'অনুসন্ধিৎসু' এবারে বেশ বড় করেই আয়োজন করেছিল আলোচনা সভাটার। বছরে একবার করে দিন তিনেকের জন্যে এরকমই কিছু না কিছু করেন ওঁরা। অনুসন্ধিৎসু আসলে একটা প্রকাশনা সংস্থা, কিন্তু একটু অন্য ধরনের। দর্শন, সমাজ এবং বিজ্ঞান - এসবের ওপরেই বই এবং ই-বই বার করেন। সঙ্গে অবশ্য অন্যান্য সামাজিক ক্রিয়াকলাপেও অংশ নেন। তিন-চার বছরেই বেশ নাম করে গেছে। এবারে ওঁরা দেশিয় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশ থেকেও এগারো জন বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিষয় ছিল 'সৃষ্টি রহস্য'।তিনজন আমন্ত্রিত বিজ্ঞানী ছাড়া প্রায় সবাই এসেছিলেন এবং ভাষণ দিয়েছেন।আমিও একজন সৌভাগ্যবান স্পিকার। বললাম মাল্টিভার্স আর স্ট্রিং থিয়োরির সম্পর্কের ওপর ।
ইংল্যান্ডের ডক্টর প্লেম্যান আর চিলির ডক্টর জোস্ বারেরা অসুস্থতার জন্যে যোগ দিতে পারেননি। কলকাতার ডক্টর সৈয়দ রেজা কেন আসেননি তা জানা গেল না। ওঁর কোনো উত্তর আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জানা গেছে, কয়েক মাস থেকে উনি কিছু না জানিয়েই হঠাৎ আসা বন্ধ করে দিয়েছেন l ফোনও সুইচড অফ বলছে। এই বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিকের ভাষণ শোনার খুব ইচ্ছে ছিল, হলো না। এমনিতে খুবই ভাল সাড়া মিলেছে। বড় বড় ব্যক্তিত্বদের ভাষণ এবং আলোচনা প্রায় সব মিডিয়া হাউস-ই কভার করেছে। রবীন্দ্রসদনের মতো প্রেক্ষাগৃহও প্রায় ভরে গিয়েছিল তিন দিনই।
আজ প্রায় কুড়ি বছর ধরে আছি ব্যাঙ্গালোরে। বহু বছর পরে সুযোগ পেলাম বাংলায় আসার। তাই ভাবলাম, কয়েকটা দিন কাটিয়ে স্মৃতিগুলো একটু ঝালিয়ে নিয়ে ফিরব কর্মক্ষেত্রে। বিশ্বনাথন চেন্নাই থেকে এসেছে। আমার কাছে শুনে বলল,'বাংলার ব্যাপারে অনেক পড়েছি, রে-এর ফিল্মেও দেখেছি। একদিন বাংলার কোন গ্রামে গিয়ে যদি একটু অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়, বেশ হয়।' এই আলোচনা শুনে কার্ল আর ডেভিডও 'রুরাল ইন্ডিয়া' আর 'অ্যাকচুয়াল ইন্ডিয়ান লাইফ' দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করল। কার্ল ফিশার এসেছে জার্মানি থেকে আর ডেভিড মার্টিন আমেরিকা থেকে। থিওরেটিকাল ফিজিক্সে এরা সব দিকপাল ব্যক্তিত্ব। এদের অনুরোধ তো আর ফেলা যায় না! রাজি হলাম। কথা হল, পরিকল্পনাহীন ভাবে দিনে দিনে ঘুরে ফিরে আসা হবে কলকাতার কাছের কোনো গ্রাম থেকে। সবাই বলল, কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নয়, যাওয়া হবে সাধারণ মানুষের মত সাধারণ যানবাহনে। তবেই নাকি প্রকৃত ভারতকে ছোঁয়া যাবে। তাই সই! বড় মানুষের বিচিত্র খেয়াল!
পরের দিন ছিল রোববার। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম চার মক্কেলে।বিশ্বনাথন কাজ-চলা হিন্দী জানে, কিন্তু তাতে দক্ষিণী টান বড় প্রকট। কার্ল ইংরেজি ভালই জানে আর ডেভিডের তো মাতৃভাষাই ইংরেজি। এরা কেউই বাংলা জানে না, জানার কথাও নয়। তাই প্রথমেই ওদের বলে দিলাম, 'গ্রামেগঞ্জে অত ইংরেজি না-ও বুঝতে পারে, আমিই দোভাষীর কাজ করে দেব।' শেয়ালদা সাউথ থেকে লোকাল ট্রেনে শুরু হল যাত্রা। রোববার বলে ট্রেন একদম ফাঁকা। হকার ওঠা শুরু হল। ওদের মাঝে মাঝেই বুঝিয়ে দিতে হচ্ছিল - কী প্রোডাক্ট, কোন কাজে লাগে - এই সব। বেশির ভাগ সময়েই ওরা বলে উঠছিল,'ইন্টারেস্টিং, ওয়াও, দ্যাট'স গ্রেট' ।
ক্যানিং স্টেশনে নেমে বাইরে বেরিয়ে দেখি কোনো রিকশা বা টোটো নেই।কয়েকটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে ভ্যানওয়ালা নেই এবং চাকায় তালা লাগানো। সামনের পান-বিড়ির দোকানদার বললেন, আজ গোসাবায় বড় রাজনৈতিক সভা আছে, সবাই গেছে সেখানে। এ ব্যাপারটার সঙ্গে আমরা ভালোই পরিচিত। বিশ্বনাথনেরও অজানা নয়। কিন্তু বাকি দুজন বেশ অবাক হলো। আমরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় উস্কখুস্ক চুলদাড়িওয়ালা একটা বয়স্ক লোক বলে উঠল, 'কোথায় যাবেন?' লোকটা ভ্যানের পাশেই অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বসে ছিল। মাঝারি উচ্চতা, সাধারণ ময়লা-ময়লা জামাকাপড়। বললাম, 'মাতলা নদীর দিকে কোথায় যাওয়া যায় চাচা? এই একটু ঘোরার জন্যে আর কি!' চাচাই বললেন ছোট গনিপুরের কথা। দু-আড়াই কিলোমিটার দূর। চাচা বলল, 'যাবেন কিকরে? লোকাল বাসের ভিড়ে সায়েবদের নিয়ে চড়তে পারবেন?' কথাটা ঠিক, স্থানীয় বাসে প্রবল ভিড়, ছাদে লোক বসে আছে। তারপরে চাচা বলল, 'আমি তো ভ্যান চালাই না, তবে ভ্যান পেলে আমিই আপনাদের নিয়ে যাব। দাঁড়ান দেখছি।' পানের দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সৌভাগ্যক্রমে এক ভ্যানওয়ালা তার কাছে চাবি রেখে গেছে। কত দিতে হবে বলায় চাচা বললেন, 'কিছু লাগবে না। আপনি বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে বিপদে পড়ে গেছেন, তাই চালাচ্ছি। এ তো আমার পেশা নয়!' নাম জিজ্ঞাসা করায় চাচা বলল, 'এখানে আমায় সবাই সদু-মাস্টার বা সদুচাচা বলে ডাকে, আপনারাও তাইই বলবেন।' জিজ্ঞাসা করলাম, 'কী করো?' সদুচাচা মুচকি হেসে বলল, 'এই গাঁয়ের বাচ্চাদের বিজ্ঞান-অংক এইসব পড়াই। একটা পেট কোনোরকমে চলে যায়।' একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, চাচার কথায় কিন্তু দক্ষিণ চব্বিশপরগণার স্থানীয় টানটা নেই। লোকটাকে বেশ পরোপকারীই লাগল।
ভ্যানে পা ঝুলিয়ে বসে কার্ল আর ডেভিড খুব মজা পেল। নতুন অভিজ্ঞতা।বিশ্বনাথন অবশ্য আগে চড়েছে। গ্রাম শুরু হতেই সবার ভাল লাগতে
লাগল।কার্ল বা ডেভিড - কেউই
প্রাচ্যের গ্রাম কখনো দেখেনি। সবুজ ক্ষেত, গাছপালা, নারকোল গাছ আর তালগাছের সারি, ছোট ছোট বাড়ি, নিকোনো কুঁড়ে ঘর, গরু-ছাগলের দল, হাল-চষা বলদ, পুকুরধারে হাঁসের দল, গ্রাম্য হাট-বাজার - এসব দেখে
ইংরেজি বিশেষণের বিস্ফোরণ বেড়েই চলল। চাচা লোক বেশ ভাল, রাস্তায় জায়গায় জায়গায় থেমে দৃশ্য দেখাতে দেখাতে নিয়ে
চলল।এমনকি আমার সঙ্গিরা যখন আনন্দ ও
উৎসাহ প্রকাশ করছিল, তখন চাচাকে দেখে লাগছিল বেশ
উপভোগ করছে। আমারও খুবই ভাল লাগছিল, শহুরে ব্যস্ততার থেকে যেন একটু
মুক্তি পেলাম, সঙ্গে উপরি পাওনা বিদেশিদের
মুখে নিজের দেশের প্রশংসা !
ছোট ছোট মেটে রাস্তা দিয়ে কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছলাম মাতলা নদীর ধারে। অপূর্ব দৃশ্য - চওড়া শান্ত নদীর দুধারে সবুজের অকৃপণ সমারোহ, নদীতে দু-একটা ছোট্ট নৌকো, দূরে দূরে দৃশ্যমান বাড়িঘর, আকাশে মেঘ রোদের আলোছায়া। আমরা একটা বড় বটগাছের নিচে শতরঞ্চি বিছিয়ে বসে পড়লাম। চাচাও ভ্যান রেখে আমাদের পাশেই বসল।
আমাদের সঙ্গে স্যান্ডুইচ আর বার্গার নিয়ে এসেছিলাম। ফ্লাস্কে এনেছি কফি।খেতে খেতে যথারীতি শুরু হয়ে গেল বিজ্ঞানের আলোচনা। ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে! এদিকে চাচা চোখ বন্ধ করে দিয়েছে, ঝিমোচ্ছে মনে হয়। এটা সেটা হতে হতে আলোচনা ঢুকে পড়ল সেই চিরাচরিত দ্বন্দ্বে - জেনারেল রিলেটিভিটি বনাম কোয়ান্টাম তত্ব। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ দিয়ে গ্ৰহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ ইত্যাদির মতো বড় বড় ব্যাপার ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু সাব-এটমিক কণার অনেক কিছুই বিশ্লেষণ করা যায় না। আবার কোয়ান্টাম তত্বে অতি ছোটদের জগতের বেশিরভাগই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু মহাজাগতিক ঘটনার ভাল ব্যাখ্যা করা যায় না। বিশ্বনাথন আর ডেভিড জেনারেল রিলেটিভিটির কড়া সমর্থক, কার্ল কোয়ান্টাম তত্বের। তর্ক ক্রমশ উত্তপ্ত হতে লাগল, বাড়তে লাগল গলার জোরও। এত চেঁচামেচির মধ্যেও চাচা দিব্যি চোখ বন্ধ করে বসে আছে, ঝিমোচ্ছে মনে হয়। এদের একটু শান্ত করতে বললাম,'দেখো, এই কারণেই তো ইউনিফায়েড থিওরি বার করার জন্যে এত চেষ্টা চলছে।' হো হো করে হেসে কার্ল বলল,'আরেকটা ভাঁওতা! হয় এটা ঠিক, নয় ওটা। এই দুই মতকে মেলানোর চেষ্টাটাই পণ্ডশ্রম, অবাস্তব এবং থিওরেটিকাল!' বললাম,'তা কেন? কদিন আগেই তো গবেষণাগারে সফল ভাবে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট করা গেছে। বলতে পারো, কৃত্রিম ওয়ার্মহোল বানানো গেছে। তাহলেই তো থিয়োরির ইউনিফিকেশনের দিকে আমরা এক পা এগিয়ে গেলাম ।' একই জায়গায় উৎপন্ন দুটি কণাকে যত দূরেই রাখা হোক না কেন, একটার দশা পাল্টালে সঙ্গে সঙ্গে অন্যটারও দশা পাল্টে যাবে - এই হল কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট। আইনস্টাইন বলেছিলেন, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের নিয়ম অনুযায়ী স্পেস-টাইমে শর্টকাট বানানো সম্ভব, যাতে ব্রহ্মাণ্ডের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুব সহজেই পৌঁছনো সম্ভব। একে বলে ওয়ার্মহোল। কার্ল বলল,'বটে! তা কোথায় হয়েছে এ পরীক্ষা? কে করেছে?' বেশ অসুবিধেয় পড়ে গেলাম। কারণ, মাঝে একদিন খবরটা পড়লেও ডিটেলসটা আর মনে নেই। কার্লও মুচকি মুচকি হাসতে লাগল, যেন আমি মিথ্যেকথা বলেছি আর ও ধরে ফেলেছে! খুব রাগ হচ্ছিল। হঠাৎ শুনলাম চাচা বিড়বিড় করছে, 'কালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির মারিয়া স্পিরোপুলু।' চমকে তাকিয়ে দেখি, চাচার চোখ তেমনই বন্ধ। আমি বললাম কার্লকে। কার্ল মোবাইলে সার্চ করে দেখে বলল, ' ঠিক বলেছো, এ খবরটা মিস করে গেছিলাম। আমি দুঃখিত! ব্যাপারটা আরো জানতে হবে।' বেলা বেড়ে গেছে, তাই সবাই ফেরার জন্যে তৈরি হল।
এবারে বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম স্টেশনে। চাচা কিছুতেই কোনো পয়সা নিলো না। নির্লোভ মানুষ। বললাম, 'আচ্ছা চাচা, তুমি স্পিরোপুলুর এক্সপেরিমেন্টের কথা কিকরে জানলে?' চাচা সেই মুচকি হাসিটা দিয়ে বলল, 'বাচ্চাদের বিজ্ঞান পড়াতে গেলে নিজেকেও আপডেটেড থাকতে হয়। তাই নেটে একটু খবরটবরগুলো পড়ে নিই ।' লোকটা বেশ ইন্টারেস্টিং!
আজ ট্রেন লাইনে কি একটা মেরামতির কাজ চলছে, তাই ট্রেন বেশ দেরিতে দেরিতে চলছে। এখন ঘন্টাখানেক পরে শেয়ালদার ট্রেন। কার্ল আর ডেভিড ঘুরে ঘুরে স্টেশন দেখছে আর স্থানীয় লোকেরা ওদের দেখছে। বিশ্বনাথন মোবাইলে কার সঙ্গে বেশ গল্পে মেতেছে তামিল ভাষায়। আমি অগত্যা একটা খবরের কাগজ কিনে পড়তে শুরু করলাম। মাঝের পাতায় একটা খবরে চোখটা আটকে গেল! খবরটা এইরকম -
" বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর পদত্যাগঃ
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায় বিজ্ঞানী ইদানিং ঘনিষ্ঠ মহলে প্রায়ই বলতেন, 'অসাধারণ কাজের জন্য বিশ্বজুড়ে অসাধারণ লোকেরা তো কত কিছুই করছে, এখন সাধারণ লোকের জন্যে সাধারণ কাজ করে তাদের অসাধারণ করে তুলতে হবে! সাধারণ মানুষকে করে তুলতে হবে কুসংস্কার বিরোধী, বিজ্ঞানমনস্ক। ছোটবেলা থেকে তাদের যুক্তিবাদী করে তুলতে হবে। এই হবে প্রকৃত বিজ্ঞানসাধনা!'
আমরা অনেক চেষ্টা করেও ড. রেজাকে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাট তালাবন্ধ এবং মোবাইল সুইচড অফ ।"
সঙ্গে ছাপা বিজ্ঞানীর ছবিটা দেখে চমকে উঠলাম!
ট্রেন ঢুকছে। বিশ্বনাথনকে বললাম, 'কার্ল আর ডেভিডকে নিয়ে কলকাতা ফিরতে পারবে?' বিশ্বনাথন বলল,'হ্যাঁ পারবো। কেন, তুমি ফিরবে না?' বললাম, 'না, পরে ফিরবো। একটা বড় ভুল হয়ে গেছে - একজনকে চিনতে পারিনি।একবার ক্ষমা চাইতে তাঁর কাছে ফিরে যেতেই হবে। তোমরা এগোও, আমি পরে ফিরবো।' বিশ্বনাথন ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওদের নিয়ে উঠে পড়ল ট্রেনে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন