“ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী-নদী বহি যায়। বস্তি যাদবানন্দ করেন তথায়।।
ভট্টাচার্য্য ঘরে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী । বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনী।।
ঘট বসাইয়া সদা পূজে মনসায়। কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছাড়ি যায়।।
দ্বিজ বংশী বড় হৈল মনসার বরে। ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।।
ঘরে নাই ধান-চাল, চালে নাই ছানি। আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।।
ভাসান গাইয়া পিতা বেড়ান নগরে। চাল-কড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।।
ভাড়াতে দরিদ্র জ্বালা কষ্টের কাহিনি। তাঁর ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।”
-
কবি
চন্দ্রাবতী
কাজের
কী আর শেষ আছে! বেশি যে আর দেরি নেই! এখনও ফুল এসে উঠতে পারেনি, উঠোনে আলপনা
দেওয়াও বেশ কিছুটা বাকি, হালুইকর নিজের কাজে মহাব্যস্ত। ওদিকে ভেতরঘর থেকে মেয়ে
বৌদের হাসি ঠাট্টা কলকাকলি ভেসে আসছে। তবে হইহই না হলে বিয়েবাড়ি কীসের! কার
বিয়ে? আরে, চন্দ্রাবতীর বিয়ে গো, চন্দ্রাবতীর! ওইযে কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারি
গ্রাম, সেখানকার নিবাসী কবি দ্বিজ বংশীদাস আর সুলোচনা দেবীর মেয়ে সে। বহুবছর ধরে
লালিত স্বপ্ন তার সত্যি হতে চলেছে। জীবনের প্রথম প্রেম, কিশোরবেলার প্রেম আজ শুভ
পরিণতি পাবে। জীবনসঙ্গী যে ছেলেবেলার খেলার সাথী জয়ানন্দ। এইতো করিমগঞ্জ উপজেলার
সুন্ধা গ্রামে বাড়ি তার। ছোটবেলায় দুজনে মিলে একসঙ্গে পুজোর জন্য কতো ফুল
তুলেছে। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হতে হতে দুজনের মনের মধ্যেই এক অন্যরকম অনুভূতি
কাজ করতে লাগলো। কিন্তু সে কথা বলবে কাকে! চন্দ্রাবতী লজ্জা পায়, দ্বন্দ্বে ভোগে।
এদিকে জয়ানন্দর তর সয় না। যা হওয়ার হবে ভেবে শেষমেশ চন্দ্রাকে মামার বাড়িতে আশ্রিত পিতৃ্মাতৃহীন জয়ানন্দ
চন্দ্রাবতীকে প্রেমপত্রে আড়াই অক্ষরের প্রেমনিবেদন করেই বসে। চন্দ্রার লাজুক হাসি তার মনে সামান্য
সাহসের সঞ্চার ঘটায়। মনে বল এনে পরেরবার জয়ানন্দ বেশ গুছিয়ে কাব্য করে
চন্দ্রাবতীর জন্য একখানা প্রেমপত্র লিখে পাঠায়। সে প্রেমপত্র ছিল গোছানো, সাহিত্যরস সমৃদ্ধ।
“পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে। পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।।”
…
“যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন। সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই। সর্ব্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমারে যদি পাই।।
আজি হইতে ফুলতোলা সাঙ্গ যে করিয়া। দেশান্তরি হইব কন্যা বিদায় যে লইয়া।।
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দাও ভর। যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিংকর।।”
তখন
থেকেই শুরু। চন্দ্রবতীও
মনের কথা লিখে চিঠির উত্তর দেয়। এভাবেই প্রেমপত্রের মাধ্যমে দুটি হৃদয় কাছাকাছি
আসে- চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে স্বামী হিসাবে কামনা করে –
“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া। তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা-মালতী। জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মতন পতি।।”
সেই কাহিনীর এখন পূর্ণতা পাওয়ার
সময় এসে গেছে। দুই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মতিতে পঞ্জিকা দেখার পর শুভদিনে চার
হাত এক করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। খুশিতে ভেসে যায় দুজনে। এতদিনের স্বপ্ন তাদের
সত্যি হতে চলেছে।
কিন্তু ললাটলিখন কে খন্ডাতে পারে! চন্দ্রাবতী আর জয়ানন্দর প্রেমকাহিনী অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। তার জন্য অবশ্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী জয়ানন্দ নিজে। ওদিকে যখন চন্দ্রা নতুন সংসার সোহাগে যতনে ভরিয়ে রাখার কথা ভাবছে, অন্যদিকে জয়ানন্দর মন মজেছে ভিন্ন ধর্মের এক তরুণীর কাজলচোখে। শৈশবসঙ্গী চন্দ্রার কথা ভুলে যায় সে, ভুলে যায় নতুন সংসারের কথা। বিয়ের প্রস্তুতিতে চন্দ্রার বাড়ির লোকজনের ব্যস্ততা যখন তুঙ্গে, সেইসময় এক কাজীর কন্যা আশমানির রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে প্রেমপত্র লিখে বসে জয়ানন্দ। হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ও নিজের নাম "জয়নাল" হিসাবে পরিবর্তন করে আশমানিকে বিয়ে করে সে। এই সংবাদ পেতে বেশি দেরি হয় না। মুহূর্তের মধ্যে আঁধার হয়ে যায় চন্দ্রাবতীর জগৎ। ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে চন্দ্রাবতী অন্নজল ত্যাগ করে। অশ্রুসজল নয়নে কেটে যায় একটার পর একটা নির্ঘুম রাত। জয়ানন্দ তার সঙ্গে এমনটা করতে পারলো! এখনও যেন বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করে তো আর তাকে ফিরে পাওয়া যাবে না! দ্বিজ বংশীদাস এহেন অবস্থা দেখে কন্যার জন্য পুনরায় সম্বন্ধ দেখা শুরু করেন। তার মনোবাঞ্ছা, এই পাত্র যেন হয় জয়ানন্দর তুলনায় বহুগুণে শ্রেয়। কিন্তু বাদ সাধে কন্যা স্বয়ং। ভালোবাসার প্রতি, সম্পর্কের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। দৃঢ়স্বরে জানায় সারাটা জীবন কুমারী হয়েই কাটিয়ে দিতে চায় সে।
নেহাত আধুনিক যুগ ছিল না তখন। সেসময় সমাজের সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের অভিভাবকদের পক্ষে মেয়েকে আজীবন কুমারী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু তাহলেও এই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দ্বিজ বংশীদাস। তাঁদের পরিবার যে কোনো সাধারণ পরিবার ছিল না। তিনি ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর ভাসান গানের বিখ্যাত গায়ক ও মনসামঙ্গল কাব্যের কবি। পিতার কাছেই ছোট থেকে শিক্ষালাভ করেছেন চন্দ্রাবতী। এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনে চারিদিকে কানাঘুষো শুরু হলেও কন্যার পাশে দ্বিজ বংশীদাস অটল হয়ে রইলেন। কন্যার সিদ্ধান্তে সম্মতি দিলেন। সেই সঙ্গে দেখলেন ভবিষ্যতের পথ। চন্দ্রাবতীদের বাড়িতে বরাবর শিবের পুজো হতো। তাঁর পিতাই করতেন। সেই ছোটবেলা থেকে প্রতিদিন সকালে পুকুরপাড়ে পুজোর ফুল তুলতে যেত চন্দ্রাবতী। নিদারুণ এই কষ্টের সময় দ্বিজ বংশীদাস কন্যার মনকে শান্ত করার জন্য শিবপুজো আর ‘রামায়ণ’ রচনার উপদেশ দেন।
“অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
শিবপুজা কর আর লেখ রামায়ণে।।”
পিতার উপদেশ চন্দ্রাবতী অক্ষরে
অক্ষরে পালন করেছিলেন। বাড়িতে একখানি সব মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন দ্বিজ বংশীদাস।
সেখানেই শিবপুজো ও অবসরে বিদ্যাচর্চায় মন দেন চন্দ্রাবতী।
অতি অল্প বয়সেই চন্দ্রাবতী সারাজীবনের দুঃখ পেয়ে গিয়েছিলেন। তাও কলম থেমে থাকেনি তাঁর। মধ্যযুগের একমাত্র মহিলা কবি ছিলেন তিনি। বলা ভালো, চন্দ্রাবতী ছিলেন প্রথম মহিলা কবি। সেসময়ে লেখক এবং কবিরা সাধারণত দেবদেবীনির্ভর সাহিত্য রচনা করতেই বেশি আত্মনিয়োগ করতেন বেশি। একমাত্র চন্দ্রাবতী সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ, প্রতিবাদ এবং বীরত্বের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর রচিত ‘মলুয়া’ ও ‘দস্যু কেনারামের পালা’ এই দুই পালায় তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। তাঁর পিতা যে রামায়ণ রচনা করতে বলেছিলেন, চন্দ্রাবতী তাঁর আদেশের মান্যতা দিয়েছিলেন। প্রচলিত কৃত্তিবাসী বা বাল্মীকির ‘রামায়ণ’কে অনুসরণ করার পরিবর্তে গ্রাম্যগল্পকে প্রাধান্য দিয়ে এক ব্যতিক্রমী ‘রামায়ণ’ পালা রচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমী কারণ তাঁর রামায়ণের মুখ্য চরিত্র সীতা। সীতার দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি রচনা করেছিলেন। এমনকি রামচন্দ্রের দোষত্রুটিগুলো অবলীলায় তুলে ধরতে পিছপা হননি। সীতার পৌরাণিক জন্মকাহিনীকেও তিনি অনুসরণ করেননি, উপরন্তু এখানে লোকমুখে প্রচলিত গল্পকে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। সীতা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন -
চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণ তিনটি খণ্ডে উনিশটি অধ্যায়ে রচিত। প্রথম খণ্ডে ৮টি, দ্বিতীয় খণ্ডে ২টি ও তৃ্তীয় খণ্ডে ৯টি অধ্যায় আছে। তাঁর রামায়ণের প্রথমে রয়েছে সীতার জন্মবৃত্তান্ত, তারপর রামের জন্ম, রামসীতার বিবাহ ও রামের বনবাস। দ্বিতীয় খণ্ডে শুরু হয়েছে সীতার বারোমাস্যা যা বর্ণনার মধ্য দিয়ে রাবণের সীতাহরণ ও রাম-রাবণের যুদ্ধের কথা সংক্ষেপে পাওয়া যায়। তৃ্তীয় খণ্ডে সীতার বনবাসের পূর্ব সূচনায় রাম অযোধ্যায় ফেরার পর পাঁচমাসের গর্ভবতী সীতাকে রাজ্যের বাইরে বনবাসে পাঠিয়েছে। সেখানে যমজ পুত্রের জন্ম দিয়েছে সীতা। আবার রাজ্যকে অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রাম বন থেকে সীতাকে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে তাকে সতীত্ব প্রমাণ করতে বললে শেষপর্যন্ত পাতলে প্রবেশ করেছে সীতা। চন্দ্রাবতী তাঁর রামায়ণে গঠনগত, ভাষাগত ও কাহিনীগত দিক থেকে প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে মহাকাব্যের ধরণে নয়, পাঁচালির ধরণে রচনা করেছেন তাঁর রামায়ণ আর মঙ্গলকাব্যের ধরণে লিখেছেন সীতার বারোমাস্যা।
চন্দ্রাবতী বিভিন্ন লোকগাথা থেকে রামকথার উপাদান সংগ্রহ করে নতুন এক রামায়ণ রচনা করেছিলেন। জীবনপীড়াকে তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তাঁর রচিত রামায়ণে সীতার দুঃখ কষ্ট প্রাধান্য পেয়েছিল। পরিশীলিত সাহিত্য-দরবারে চন্দ্রাবতীর রামায়ণপালাটি স্থান না পেলেও বিভিন্ন নিম্নবিত্ত পল্লিসমাজে নারীদের ঘরোয়া রামায়ণী আচার অনুষ্ঠানে কোথাও কোথাও আজও এই পালাগানটি পরিবেশিত হয়ে থাকে। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রখ্যাত সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। সীতার দুঃখের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল চন্দ্রাবতীর দুঃখ। সেই একই সূত্রে হয়তো মিলেছিল নবনীতা দেবসেনেরও বিরহব্যথা। চন্দ্রাবতী রামায়ণ পড়ার পর তিনি এতটাই অভিভূত হন যে ১৯৮৯ সালে প্রথমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে দিল্লিতে এ বিষয়ে দু'টি বক্তৃতা দেন। ১৯৯১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ নিয়ে বক্তৃতা দেন। পরে ইউটা, কলম্বিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানা জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে এই সম্পর্কে বলেন। শুধু তাই নয়, নবনীতা দেবসেন অবাঙালিদের কাছে এটির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য চন্দ্রাবতী রামায়ণের ইংরাজী অনুবাদও করেন।
বাংলা ভাষার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর মন্দির ( ছবি – সংগৃহীত)
চন্দ্রাবতী আর নেই, তবে তাঁর রচিত
পালাগানগুলি আজও রয়ে গেছে কিশোরগঞ্জের লোকসংস্কৃতির আনাচে কানাচে। রয়ে গেছে
কিশোরগঞ্জ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাতুয়ারি গ্রাম, ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। এখন আর
নদীর কোন চিহ্ন নেই। তবে ওই গ্রামেই রয়ে গেছে বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর
শিবমন্দির ও তাঁর পূর্বপুরুষদের ভগ্নপ্রায় কয়েকশ’ বছরের পুরনো বাড়ি। এই মন্দির ও
বাড়ি পরমযত্নে আগলে রেখেছে চন্দ্রাবতীর স্মৃতিচিহ্নকে। পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান এটি। কিন্তু দীর্ঘদিন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে
এগুলি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই কারণে এলাকাবাসীরা মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে একখানা
পর্যটনকেন্দ্র এবং কবির স্মৃতিরক্ষায় একটি পাঠাগার গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক চন্দ্রাবতীর
স্মৃতিচিহ্ন যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে শুনিয়ে যাবে এক দুখিনী কবির আখ্যান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন