অপেক্ষারা আর তিষ্টোতে দেয় না। দেখতে দেখতে বারোটা বছর পেরোতে চলল নিখোঁজের খবর। শ্যামলীর বুকটা পাথর। মন আর পাখি হয়ে ওড়ে না। চোখের জলের রাগিনী রাগ করে। সব ঋতুরা কেমন বোবা হয়ে গেছে। সময়ের ঘরে ধুলো জমছে দ্রুত! বিয়ের পরে তোলা সাদা কালো ছবিটা লালচে হতে শুরু করেছে। শাশুড়ি পড়শির মানা, ফটোতে ধূপ দিতে গেলে বলে - 'খোঁজ নেই কিন্ত মরার তো কুন খপর লাই।‘
'মরা’- কথাটা
শুনে শ্যামলীর বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। ‘ও’ তো রাজ মিস্ত্রির কাজে কেরালা গেল। চার ছ'মাস ছাড়া বাড়ি আসত। তখন শ্যামলী উড়ন্ত
প্রজাপতি! কি খাবে,কতটা সময় ওকে ভাল রাখা
যায়, নিজেও থাকা যায়! সাইকেলে করে দু’জনে বটতলার বাজারে সওদা করে, তারপর ঘুঘনি মুড়ি খেয়ে বাড়ি ফেরা। ক'দিন শ্যামলী ঘোরের মধ্যে থাকত। বিছানাতে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে কখন বুকে চাঁদ
ঘুমিয়ে পড়ত! পাশের বুথ থেকে ফোন করত স্বামীকে, ওর সঙ্গে পড়শির চারজন গিয়েছিল, ওদের হাতেই টাকা পাঠাত, আর শ্যামলী বিড়ি বাঁধার কাজটা শিখে নিয়েছিল, তাতেই মোটামুটি শাউড়ি বউয়ের চলে যেত। স্বামী চলে
যাওয়ার এক মাসের পর বেদম বমি, মুখে স্বাদ নেই। শাউড়ি
বুঝতে পারে!
'তোর পেটে নাতি আসতিছে রে!’
শ্যামলী লজ্জায় আনন্দে মুখ ঢাকে। একমাস পর ওর সাথে যে রাজমিস্তিরি কাজ করত সে এসে জানালো - ‘মদনাকে কয়েকদিন পাওয়া যাচ্ছে না, অনেক খোঁজ করেছি, তাই আমি খবরটা দিতে এলাম।‘
শুনে আঁতকে ওঠে শ্যামলী মুর্চ্ছা যায়। শাশুড়ির আর্ত কান্না!
দেখতে দেখতে নিরুদ্দেশের বারোটা বছর!
গ্রামের মাতব্বর রুক্ষ স্বরে জানিয়ে গেল - ‘কুশপুত্তলিকা দাহ করে, বৈধব্য কে মেনে নেবে।‘
নির্জনে রায়দিঘির পাড়ে সিঁদুর মুছে শাঁখা
ভাঙে।
‘ না, এ জীবন আর
রাখব না।‘ দিঘির জল কলকলিয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় শ্যামলী।
‘মা! এখনও বাড়ি যাচ্ছ না কেন? খিদে পেয়েছে যে!’
দিঘির চোখ সরে গেল গোপালের দিকে। ‘গো- পা- ল আমার! তোকে নিয়েই বাঁচব অনেক দিন।‘
মৃদু বাতাসে গাছের পাতা হাততালি দিয়ে
ওঠে। দমন ক্রিয়া স্তব্ধ হয়!..
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন