প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালিত হয়। প্রতি বছর ভারতে ৩০ শে জানুয়ারী মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এই দিবস পালন করা হয়। কুষ্ঠ এক প্রকারের Neglected tropical disease (NTD), যা এখনও ১২০ টিরও বেশি দেশে দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর ২০০০০০ এরও বেশি নতুন কেস রিপোর্ট করা হয়। বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালনের লক্ষ্য হল এই রোগের সাথে যুক্ত সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা, সাধারণ জনগণকে সচেতন করা যে এটি এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ছড়ানো রোগ এবং এটি সহজেই নিরাময় করা যায়। যাতে কুষ্ঠ রোগীদের নিয়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক ভীতি বা কলঙ্ক থেকে রোগীকে মুক্ত করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনদান করা যায়।
বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস ২০২৪ সালের থিম হল “Ending Stigma, Embracing Dignity” অর্থাৎ কলঙ্কের অবসান ঘটিয়ে মর্যাদাকে আলিঙ্গন করা। এই থিম এই দিবসের দুটি উদ্দেশ্যকে সফল করে।
এক - কুষ্ঠরোগের
সাথে সম্পর্কিত কলঙ্ক দূর করা
দুই – রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদাকে
বজায় রাখা।
"কলঙ্কের
অবসান, মর্যাদাকে আলিঙ্গন করা" থিমটি
রোগ নির্মূল করে চিকিৎসার পাশাপাশি কুষ্ঠরোগের সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলিকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে সমাজে শক্তিশালী বার্তাও বহন করে। এটি এক কুষ্ঠ রোগীদের জন্য এমন এক বিশ্বের স্থাপনা করতে চায় যেখানে কুষ্ঠ কোনও কলঙ্ক রূপে নয় বরং
একপ্রকারের স্বাভাবিক রোগরূপে গণ্য হয়ে রুগিদের প্রতি সমাজের সমবেদনা এবং সম্মান প্রদর্শনের একটি সুযোগ করে দেয়। বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস ২০২৪, ভারত ব্যতীত সারা পৃথিবীতে ২৮ শে জানুয়ারী রবিবার
অনুষ্ঠিত হবে।
কুষ্ঠ রোগ কিঃ
কুষ্ঠরোগ হ্যানসেনের রোগ নামেও পরিচিত। কুষ্ঠরোগে স্নায়ুর মারাত্মক
ক্ষতি ও বিকৃতি হয়। এছাড়াও ত্বকে ঘা দেখা দেয়। কুষ্ঠ হলে ছোঁয়া, ব্যথা এবং তাপমাত্রার প্রতি শরীরের সংবেদনশীলতাকে কমে যায়। ত্বকে ক্ষত হওয়া,
পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং হাত ও পায়ে অসাড়ভাব কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ।
এই রোগটি সংক্রামক রোগ। মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি কুষ্ঠ রোগের ব্যাকটেরিয়া। এই রোগে
বিভিন্ন অঙ্গের স্নায়ু, শ্বাসনালীর উপরের অংশ ও নাকের ভিতরের
আস্তরণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
লক্ষণ সমূহঃ
৫. সংক্রমিত স্থানে অসাঢ়তা অনুভব হয় ও অতিরিক্ত ঘাম
হয়।
৬. পেশী দুর্বল হয়ে যায়। অনেকে পঙ্গু হয়ে যান।
৭. মুখের নার্ভ বা স্নায়ুতে প্রভাব পড়ায়
অন্ধত্বের ঝুঁকি বাড়ে।
৮. হাত-পা অকেজো হয়ে যায়। আঙুল ও পা ছোট হয়ে যেতে পারে।
৯. পায়ের আলসার বা ঘায়ের কারণে অঙ্গহানি
ঘটে।
১০. নাক বিকৃত হয়ে যায়। চামড়ায় জ্বালা-যন্ত্রণা হয়।
এই আন্তর্জাতিক দিবস পালন প্রথম শুরু হয় ১৯৫৪ সালে। ফ্রান্সের একজন জনহিতৈষী ও লেখক ফরাসি মানবতাবাদী, রওল ফোলেরেউ বিশ্বব্যাপী এই প্রচেষ্টার কথা ভেবেছিলেন যাতে সারা বিশ্বে কুষ্ঠরোগ নিয়ে সচেতনতা কমানো যায়। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে রোগীকে ঘিরে গড়ে ওঠা বৈষম্য কমানোও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। দিনটি পালনের নেপথ্যে লক্ষ্য ছিল, কুষ্ঠ রোগীদের মানসিক এবং শারীরিক আঘাতের কারণ সম্পর্কে মানুষকে জানানো। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনোভাবে বদল আনা।
২০২৪ সালে, বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস ২৮ শে জানুয়ারী রবিবার পালিত হবে। বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস সবসময় জানুয়ারির শেষ রবিবারে অনুষ্ঠিত হয়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গান্ধীজী সমাজ সেবামুলক বহু কাজ করেছিলেন। তাই মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে তাঁর মৃত্যু দিবস ৩০ শে জানুয়ারিকে এই দিনের জন্য বেছে নেন এবং ভারতে এইদিনেই কুষ্ঠ দিবস পালন করা হয়।
কেন আমরা বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালন করি?
আমরা এমন একটি রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্ব কুষ্ঠ
দিবস উদযাপন করি যা অনেকে মনে করে সমাজে এর কোনও অস্তিত্ব নেই। প্রতি বছর ২০০,০০০
লোক কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয় এবং এমন লক্ষ লক্ষ লোক রয়েছে যারা বিলম্বিত
কুষ্ঠ চিকিৎসার ক্ষতিকর পরিণতির সাথে জীবনযাপন করছে। বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হল আক্রান্ত
ব্যক্তিদের জীবন উদযাপন করার, রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ সম্পর্কে
সচেতনতা বাড়াতে এবং কুষ্ঠরোগকে ঘিরে যে কলঙ্কময় ভীতি রয়েছে, তার মোকাবিলা করার একটি সুযোগ
তৈরি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পালিত হয়। এর মাধ্যমে অর্থ
সংগ্রহ করা হয়, যার দ্বারা ভবিষ্যতে বিশ্বকে কুষ্ঠমুক্ত করে তোলার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস কিভাবে পালিত হয়?
এই দিনটি কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত এবং কুষ্ঠ রোগহীন, সমস্ত দেশেই সমান ভাবে পালিত হয়। যেসব দেশে কুষ্ঠ রোগের অস্তিত্ব
নেই বা খুবই বিরল, সেখানে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস গির্জা, এনজিও এবং কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রচার
করা হয় এবং জনগণকে সচেতন করা হয় যে কুষ্ঠরোগ এখনও বিদ্যমান এবং এটি এখনও
বহু জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যেসব দেশে
এখনও কুষ্ঠ রোগ রয়েছে, সেখানে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত মানুষরাও
স্বাভাবিক লোকেদের সাথে মিলিত হয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে
অংশগ্রহণ করেন। সবাই একত্রিত হয় যার লক্ষ্য কুষ্ঠের ভীতি ও কুসংস্কার কমানো এবং রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বহু দেশে সরকারীভাবেও
সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়।
যারা বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস ২০২৪ এর প্রচার ও প্রসারে অংশ নিতে চান তাদের জন্য একটি ডিজিটাল টুলকিট তৈরি করা হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিরা যদি এই বিশ্ব কুষ্ঠ দিবসে অনলাইনে সকলের সাথে সচেতনতা বাড়াতে চান, তবে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং বিবরণ রয়েছে যা সবার সাথে বিভিন্ন মাধ্যমে শেয়ার করতে পারেন। মাল্টি ড্রাগ থেরাপি (MDT) নামে পরিচিত অ্যান্টিবায়োটিকের সংমিশ্রণে কুষ্ঠ রোগ নিরাময়যোগ্য। এই চিকিৎসা সারা বিশ্বে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা না করা হলে তা মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। কুষ্ঠ রোগ কমপক্ষে ৪০০০ বছর পুরনো। এটি সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীনতম রোগগুলির মধ্যে একটি রূপে পরিচিত। প্রাচীন পুরাণ ও ইতিহাসেও এই রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। আশা করা যায় আগামী প্রজন্ম অবশেষে কুষ্ঠ রোগের সংক্রমণের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বকে কুষ্ঠ মুক্ত করে তুলতে সফল হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৩৫ সালের মধ্যে কুষ্ঠ সংক্রমণ শূন্য হবে। কুষ্ঠ এখনও আছে! প্রতি বছর প্রায় ২০০০০০ লোক কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয় এবং বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষ কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত অক্ষমতা নিয়ে লড়াই করছেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন