সোনার আংটি - শান্তনু চ্যাটার্জী


 

মিলন যখন বাড়ি ফিরলবাইরে তুমুল বৃষ্টি হয়ে চলেছে বেরোবার সময় ছাতাটা নিতে ভুলে গেছিল বলে একেবারে কাক স্নান করে ফিরেছে মালতী বলল, ‘তুমি কি গোছাতাটা নাওনিবৃষ্টির মধ্যে কোন শেডের নিচে দাঁড়িয়ে যেতে পারতে কেমন ভিজে গেছ বল তো!’ বৌয়ের কথার কোন উত্তর দিল না মিলন ঘরের দড়িতে টাঙান গামছাটা টেনে নিয়ে কোনোরকমে গা মুছে জামার পকেট থেকে সন্তর্পণে একটা চকচকে জিনিস বার করল

ঘরের মধ্যে বেশ অন্ধকার লোডশেডিং হওয়ায় একটা মাত্র মার্জেন্সি ল্যাম্প জ্বলছে তাই মালতীও প্রথমে বুঝতে পারেনি মিলনের হাতে ওটা কিমিলন সেটাকে যখন মালতীর কাছে নিয়ে এল মার্জেন্সির আলোয় চকচক করে উঠল একটা সোনার আংটি মালতী চমকে উঠে বলে, ‘তুমি এটা কিনতে গেছিলেআমাকে বলনি তো ?’

নীরবে মুচকি হেসে মিলন জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগলবললে না তো?’

মালতী আর কি বলবেএকটা সোনার আংটির শখ তার কত বছরের! তার স্বামী সামান্য কাজ করেমাইনে বেশি নয় সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক জিনিস আর মালতীর চিকিৎসার খরচ জোগাতেই তো তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় কিভাবে কিনবে সে সোনার আংটি?

মিলন যখন আংটিটা তার মধ্যমায় পরিয়ে দিলদেখা গেল একটু ঢিলা হচ্ছে কিন্তু মালতীর সেসবে খেয়াল নেই তার এত বছরের সাধ পূরণ হয়েছেএতেই তার তৃপ্তি আংটিটা পরে হাতটাকে বার বার নেড়েচেড়ে সে দেখতে লাগল আংটিটা বেশ বড়, মাঝখানে একটা হীরে বসানো আর চারিদিকে লাল-নীল রঙের রত্ন খচিত খুশিতে ডগমগ হয়ে মিলনকে দুবার চুমু খেল সে তারপর ভিজে জামাকাপড় পরে থাকবার জন্য বকা দিল

পোশাক পাল্টে মিলন যখন ঘরে ঢুকলমালতী তখন আংটিটার দিকে তাকিয়ে যেন সেটার উদ্দেশেই বলছিল, ‘আর কতদিনই বা পরতে পারব বড়োজোর একটা বছর তারপর

মিলন এক ধমক দিল তাকে, ‘একদম অমন কথা বলবে না আজকের এই আনন্দের দিনেও ওসব কথা?’

মালতী বলে, ‘তা নয় গো দশ বছর আগে যা হারিয়েছিলামআজ তুমি সেটা এনে দিলে কিন্তু তোমায় আমি কি এনে দিতে পারলাম বল?’

মিলন তাকে বলে, ‘আজ ওসব কথা থাক নামালতী

পরের দিন সকালে মিলন কাজে বেরোচ্ছে, এমন সময় একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল তার বাড়ির সামনে। কে এসেছে দেখার জন্য দরজা খুলে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে সে। সামনে দাঁড়িয়ে অনিকেত মালাকার। অর্থাৎ সে যে হোটেলে কাজ করে তার মালিক। তার সাথে এসেছে দোকানের অন্য এক কর্মচারী, সুজয়। জুতো পরেই দুজন তার ঘরের দাওয়ায় উঠে দাঁড়িয়েছে। অনিকেতের মুখে একটা রাগত ভঙ্গী

ওদের দুজনকে এভাবে এখানে দেখবে, মিলন এটা আশা করেনি। সে কি বলবে, প্রথমটায় ঠিক করে উঠতে পারল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সুজয়ই মুখ খুলল প্রথমে। সে বলল, ‘কাল অনিকেতদার একটা আংটি হারিয়ে গেছে। তুমি এই ব্যাপারে কিছু বলবে মিলনদা?’

মিলন তো যেন আকাশ থেকে পড়ে। সে বলে, ‘আংটি? অনিকেতদার আংটির খোঁজ আমি কি করে জানব ভাই?’

সুজয় ঠোঁট কাটা ভঙ্গীতে বলে, ‘আসলে তুমি ওর পেয়ারের লোক কিনা। আর কালও তো তুমি কি একটা জিনিস আনতে যেন ওর ঘরে গেছিলে।’




মিলন এবার যেন ঈষৎ ক্ষুণ্ণ হয়ে বলে, ‘তুই কি বলতে চাচ্ছিস সুজয়?’

 

উত্তরটা এবার সুজয় দিল না। অনিকেতই বলল, ‘তোমাকে একবার আমার সাথে আসতে হবে মিলন। আমার গাড়িতে।’ কথাটার মধ্যে একটা আদেশোচিত অভিব্যক্তি ছিল যা অগ্রাহ্য করতে পারল না মিলন। সে বলল, ‘চল, আমি আসছি।’

এই বলে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ঘরে তখন মালতী বিছানায় উঠে বসে একদৃষ্টে চেয়ে আছে মিলনের দিকে, ‘ওরা কি বলছিল গো তোমাকে? কেন এসেছে ওরা?’ মিলন দেখে মালতীর শ্বাস-প্রশ্বাস খুব দ্রুত পড়ছে। তার মধ্যে অত্যন্ত উদ্বেগ কাজ করে চলেছে

মিলন তাকে আশ্বস্ত করে, ‘ঐ অনিকেতদা এসেছে। একটা জরুরী কাজ আছে তো, তাই আমাকে এখুনি বেরোতে হবে।’

সান্ত্বনা মানে না মালতী, ‘তুমি সত্যি কথা বল কিন্তু। ওরা আংটির কথা বলছিল। কি হয়েছে সত্যি করে বল তুমি আমায়। কোথা থেকে পেয়েছ এই আংটি?’

মিলন বারবার মালতীকে বোঝাতে থাকে, ব্যাপারটা আসলে কিছুই নয়। অনিকেতদা একটা আংটি কিনবে, সেকথা নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। এখন তাকে বেরোতে হবে। মালতী যেন তার আর দেরী না করায়, আর নিজেও যেন এসব উদ্ভট কাল্পনিক চিন্তা না করে। তার শরীরের অবস্থা ভাল নয়, সেকথা যেন সে মাথায় রাখে

এই বলে মিলন যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, মালতী ম্রিয়মাণ স্বরে বলে ওঠে, ‘ছোট সুখের জন্য বড় ক্ষতি করে কি লাভ? তোমার কিছু হলে আমাকে কেউ দেখার থাকবে না গো, সেটা মনে রেখো।’

মালতীর কথার কোন উত্তর না দিয়ে মিলন বেরিয়ে যায়

 

মিলনকে নিয়েই অনিকেতের গাড়ি ছেড়ে দিল। কিন্তু বেশিদূর নয়, মিলনের বাড়ি থেকে বড়জোর মাইলখানেক পথ পেরিয়েই গাড়িটা একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে এসে দাঁড়াল। সুজয় বলে, ‘অনিকেতদা তোমাকে গাড়ি চড়াবে বলে কিন্তু এখানে আনেনি মিলনদা। সুতরাং এবার জবাব দাও তুমি। আর চুপ করে থেক না।’

মিলন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘কি বলব আমি? তুই কি শুনতে চাস আমার কাছ থেকে?’

অনিকেত বলল, ‘কাল তোমাকে যখন আমার ঘর থেকে আমার চশমাটা আনতে বললাম, তখন তুমি তো আমার ঘরে গেছিলে। তার কিছুক্ষণ আগেও ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি দেখেছি আংটিটা আমার ড্রয়ারেই ছিল। তারপর থেকে আমি বাড়িতে ঢোকার মধ্যে সে ঘরে আর কেউ ঢোকেওনি। তাহলে আংটিটা গেল কোথায়?’

মিলন গম্ভীরভাবে বলে, ‘একথা আমাকে বলছ কেন? আমি তো কেবল তোমার চশমাটা আনতে গেছিলাম। চশমাটা টেবিলের ওপরে ছিল, আমি ওটা নিয়েছি আর চলে এসেছি। ব্যস।’

অনিকেত বলে, ‘তুমি আমার অনেক পুরনো কর্মচারী মিলন। তোমাকে অবিশ্বাস করাটা আমার উচিত হবে না। তবুও বলছি, জিনিসটা যদি তুমি নিয়েই থাক, তবে আমাদের বলে দাও। পুলিশের হাঙ্গামা আমার ভাল লাগে না।’

সুজয় বলে, ‘দাম জানো আংটিটার? অমন জিনিসের দাম দিতে গেলে তোমাকে বাড়ি বেচতে হবে। ভাল চাও তো স্বীকার কর। না হলে, দেব এমন কমপ্লেন ঠুকে যে সারাজীবন জেলের ঘানি টানবে।’

মিলন বলে, ‘তোমরা আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছ। চুরি আমি করিনি অনিকেতদা। আর চুরি করার ইচ্ছেই যদি আমার থাকত, তবে আমি সেটা অনেক আগেই করতে পারতাম। কেন চুরি করব আমি?

সুজয় বলে, ‘এ এমনিতে সোজা হবে না অনিকেতদা। তুমি দাদার পুরনো লোক, তাই দাদা এভাবে তোমাকে বলছে। কিন্তু তুমি শুনলে না। এবার পুলিসে কেস দিলেই তুমি ঠেলা বুঝবে।’

মিলন বলে, ‘আমি গরীব হতে পারি। কিন্তু চুরি করা আমার স্বভাব নয়। বাড়িতে আমার বৌ আছে অসুস্থ’ কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ থেমে যায় মিলন

মিলন কিছুতেই স্বীকার করল না দেখে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে অনিকেত আর সুজয় চলে যায়। মিলন জানে, এসময় বাড়িতে পৌঁছলে মালতী তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলবে। তাছাড়া মনটাও তার অত্যন্ত বিমর্ষ। রাস্তাটা ফাঁকা। সেই রাস্তা দিয়েই হাঁটতে থাকে সে। কিছুক্ষণ পরে একটা দীঘি পড়ল পথের ধারে। সেই দীঘির ধারে চুপ করে বসে রইল মিলন

ঠিক এইসময় তার বাড়িতে মালতীও খাটের ওপর বসে রয়েছে। হয়ত দুজনেরই মনে ভেসে আসছে একই কথা, সেই একই স্মৃতি

ছোট্ট তাদের সংসার। এই সংসারে সুখ ধরা দিয়েও ফসকে যায় খুব সহজে। দশ বছর আগের একটা ভাবনা আজ আবার ভেসে আসে তার মনের পর্দায়

মিলন তখন একটা গ্যারেজে কাজ করত। আর বাড়ি ফেরার সময়ে রোজই নারায়ণের চায়ের দোকানে আড্ডা মারত। মালতী ওকে প্রথমবার সেখানেই দেখেছিল। মাঝেমধ্যে বাবাকে সাহায্য করতে বাবার দোকানে আসত বটে মালতী। তবে বেশি একটা নয়। এর মধ্যেই যে কিভাবে তার মেয়ে তার দোকানেরই একজন স্থায়ী খরিদ্দারকে খরিদ করে নিল, আর তাকে অগাধ দুশ্চিন্তার সাগরে নিমজ্জিত করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল সেটা মালতীর মা ও বাবা দুজনের কাছেই একটা পরমাশ্চর্যের বিষয়

সে যাই হোক, প্রেম হল, ভালবাসা হল, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়েটাও হল। তারপর একদিন শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে মেয়ে জামাইয়ের মন-কষাকষিও সমাপ্ত হল। কিন্তু অভাব ঘুচল না নিত্যদিনের অভাব সেই একই রয়ে গেল। এই নিয়ে শ্বশুর আর শালা দুজনেই মিলনকে খোঁচা দিত। ‘যে পুরুষ বিয়ের পর বৌকে নিদেনপক্ষে একটা আংটিও দিতে পারে না, সে আবার কিসের পুরুষ?’ এইসব উক্তি মিলনকে প্রায়শই শুনতে হত। মালতীর সম্মানেও এতে আঘাত লাগত

আসলে গ্যারেজে কাজ করে সংসারের খরচ চালানোর সামর্থ্য হচ্ছিল না মিলনের। একটা ভাল কাজের সন্ধান সে করতে লাগল। এই সময়ই এক পরিচিত বন্ধুর সূত্রে সে জানতে পারল অনিকেতের রেস্টুরেন্টটার কথা। মিলন তখন আর রাজী হয়ে যেতে দেরি করেনি। পরদিন বন্ধুই তাকে নিয়ে যায় অনিকেতের বাড়ি। মিলনের বন্ধুর কাছ থেকে আগেই তার সম্বন্ধে কিছুটা শুনেছিল অনিকেত। সামনাসামনি তাকে দেখেশুনেও ভদ্র ভাল ছেলে বলেই মনে হল তার। তারপর মৌখিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে চাকরিতে বহাল করে নিল

এখানে মাইনে কিছুটা বেশি হওয়ায় সংসারের খরচ করেও হাতে কিছু টাকা বাঁচত মিলনের। আর এই টাকাগুলো জমিয়েই শ্বশুরবাড়ির সমস্ত অপমানের জবাব দিয়েছিল মিলন একদিন। সেই দিনটাও ছিল বৃষ্টি মুখরিত। মালতীর গর্ভে তখন সাত মাসের সন্তান কাজ সেরে ঘরে ফিরে মিলন হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ছিল মালতীর সামনে গা থেকে তার টপটপ করে জল পড়ছে তবু ভ্রূক্ষেপ নেই মালতী বলে, ‘গায়ের জলটা আগে মোছ দাঁড়াও আমি গরম জল করে দিইএকটু গরম জলে স্নান কর’ এই বলে মালতী উঠতে যাবেমিলন তাকে থামিয়ে জামার পকেট থেকে একটা সোনার আংটি বের করে দেখায় তারপর তার হাতে তুলে দেয় সেটা গরীব ঘরের মেয়ে মালতীবৌও হয়ে এসেছে সে গরীবের বাড়িতে সোনার আংটি তার কাছে স্বপ্ন কিন্তু সেই স্বপ্নকে হাতে পেয়ে সে আর কোন বাধ মানেনি বাঁধনহারা আনন্দে উচিত অনুচিতের সীমাটা ভুলে গিয়েছিল সে পরদিন থেকেই পাড়ায় যত পরিচিত জনকে সামনে পেয়েছেতাদের সকলকে বলে বেড়িয়েছে, ‘দেখোআংটিটা খুব সুন্দর নাকালকেই ও এনে দিল’ শুধু পাড়ার লোক নয়আত্মীয়-স্বজনদেরও দেখিয়েছেসব শুনিয়েছে তা দেখে কেউ হয়েছে খুশিকেউ ব্যঙ্গ করে মুখ বেঁকিয়েছেবলেছে, ‘ধুরওসব অনেক দেখেছি সোনার না ছাইও নকল মাল সব জানা আছে আমাদের আর কেউ বা তার আংটি দেখে অন্য ফন্দি এঁটেছে

এর দুদিন পরের এক সন্ধেবেলার ঘটনা মিলনের তখন ঘরে ফেরার সময় হয়ে গেছে এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ মালতী ভেবেছিল তার স্বামীই এসেছে কিন্তু দরজা খুলে সে দেখে দুজন অপরিচিত লোক মুখ গামছায় ঢাকা অবাক হয়ে মালতী প্রশ্ন করে, ‘কে আপনারাকি চান?’ কিন্তু তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ওকে জোর করে ঠেলে ওরা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর প্রথমেই বলে, ‘একদম চেঁচাবি না চেঁচালেই কিন্তু এমন লাথি মারব যে এখানেই পেট খসে যাবে’ এই বলে ওদের একজন একটা চকচকে ভোজালি বার করল মালতী বুঝতে পারল কত বড় বিপদ তার সামনে দেওয়ালে পিঠে ঠেকিয়ে সে সভয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি চাই?’

ওদের একজন ঘরের দরজার ছিটকিনি আটকাতে আটকাতে উত্তর দিল, ‘তোর সেই সোনার আংটিটা বের কর’ মালতী বুঝল গত্যন্তর নেই ভোজালির মুখে ওদের বিরুদ্ধে যাওয়ার বোকামি না করে সে আলমারির চাবিটা ওদের হাতে তুলে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করল নির্দ্বিধায় ওরা যখন ওদের অপারেশন শেষ করে চলে যাচ্ছিলতখন শুধু একবার মালতী চিৎকার করে উঠেছিল, ‘বাঁচাওচোরচোর আমার আংটি নিয়ে পালাল

আর সেটাই হল কাল মালতীর চিৎকার শুনে ওরা আর স্থির থাকতে পারল না রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আবার ফিরে এল ‘তোকে চেঁচাতে মানা করেছিলাম না’ বলে দুজনেই মালতীর গর্ভে করল সুতীব্র পদাঘাত তীক্ষ্ণ আর্তনাদে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মালতী আওয়াজ শুনে পাড়ার লোক যখন দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকেতখন দুজন দুষ্কৃতীই পালিয়েছে আর অচৈতন্য মালতীর দেহের চারিপাশটা ভেসে যাচ্ছে তাজা লাল রক্তে

তাকে যে বাঁচানো গেছিল সেটাই বড়ো কথা ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ‘এ যাত্রায় ও বেঁচে গেল ঠিকইতবে ওর পক্ষে আর মা হওয়া সম্ভব হবে না’ মিলন সেটা শুনে দুঃখ পেয়েছিল কিন্তু মালতীকে না-হারাবার আনন্দের চেয়ে সে দুঃখ ছিল অনেক কম

পরে অবশ্য পুলিস ঐ দুজন দুষ্কৃতীকে ধরেছিল জানা গেছিলওরা ওদের এক পড়শির জ্ঞাতি মালতীর সোনার আংটির খবর পেয়ে ওরা সেটাকে চুরি করবার পরিকল্পনা করে যারা এই চুরির সাথে যুক্ত ছিল তাদের সকলেরই সাজা হয় তবে মালতী যেমন তার সোনার আংটি ফিরে পায়নিতেমনি ফিরে পায়নি তার মা হওয়ার ক্ষমতাও

তাই সে মাঝেমাঝেই বলে উঠত, ‘তোমাকে তো কিছুই দিতে পারলাম না।’ এই আক্ষেপ হয়ত তার এ জীবনে মিটবে না

মিলন সেদিন সারাটা সকালই কখনো দীঘির পাড়ে, কখনো এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে কাটাল। মনের মধ্যে তার নানা চিন্তা ঘুরছে। শেষমেশ সে ঠিকই করে ফেলল মালিকের সাথে সে দেখা করবে। শেষ বিকেলের লাল সূর্যটা তখন দীঘির ওপারের গাছগুলোর পেছনে অস্ত যাচ্ছে আর উল্টোদিকের আকাশটার রঙ গাঢ় হয়ে আসছে। রাস্তা দিয়ে অফিস ফেরত লোকগুলো বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু মিলনের এখন বাড়ি গেলে চলবে না। আজ মালিকের সাথে একটা বোঝাপড়ার দরকার আছে

মিলন যখন অনিকেতের বাড়ি পৌঁছলতখন সারা বাড়ি প্রায় অন্ধকার দোতলা বড় বাড়ি বাড়ির সামনে একটা সাজানো বাগানআর তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু এক ফালি রাস্তা বাইরের এই জায়গাটাও বেশ অন্ধকার রাস্তাটার দুধারে আলোর ব্যবস্থা রয়েছেকিন্তু একটাও আলো জ্বালানো হয়নি সদর দরজার সামনে একটা গাড়ি বারান্দা রয়েছে বেশ কিছুটা হাতড়ে মিলনকে কলিং বেলটা খুঁজে পেতে হল

দুবার বেল বাজানোর পরেও যখন কেউ দরজা খুলল নামিলন ভাবলবাড়িতে বোধহয় কেউ নেই ফিরেই যাবে মনস্থ করেছিল এমন সময় বাড়ির পেছন দিক থেকে একজন বেঁটেখাটো রোগা লোক তার দিকে এগিয়ে এল, ‘কাকে চাই?’ মিলন জবাব দেয়, ‘অনিকেতদা আছে?’ লোকটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল খানিকক্ষণ পরে জিগ্যেস করল, ‘আপনি মিলন না?’ এ বাড়ির পুরনো চাকর ভোলাকে চিনতেও দেরি হল না মিলনের। সে বলল, ‘হ্যাঁ, অনিকেতদার সাথে একটু কথা বলার দরকার আছে।’ কিছুক্ষণ চিন্তা করে ভোলা বলল, ‘ঠিক আছেআপনি দোতলায় চলে যান তবে সামনের দরজা খুলবে না আপনি পেছনের দরজা দিয়ে যান

এই বলে লোকটা বিদায় নিল ধীর পদক্ষেপে মিলন অন্ধকারময় রাস্তা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে অবশেষে অনিকেতের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল ঘরের দরজা খোলাই ছিল বড় ড্রেসিং টেবিলএকটা ওভাল আয়না আর তার সামনে স্থির শিখায় জ্বলছে একটা মোমবাতি তার বিপরীতে একটা ইজিচেয়ারে বসে হাতের তালু দুটো চিবুকে রেখে কি এক গভীর চিন্তায় মগ্ন অনিকেত মালাকার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে ঐ মোমবাতির নিষ্কম্প শিখার দিকে

মিলন বাইরে থেকে প্রথমে গলা খাঁখারি দিল কিন্তু তাতে অনিকেতের ভাবভঙ্গীর কোন পরিবর্তন দেখা দিল না মিলন এবার কথা বলল, ‘অনিকেতদাআমি এসেছি’ মুখ না তুলেই অনিকেত মৃদু অথচ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘কি ব্যাপার?’

মিলন বলে, ‘আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি অনিকেতদা বিশ্বাস করআমি নিরুপায় ছিলাম আসলে মালতী অনেকদিন ধরেই একটা সোনার আংটির কথা বলছিল ওর ক্যান্সার যেভাবে ওকে আঁকড়ে বসেছেতাতে ও যে আর বেশিদিন বাঁচবে না তা জানি শুধু জানি নাকিভাবে পূরণ করব ওর এই শেষ ইচ্ছেটা একে তো আমার আয় বেশি নয়তার ওপর ওর চিকিৎসার খরচে আমার সর্বস্ব চলে যাচ্ছে নিজেকে খুব অসহায় লাগে সবসময় তাই গতকাল যখন তোমার টেবিলের ড্রয়ারে আংটিটা দেখতে পেলাম.

এইটুকু বলে মিলন থেমে গেল চারিদিকে একটা দম চাপা নিস্তব্ধতা মিলন ফের বলতে গেল, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে অনিকেতদা, আমাকে ক্ষমা কর আমি কথা দিচ্ছিতোমাকে আমি ওটা ফেরত দিয়ে দেব

অনিকেত বলল, ‘আমি সবই বুঝেছি

মিলন বলল, ‘দয়া করে তুমি আমার নাম পুলিসে দিও না আমি নিজের জন্য ভাবি না কিন্তু আমি ছাড়া মালতীকে দেখবার কেউ নেই অন্তত ওর কথা ভেবেও’ এক করুণ আকুতি ফুটে উঠল মিলনের গলায়

বোধহয় সেটা অনিকেতকে স্পর্শ করল সে বলল, ‘ওতে আমার আর প্রয়োজন নেই তুমি এখন এস

মিলন কথাটা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না সে বলল, ‘জানিআংটিটা খুবই দামী তোমার প্রিয়ও আর...

ওকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বিরক্তির সুরে অনিকেত বলে উঠল, ‘তোমাকে আবারও বলছি, ও আংটির আর দরকার নেই আমার। তুমি এখন এস প্লিজ

এরপরে আর কোন কথা চলে না মিলন সন্ত্রস্ত পদক্ষেপে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নিচে নেমে এল

নিচে নেমে ফের একবার বাড়িটার দিকে তাকাল সে একতলাদোতলা পুরোটাই অন্ধকার কেবল দোতলার একটা ঘরের জানালায় মোমবাতির মৃদু আলো আর একজন মানুষের দীর্ঘকায় কালো ছায়া

 

ধীর পদক্ষেপে বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে যাচ্ছিল সে এমন সময় উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাক এসে ঢুকল বাড়ির প্রাঙ্গণে আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতর থেকে দুজন পরিচারক ছুটে বেরিয়ে এসে বলে লাগল, ‘বল হরিহরিবোলএক মহিলার তারস্বরে চীৎকার করা কান্নার আওয়াজ কানে এল এই দুজন পরিচারকের মধ্যে ভোলা একজন মিলন তাকে দেখে জিগ্যেস করল, ‘কে মারা গেছে ভোলাদা?’ সে বলে, ‘আপনি জানেন নাআজ সন্ধেবেলায় বাবুর বৌ আর মেয়ে দুজনেই একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে এতক্ষণে তাদের বডি এল’ এই বলে সে এগিয়ে গেল

গাড়ির পেছন পেছন বেশ কয়েকজন লোক এসে ঢুকল। সকলের মুখেই বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। এদের মধ্যে কয়েকজনের কথা কানে এল মিলনের। একজন বলছিল, ‘ভাবতেও খারাপ লাগে, আগামীকাল বৌয়ের জন্মদিনে পার্টি দেবে বলে আমাদের নিমন্ত্রণ করে গেল।’ আরেকজন বলে, ‘হ্যাঁ, সেই কারণেই তো একটা দামী আংটিও কিনেছিল বৌকে গিফট দেবে বলে। আমি ওর এক কাছের লোকের থেকে খবরটা পেয়েছি।’ আরেক ব্যক্তি বলে, ‘আর এখন এসব নিয়ে ভেবে কি হবে? সবই কপাল!’ এমন সময় মিলন পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেদোতলার যে ঘরটায় মোমবাতির আলো জ্বলছিলসেটা নিভে গেছে গোটা বাড়িটাই এখন পুরোপুরি অন্ধকার



এই ঘটনার পর ধীরে ধীরে একসময় মালতীর মন থেকে আংটিটা নিয়ে সমস্ত চিন্তা আর উদ্বেগই মুছে গেল। তবুও সে যখনই আংটিটার সম্বন্ধে কোন কথা বলতমিলন কেমন যেন গুম হয়ে যেত কোনো এক চিন্তায় সে বিমর্ষ হয়ে পড়ত যার কারণ মালতী কোনদিনই জানতে পারেনি

 


1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন