তাসের দশা - তুষার সরদার

   

        ডাউন লালগোলা-শিয়ালদহ ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। সারাদিনের কাজ সেরে লালগোলা স্টেশন থেকেই রাতের ট্রেনে উঠেছি সকালেই শিয়ালদহ ফিরতে পারব বলে। তখন লালগোলা-শিয়ালদহ ফাস্ট প্যাসেঞ্জারে একটা প্রথম শ্রেণির কোচ থাকত। সেই প্রথম শ্রেণির কোচে চার বার্থের ক্যুপের একটি নীচের বার্থ আমার। আমার উপরের বার্থের যাত্রী আগেই এসে গেছেন এবং সময় নষ্ট না করে বিছানা পেতে শুয়েও পড়েছেন। আমি সারাদিনের কাজের ধকলে যথেষ্ট ক্লান্ত। রাতের খাওয়া সেরে ট্রেনে উঠেছি। আর দেরি না করে আমার বার্থে বিছানা পেতে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

       আজ রাতে ঘুম হওয়াটা বিশেষ জরুরি। আগামী কাল কাজের আরও চাপ আছে। ন’টা নাগাদ ট্রেনছাড়ার সময় পর্যন্ত অন্য পাশের দুটো বার্থ খালি রইল। অর্থাৎ ওই দুটো বার্থে যাদের রিজার্ভেশন আছে সেই দুজন মাঝপথের কোনো স্টেশন থেকে উঠবে। তারা দুজন পরস্পরের পরিচিত হতে পারে, আবার তা নাও হতে পারে।

        এগারোটা নাগাদ ওরা দুজন ট্রেনে উঠল। একজন পুরুষ। অন্যটি মেয়ে। ওরা পরস্পরের পরিচিত, বরং বলা ভালো ওরা পরস্পরের বিশেষভাবে পরিচিত। ওদিকে আমার উপরের বার্থের সহযাত্রীটি ততক্ষণে ঘুমের সমুদ্রে একেবারে তলিয়ে গিয়ে প্রবল নাসিকার বিপুল গর্জনে তা ঘোষণা করছেন। সেই শব্দের দাপটে আমি ঘুমের ডোবায় এতক্ষণ ধরে বৃথাই ডোবার চেষ্টায় ঝাঁপ দিচ্ছিলাম।

নবাগতদের কথাবার্তার শব্দের ফলে এবার আমাকে পুরো ডাঙায় উঠে পড়তে হল। দুজনের কথাবার্তার খানিকটা কানে ঢুকতে বোঝা গেল ওরা একেবারে নবদম্পতি। নতুন বিয়ের পর দুটিতে এখন অষ্টমঙ্গলায় যাচ্ছে। অর্থাৎ এপর্যন্ত মাত্র ছয়টি নিশিযাপন সম্ভব হয়েছে।

        পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আজ রাতে আমার ঘুমের দফারফা। সারাদিনের কাজকর্মের ধকলও আমার চোখে ঘুম ঢালতে পারবে না। ওরা এবার কত বেশি রাত পর্যন্ত ফুসফুস, গুজগুজ, চাপা হাসাহাসি করবে তা আন্দাজ করতে পারা খুব শক্ত। আমি নিজেই তো সেসময়... ইয়ে, মানে আমরা তো সেসময় প্রায়ই শেষরাত বা ভোররাত বা একেবারে ভোর করে ফেলতাম কিনা! তবুও তো আমাদের কথার সমুদ্র ও পাহাড় কমছে বলে তখন মনে হত না। সুতরাং ওদের গুঞ্জনে কোনোভাবে কোনো বাধা দেওয়া চলবেই না। তাছাড়া আমার মতে সেই কাজটা একধরণের ক্রিমিনাল অফেন্সও বলে গণ্য করা যাবে।

ওরা বিছানা পেতে ফেলছে। এবার জোরালো আলোদুটো নিভিয়ে দিয়ে নাইটল্যাম্পটা জ্বালবে বা সেটাও নিভিয়েই রাখতে পারে। তার পর দুটিতে নীচের বার্থের বিছানায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি বসে গুনগুন করতে থাকবে। ঝাপসা আলোর বা অন্ধকারের আড়ালে বড়োসড়ো না হোক, অবধারিত ভাবে মাঝারি এবং ছোটো চুম্বন দেওয়া-নেওয়া চলতে থাকবেই।

প্রস্থিত সেসব অমৃতমদিরাচ্ছন্ন সময়ের গাঢ় সুখস্বপ্নিল স্মৃতির প্রতি একটি মধুর দীর্ঘনিশ্বাস উপহার নিবেদন করে বার্থের দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরলাম। গায়ের চাদরটা দিয়ে মাথা-কান পুরোপুরি মুড়ি দিয়ে ওদের যথাসম্ভব প্রশ্রয় দেবার চেষ্টা করলাম।

বিছানা পাতা হয়ে গেলেও ট্রেনের স্বাভাবিক নিয়মমতো ওরা কিন্তু জোরালো আলোদুটো নেভালো না। নীচুগলার বদলে জোরে জোরেই কথা চলতে লাগল। অবশ্য ওদের অবস্থায় থাকলে বেনিয়ম বা অস্বাভাবিক বলে কোনো কিছু হয় না। পুরুষটির গলা শোনা গেল। ওদের সেসব একেবারেই শুনতে না চাইলেও স্রেফ জেগে থাকার অপরাধে ওদের সব কথা ঠেলেঠুলে কানে ঢুকে পড়তে লাগল -

‘এখন শুয়ে পড়বে তো? তাহলে তোমার শোবার ব্যবস্থা করে দিই?’

‘নাঁ-আঁ-! আঁমি এখন শোবঁ না। আগে দুজনে এখানে বসে খানিকটা গল্প করি এসো না গো!’

‘ধোর্‌, গল্পফল্প করা আমার আসে না। এই এত রাতে তোমার সঙ্গে গল্প করার আছেই বা কী? তাছাড়া আমি এখন তাস খেলব।’

‘ওমা, সেকি কথা গো! এই এতরাতে তুমি এখন তাস খেলবে? আমরা রাতে শোব না?’

‘ধোর্‌, সবে তো বারোটা বাজে। হপ্তায় ছুটির দুদিন শনি-রবি রাতে তাস খেলি–  রাত ন’টা থেকে সকাল ছ’টা। এছাড়া হপ্তার বাকি পাঁচদিন অফিস যেতে হয় বলে এমনি খেলতে বসি, সেদিন একটু তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করতেই হয়। এই রাত দুটো-আড়াইটে বাজলে খেলা বন্ধ করতে হয়।’

‘ই-স-স্‌! অথচ রাতে আমার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তোমার কত না ঘুম পায়! -  কেন গো?’

‘ঘুম পেয়ে গেলে আমি কী করব?’

‘তাহলে অত রাত করে তাস খেলার সময় তোমার ঘুম পায় না কেন?’

‘তখন ঘুম না পেলে আমি কী করব? আমার তাসের প্যাকেট-দুটো তোমাকে রাখতে দিয়েছিলাম। সে দুটো কোথায় রেখেছ?’

‘ওই কালো ব্যাগটায় আছে। কিন্তু তুমি কি সত্যিই তাস খেলবে এখন?’

‘হ্যাঁ, সময়গুলো ফালতু ফালতু নষ্ট করে লাভ কী?’

‘তবে - তবে আমিও তোমার সঙ্গে তাস খেলব গো।’

‘অ্যাঁ! তুমি তাস খেলতে জানো নাকি? ইস্‌-স্! একথা আগে কেন বলোনি?’

‘আমার বাপের বাড়িতে দাদাদের মাঝেমধ্যে খেলতে দেখেছি। মোট বাহান্নখানা তাস, তারা আবার তেরোজন করে আলাদা আলাদা চারটে দলে থাকে, - স্পেড, হার্ট, ডায়মন্ড আর- কী যেন একটা- মনে পড়েছে - ক্লাব!’

‘বাঃ! ভেরি গুড। কিন্তু তাসগুলো চেন কি? মানে কোন তাসের কী নাম তা জানো?’

‘হ্যাঁ জানি। কালো ফুলটা হল ক্লাব। কালো পানটা স্পেড। লাল বরফিটাকে বলে ডায়মণ্ড। আর বোঁটা ছাড়া লাল পানটার নাম হার্ট।’

‘বেশ বেশ। তুমি তাস চেনো যখন, তাস খেলতেও যখন দেখেছ, তখন খেলতে পারবে। ব্রিজ খেলা হবে। দুটো হাত ডামি থাকবে।’

‘সে দুটো হাত কেন, চারটে হাত ডামি থাকলেও তোমার সঙ্গে খেলতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। তুমি আমি কিন্তু একদলে!’

‘ধোর্‌, সে হয় না।’

‘কেন? হয় না কেন গো? তুমি আমাকে তোমার দলে নেবে না! আমি তবে তোমার কাছে এতই খারাপ বউ!’

‘আরে বাপু, এখানে খারাপ ভালোর কথা হচ্ছেই না। চারজনে যখন তাস খেলা হয় তখন ইচ্ছামতো যে কোনো দুজন করে এক একটা দলে থাকা যায়। কিন্তু যখন শুধু দুজন তাস খেলে তখন দুজনে একদলে হয় না। তাহলে বিপক্ষ দল তৈরি হবে কী করে?

‘না হোকগে! আমার প্রাণ থাকতে আমি তোমার বিপক্ষে কিছুতেই যাব না!’

‘ও হো! একি সত্যি সত্যি পক্ষে বা বিপক্ষে নাকি? এতো শুধু খেলা হচ্ছে। তুমি এসব সিরিয়াস্‌লি নিচ্ছ কেন? যতক্ষণ খেলা ততক্ষণই দল। তারপর তুমি আমি যেমন আছি তেমন। আজেবাজে কথায় সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। নাও, তাসবাঁটা হয়ে গেছে। এবার নিজের তাস দেখে নিয়ে কল দাও।’

‘তুমি আগে কল দাও না গো। তারপর আমি দেব।’

‘আমার চারটে স্পেড।’

‘তবে আমারও চারটে স্পেড।’

‘সে কী! এরকম বললে খেলা হবে কীকরে? তোমার হাতে অন্য কিছু বড়ো তাস নেই?’

‘সে থাকুকগে। আমারও তোমার মতোই চারটে স্পেড।’

‘তাহলে আমার ফাইভ হার্টস্‌! তুমি কিন্তু আর ফাইভ হার্টস্‌ বলতে পারবে না। তোমাকে অন্য কিছু বলতে হবে।’

‘ঠিক আছে গো, আমি ফাইভ হার্টস বলব না। তাহলে – তাহলে, আমার ফোর হার্টস্‌।’

‘ধোর্‌! (তাস জোরে আছড়ে ফেলার শব্দ) তুমি তাস খেলার কিচ্ছু জানো না। এভাবে খেলা হয় না। তার চেয়ে এখন শুয়ে পড়।’

‘সেই বেশ ভালো হবে। দেখ না গো, ফার্স্ট ক্লাসের নীচের এই বার্থটা কত্তোখানি চওড়া। আমাদের দুজনের খুব ভালোভাবে শোবার জায়গা হয়ে যাবে। মালপত্র যা আছে সব উপরে তুলে দাও। আমরা দুজনে নীচেই শোব।’

একদম ঠিক কথা! এখন সেটাই সম্পূর্ণ উচিত কাজ হবে। আমি বউটিকে মনে মনে দু’শো ভাগ সমর্থন করলাম। ফার্স্ট ক্লাসের নীচের বার্থটা সত্যিই একটু বেশি চওড়া হয়। ওখানে দুটিতে মিলে শুয়ে তারপর একটা চাদর মুড়ি দিয়ে নিলেই একদম আলাদা একটা নিজস্ব ভুবন ওরা পেয়ে যাবে। সেই সঙ্গে ওই রকম মারাত্মক তাসুড়ে বরটাকে তার তাসের নেশা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বের করে অন্য জগতে আনা যাবে। কিন্তু প্রবাদবচন আছে - ‘বান্দা ভাবে এক ... খোদা করে আর এক’। পুরুষটির গলা শোনা গেল আবার -

‘না, মালপত্র কিছু উপরে কিছু নীচে যেখানে যেমন আছে তেমন থাক। তুমি রিল্যাক্স করে নীচেই শুয়ে পড়। আমি ওপরের বার্থে উঠে যাচ্ছি। ওখানে বসে আমি খানিকক্ষণ তাস খেলব।’

‘এ-মা! তুমি এখন ফের সেই তাস খেলবে! তাও একা একা ? একা একা আবার তাস খেলা যায় নাকি?’

‘যায়। তাস এক অদ্ভুত আশ্চর্য সুন্দর জিনিস। তাস একা খেলা যায়, আবার দুজন, তিনজন বা চারজনে মিলেও খেলা যায়! ... তাসের অপার গুণকীর্তন করতে গিয়ে পুরুষটির গলার স্বর এবার গভীর মুগ্ধতায় ভরে উঠতে থাকে... জানো তো, তাস নিয়ে তুমি একবার বসলে কোথা দিয়ে কীভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কেটে যাবে তুমি টেরও পাবে না! পৃথিবীতে আর এমন অপূর্ব কোনো খেলাই তুমি পাবে না যার সঙ্গে তাস খেলার তুলনা করা যেতে পারে। জানো তো এমন তাস খেলা আছে যে খেলায় শুধু তাস খেলে নবাব ফকির হতে পারে, আবার ফকির নবাব হয়ে যেতে পারে! সবাই জানে, সারা বিশ্বে তাসই হচ্ছে একনম্বর খেলা, সবার সেরা খেলা! আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে নিশ্চয়ই এব্যাপারে তোমার উন্নতি হবে। আস্তে আস্তে হলেও তুমিও একসময় শিখে যাবে এই তাসের মধ্যে কতই না মজার ব্যাপার আছে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাই হবে গো। কিন্তু এখন যে আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। আলো জ্বালা থাকলে যে আমি একদম ঘুমাতে পারি না। তুমি তো উপরে গিয়ে আলো জ্বালিয়েই তাস খেলবে মনে হয়।’

‘ঠিক আছে। আমি নাহয় সব আলো নিভিয়ে দিচ্ছি, তুমি ঘুমোনোর চেষ্টা কর।’

‘কিন্তু সব আলো নেভালে তুমি তাস খেলবে কীকরে?’

‘সে নিয়ে ভেব না। আমি টর্চ জ্বালিয়ে নিয়ে তাস খেলব।’

‘শোনো না। তোমার তাস খেলা হয়ে গেলে তুমি নীচে এসে এখানে শোবে তো?’

‘সে এখন বলতে পারছি না। আমি সারা রাতও খেলতে পারি। এখন তোমাকে একটা খুব জরুরি কথা বলে রাখি শোনো, এবার তোমার বাপের বাড়ি যাবার পর ফেরার সময়ে আমার সঙ্গে তোমার ফিরে আসার দরকার নেই। তাস যখন তুমি ভালোভাবে চেন, তখন বাপের বাড়িতে থেকে গিয়ে তাসখেলাটা, বিশেষ করে ব্রিজ খেলাটা ভালো করে শিখে নিয়ে তবেই তুমি আমাকে খবর পাঠাবে। আমি তখন গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব। তখন বাড়িতে রোজ রাতে দুজনে মজা করে শুধুই তাস খেলব। তাস খেলা শিখতে তোমার একমাস, বা দুমাস বা আরও বেশি সময় যদি লেগে যায় তো লাগুক, তাতে কোনো অসুবিধে নেই। তুমি তাসখেলাটা ঠিকমতো শিখে নিয়ে তবেই কিন্তু ...’

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন