেটা আগে দেখি। তারপর দয়ার কথা ভেবে দেখা যাবে।’

 

সাত


এবার গণেশ আর যতীশ দুজনে আরিফের দুপাশে এসে দাঁড়ায়। আরিফের গায়ে জড়ানো ধূসর রঙের চাদরটা সাবধানে খুলে নেয়। তারপর আরিফকে ঘুরিয়ে তার পিছন দিকটা ডাক্তারবাবুর দিকে নিয়ে আসে।

আরিফের পরনে একটা লুঙ্গি। তবে লুঙ্গিটা কোমরে বাঁধার বদলে পিঠ ঢেকে বগলের নীচ দিয়ে বাঁধা। পুরো লুঙ্গিটা কালচে আর লাল

রক্তে সপসপে ভেজা। আস্তে আস্তে কষি আলগা করে আরিফের লুঙ্গিটা নীচের দিকে একেবারে কোমর পর্যন্ত নামিয়ে দেয় ওরা।

এখন আরিফের পিঠ সম্পূর্ণ অনাবৃত। তার পিঠের তিন চার জায়গা কালচে নীল মোটা সাপের মতো লম্বাটে আকারে বীভৎস ভাবে ফুলে উঠেছে। ফোলা জায়গাগুলো থেঁৎলানো, রক্তাক্ত। একটু ডানদিক ঘেঁষে পাছার উপর আর পিঠের একটু নীচ বরাবর চার-পাঁচটি গভীর দগদগে ক্ষত। সম্ভবত কোঁচ বা সড়কির জোরালো আঘাতের ফল।

এছাড়া সারা পিঠে ছোটো আর মাঝারি কাটা-ছেঁড়া কতগুলো তা এক নজরে হিসেব করা যাবে না। পুরো পিঠে এক ঝলক চোখ বুলিয়েই আতঙ্কের চমক লাগে ডাক্তারবাবুর মনে... ডান দিকের কিডনিটা – ??

‘হুঁ-, কোথাও খুনটুন করে এসেছিস কী না সত্যি করে বল? ডাকাতের চিকিৎসা করতে হয়তো রাজি হতে পারি। কিন্তু খুনির চিকিৎসা কখনও করব না।’

‘না – না, মা কালীর দিব্যি – ডাক্তারবাবু, ওসব কিছু হয়নি ’ – সমস্বরে বলে ওঠে গণেশ আর যতীশ – ‘দু’পক্ষেরই কমবেশি চোট আঘাত কিছু কিছু হয়েছে। তার বেশি কিছু নয়। শুধু আরিফ ভাইয়ের চোট সবচে’ বেশি হয়ে গেছে – ’

ততক্ষণে আরিফ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এদিকে। ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে খুবই বেমানান ভাবে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে সে-

‘আল্লার কসম ডাক্তারবাবু! শুধু আজকে বলে নয়, আমি কোনোদিন কারও জান নিইনি...’

অপ্রত্যাশিত এক হঠাৎ কান্নার তোড়ে আরিফের বাকি কথা আটকে যায়। তার কান্না দেখে কঠিন গলায় ডাক্তারবাবু বলে ওঠেন -

‘কাঁদছিস তুই আরিফ? লজ্জা করছে না তোর এভাবে কাঁদতে! এই তো বললি তেমন কিছুই হয়নি। এসব সহ্য করতে না পারবি তো হাঙ্গামা করতে যাস কেন?’

কান্না থামে না তবু তার। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আরিফ বলে –

‘আমার সত্যিই তেমন কিছু হয়নি ডাক্তারবাবু। আর চোট আঘাত খুব বেশি কিছু হলেও তাতে কাঁদার কিছু নেই। কিন্তু আমার কী না শেষে পিছনেই চোট হল! পিছনে চোট হবার আগে আমার ইন্তেকাল হল না কেন!’

‘মানে –?’ আরিফের কথার শেষ অংশটুকু শুনে বিভ্রান্ত হন ডাক্তারবাবু – ‘কী বলছিস তুই বুঝলাম না।’

 

আট

আরিফের সঙ্গী দু’জন একবার কিছু বলবে বলে মুখ তুলে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকায়। কিন্তু আরিফের দিকে একবার চোখ তুলে দেখে দুজনেই আবার মাথা নীচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। সামান্য ভাঙা গলায় আরিফ বলে চলে –

‘আমি আজকে ধান আগলানোর কাজে গেছিলাম, ডাকাতি করতে যাইনি। গন্ডগোলের জমি ছিল। একজন সেই জমিতে ধান রোয়ার কাদা তৈরি করেছে। অন্য একজন দলবল নিয়ে এসে জোর করে ধানখেতের সেই কাদাতে ধানচারা রুয়ে দখল রেখে গেছে। দুজনের তুলনায় আগের জন একটু কমজোরি। ধান পুরো পাকতে না পাকতে প্রথম জন আমার কাছে এসে পড়ল। একটু আগেভাগেই সে ধানটা তুলে নিতে চায়। আমরা জনপাঁচেক আজ ভোরে গেলাম তার ধান কাটা আগলাতে। ধান কেটে তুলে নেবার কাজ প্রায় সারা হয়ে এসেছে তখন। এমন সময় দ্বিতীয় জন খবর পেয়ে দলবল জুটিয়ে ছুটে এল। ওরা দলে অনেক ভারী ছিল। তবু আমরা ওদের আটকে রাখলাম। সড়কি বল্লম আমার তেমন পছন্দ নয়। লাঠিটাই আমার খুব পোষ মানা। ওদের সড়কি বল্লম আমার লাঠিতেই আটকে গেল। আমার হাতে লাঠি থাকলে কখনও আমাকে ছোঁয়া যায় না। এদিকে কিছু পরে বিপক্ষের প্রচন্ড মার সইতে না পেরে আমার লোকেরা একটু একটু করে পিছু হটতে লাগল।

সামান্য বিরতি নেয় আরিফ। গণেশ বোধহয় কিছু বলার জন্য একবার মুখ তোলে, কিন্তু কিছু না বলে আবার মুখ নীচু করে। আরিফের ক্লিষ্ট গলা আবার শোনা গেল –

‘আমি দলের মাথা। দরকার হলে আমি মরতে পারি, কিন্তু পিছু হটা কী তা আমি জানি না – পারি না। আমার লোকেরা খানিক পিছু হটতে একা হয়ে গেলাম। একা হয়ে যেতে বেশ ক’জন এসে আমাকে ঘিরে ফেলল। তাতেও তেমন অসুবিধা কিছু ছিল না। লাঠির আড়া ঘায়ে তিনজনের হাঁটু জখম করে ছিটকে ফেলে দিয়ে আমি পাশ-কাটান করে বেরিয়ে এসে আবার ঘুরে বাকি ক’জনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, – হঠাৎ আমার ডান-পা একটা কাদার গর্তে পড়ে পিছলে গেল। আমি উপুড় হয়ে পড়ে গেলাম, তখন ওরা আমার উপর ঝাঁপিয়ে এল। বিশ্বাস কর ডাক্তারবাবু, আমি তোমাকে আমার আব্বু মানি, সত্যি বলছি, আমি পালাতে যাইনি – আমি পালাতে জানি না। অথচ আমার পিঠের দিকটাই ওরা ছিঁড়ে কুটে দিল। তার চেয়ে ওরা আমাকে জানে খতম করে দিল না কেন? আমাকে কোনো ওষুধ দিও না ডাক্তারবাবু! সব লড়াইতে হার-জিত থাকেই। আল্লা-রসুলের কিরা – হার বা জিত যাই হোক, পিছনে ঘায়ের দাগ নিয়ে আমি জানে বেঁচে থাকতে চাই না! আঃ...! আল্লা মালিক! আমায় জাহান্নাম দাও মেহেরবান, তবু এই কলঙ্কের জান দিও না!’

 

নয়

কথা ফুরিয়ে যেতে আবার নিরশ্রু খিন্ন কান্নায় ফুঁপিয়ে ওঠে আরিফ। কীভাবে কী ভাষায় তাকে সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব তা আরিফের

সঙ্গীরা কেউ ভেবে উঠতে পারে না। তার সবাই অসহায় নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কচি পুরুষটিও বাক্যহারা হয়ে অবাক চোখে আরিফের

দিকেই তাকিয়ে আছে। এখন কথা বলার অধিকারী শুধুমাত্র একজনই এখানে আছেন, তিনি হলেন ডাক্তারবাবু।

রাত্রি তখন তৃতীয় যামে সদ্য প্রবেশ করেছে। এখন গহন স্তব্ধতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে আছে শীতাতুর নৈশ চরাচর। অনির্ণেয় প্রাকৃতিক কারণে রাত্রিচর পশু-পাখি-পতঙ্গ সবই নীরব হয়ে যায় রাত্রির তৃতীয় যামে। গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন গাছের পাতায় জমে ওঠা শিশিরের খসে পড়ার নিষ্প্রাণ টিস্‌-টুস্‌ শব্দ উঠতে না উঠতেই অতি ক্ষীণ বুদবুদের মতো তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেই মহানীরবতায়।

সেই রুদ্ধদ্বার চিকিৎসা-কক্ষের বাতাস তখন ক্রমশ ভারী আর অসহ হয়ে উঠছে মানুষের রক্তের উগ্র আঁশটে গন্ধে। চারজন অরব মানুষের উপস্থিতিতে নিজ রক্তে সিক্ত, হতমান এক নিতান্ত অবিধেয় সেনানী তার শরীরের পিছন দিকে শস্ত্রলেখা বহন করে বেঁচে না থাকার জন্য বিষণ্ণ করুণ আর্তিতে ভাঙতে থাকে – ভাঙতেই থাকে...।’


2 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন