"ট্যার ট্যার ট্যার!!" .... প্লাস্টিকের মেশিন গান নিয়ে বুবান বাড়ির
সকলকে প্রায় অতিষ্ট করে তুলেছে! দু'দিন আগেই ছোট্ট বুবানের
পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন হয়েছিল বেশ বড় করে। বন্দুকটা কোন এক আত্মীয়ের থেকে
উপহার পাওয়ার পরে বুবান বাকি খেলনাগুলোর দিকে আর ফিরেও তাকায়নি! কখনও বন্দুকটা
নিয়ে সে একবার মায়ের দিকে, কখনও দাদু ঠাকুমার দিকে, কখনও কাজের দিদির দিকে তাক করে গুলি চালিয়েই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাড়ির লোকজন
বিরক্ত হলেও সকলের আদরের বুবানের মিষ্টি হাসিমুখ দেখে কেউ আর তাকে কিছু বলছে না।
বুবানের বাবা মানব বন্দোপাধ্যায় ক্যালকাটা
ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। ওনার বাল্যবন্ধু
ধরণী সামন্ত একজন নাম করা পেইন্টার, যিনি কেন্দ্রীয় একাডেমির
সাথে অনেক বছর যুক্ত। নামী শিল্পী হলেও ওনার আর্থিক অবস্থা বুবানদের মতন অতোটা
ভালো নয়। এমনিতেই আঁকা থেকে রোজগার প্রায় নেই বললেই চলে! ধরণীবাবু প্রায়ই নানা
এক্সিবিশনে এদিক ওদিক চলে যান, নিজের শিল্পীসত্ত্বাকে
বাঁচাতে যিনি সংসার পর্যন্তও করেননি। বুবানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দিন ধরণীবাবু
কলকাতায় ছিলেন না। তাই তিনি জন্মদিনের দু'দিন পর মানববাবুর সাথেই গেলেন বুবানদের
বাড়িতে।
ধরণীবাবুকে দেখে বুবানের আনন্দের শেষ নেই। লম্বা
দাড়ি থাকার জন্য বুবান তাকে 'দাড়িকাকু' বলে ডাকতো। বুবান তার নতুন মেশিন গানটা তার দাড়িকাকুকে দেখাবার জন্য অনেকক্ষণ
থেকে ছটফট করছে! দু-চার কথা হবার পরেই বুবান ঠিক তার বন্দুকটি লুকিয়ে রাখা জামার
ভেতর থেকে বার করে ধরণীবাবুর দিকে তাক করে "ট্যার ট্যার ট্যার!!" শব্দে
আওয়াজ করে নাড়াতে থাকে। সামান্য মুচকি হেসে ধরণীবাবু বুবানের হাত থেকে খেলনা
বন্দুকটি নিয়ে নিলেন! তারপর সেটি তার সাথে থাকা ঝোলা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে সেখান
থেকে আরেকটি বড় র্যাপার মোড়া, রিবন দেওয়া একটি বড়
সাইজের বাক্স বুবানের হাতে দিয়ে বললেন, "এটা তোমার জন্য! আজ থেকে
এক সপ্তাহের জন্য তোমার এই বন্দুকটি আমার কাছে থাকবে, আমি একটা কাজ দেবো সেটা করতে পারলে তুমি বন্দুকটা আবার ফেরৎ পাবে! "
আচমকা ঘটনাটা হওয়ার পরে বাড়ির সকল সদস্যসহ ছোট্ট
বুবানও হকচকিয়ে যায়! তার হাতে রঙীন র্যাপার মোড়া নতুন উপহার এলেও তার প্রিয়
মেশিনগান খেলনাটি এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাবে সে বেচারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
এদিকে দাড়িকাকুর কাছ থেকে ফেরৎ চাইবে সেই সাহস বা জেদ কোনোটাই সে করতে পারছে না!
তাই কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে বাকি সকলের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন ইশারায় বলছে যে তার বন্দুকটা যেন ফেরৎ দিয়ে দেয়। বুবানের চোখ ছলছল করে
এল! ধরণীবাবু পরিস্থিতি আঁচ করে বুবানের হাতে থাকা উপহারের বাক্সটি নিয়ে নিজেই র্যাপারটা
খুলে দিলেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি আঁকার খাতা, একটা পেন্সিল রবারের সেট
আর প্যাস্টেল কালারের বাক্স!
ধরণীবাবু বাক্সটা দেওয়ার পরে বুবানকে কোলে নিয়ে
বললেন, "আগামী সাতদিন এই আঁকার
খাতাটায় যদি তুমি সাতটা ছবি এঁকে দিতে পারো তাহলে তোমার বন্দুক তুমি আবার পেয়ে
যাবে!" বলে তিনি আরও দু'চার কথা বলে বুবানকে একটু
আদর করে বাড়ি থেকে বিদায় নিলেন। দাড়িকাকু চলে যাবার পরে বুবান বেশ কান্নাকাটি
করে! বুবানের বাবা মনে মনে বুঝলেন যা হলো তাতে একপ্রকার তার সন্তানেরই মঙ্গল হবে, তাই তিনি বাড়ির সকলকে ইশারা করে দিলেন ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব না দিতে!
অগত্যা বেগতিক দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পরেরদিন থেকে বুবান ছবি আঁকতে শুরু করে।
ঠিক সাতদিন পরে বুবানদের বাড়িতে আবার দাড়িকাকুর
পদার্পণ ঘটে। ধরণীবাবু বাড়ির সকলের থেকে জানতে পারলেন, একটা দু'টো নয়, সাত দিনে প্রায় পনেরোটা ছবি এঁকে ফেলেছে বুবান! ঘরের
দরজায় দাড়িকাকুকে দেখেই বুবান প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, "দেখো কাকু দেখো, আমি কত ছবি এঁকেছি!" ধরণীবাবু বুবানের থেকে
আঁকার খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলেন বুবানের অপরিণত হাতে পেন্সিল এবং রঙের মিশেলে গাছ, ঘর বাড়ি, নানারকম পশুপাখি যেন জীবন্ত রূপ ধারণ করেছে!
ধরণীবাবুর মনটা ভরে উঠলো। তিনি তাঁর ঝোলা ব্যাগ থেকে বুবানের খেলনা মেশিনগানটা
দিতে গিয়ে দেখলেন, বুবান আবার তার আঁকার খাতাটা নিয়ে পেন্সিলে, রঙে আঁকিবুঁকি করতে বসে গেছে! আর সে তার সাধের বন্দুকটার দিকে ফিরেও তাকায়নি।
ভারত সেরা অঙ্কনশিল্পীর মেমেন্টো নিয়ে সোজা
ধরণীবাবুর বাড়ি গেল বুবান, আজ তার প্রিয় দাড়িকাকু রোগসজ্জায়, অবস্থা বেশ শোচনীয়! সেই ঘটনার পরে কেটে গেছে পঁচিশটা বছর, বুবান আজ ভারতবর্ষ ছাপিয়ে পৃথিবীখ্যাত প্রথম সারির একজন অঙ্কনশিল্পী।
ধরণীবাবুর বাড়িতে বিছানায় দাড়িকাকুর মাথার পাশে বসে বুবান ধরণীবাবুর হাতের কাছে
মেমেন্টোটা এগিয়ে দিলেন। কোনরকমে অচল হাতে মেমেন্টোটা একটু ছুঁয়ে দেখলেন, চোখজোড়া ভিজে গেল ধরনীবাবুর! তারপর ডান হাতটা অনেক কষ্ট করে বুবানের নত
মাথায় হাত দিয়ে বললেন, "আরও বড় 'শিল্পী' হও!" মাথায় দেওয়া হাতটা বুবান তার দু'হাতে
জড়িয়ে আনন্দে কেঁদে বলে ওঠে, "কাকু, তুমিই তো আমার জীবনের অনুপ্রেরণা।"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন