নাগার্জুনের দর্শনে স্বভাব ও শূন্যতা: পর্ব ১ - ডঃ দীপ সরকার


নাগার্জুন (চিত্রসুত্র: উইকিপিডিয়া)

বিশিষ্ট বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের শূন্যবাদ দর্শন, যা বৌদ্ধধর্মের “শূণ্যতার” ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, দাবী করে যে এই মহাবিশ্বের কোন বস্তু কিংবা প্রপঞ্চের কোন অন্তর্নিহিত প্রকৃতি বা “স্বভাব” নেই, অর্থাৎ তা স্বভাবশূন্য। এর অর্থ কী তা বোঝার জন্য  স্বভাবের ধারণা বোঝা প্রয়োজন।

একটি বস্তুর “স্বভাব” বলতে সেই বস্তুর একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বোঝানো যেতে পারে, যা ব্যতীত বস্তুটির অস্তিত্বই থাকবে না । যেমন, তাপকে আগুনের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ভাবা যেতে পারে,  যেহেতু কোনো আগুনের তাপহীন হওয়ার বৈশিষ্ট্য নেই। যদিও অন্যান্য বস্তু, যেমন একটি কয়লার টুকরো, উত্তপ্ত হতে পারে, “উত্তাপ” তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নয় কারণ উত্তপ্ত না হয়েও কয়লাটির অস্তিত্ব থাকতে পারে।এই অর্থে তাপকে আগুনের “স্বভাব” বা “সার-স্বভাব” বলা যেতে পারে।

কিন্তু  নাগার্জুনের যুক্তির লক্ষ্যবস্তু যে “স্বভাব” তার ধারণা উপরোক্ত ধারণার থেকে ভিন্ন; এক্ষেত্রে স্বভাব থাকার অর্থ একটি প্রাথমিক (অগঠিত) উপায়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন অস্তিত্ব থাকা । সহজ ভাষায়,  একটি বস্তুর স্বভাব থাকার অর্থ হল:

১. বস্তুটি সরলতর অংশ দ্বারা গঠিত নয় (বস্তুটি অগঠিত)।

২. বস্তুটির অস্তিত্ব কার্যত (causally) কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়।

স্বভাবের এই ধারণা, যাকে “বস্তু-স্বভাব” বলা হয়, সার-স্বভাবের থেকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ধারণা কারণ এমনটা হওয়া সম্ভব যে কোন বস্তুর সার-স্বভাব আছে কিন্তু বস্তু-স্বভাব নেই। প্রকৃতপক্ষে,  স্বভাবের এই অর্থ অনুযায়ী একমাত্র যে বস্তুর পক্ষে বস্তু-স্বভাব ধারণ করা সম্ভব তা হল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক কণারা (কোয়ার্ক, গলুয়ন ও লেপটন কণিকাসমূহ)।

কিন্তু এদিকে  নাগার্জুনের যুক্তি তো সম্পূর্ণভাবে সমস্ত স্বভাবের অস্তিত্বকেই বাতিল করে, যার অর্থ পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক কণাদেরও কোন স্বভাব থাকতে পারবে না! কিন্তু তা কেমন করে হয়?

এর কারণটা বস্তু-স্বভাবের স্বাধীন অস্তিত্বের মাপকাঠির সাথে সম্পর্কিত। নাগার্জুনের যুক্তি অনুসারে  মৌলিক কণারা তাদের বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্তিত্বশীল হতে পারে না। যদি তা সম্ভব হয় তবে তাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আর অপরিহার্য থাকল না, অর্থাৎ তাদের সার-স্বভাব বলে কিছু রইল না; কিন্তু তার অর্থ দাঁড়ালো যে কণাগুলি তাদের অস্তিত্বের জন্য তাদের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভরশীল।

 

তবে  নাগার্জুনের উদ্ভাবনীপটুতার মূল স্বাক্ষর হল শূন্যতাকেও সমস্ত বস্তুর অন্তর্নিহিত প্রকৃতি হিসাবে বাতিল করা। অর্থাৎ শূণ্যতা নিজেও স্বভাবশূন্য। এটি আপাতদৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর মনে হয় কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হল যে স্বভাব না থাকার বৈশিষ্ট্যও আসলে স্বাধীন নয়, বরং এটি স্বভাবের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের ভ্রান্ত ধারণার উপর নির্ভরশীল। ব্যাপারটিকে “রজ্জুতে সর্পভ্রম”এর উপমা দিয়ে বোঝা যেতে পারে| যিনি সর্পভ্রমে আক্রান্ত তাঁর জন্য “দড়িটি সাপ নয়” এই উপলব্ধি সহায়ক হলেও  দড়িটি স্বকীয়ভাবে "সাপ নয়" এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়। যে ব্যক্তি দড়িটিকে সাপ বলে ভুল করেননি তাঁর দড়িটিকে "সাপ নয়" বলে ধারণা করার প্রয়োজন নেই।

 এখনো পর্যন্ত সংক্ষেপে নাগার্জুনের দর্শন এবং স্বভাবশূন্যতার ধারণা (যা এটি প্রতিষ্ঠা করে)সম্পর্কে আলোকপাত করেছি । কিন্তু বৌদ্ধদর্শনে শূন্যতার ধারণার মূল তাৎপর্য কী সেটা নিয়ে কোন আলোচনা করিনি |

বৌদ্ধ দর্শনে শূণ্যতাকে নিছক একটি দার্শনিক গঠন বা ধারণা হিসাবে বোঝাটা যথেষ্ট নয়, বরং এটি অনুভব করা প্রয়োজন । শূন্যতার অনুভূতি হল এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে আর (ভুলবশত) কোন বস্তু বা প্রপঞ্চের মধ্যে বস্তু-স্বভাব পরিলক্ষিত হয় না । তা শূন্য, অর্থাৎ তার পরম রূপেই, আমাদের কাছে প্রকট হয় |

পাঠক হয়তো ভাবছেন যে শূন্যতার এই ধারণা এবং এর অনুভূতির সাথে জাগতিক দুঃখ এবং চক্রাকার অস্তিত্ব থেকে মুক্তি (নির্বাণ) অর্জনের লক্ষ্যের সম্পর্ক ঠিক কোথায় । সেটা বুঝতে হলে  আমাদের "নির্ভরশীল উৎপত্তি"র ধারণাটির দিকে তাকানো দরকার |

নির্ভরশীল উৎপত্তি হল এই ধারণা যে জাগতিক সমস্ত প্রপঞ্চ বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে উদ্ভূত হয় । অর্থাৎ, নির্ভরশীল উৎপত্তির অন্তর্নিহিত নীতিটি হল কার্যকারণ (কারণ এবং প্রভাব) নীতি। বৌদ্ধধর্ম অনুসারে, এই নীতিটি জাগতিক দুঃখ এবং পুনর্জন্মের সমস্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দুঃখ দুঃখের কারণের প্রভাব, আর পুনর্জন্ম এই জন্মের কর্মের প্রভাব।

বৌদ্ধ দর্শন নির্ভরশীল উৎপত্তিকে বারোটি সংযোগ বা উপাদান দ্বারা গঠিত বলে মনে করে, যথা অজ্ঞতা (অবিদ্যা), মানসিক গঠন (সংস্কার), চেতনা (বিজ্ঞান), নাম এবং রূপ, ছয়টি ইন্দ্রিয় (ষড়ায়তন), স্পর্শ, অনুভূতি (বেদনা), তৃষ্ণা, আঁকড়ে থাকা (উপাদান), হওয়া (ভব), জন্ম এবং বার্ধক্য ও মৃত্যু (জরা-মরণ)। এটা লক্ষণীয় যে উক্ত বারোটি সংযোগের একেবারে প্রথমটি হল অজ্ঞতা, যার অর্থ হল অজ্ঞতাই সমস্ত কর্মের কারণ। দুঃখ এবং পুনর্জন্ম এই কর্মের ফলস্বরূপ।

যে ব্যক্তি সমস্ত বস্তু এবং ঘটনার মধ্যে শূণ্যতা অনুভব করতে সক্ষম হন, তাঁর অজ্ঞতা দূর হয়, | যেহেতু অজ্ঞতাই নির্ভরশীল উৎপত্তির প্রথম সংযোগ এবং কোনো প্রভাব তার কারণ ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না, সেহেতু অজ্ঞতা দূর হলে অন্য সমস্ত সংযোগও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এইভাবে  শূণ্যতার অনুভূতি একজনকে দুঃখ এবং পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি দেয় ও সেই ব্যক্তি নির্বাণপ্রাপ্ত হন।

বুদ্ধের নির্বাণপ্রাপ্তি (চিত্রসুত্র: উইকিপিডিয়া)


শূন্যতার ধারণা এবং অনুভূতির মধ্যে পার্থক্যটি আরও ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে অপটিকাল ইলিউশনের উদাহরণের মাধ্যমে: আমরা সবাই ইন্টারনেটে কোনো-না-কোনো অপটিকাল ইলিউশনের সংস্করণ দেখেছি। এই বিভ্রমগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের বিভ্রম হিসাবে চিহ্নিত করার পরেও তারা অন্তর্হিত হয়ে যায় না |আমরা তাদের আগের মতই প্রত্যক্ষ করতে থাকি | শূন্যতাকে কেবল একটি দার্শনিক ধারণা হিসাবে অনুধাবন করার ব্যাপারটাও এইরকম। এটি আমাদের মনকে বস্তুর মধ্যে স্বভাবের প্রকাশ ঘটানো থেকে বিরত করতে পারে না।

উপরের চিত্রে সবকটা গোলকের রঙই আসলে এক! (চিত্রসুত্র: https://planetradio.co.uk/)

কিন্তু আমরা যদি কোনোভাবে আমাদের মনকে প্রশিক্ষিত করে তুলে এই অপটিকাল বিভ্রমকে প্রত্যক্ষণ করাই বন্ধ করে দিতে পারি, সেটা হল শূণ্যতার অনুভূতির অনুরূপ।এর অর্থ শূণ্যতা সমস্ত ধারণাকে অতিক্রম করে এবং একে কেবল "অনির্বচনীয়" হিসাবেই বর্ণনা করা যেতে পারে।


(নাগার্জুনের দর্শনে স্বভাব ও শূন্যতা: পর্ব ২ পড়ার লিঙ্ক)






References

1.      Westerhoff, J. (2009). Nagarjuna's Madhyamaka: A Philosophical Introduction. Oxford University Press.

2.      https://www.buddhanet.net/fundbud.htm

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন