এইচ.এম.আই.এস.
হিন্দুস্তান
১.
১৯৪৫ সাল। আমেরিকা জাপানে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করল।
মুহুর্তে মানচিত্র থেকে মুছে গেল দুটি শহর – হিরোসিমা ও নাগাসাকি। অতঃপর, জাপানের মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ ও
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি। জাপানের পতনের পরপরই রহস্যজনক পরিস্থিতিতে বিমান
দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু(?) ঘটে। ব্রিটিশরা প্রায় কুড়ি হাজার
অফিসার ও সেনাসহ গোটা আজাদ হিন্দ ফৌজ দখল করে নেয়। ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ ক্লঁদ
জন অখিনলেক(Claude
John Auchinleck) আজাদ
হিন্দ ফৌজের সদস্যদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে চাইলেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি
আনুগত্য রক্ষা করা তাঁদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, তাঁদের সে কাজে ব্যত্যয় ঘটেছে – এইরকম
অভিযোগ তুলে ‘সদাশয় সরকার বাহাদুর’ তাঁদের উপর রাজদ্রোহের দোষ চাপায়। দিল্লির লাল
কেল্লায় শুরু হয় তাঁদের বিচার।
প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছিল বিচারের পরিস্থিতি; সঙ্গে তাঁদের বীরত্ব, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের কাহিনী। বিচারে
দোষী সাব্যস্ত হলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তিনজন সেনা অফিসার-
কর্নেল শাহনওয়াজ খান, ক্যাপ্টেন
গুরবক্স সিং ধিলোঁ ও ক্যাপ্টেন প্রেম কুমার সায়গল। কোর্ট মার্শাল করা হল তাঁদেরকে।
সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পরল ভারতবাসী। কর্নেল শাহনওয়াজ, ক্যাপ্টেন ধিলোঁ ও ক্যাপ্টেন সায়গলকে
দীর্ঘমেয়াদী কারাবাসের যে দণ্ডাদেশ দেওয়া হল, তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে ফুঁসে উঠলো গোটা দেশ। আর সরকার? সরকার সেই বিক্ষোভ দমনের জন্য
দলনপেষণের পন্থা অবলম্বন করল। এমনকি বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলিবর্ষণেও
পিছপা হলনা। দেশ ভরে গেল নানান উত্তেজক স্লোগানে- ‘গদ্দার নয়, ওঁরা দেশভক্ত’, ‘একজন আই এন এ সৈন্যের জন্য ২০টা করে
ইংরেজ কুত্তা’,
‘লাল কিলে সে
নিকলা আওয়াজ/সায়গল, ধীলোঁ
অউর শাহনওয়াজ’,
‘আজাদ হিন্দ ফৌজ
কো ছোড় দো/লাল কিলে কো তোড় দো।’ আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচারের প্রতিবাদের
আঁচ একসময় পৌঁছায় ব্রিটিশদের ‘নিজস্ব’ সেনাবাহিনীতে- Royal Indian Navy-তে।
২.
নৌবিদ্রোহের সময় কমিউনিষ্ট পার্টির পোষ্টার
ইষ্ট ইন্ডিজে ব্যবসারত বণিকগণের দেখাশোনার জন্যে ব্রিটেন
থেকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক স্কোয়াড্রন যুদ্ধজাহাজকে এদেশে পাঠায়। স্কোয়াড্রনের
অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন টমাস বেস্ট। ক্যাপ্টেন বেস্টের অধীনে ১৬১১ সালের
সেপ্টেম্বরে ভারতের সুরাটে নোঙর করে ৪টি জাহাজ – রেড ড্রাগন, ওসিয়েন্ডার, জেমস এবং সলোমন।
ভারতে তখন শাষন করছেন মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর
ব্রিটিশদের এদেশে বাণিজ্য করার ছাড়পত্র দিলেন। প্রথমে, ক্যাপ্টেন বেস্টের নৌসেনা তাঁদের
বাণিজ্যতরীগুলোকে অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি ও জলদস্যুদের ঘাত থেকে রক্ষা করতে
সাহায্য করেছিল। পরে এই নৌসেনার সাহায্যেই ব্রিটিশদের পক্ষে সম্ভব হয় ভারতের মুল
ভুখণ্ডের বুকে নিরাপদে পদস্থাপন করা। নৌসেনার বলেই ব্রিটিশ বাণিজ্যতরীগুলো অবাধে
চলাফেরা করতে পারতো। তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সুভালীতেই একটা বন্দর স্থাপন করে
এবং ১৬১২ সালের ৫-ই সেপ্টেম্বর ভারতে ব্রিটিশদের নিজস্ব নৌসেনার পত্তন ঘটে।
এই নৌবাহিনীর নাম প্রথমে রাখা হয় ‘Honourable East India
Company’s Marine’। ১৬৮৬ সাল অবধি এই নামই প্রচলিত ছিল। ১৬৮৬ সালে এই
নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘Bombay Marine’। ১৮৩০ সালে বম্বে মেরিনের
পুনঃনামকরণ করা হয় ‘His Majesty’s Indian Navy’, সংক্ষেপে H.M.I.N.। ১৮৯২ সালে আবার নৌসেনার নাম
বদলানো হয়, এবার এর নাম হয় ‘Royal Indian Marine’। এই সময় নৌবাহিনীর কাছে ৫০ এরও বেশি
যুদ্ধজাহাজ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই বাহিনী অভাবনীয় সাফল্য লাভ করে, মোট ১৩ লক্ষাধিক মানুষ ও ৩৬ লক্ষাধিক
টন যুদ্ধসামগ্রী নিয়ে গোটা পৃথিবীতে সরবরাহ করেছিল এই রয়্যাল ইন্ডিয়ান মেরিনের
নানান যুদ্ধজাহাজ।
১৯৩৪ সালে আবার নৌবাহিনীর নাম পালটানো হয়, এবার তাঁর নাম হলো – ‘Royal Indian Navy’ বা ‘R.I.N.’। এরই মাঝে ইতিহাসের অনেক পাতা ওলটানো হয়ে গেছে, ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ ও ১৭৬৪-তে
বক্সারের যুদ্ধে জিতে ব্রিটিশ কোম্পানী এদেশে সম্পূর্ণরূপে থাবা গেঁড়ে বসলো, ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে।’
১৮৫৭ সালে ব্যর্থ সিপাহী বিদ্রোহ, ফলে ১৮৫৮ সালে অবসান হল কোম্পানি শাষনের; কোম্পানি ছেড়ে পরাধীন ভারতবর্ষ এবার
সম্পুর্ণরূপেই ব্রিটিশদের অধীনস্ত হল।
৩.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অবধি পশ্চিম ভারতীয় অধিবাসীদের
মধ্যে থেকেই সেনাবাহিনীতে সেনা নিযুক্ত করা হত। কিন্তু সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ
অফিসার পদগুলো অলংকৃত করত কেবলমাত্র ব্রিটিশরাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহাসংকটে
পরে সরকার বাধ্য হল ভারতের ১৯টি বিভিন্ন জাতির অধিবাসীদের মধে থেকে লোক সংগ্রহ
করতে। এই সময় অফিসার পদেও কিছু ভারতীয়
স্থান পেলেন। কিন্তু হলে কী হবে, দেশের বৃহৎ জনসাধারণের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হত এই
সেনাবাহিনীকে। এটা বিশেষভাবে দেখা দিয়েছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে।
সৈন্যসংগ্রহের সময়ে বিশেষভাবে পরীক্ষা করা হত, কোনো রাজনৈতিক সংস্থার সাথে ঐ
নিয়োগপ্রার্থী ব্যক্তির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। সংগ্রহকারী অফিসার প্রত্যেকের
রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা যাচাই করে দেখতেন। সামান্য প্রাথমিক ধরণের রাজনৈতিক সাহিত্যও
রেটিং নৌ-সৈন্যের নাগালের বাইরে রাখা হতো।
ভারতীয় সেনারা প্রায়ই লক্ষ্য করত যে তারা যখন ব্রিটিশ
নাবিকদের (সৈন্যদের) পাশাপাশি কাজ করত তখন গোরা সৈন্যরা পেত পক্ষপাতমূলক বৈষম্য।
নৌ-ঘাঁটিতে অথবা যুদ্ধ এলাকাতে তাদের জন্য ভাল ভাল খাবার, ব্যবস্থা ছিল উপযুক্ত
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের। তারা চলাফেরা করত অনেকটা স্বাধীন মত। কিন্তু অপরদিকে ভারতীয়
সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের তুলনায় সুযোগ সুবিধা বিশেষ কিছুই পেত না। শুধু তাই নয়, ভারতীয় সৈন্যরা যদি ব্রিটিশ অফিসারদের
অভিবাদন করতে ভুলে যেত, তবে তার জন্য তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হত। অপরপক্ষে ভারতীয় অফিসারদের ওরা
অভিবাদন না-জানালে কিছুই হত না।
এই প্রভেদগুলি ছিল খুবই অভদ্র ও অপমানজনক। ব্রিটিশের
লোকদের জন্যে,
সে বহুদূরের
সমুদ্রতীরেই হোক, বা গভীর
জঙ্গলেই হোক, ভাল গরম খাবারের ব্যবস্থা, উপযুক্ত যানবাহন এবং অস্থায়ী বসবাসের
জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হত। অথচ ভারতীয় সৈন্যরা কিছুই পেত না। তাদের কপালে জুটত
না বিশেষ কিছুই- অতিকষ্টে কঠোর পরিশ্রম করে কাদায়-বৃষ্টিতে অথবা ঝলসানো রোদে
না-খেয়ে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করত। ওদিকে কার্যক্ষেত্রে যোগ্যতার বিচারে
দেখা গেছে ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের তুলনায় অনেক বেশি পারদর্শী। তবুও
কিন্তু ভারতীয় সৈন্যদের ওরা (ব্রিটিশ সৈন্যরা) বিদ্রূপ করে বলত, ‘Incompetent niggers’। তা ছাড়া দৈনন্দিন খাদ্যও ছিল ওদের বেলায় উৎকষ্ট আর
ভারতীয়দের ভাগ্যে জুটত।
৪.
বিক্ষোভের ছায়া যেমন সৈন্যবাহিনীর বাইরে দেশের সর্বত্র পরিদৃশ্যমান, সৈন্যবাহিনীর ভেতরেও তার ব্যতিক্রম ঘটে
নি। রেটিংদের ন্যুনতম অন্ন বস্ত্রের দাবীর সাথেও ক্রমাগত বৈষম্য তাঁদের
ধৈর্য্যহারা করে তুলছিল। অবশ্য খাদ্য বলতে কুখাদ্য, তাও যথেষ্ট পরিমানে নয়। তা ছাড়া উর্দি
পোশাকের টানাটানি, টাকাকড়ির টানাটানি। সামান্যতম ঘটনাকে
কেন্দ্র করে ধূমায়িত অসন্তোষ ফেটে পড়তে শুরু করেছিল নৌবাহিনীর মধ্যে। দু একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনার
মধ্যে দিয়েই ভারতীয় নৌসেনা তাঁদের মনে অসন্তোষটা ক্রমাগত জানান দিয়ে আসছিল।
এরই মধ্যে ১৯৪৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, বোম্বাইয়ের এম. আর. ব্যারাকসের নৌসেনা
আন্দোলন শুরু করল। দাবী অতি সামান্যই- উন্নত খাদ্য ও বস্ত্র। খাদ্যের জন্য
আন্দোলনে নৌসেনারা অনশন শুরু করল। নৌসেনার এই ‘খানা বন্ধ’ এর ডাক মুহুর্তেই
অন্যান্য ব্যারাকেও ছড়িয়ে পড়ল। আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার জন্য এমন পরিস্থিতিতে এম. আর.
ব্যারাকসের কমান্ডিং অফিসার Captain Inigo Jones কোনোরকম সতর্কতা ঘোষনা ব্যতিরেকেই গোরাসৈন্য নিয়ে ভারতীয়
সৈন্যদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ করে বসেন। ভারতীয়রাও মরিয়া হয়ে ইট পাটকেল ছুড়ে তাঁদের
আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। দুজন ব্রিটিশ সেনা জখম হয়। অবস্থা হাতের বাইরে
চলে যাচ্ছে দেখে এম. আর. ব্যারাকসের সৈন্যদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়।
গুলিবর্ষণের খবর চাউর হতেই বোম্বাইয়ের ক্যাসল রোডস্থ
নৌসেনার অন্য ব্যারাকেও সেনারা পরিস্থিতি
নিজেদের হাতে তুলে নেয়। স্টোররুম ও ম্যাগাজিন লুঠ করা হয়। ক্যাসল ব্যারাকের
নৌসেনারা লূঠ করা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এম. আর. ব্যারাকের সেনাদের সাহায্যার্থে ছুটে
যায়। গোরাসৈন্যদের সাথে ভারতীয়দের এই প্রথম সোজাসুজি এক খণ্ডযুদ্ধ বাঁধল। শেষে ক্যাসল ব্যারাকের সৈন্যরা রেডিও
মাধ্যমে গোরাদের এই গুলিবর্ষনের খবর ছড়িয়ে দিতেই নিকটস্থ ‘তলোয়ার’ এবং আরও
অন্যান্য জাহাজ থেকে ভারতীয় রেটিংরা বেড়িয়ে এসে সম্মিলিত ভাবে এম. আর. ব্যারাক
আক্রমণ করে। মুখে শ্লোগান- “এ যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ মুক্তির যুদ্ধ।” করাচীতেও
নৌসেনারা গোরাদের উপর হামলা করে বসল।
প্রথম আক্রমণে ভারতীয়রাই জয়ী হল। ব্রিটিশরা সেদিনের মতো
পিছু হটে। দিনের শেষে তাঁদের ৩৫ জন নিহত, ৩০০ জন আহত। পরের দিন গোড়া সৈন্য দলে আরোও ভারি হয়ে আক্রমণ করল।
রিয়ার অ্যাডমিরাল র্যাটট্রের নেতৃত্বে ঘিরে ফেলা হয় সবকটি সেনা ব্যারাক। বিপুল
পরিমানে সেনাদের গ্রেপ্তার করা হয়। করাচী ও বোম্বাই মিলিয়ে মোট গ্রেপ্তার হওয়া
সৈন্যের সংখ্যা ৫৫০০। এই আন্দোলনের নেতৃস্থানিয়া দুই তেজস্বিনী – উর্মিলা বাই ও
বাংলার অনুভা সেনকে কোর্টমার্শালের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মুলতান সামরিক
জেলে এই দুই মহীয়সীকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হল। তাঁদের সাথেই ভুমিতে
লুটিয়ে পড়ল আরও একটি আন্দোলন।
এর পরেও কিন্তু সেনাদের কোনো দাবীই ব্রিটিশ হাই কমান্ড
পুরণ করেনি। ফলে বিদ্রোহের আগুনও একেবারে নিভে যায়নি। প্রদীপ যেমন নিভে যাওয়ার আগে
শেষ বারের মতো একবার দপ করে জ্বলে ওঠে, নৌবাহিনীও আবার জ্বলে ঊঠেছিল, শেষবারের মতো ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি
মাসে।
৫.
১৯৪৫ সাল। নভেম্বর বিদায় নিচ্ছে। জাপান সাম্রাজ্যের পতন
ঘটেছে। যুদ্ধ চলাকালীন যে-সমস্ত নৌবাহিনীর সৈন্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে চলে
গিয়েছিল, যুদ্ধের শেষে বোম্বাইতে নৌবাহিনীর 'তলোয়ার' জাহাজে এসে হাজির হতে লাগল সবাই। এই H.M.I.S. তলোয়ার কিন্তু কোনো যুদ্ধজাহাজ
ছিলনা, বরং এ জাহাজে সৈন্যদের
যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত। এখানকার রেটিংগণ ছিল মোটামুটিভাবে শিক্ষিত। 'তলোয়ার' জাহাজে আজাদ হিন্দ ফৌজের আসন্ন বিচারের
সংবাদে নৌ-সেনারা বা রেটিংরা বিচলিত ও চঞ্চল হয়ে উঠল। তাছাড়া, যুদ্ধশেষে সামরিক কর্ম থেকে অব্যাহতি
পাওয়া সৈন্যদের পুনঃ কর্ম-সংস্থানের বিষয়টির প্রতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অবহেলা
দেখা গেল। রেটিংদের মধ্য থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে, আরো অনেকে ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন, তারা নোটিশও পেয়ে গেছে। অথচ বিকল্প
ব্যবস্থা নেই। অতর্কিতে রেটিংরা বেকার হওয়ায় তাদের নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন হতে
হল।
এদিকে খবর এলো ১৯৪৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ
কমান্ডার-ইন-চিফ অখিনলেক ‘তলোয়ার’ জাহাজ পরিদর্শনে আসবেন। রেটিংরা ঠিক করল, এবার ভালো ভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন
করতে হবে। একজন দুঃসাহসী রেটিং বলাইচন্দ্র দত্ত কয়েকজন সাথী নিয়ে যে-বেদির ওপরে
দাঁড়িয়ে কম্যাণ্ডার-ইন-চিফ অভিবাদন গ্রহণ করবে, সেই বেদির গায়ে বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখল, 'জয়হিন্দ', 'ভারত ছাড়ো'- এই স্লোগান দু'টো। ভোরবেলায় প্রহরীরা এসে আবিষ্কার করল
সেইগুলো। বলাই চন্দ্র দত্তকে গ্রেপ্তার
করা হল। বলাইচন্দ্রের গ্রেপ্তারীতে স্লোগান ও দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে
প্রতিবাদ বেড়ে গেল।
ফেব্রুয়ারীর ৮ তারিখে কমাণ্ডার কিং যাচ্ছিলেন মহিলা
ব্যারাকের পাশ দিয়ে। তখন শুনতে পেলেন কয়েকটি রেটিং ডব্লিউ.আর.আই.এনদের (আর.আই.এন
এর ভারতীয় মহিলাশাখা) লক্ষ্য করে বিড়ালের ডাক ডাকছে। এই অস্বাভাবিক আচরণের হেতু
খোঁজার জন্য অপেক্ষা না করেই তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। চিন্তা করে দেখলেন না, কেন 'তলোয়ারে'র এই শিক্ষিত রেটিংগণ এরকম ইতরপনায়
মত্ত হয়ে উঠলো,
যাদের আচরণে
পূর্বে কখনো এরূপ দোষ দেখা যায়নি। ঝড়ের বেগে ব্যারাকে প্রবেশ করে, তিনি প্রত্যেককেই কশাঘাত করে তীব্র
ব্যাঙ্গোক্তিতে ফেটে পড়লেন, "You sons of bitches, sons of coolies, sons of bloody
jungles.”।
রেটিংরা এতে চুপ করে থাকল না। সকলে মিলে হৈ-হৈ করে তাকে
তাড়া করল। কিং সম্মান বাঁচাবার জন্যে কোনোরকমে পালিয়ে গেল। কিং-এর এই অপশব্দ
প্রয়োগের প্রতিবাদে চৌদ্দজন রেটিং সংঘবদ্ধভাবে (যদিও তা সামরিক আইনে বিদ্রোহ)
অভিযোগ পেশ করল এক্সিকিউটিভ অফিসার লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার শ-এর নিকট। তিনি আবার
তা পাঠিয়ে দিলেন কিংয়ের কাছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি যখন অফিসের কানুনমাফিক তাদের
(সৈন্যদের) অভিযোগ শুনলেন, তখন তিনি (মিঃ শ) সৈন্যদের উলটে দোষী সাব্যস্ত করে ছাড়লেন এই বলে যে, “তোমরা মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করেছ।”
সৈন্যদের (রেটিংদের) বিবেচনা করার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টার সময় দেওয়া হল। রেটিংরা তাঁর
উপদেশ গ্রহণ করল ভীতি-প্রদর্শন বলে।
অন্যদিকে লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধবন্দিদের বিচার আরম্ভ হয়েছে। কংগ্রেস
এদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে এবং সুপ্রসিদ্ধ আইনজীবীদের দ্বারা তাঁদের পক্ষ সমর্থন
করাচ্ছে। রেটিংরাও ঐ বন্দিদের খালাশ করে নিয়ে আসার জন্যে ব্যারাকে ব্যারাকে, জাহাজে জাহাজে ঘুরে ঘুরে প্রকাশ্যে
চাঁদা তুলতে আরম্ভ করেছে। এই ফাঁকে ফাঁকে বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপও চালানো
১৭ ফেব্রুয়ারির রাত। সকলে মিলিত হয়ে স্থির করল একটা
কাজের ধারা। সবাই এসেছিল সেই 'তলোয়ার'
জাহাজে। ঠিক হল, ১৯৪৪ সালে এই ফেব্রুয়ারী তারিখেই
নিকৃষ্ট খাবার খাবে না বলে আন্দোলনের যে ডাক দেওয়া হয়েছিল, এখনো সেই নিকৃষ্ট খাবার দেওয়া হচ্ছে।
বরং পূর্বের তুলনায় এখন খাবার নিকৃষ্টতর। অতএব রেটিংরা ঐ খাবার গ্রহণ করবে না।
অর্থাৎ আবার সেই 'খানা বন্ধ' অর্থাৎ No food, no work' আন্দোলন শুরু করা হবে।
নতুনভাবে নৌবাহিনীতে দ্বারা ছত্রিশ জনের সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি তৈরি
করা হল আন্দোলন পরিচালনার জন্ম। সংক্ষেপে
নামকরণ করা হল-N.C.S.C.(Naval
Central Strike Committee)।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬। নিয়মমাফিক ভোর পাঁচটায় H.M.I.S(His Majesty’s Indian Ship) 'তলোয়ার'-এর রেটিংদের জাগিয়ে তোল। হল। সকাল ৮
টায় তারা চলে গেল প্রাতরাশের জন্য মেসের কামরাগুলোতে। সংখ্যায় তারা দেড় হাজারেরও
বেশি। হঠাৎ, শ্লোগান উঠল - 'না-খাবার, না-কাজ।' খাবার খাবে না তারা। তাছাড়া, সেই খাবার নিকৃষ্ট, অপর্যাপ্ত। সিদ্ধান্তমত খানা বন্ধ, শুরু হয়ে গেল।
দুপুর প্রায় ১টার সময়ে ফ্ল্যাগ অফিসার রিয়ার অ্যাডমিরাল
র্যাটট্রে ছুটে এলেন 'তলোয়ার'-এ। ইনি এখন বোম্বাইয়ের
নৌবাহিনীর সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তিনি রেটিংদের সাথে কথা বলতে চাইলেন। রেটিংরা চিৎকার করে স্তব্ধ
করে দিল তাঁকে,
আর সঙ্গে সঙ্গে
শ্লোগান উঠল সমন্বরে, 'ভারত
ছাড়ো!' শ্লোগান অনুরণিত হতে থাকল
বাতাসের তালে তালে। র্যাটট্রে বেগতিক বুঝে তাঁর ফ্ল্যাগশিপে ফিরে গেলেন। সেদিন
সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বম্বে প্রেসে রেটিংদের পক্ষ থেকে বিদ্রোহের সংবাদ পৌছে দেওয়া
হল। দৃঢ় জাতীয়তাবাদী মতের ঐতিহ্যবহনকারী দৈনিক 'ফ্রি প্রেস জার্নাল' সংবাদপত্রের সম্পাদক এস. নটরাজন এই চাঞ্চল্যকর সংবাদের গুরুত্ব
উপলব্ধি করেছিলেন। সাহসে ভর করে তাঁর সংবাদপত্রের কলমের সদ্ব্যবহার করতে বেটিংদের
আমন্ত্রণ জানালেন। সংবাদপত্রে সাধারণত সরকার-প্রকাশিত সংবাদই প্রচারিত হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হল বৈকি। 'ফ্রি প্রেস জার্নাল' রেটিংদের প্রচারের মাধ্যম হয়ে উঠল। ১৮ই ফেব্রুয়ারি; ‘তলোয়ার’ অবাধ্য, উদ্ধত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে- কিন্তু একা, একান্ত অসহায়। কাজে লাগানোর মতো
সামান্য আগ্নেয়াস্ত্রও তখনও সেনার হাতে ছিলনা। ফলে, যেভাবেই হোক নিকটবর্তী ক্যাসেল ব্যারাক
এর নাবিকদের থেকে সমর্থন লাভ করাটাই তাঁদের প্রধান কর্মসূচি হয়ে উঠল।
৬.
১৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৬। সকালবেলা ক্যাসেল ব্যারাকের লোকেরা তখন নিজেদের স্বাভাবিক
কাজকর্ম করছিল। এমনসময়, কয়েকটি রেটিং পাহারারত প্রহরীদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, প্রধান ফটকের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে ঢুকে
পরলো ব্যারাকে। 'তলোয়ার' থেকে এসেছিল তারা। সঙ্গে এনেছিল এক
ভয়ঙ্কর খবর, “তোমাদের ভাইদের 'তলোয়ারে'র ওপরে গুলি ক'রে- বেয়নেটের খোঁচায় মেরে ফেলছে ব্রিটিশ টমিরা”। সংবাদে জ্বলে উঠলো তারা। পাগলের
মতো ছুটে গেল রেটিংরা তাঁদের পিছনে। উন্মত্ত রেটিংরা পাগলের মতো যা কিছু বিদেশী, সবই নষ্ট করতে লাগল। যেখানেই তাঁরা
বিদেশীদের দেখল,
দুয়ো দিতে লাগল। পাথড়
ছঁড়তে লাগল বিদেশী দোকানগুলোতে। টেনে নামিয়ে আনল ইউনিয়ন জ্যাক, আর মুখে স্লোগান, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ।” ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোতে এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্ত জুড়ে বড়োবড়ো হরফে প্রকাশিত হল, ভারতীয় নৌসেনারা খুনের নেশায় মেতেছে।
১৯ ফেব্রুয়ারির সূর্য অস্তমিত। 'তলোয়ার' এখন আর একা নয়। বিদ্রোহের খবরর
দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বোম্বাইয়ের তীরে এগারোটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় কুড়ি
হাজার রেটিং মিলিত হয়েছে। পোতাশ্রয়ের সব জাহাজ থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে ইউনিয়ন
জ্যাক। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ভারতীয় নৌ-সেনার সকল সংস্থা থেকেই ব্রিটিশরা তাঁদের প্রভুত্ব
হারিয়ে ফেলল। ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ল চুয়াল্লিশটি জাহাজে, চারটি মেজর বেস্-এ, চারটি ফ্লোটিলাতে এবং কুড়িটি
সমুদ্র-তীরবর্তী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। বোম্বাইয়ে 'তলোয়ার' জাহাজ হল নাবিকদের সংগ্রামী কমিটির
ঘাঁটি। বিভিন্ন যুদ্ধ জাহাজগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বেতারযন্ত্রে এক বিশেষ
সংকেত প্রণালী উদ্ভাবন করা হল। Royal Indian Navy-র নতুন নামকরণ করা হল Indian National Navy।
বোম্বাইয়ের রাস্তায় রেটিং-দের বিক্ষোভ, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬
এরই মধ্যে ফ্রান্সের উপকুল থেকে ভারুতীয় নৌসেনার এক
জাহাজ করাচীর দিকে যাচ্ছিল। ‘খাইবার’ নামক এই জাহাজটি যখন আরব সাগরে, তখন ‘তলোয়ার’ থেকে বেতার সংকেত যায়
তাঁর কাছে। ‘খাইবার’-এর কর্মীদের আনন্দ আর ধরেনা। তাঁরা তাঁদের উর্ধতন অফিসারদের
নির্দেশ অমান্য করে, গোরা
সৈন্যদের বন্দি করে ও জাহাজ ঘুরিয়ে দেয় বোম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে। ‘খাইবার’ও যোগ ফিল
আন্দোলনে। শুধু ‘খাইবার’-ই নয়, করাচী বন্দরের ‘হিন্দুস্থান’-ও তলোয়ারের সাথে যোগ দিল। একে একে ‘বাহাদুর’, ‘হিমালয়’, ‘চম্পক’ এবং কর্ভেট ‘ত্রিবাঙ্কুর’ও
বিদ্রোহীদের তালিকায় যুক্ত হল। বোম্বাই থেকে করাচী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহের
আগুন।
ঘন ঘন কেন্দ্রীয় ধর্মঘট সমিতির মিটিং বসছে। তাঁরা এবার
সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন থেকে
কেবলমাত্র জাতীয় নেতাদের কাছ থেকেই নৌসেনার রেটিংদের নির্দেশ নিতে হবে। বিদ্রোহের
উদ্দেশ্য ভালভাবেই প্রচার লাভ করল, তবুও জাতীয় নেতাদের মধ্যে কোনো একজনকেও দেখা গেল না রেটিংদের জন্য অভিনন্দন
পাঠাতে বা তাদের নির্দেশ দেবার জন্য কোনোরকম উদ্যম প্রকাশ করতে।
কমিটি স্থির করলো, কংগ্রেসের বাম ভাগের নেতা শ্রীমতী
অরুণা আসফ আলির নিকটে যাবে। সে সময়ে তিনি বম্বেতে। কিন্তু তিনি শুধু উপদেশ দিলেন
যে, শান্ত থাকো, Remain Calm। তাঁর কথা শোনালো মহাত্মার বাণীর
প্রতিধ্বনির মত অর্থহীন। উপরন্তু, তিনি নৌসেনার দাবীগুলির মধ্যে আইনের ছিদ্রের ব্যাখ্যা করতে বসলেন। তিনি
তাড়াতাড়ি ধর্মঘট কমিটিকে নির্দেশ দিলেন বম্বে কংগ্রেসের সর্ব্বোচ্চ কর্তা সর্দার
বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে দেখা করতে। সর্দার প্যাটেল বিদ্রোহের কর্মকর্তাদের সঙ্গে
এমন ব্যবহার করলেন, যেন
তাঁরা একদল উগ্রমস্তিষ্ক যুবক এবং জগাখিচুড়ি পাকাচ্ছেন এমন সব ব্যাপারে যাতে
তাঁদের নাক গলাবার কথা নয় (“Bunch of young hotheads messing with things they had no
business in.”, স্বাধীনতার
কয়েক মাস আগে বম্বেতে চৌপাটি সমুদ্রতীরে এক সাধারণ সভায় ঠিক এই কথাগুলিই তিনি
ব্যক্তি করেছিলেন) হিন্দু, মুসলমান অথবা শিখ নেতারা তখন কনফারেন্স টেবিলে মত্ত। তাঁদের কাছে রেটিং-রা
ছিল ‘young
fools’ যারা
তাঁদের কাছ নেতৃত্ব আশা করছে।
যে সকল লোক নৌসেনার এই অভ্যুত্থাঙ্কে নেতৃত্বদান করতে
পারতেন, তাঁরা এই উত্থানের ব্যাপার
নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তার অপব্যয় করলেন না। তাঁদের কাছে অল্পবয়সী এই রেটিংরা ছিল
অবাঞ্ছিত, দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেবার
মত তাঁদের কাছে যেন কিছুই নেই। এক নেতা থেকে অন্য নেতার কাছে ধাক্কা খেয়ে ঘুরতে
লাগলো ধর্মঘট কমিটির সভ্যরা। গান্ধীজীও এই ‘গোলমাল’-এর কথা শুনে একদিন তাঁর
সান্ধ্য প্রার্থনা সভায় কেবল এই মন্তব্যটুকুই করলেন, “রেটিংরা যদি অসন্তুষ্টই ছিল তবে তাঁরা
তো কাজে ইস্তফাও দিতে পারত(They could have resigned)।” এর বেশি মহাত্মাজী এই প্রসঙ্গে আর মাথা ঘামাননি।
বিক্ষুব্ধ
জনতার উপর ব্রিটিশ পুলিশের লাঠিচার্জ
ফেব্রুয়ারীর ২০ তারিখে স্বাধীনতার মদিরার রং মনে হলো যেন একটু ফিকে, আবেগের উচ্ছলতা কিছুটা মন্দীভূত। এখন
ধর্মঘট কমিটি বুঝেছেন, যে জাতীয়
আন্দোলনের নেতাদের কাছে তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা হয়ে
দাঁড়ালো সহজ সরল - হয় এগিয়ে যেতে হবে একাই, নয়তো কিছু দর-কষাকষি করতে হবে চাকুরীর
ব্যাপারে-আরো কিছু ছোট খাটো সুবিধার ব্যবস্থা করে নিতে। ফলে দেখা দিল দ্বিধা, বিহ্বলতা ও বিচলিত হওয়ার লক্ষণ। এর পরে
কোন পথ নিতে হবে সে বিষয়ে অনেকেরই কোন ধারণা না থাকায় কাজের বদলে বাকবিতণ্ডা এসে
আসর দখল করলো। অনর্থক তর্ক বিতর্ক সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হচ্ছিল না।
সেদিন দুপুরবেলা ফ্ল্যাগ অফিসার কমান্ডিং ভাইস
অ্যাডমিরাল গডফ্রে নৌবাহিনীব সর্বোচ্চ অফিসার (FOCRIN) এসে পৌঁছলো বম্বেতে। ফ্ল্যাগ অফিসার
রিয়ার অ্যাডমিরাল র্যাটট্রের ফ্ল্যাগশিপে ছয় ঘণ্টাব্যাপী আপস আলোচনা চলে। কিন্তু
ফল কিছুই হল না। আটটি দাবির একটিও তাঁরা মানলেন না। ওরা বললেন যে নৌবহরে হরতাল
মানে বিদ্রোহ। এদিকে বোম্বাইয়ের বন্দরে যত জাহাজ ছিল, সব জাহাজ থেকে উড়ছে
কংগ্রেস-লিগ-কম্যুনিস্ট পার্টির পতাকা রজ্জুবদ্ধ ঐক্যের প্রতীক হয়ে। সেখানে ছিল, 'বেরার', 'মোতি', 'নীলম', 'যমুনা', 'কুমায়ুন', 'আউধ', 'মাদ্রাজ', 'সিন্ধ', 'মারাঠা', 'তীর', 'ধনোজ', 'আসাম', 'নর্মদা', 'ক্লাইভ' এবং 'লরেন্স' ইত্যাদি মোট ৭৪টি জাহাজ। উপকূলে ফোর্ট
ব্যারাকে, এম আর ব্যারাক্সে এবং ক্যাসেল
ব্যারাকেও উড়ছে স্বাধীনতার পতাকা। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও স্বাধীনতার পতাকা
উড়ছিল। কিন্তু তবুও কোনো নেতাই এলেন না রেটিংদের সঙ্গে কথা বলতে।
ভাইস অ্যাডমিরাল গডফ্রে তখন আদেশ করলেন যে পরের দিন
বিকাল সাড়ে তিনটের মধ্যে সমস্ত রেটিংদের নিজ নিজ ব্যারাকে ও জাহাজে ফিরে যেতে হবে।
সামরিক পুলিশের গাড়ি এসে তুলে নিতে লাগল রেটিংদের, যে যেখানে ছিল সেখান থেকেই।
সন্ধ্যাবেলায় যে-ছবি দেখা গেল তা ভয়াবহ। এদিকে ব্যারাকে এবং জাহাজগুলোতে খাদ্যের
ভীষণ অভাব দেখা দিয়েছে। ওদিকে বোম্বাইয়ের রাস্তায় রাস্তায় রক্ত- গঙ্গা বইছে।
বোম্বাইয়ের জনগণ নৌবিদ্রোহের সমর্থনে সর্বত্র দু'দিনের হরতাল পালন করার নির্দেশ পেয়েছে।
২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি সেই হরতাল পালনের দিন ধার্য হয়েছে। এই হরতালের আহ্বান করেছে
বোম্বাইয়ের শ্রমিক সংস্থাগুলি। জনগণ তাই রাস্তায় রাস্তায় নেমে পড়েছে। গোরা সৈন্য
তাদের মেশিনগান ও বোম্বার্ড-কার সহ গুলি দিয়ে তার মোকাবিলা করছে।
২১ শে ফেব্রুয়ারী সূর্যোদয় হওয়ার সাথে সাথে ব্রিটিশ
অনুগত ভারতীয় সেনাগণ ক্যাসেল ব্যারাকের রেটিংদের উপর ফায়ারিং শুরু করে। যেহেতু
ভারতীয়রা গুলি ছুঁড়ছে, তাই
রেটিং রা প্রথমেই পালটা জবাব দিতে চালোনা। তাঁরা লাউড স্পিকারের সাহায্যে সৈনিকদের
সাথে কথা বলল,
তাদেরকে বোঝালো।
আশ্চর্যজনক ভাবে, এতেই ফল
হল। তাঁরা গোলাগুলি বন্ধ করে রেটিংদের দলে যোগ দিলেন। বেলা ১১টার সময়ে অবশেষে
গোরাসেনার দল আক্রমন শুরু করল। এবার
ভারতীয় সেনারা অপেক্ষাকৃত পুরোণো ‘তলোয়ার’কে ছেড়ে অত্যাধুনিক স্লুপ ‘নর্মদা’কে
বেছে নিল তাঁদের প্রধান অবস্থানক্ষেত্র হিসেবে। এটাই হলো তাঁদের হেড কোয়ার্টার।
অতঃপর, নর্মদা থেকে পোতাশ্রয়ের সমস্ত জাহাজকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ
দেওয়া হল,
“Raise steam and prepare for action stations.”
এখানে এক অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা গেল, যার জন্য হয়তো কেউই প্রস্তুত ছিলনা।
রেটিংরা যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন শহরে রটে যায় যে কর্তৃপক্ষ তাঁদের অবরোধ করে রসদ বন্ধ করার
পরিকল্পনা করছে। গোটা বোম্বাই শহর যেন রেটিংদের সাহায্য করতে ছুটে এল। সর্বস্তরের
লোক এসে জড়ো হল সমুদ্রতীরে, কারো হাতে খাবারের প্যাকেট, কারো হাতে জলের পাত্র। রেস্তোরাঁর মালিকরা জনগণকে অনুরোধ করতে লাগলো যতখুশী
খাওয়ার তুলে নিয়ে অবরুদ্ধ ড়েটিংদের কাছে পৌছে দিতে। হাজার হাজার সাধারণত নাগরিক
খাবারের প্যাকেট নিয়ে সমুদ্রকুল যেন অবরোধ করে ফেলল। এমনকি দেখা গেল, রাস্তার ভিখিরিরাও ক্ষুদে খাওয়ারের
প্যাকেট নিয়ে পোতাশ্রয়ের দিকে এগিয়ে আসছে- সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য। জননেতা নয়, জনগণই যেন রেটিংদের সাহায্য করার জন্য
উদ্বেল। কয়েকঘন্টার মধ্যে গোটা বোম্বাই শহর রেটিংদের এতো খাবার সরবরাহ করেছিল যা, সমস্ত বিদ্রোহী রেটিংদের কয়েকদিনের ধরে
খাবার পক্ষে যথেষ্ট।
পুলিশ-জনতা
খণ্ডযুদ্ধের পর বোম্বাইয়ের রাস্তার অবস্থা
এরই মধ্যে অল ইন্ডিয়া রেডিও মারফত ভাইস অ্যাডমিরাল
গডফ্রে হুমকি দিলেন, “বিদ্রোহ
দমনে সরকার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করবে, তাতে সমস্ত নৌবহর যদি ধ্বংস হয় তো হোক।” অ্যাডমিরাল র্যাটট্রে
জাতীয় নেতাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছেন। বিদ্রোহীদের ডাকে যখন নেতারা এলেন না তখন র্যাটট্রে
বোম্বাইয়ের সর্বত্র মার্শাল ল জারি করে গডফ্রের (নৌ বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার)
নির্দেশমত গুলি চালাবার আদেশ দিলেন। এই আদেশ করাচীতেও বর্তালো। বোম্বাই ও করাচীতে
বহু লোক গুলিতে প্রাণ দিল। সবচেয়ে বেশি নৃশংস হত্যাঙ্গীলা চালিয়েছিল বোম্বাইয়ের
প্যারেল বস্তিতে এবং ডকইয়ার্ডে, যেখানে জাহাজের নাবিকদের পরিবার-পরিজন বাস করত। বোম্বাইয়ের রাস্তায় এবং ঐ
সমস্ত বস্তিতে আনুমানিক প্রায় সাড়ে সাত হাজার লোক প্রাণ হারালো অগ্নিবর্ষী গোলার
আঘাতে।
এই ঘটনায় 'খাইবার' এবং 'নর্মদা' জাহাজদ্বয় চুপ করে থাকল না, থাকার কথাও নয়। তাদের হাতে প্রচুর
অস্ত্র ছিল, এবারে তারা তা ব্যবহার করতে
আরম্ভ করল। 'খাইবার' ঢুকেছিল খাঁড়ির ভেতরে সংকীর্ণ
প্রণালীতে ক্যাসেল ব্যারাকের আক্রান্ত সহযোদ্ধাদের সাহায্য করতে। ব্রিটিশ নাবিকরা
অতি দক্ষতা দেখাতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ পাঁচটি শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ দিয়ে বন্ধ করবার
চেষ্টা করল প্রণালীর মুখটি। উপকূল ঘিরে রেখেছে কিংস রয়েল রাইফেলস, ভারহাম লাইট ইনফেনট্রি, প্রপসায়ার লাইট ইনফেনট্রি, আর ইলেভেনথ শিখ রেজিমেন্টের ফৌজ, যারা সাঁজোয়া গাড়ি, হালকা কামান আর মেশিনগান নিয়ে আক্রমণ
চালাচ্ছিল। একমাত্র ওয়াটার ফ্রন্ট বস্তির কিয়দংশ ছাড়া সেই লৌহ যবনিকায় কোনো
ছিদ্রই ছিলনা। তাঁরই মধ্য দিয়ে কামান দেগে
এগোতে থাকে ‘খাইবার’।
বোম্বাইয়ের সমুদ্রতীরে যেখানে ব্রিটিশরা বাস করত, বিশেষভাবেই সেখানে তীক্ষ্ণ নজর রেখে
দূরপাল্লার কামান দাগতে থাকল। বিশেষ করে ক্যাসেল ব্যারাকের যে-দিকটায় ব্রিটিশরা
থাকত সেখানটা দূরপাল্লার কামান দেগে একরকম উড়িয়ে দেওয়া হল।
এদিকে তীরে এবং শহরের মধ্যে জনতা বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে
পথে মৃতদেহগুলি দেখে ক্রমেই হিংস্র হয়ে উঠল। তারা বোম্বাইয়ের হর্নবি রোডের যত ব্রিটিশ
ব্যবসায়ীয় দোকান ছিল, সবগুলো
আক্রমণ করে আগুন জালিয়ে দিয়ে বিধ্বস্ত করল। সেখানেও অনেক ব্রিটিশকে হত্যা করা হল।
এক কথায় বোম্বাই তখন বিদ্রোহী জাহাজীদের সম্পূর্ণ দখলে এসেছে। যে-সমস্ত ব্রিটিশ
ছিল, তারা সবাই -পালিয়ে প্রাণ
বাঁচালো। ওদিকে ডক ইয়ার্ড অথবা ক্যাসেল ব্যারাকে ব্রিটিশ টমিদের প্রবেশের সমস্ত
চেষ্টাই প্রতিহত করা হয়। যে-সকল জায়গা থেকে আক্রমণের আশঙ্কা ছিল, জাহাজ থেকে সে সকল স্থানে বিশেষ করে
ওয়ার্লিকান কামানের গোলা ছোড়া হল।
বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি-গোলা চলছিল; মাঝে মাঝে গ্রেনেড বোমাও ছোড়া হচ্ছিল।
এই সময়েই গডফ্রে সাহেব ধর্মঘট কমিটির কাছে এক তারবার্তা পাঠালেন। তাতে বললেন, তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা
করতে ইচ্ছুক। এই বার্তা পেয়ে গুলি ছোঁড়ার কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন ধর্মঘট
কমিটি।
২২ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১ টায় F.O.C.R.I.N. (ফ্ল্যাগ অফিসার কম্যান্ডিং রয়াল
ইন্ডিয়ান নেভি)-এর বার্তা ব্যাটট্রে সাহেব বেতারযোগে ঘোষণা করলেন। কিন্তু তাও, অতিরিক্ত সৈন্যদল এসে গেল, তারা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। তখনও
কিন্তু বোম্বাইয়ের জনসাধারণ রাস্তায় বেরিয়ে এসে টমীদের সঙ্গে লড়াই করছিল। মেসিনগান
নিয়ে এবং ট্যাঙ্কের সাহায্য নিয়ে টমীদের ব্যাটেলিয়ানগুলি রাস্তায় টহল দিয়ে
বেড়াচ্ছিল। জনসাধারণের হাতে কোন আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। তারা রাস্তা খুঁড়ে যেমন তেমন
ভাবে ব্যারিকেড তৈরী করে তার পিছন থেকে পাথর ছুড়ছিল। এমনকি, ভিন্ডি বাজারের মত এলাকায়, সদ্য মহাযুদ্ধ জয়ী মহাশক্তিধর ব্রিটিশ
বাহিনী কে থামালেন বোরখা পরিহিত বাড়ির সাধারন মেয়ে বউরা। হাতের কাছে যা পেলেন, তাই নিয়ে আক্রমন চালানো হলো সাঁজোয়া
গাড়িতে চাপা সরকারি সেনাদের ওপর। বাড়ির ছাদ থেকে, গলির ভেতর থেকে আক্রমন চালানো হলো
ব্রিটিশ সেনাদের ওপর। তাদের কোন নেতা থাকলেও কেউ তাদের নাম শোনে নি। শত শত লোককে
গুলি করেই ট্যাঙ্কগুলি রাস্তা পরিষ্কার করতে পেরেছিল।
বিদ্রোহীরা পাগলের মত ছুটোছুটি করতে লাগল 'তলোয়ার' এবং ‘ক্যাসেল’ ব্যারাকে। যাই-ই ঘটুক না কেন, শর্তহীনভাবে ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণ
করা হবে না। রেটিংদের অবস্থা তখন শোচনীয়। সবারই দিশাহীন অবস্থা। এরই মধ্যে
বল্লভভাই প্যাটেল নৌসেনাদের অনুরোধ করেন যাতে তারা আত্মসমর্পণ করে। উপয়ান্তর না
দেখে ধর্মঘট কমিটিও হাল ছেঁড়ে দিল। কমিটি বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব
জানালো। রাত একটার সময় অন্যান্য জাহাজের থেকেও মোট ৩৬ জন সদস্য সমবেত হলেন
‘তলোয়ারে’। সমস্ত রেটিং তখন অশ্রুসজল চোখে আসন্ন কর্তব্য কি স্থির হয়, তাঁর অপেক্ষার করছিলেন। কংগ্রেসের
মুখপাত্র হয়ে সর্দার প্যাটেল আগেই আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিয়েছেন। এবার কলকাতা থেকে
জিন্নাহ ফোন করলেন জাহাজীদের। কিন্তু তিনিও ‘ন্যায় বিচার’-এর আশ্বাস দিয়ে এই
ধর্মঘট রদের আবেদন জানালেন। আর উপায় নেই। কংগ্রেস আর মুসলীম লিগ – ভারতের দুই
রাজনৈতিক দলই আত্মসমর্পনের পক্ষে। অবশেষে, আরও একপ্রস্থ বিতণ্ডার পর নৌসেনারা
আত্মসমর্পনেরই সিদ্ধান্ত নিল। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোর ছটায় ‘তলোয়ার’ জাহাজ
থেকে ওড়ানো হল আত্মসমর্পনের সাদা পতাকা। তবে, বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ বাহিনী নয়, আত্মসমর্পন করল জাতীয় নেতাদের কাছে।
৭.
কিন্তু ব্রিটিশদের জালিয়াতির এখানেই শেষ নয়। এরপরে যে
পদক্ষেপ তাঁরা নিল, তা
নেহাতই কাপুরূষোচিত, ঘৃণ্য।
সেদিন বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ দেখা গেল, ছোট ছোট কতগুলো গোরা সৈন্য বোঝাই যুদ্ধজাহাজ আস্তে আস্তে
বিদ্রোহী জাহাজগুলোকে ঘিরে ফেলতে লাগল। ঐ জাহাজগুলোতেও শান্তির পতাকা উড্ডীন ছিল।
কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ অত সহজে
পরাজয় স্বীকার করে পশ্চাদপসরণ করবে তা অসম্ভবই শুধু নয়, অচিন্ত্যনীয়ও। তাই তারা আক্রমণের ব্যূহ
রচনা করে আত্মসমর্পিত জাহাজগুলোর দিকে কামান ও মেশিনগানের ফায়ারিং শুরু করল। সবাই
তো হতবাক, একি!
মরিয়া হয়ে বিদ্রোহীরা আপ্রাণ চেষ্টা করল তাদের পূর্ব
মোহকে কাটাতে। আবার তারা গেল কামান বন্দুকের কাছে। আবার ধরল দূরে সরানো অস্ত্রগুলো, ভাঙা হাট জোড়া লাগাতে। কিন্তু
ইতিমধ্যেই হঠাৎ আক্রমণে বিদ্রোহীদের দেড়শ' জন মারা গেল। বিদ্রোহের এক নেতা মদন
সিং 'খাইবার' জাহাজের বেতার-যন্ত্রের কাছে ছুটে গিয়ে
সর্বত্র বেতার সংকেতে আবার যুদ্ধের কথা ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন,
“পেছন দিয়ে অতর্কিতে কাপুরুষ ব্রিটিশরা
আমাদের আক্রমণ করেছে। ওদের ক্ষমা নেই। শান্তির পতাকা এখন গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রতিটি
গোরা সৈন্যকে খতম করার সংকল্প নাও। ডু অর ডাই!”
তারপরে তিনি একদিকে দৃঢ়হস্তে 'খাইবার'-এর দূরপাল্লার বড় কামানের চাবি- কাঠি
হাতে নিয়ে চার্জ দিয়ে ঘন ঘন কামান দাগাতে থাকেন। আবার মাইক্রোফোনে দেশের জনগণের
উদ্দেশে উদাত্তকণ্ঠে আবেদন রাখেন,
“Oh, my beloved countrymen! See our
national leaders. They are nothing but the traitors of our motherland, see
them, see them, see them।”
বিদ্রোহীদের আত্ম সমর্পণের পর বোম্বাইয়ের রাস্তায় সাঁজোয়া গাড়ির টহল
এরই মধ্যে বেতারে খবর পেয়ে 'কাথিয়াড়' জাহাজ (করভেট কাথিয়াড়), যে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করছিল, তাঁরের দিকে এগিয়ে এল। বেতায়-সংকেতে
তার কাছে ধরা পড়ল এই আক্রমণের সংবাদ। এক ঘণ্টার মধ্যে ঐ জাহাজের রেটিংয়া। জাহাজের
কর্তৃত্বভার গ্রহণ করল। 'কাথিয়াড়'
বন্দরের দিকে
এগিয়ে এলে নেভির ক্রুজার গ্লাসগো ধেয়ে এল তার দিকে। ছোট্ট জাহাজ তার ক্ষুদে বারো
পাউণ্ডের কামান গ্ল্যাসগো-র দিকে উচিয়ে তুলে চলে গেল পার হয়ে। ক্রুজার গ্লাসগো
আঘাত না করে সম্মান দেখালো ক্ষুদে জাহাজ কাথিয়াড়-এর সাহসকে। সে কাছে এসে বিদ্রোহী
ভাইদের সাহায্যের জন্য পেছন থেকে গোরা সৈন্যদের ওপরে কামান দাগিয়ে আঘাত করতে থাকে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, 'কাথিয়াড়'-এর রেটিংরা আক্রমণ বেশিক্ষণ টিকিয়ে
রাখতে পারল না। তবুও যেটুকু মিলিত শক্তি ছিল তা দ্বারা বিদ্রোহীরা আবার নতুন করে
দেড় হাজার গোরা সৈন্যের ভবলীলা সাঙ্গ করে আরব সাগরের গভীর জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
অবশেষে নিয়তির খেলায় বিদ্রোহীরা সেই ব্রিটিশ শক্তির নিকটেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য
হল। পঞ্চাশ হাজার বিদ্রোহীর আশার প্রদীপ নিভে গেল আরব সাগরের বিষাক্ত হাওয়ায়, যে বিদ্রোহের দীপশিখা জেলেছিল 'তলোয়ার', তার বীরত্বের ও দেশ- প্রেমের নেতৃত্ব
দিয়েছিল 'খাইবার'।
৮.
এর পরের ঘটনা আরো মর্মান্তিক। ব্রিটিশ তার জিঘাংসা
চরিতার্থ করল কোর্ট মার্শাল আইনে। নৌবিদ্রোহের দুই প্রধান নেতা এম. এস. খান ও মদন
সিংকে নৃশংস হত্যা করা হয়। এম এস খানের পায়ে দুটো ভারী পাথর বেধে আরব সাগরে ডুবিয়ে
মারা হয় ও মদন সিং ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে প্রান বিসর্জন দেন। সাড়ে চারহাজার
বিদ্রোহীকে মুলতান সামরিক জেলে পাঠানো হয় তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করার জন্য। অনেক
সৈনিকদের বরখাস্ত করা হলো। এই বরখাস্ত হওয়া সৈনিকদের কাউকে "স্বাধীন"
ভারত বা পাকিস্তানে সেনাবাহিনীতে স্থান দেওয়া হয়নি। কারন এরা নাকি "বিশ্বাসঘাতক"।
২৬শে ফেব্রুয়ারী বোম্বাইয়ের এক সভায় এই বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীদের নিঃসংকোচে তীব্র
নিন্দা জানালেন জওহরলাল নেহেরু। পরের বছর ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট রাতে জহরলাল নেহেরু
যখন প্রচার করেছিলেন, “বহু বছর
আগে আমরা আমাদের ভাগ্যের সঙ্গে লড়াইয়ে নামি; এখন সময় এসেছে আমাদের প্রতিজ্ঞা সফল
করার-সম্পূর্ণভাবে বা পুরোপুরিভাবে নয়-কিন্তু বেশ ভালভাবেই,” তখন নৌবিদ্রোহ হয় তো জাতির একটি
অস্বস্তিকর স্মৃতি মাত্র হয়ে পড়েছিল। সিংহভাগ বিদ্রোহীদের নাম ভুলিয়ে দেওয়া হয়
ইতিহাসের পাতা থেকে। নৌ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল ৫০,০০০-এরও অধিক বিদ্রোহী; কিন্তু সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের
নথিতে বিদ্রোহীর সংখ্যা? মাত্র চারশ।
বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের তিনমাস বাদে বিদ্রোহের কারণ
অনুসন্ধান করার জন্যে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তিনজন ভারতীয় বিচারক ও দুজন
সামরিক অফিসার এই কমিটিতে চেয়ার করেন। কমিটি এই বিদ্রোহের তদন্ত করে ৬০০ পৃষ্ঠার
একটি রিপোর্ট তৈরী করেন। কিন্তু ছ'শো পৃষ্ঠার সেই রিপোর্ট আজ অব্ধি জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করা হয় নি।
স্বাধীন সরকারও সে রিপোর্ট নিষিদ্ধ করেছেন।
নৌবিদ্রোহ
আমাদের এক গৌরবের ইতিহাস। একই সঙ্গে লজ্জারও। সেই নেতারাই আমাদের শাসন করেছেন, করছেন। সেই লজ্জা। আর গৌরব? সেই রং ফিকে হবে না। সলিল চৌধুরি গান
বেঁধেছিলেন সেই বিদ্রোহ নিয়ে - "ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে..."। হেমাঙ্গ বিশ্বাস
এবং গননাট্য সংঘ ঝাঁপিয়ে পড়েন বিদ্রোহের সমর্থনে। উৎপল দত্ত ১৯৬৫ সালে লেখেন
বিখ্যাত নাটক ‘কল্লোল’, ওই নৌবিদ্রোহের ওপরেই লেখা। সে নাটক
নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন তৎকালীন কংগ্রেসী পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মিনার্ভা থিয়েটারে ঢুকে
কংগ্রেসী গুন্ডারা হামলা চালায়। উৎপল দত্ত কারারুদ্ধ হন নাটক লেখার অপরাধে। ব্যস, এই পর্যন্তই। আর কিছু নেই। মুছে দেবার
চেষ্টা কিন্তু আছে। দেখো ভারতীয়রা, কখনো তোমাদের পিতৃ-পিতামহ বিপ্লবাত্মক আন্দোলন করেনি। আমরা যেমন বলেছি, তারা চলেছে। তোমরাও তাই করো। সংস্কৃতি
তোমার কাছে হোক কোঁচানো ধুতি পরা বাবু কালচার। ভুলে যাও অগ্নীযুগ, ভুলে যাও আজাদ হিন্দ ফৌজ, ভুলে যাও নৌবিদ্রোহ। এসব ছিলোনা তোমার।
মুম্বাইয়ের কোলাবাতে নৌবিদ্রোহের স্মৃতিস্তম্ভ
না, ভুলে যাবেন না, পাঠক।
ভুলে যেতে দেবেন না। বিপ্লবের শ্বাশত অবদান হল, আত্মদান, সাহসিকতা, মৃত্যুভয়শূন্যতা, কর্মস্পৃহা, পরার্থবোধ এবং সবকিছু জড়িয়ে
নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা। জাতির জীবনে ঐ সব গুণাবলী সাদরে বরণ না করলে তার যৌবন
দেউলে হয়ে যাবে। শুরু হবে দুর্দিন। সে-দুর্দিন চরমে পৌঁছতে দেরি হবে না। তখন আবার
পুনবিপ্লব ঘটাবার জন্য জাতিকে নতুন করে শুরু করতে হবে সেই ক্ষুদিরাম-পর্ব থেকে।
কাজে কাজেই আজই তাদের বিশেষ করে শোনানো প্রয়োজন বিপ্লবের শ্বাশত বীর্যবত্তার
কাহিনী, আত্মদানের কীর্তি। মৃত্যুহীন
বিপ্লববাদ - বাংলা তথা ভারতের অমর ঐতিহ্য জাতির যৌবন জানুক এবং বুঝুক। আপন প্রাণের
তারে তারা অনুরণিত করুক সেদিনকার বিপ্লবীদের কর্ম-ইতিহাসের শৌর্যবাণী। আজকের
যাত্রী পূর্বগামীদের উদ্দেশ্যে বলুক যে, “তাঁদের ভুলিনি, ভুলব না,
ভুলতে দেবোনা”।
তথ্যসূত্রঃ-
1. নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস – ফণিভূষণ
ভট্টাচার্য
2. নৌ বিদ্রোহ – বলাই চন্দ্র দত্ত
3. বিদ্রোহ, বিপ্লব, স্বাধীনতা – ডঃ নীরদবরণ হাজরা
4. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের
ইতিহাস – ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ
5. Mutiny
of the Innocents – Balai Chandra Dutt
6. Rin
Mutiny: 1946 – Biswanath Bose
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন