বাংলা সাহিত্যজগতের "সম্পূর্ণা" আশাপূর্ণা দেবী - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

 


“নারী জন্ম তো দেখলাম, 

পরের জন্মে পুরুষ হয়ে দেখব কেমন লাগে।“

                     – আশাপূর্ণা দেবী 

 

 "মেয়ের সাধ পূর্ণ হয়েছে, আর মেয়ে নয়!"  -  ১৯০৯ সালের ৮ই জানুয়ারি তৃতীয়বার পৌত্রীর জন্মের সংবাদ পেয়ে ঠাকুমার এহেন প্রতিক্রিয়া অনুসরণে সেদিনের ছোট্ট মেয়েটির নাম রাখা হয়েছিল "আশাপূর্ণা"। এমন পরিবারের মেয়েদের অদৃষ্টে যে উপেক্ষা আর অবহেলা নিত্যসঙ্গী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাড়ির ছেলেরা স্কুলে যেতে পারতো, তাদের জন্য বাড়িতে মাস্টারমশাইও আসতেন। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে কঠোর অনুশাসন। নাতনীদের ঠাকুমার বদ্ধমূল ধারণা, স্কুলে গেলে মেয়েরা বাচাল হয়। এদিকে তাদের পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত সেযুগের একজন শিল্পী হওয়া সত্বেও মায়ের মুখের উপর কথা বলে উঠতে পারেননি। প্রতিবাদ করে উঠতে পারেননি যে "না, আমার ছেলেদের মতো আমার মেয়েরাও স্কুলে যাবে!" অগত্যা ছেলেদের চলতে লাগলো বিদ্যাশিক্ষা আর মেয়েদের চলতে লাগলো "মেয়েসুলভ" কাজকর্মের অনুশীলন

ছোট্ট আশাপূর্ণা বড়দের সামনে ধীরস্থির বাধ্য মেয়ে। কিন্তু চোখের আড়াল হতেই তাকে আর পায় কে! তরতর করে গাছে উঠে পড়া, অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো এসব ছিল তার কাছে নেহাতই ছেলেখেলার বিষয়। ঠাকুমার উপর রাগ কম ছিল! স্কুলে যেতে দেবে না! পড়াশোনা করতে দেবে না! দেখাচ্ছি মজা! পাশের ঘর থেকে দাদাদের পড়া শুনে শুনে শিখে ফেললেন বর্ণপরিচয়। বই পড়তে বড়ো ইচ্ছে হয়, এদিকে ঠাকুমার কড়া নিষেধ। তখন মা সরলাসুন্দরী পথ দেখালেন। সরলাসুন্দরী ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য-পাঠিকা। বাড়িতে তখনকার দিনের সবরকম প্রসিদ্ধ গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ছিল। সেদিকেই চালনা করলেন মেয়েকে। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে বাড়ির গ্রন্থাগারের দৌলতে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করে দিলেন আশাপূর্ণা। বাড়িতে থাকা ভারতবর্ষ, বঙ্গদর্শন, বসুমতি, সবুজপত্র, সন্দেশ ইত্যাদি পত্রিকাসহ বিখ্যাত লেখকদের বই পড়ে ফেললেন। হঠাৎ একদিন কিশোরী মেয়েটির চিঠি পৌঁছে গেল রবীন্দ্রনাথের কাছে। সেই পত্র পড়ে মুগ্ধ কবি চিঠির জবাবে লিখলেন, "আশাপূর্ণা, তুমি সম্পূর্ণা।"

 

ছেদ পড়লো পনেরো বছর বয়সে। ১৯২৪ সালে এক রক্ষণশীল পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী, সন্তান, সংসারের হাজার দায়িত্ব – হয়তো এখানেই তাঁর সাহিত্যচর্চার ইতি ঘটতে পারতো। তা কিন্তু হয়নি। স্বামী কালিদাশ গুপ্ত ছিলেন যোগ্য জীবনসঙ্গী। স্বামীর উৎসাহে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি, সঙ্গে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম। সংসারের সব কাজকর্ম মিটিয়ে, ছেলেমেয়েদের খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাতে হ্যারিকেনের আলোয় লিখতে বসতেন। তার পরেই পাঠকদের উপহার দিতে শুরু করেন একের পর এক কালজয়ী সব উপন্যাস, যেসব উপন্যাসে পড়েছিল তাঁরই জীবনদর্শনের এবং পর্যবেক্ষণমূলক অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি। সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তাঁর রচনার মূল উপজীব্য। তাঁর রচিত "প্রথম প্রতিশ্রুতি", "সুবর্ণলতা", "বকুলকথা" উপন্যাসত্রয়ী বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচিত হয়

এ প্রসঙ্গে "সুবর্ণলতা" বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আশাপূর্ণার ঠাকুমার সঙ্গে এই উপন্যাসের সুবর্ণলতার ঠাকুমা এবং শাশুড়ি মায়ের চরিত্রের কিছু মিল আছে। উপন্যাসে সুবর্ণলতার ঠাকুমা ও শাশুড়ি মা পিতৃতন্ত্রের প্রবল প্রতিনিধিরূপে পরিলক্ষিত হয়। তারা সেখানে নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলে। ওদিকে সুবর্ণলতাকে তার মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ঠাকুমা বিয়ে দিয়েছিল। সেই অপমানে সুবর্ণলতার মা সত্যবতী সংসার ত্যাগ করে শিক্ষকতার জীবন বেছে নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচেছিলেন। সুবর্ণলতাকে সারাটা জীবন মায়ের কুলত্যাগের জন্য নিন্দার কাঁটা সহ্য করতে হলেও সে আজীবন সংসারের নানান ভ্রান্ত ধারণা ও কর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। উপন্যাসটিতে নতুন বাড়ি তৈরির সময় সুবর্ণলতা তার স্বামীকে বলেছিল, "একটা দক্ষিণের বারান্দা চাই-ই চাই।" তা শুনে শাশুড়ি মা মুক্তকেশী বলেছিল, "জম্মে শুনিনি বাপু কোনো মেয়েমানুষ বলতে পারে চাই-ই চাই।" নিজের প্রতিবাদী সত্ত্বাকে উপন্যাসের চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে সুনিপুণভাবে পরিস্ফুট করেছেন আশাপূর্ণা দেবী। মেয়েদের প্রতি সমাজের অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন

লিখেছেন – মেয়েমানুষ যতই মুখ্যু হোক তাকে ঠকানো বড় শক্ত। সে সব জেনেশুনেও চুপ করে থাকে, পাছে তার পাখির বাসাটি ভেঙে যায়।“

প্রথাগত শিক্ষালাভে বঞ্চিতা, বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষা না জানা, পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা আশাপূর্ণা দেবী রচনা করে ফেলেছিলেন দেড় হাজার ছোটগল্প, আড়াইশো উপন্যাস, ষাটেরও বেশি ছোটদের কাহিনী এবং অসংখ্য প্রবন্ধ। সম্মানিত হয়েছিলেন সাহিত্যের সব থেকেে বড় পুরস্কার জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে। জ্ঞানপীঠ পাওয়ার পর তাঁর স্বামী বলেছিলেন, "আশাপূর্ণা, আজ আমার ইচ্ছে করছে সারা কলকাতা মোমবাতির আলো দিয়ে সাজাই।" সমগ্র কলকাতাকে সাজানো তাঁর স্বামীর পক্ষে সম্ভব না হয়ে উঠলেও সেদিন তিনি গোটা বাড়ি মোমবাতি দিয়ে সাজিয়েছিলেন। জ্ঞানপীঠ ছাড়াও বিশ্বভারতীর শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’, দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিতা হয়েছিলেন আশাপূর্ণা দেবী। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অ্যাকাডেমি ফেলোশিপ দ্বারা সম্মান জানান

প্রায়ই এমন হয়েছে, লিখতে লিখতে আশাপূর্ণা দেবী নিজস্ব দুনিয়ায় হারিয়ে যেতেন। সময়কাল জ্ঞান থাকতো না। কতদিন লেখার কাজে রাত ভোর হয়ে যেত। আধশোয়া ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে ছোট্ট একটা কাঠের ডেস্কে নিজের প্যাডে লিখে যেতেন। তা হলেও ‘টিপটপ’ থাকতে ভালোবাসতেন তিনি। বিকেলে চুল বেঁধে গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ি পরা, সুগন্ধি চন্দন সাবান মাখা, মাথায় জবাকুসুম কিংবা মহাভৃঙ্গরাজ তেল দেওয়া, মুখে হিমানী স্নো, ওটিন ক্রিম এসব দিকে সদাসচেতন থাকতেন। তাঁতের শাড়ি ছিল খুব পছন্দের। সেখানে থাকতে হবে হালকা কমলা বা হালকা সবুজ বা হালকা নীল পাড়। তবে কোনোদিন খুব রঙিন শাড়ি কখনও পড়েননি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে ভালবাসতেন তিনি। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আশাপূর্ণা দেবীর বাড়িতে এসে তাঁর একটি প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন – "ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে।"


১৯৯৫ সালের ১৩ই জুলাই আশাপূর্ণা দেবী চলে যান, গহন রাতে ঘুমের ভেতর। অমৃতলোক পাড়ি দেওয়ার দু’তিন মাস আগেও লেখালেখির কাজ করছিলেন। হঠাৎ করেই শরীরটা ভেঙে পড়েছিল। লিখতে কষ্ট হলেও কোলের উপর প্যাড নিয়ে লেখার চেষ্টা করতেন। লাইনগুলো ছেড়ে ছেড়ে যেত, অক্ষর কেঁপে যেত। একটা গল্প ওভাবেই শেষ করেছিলেন। শেষের দিকে শুয়ে থাকতেন। আশাপূর্ণা দেবীর লেখাই বুঝিয়ে দিয়েছিল নারীবাদ মানে কেবলই পুরুষবিদ্বেষী নয়, তা হতে পারে এক বা একাধিক নারীর বিরুদ্ধেও। আধুনিক ও স্বনির্ভর নারীদের সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয় তাঁর লেখা পড়েই। শুধু গল্প উপন্যাসের কাহিনী বা জীবনদর্শন নয়, তার মধ্যেকার এক একটা উক্তি যেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের মনের কথা, অনুভব, উপলব্ধি। সাহিত্যের মহাকাশে সদা জ্যোতির্ময়ী অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র আশাপূর্ণা দেবীকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম

 

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন