ইংলিশ চ্যানেলজয়ী প্রথম এশীয় মহিলা সাঁতারু আরতি সাহা - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী



আরতি সাহা 

১৯৫৯ সালের ২৭শে অগাস্ট। ফ্রান্সের দিক থেকে সমুদ্রে নামলো এক বাঙালি তরুণী। বয়স মাত্র উনিশ। লক্ষ্য চ্যানেল পার করা। এদিকে এমনই অদৃষ্ট, প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরিতে এলো পথপ্রদর্শক বোটটি। তাতে কিন্তু মেয়েটি একটুও ঘাবড়ে যায়নি। দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতার কাটার পরে গন্তব্যে পৌঁছতে তখন বাকি আর মাত্র ৩ মাইল। বোটম্যান ঘুরপথে নিয়ে গেলে তরুণী পড়ে যায় স্রোতের বিপরীতে। তার পাশে তখন সাঁতার কাটছেন ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সোনাজয়ী সাঁতারু গ্রেটা অ্যান্ডারসন। স্রোতের মুখে আর এগোতে পারছে না দেখে বোটম্যান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়েটির প্রতি, ছোঁয়া লেগে যায় তার। তৎক্ষণাৎ ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় স্বপ্নের। নিয়মানুযায়ী কেউ সাঁতারুকে স্পর্শ করলে তাকে বাতিল হিসাবে গণ্য করা হয়। নৌকায় উঠে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে তরুণী। এতো পরিশ্রমের পর যে আক্ষরিক অর্থেই তীরে এসে তরী ডুবলো!

 

সাঁতাররতা আরতি সাহা 

 কিন্তু এই মেয়ে হেরে যাওয়ার নয়। প্রথমবারের প্রচেষ্টায় হয়নি তো কী হয়েছে! এতদিনের এতো সাধনা, পরিশ্রম, স্বপ্ন সব কি মিথ্যে হয়ে যাবে! মোটেও না। পুনরায় কোমর বেঁধে লেগে পড়ে সে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না। ওই বছরেরই ২৯শে সেপ্টেম্বর ইংলিশ চ্যানেল পার করে ফেলে সেই তরুণী। ফ্রান্সের কেপ গ্রিস নে থেকে ইংল্যান্ডের স্যান্ডগেট পর্যন্ত যেতে তার ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় লেগেছিল। আর তখনই ইংলিশ চ্যানেলজয়ী প্রথম এশীয় মহিলা সাঁতারু খেতাবে সে ভূষিতা হয়। নাম আরতি সাহা। এশীয় মহিলা তো অবশ্যই। অন্যতম গর্বের বিষয়, বাঙালিও বটে!

চ্যানেল জয় করা সব সাঁতারুর কাছেই স্বপ্ন।কিন্তু এ তো আর ছেলেখেলার বিষয় নয়! এর একাধিক ধাপ রয়েছে যার প্রথম ধাপ হলো অসীম পরিশ্রম। জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলিতে সফল হওয়া যেমন একদিনের শ্রমে হয় না, এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। সাঁতার নিয়ে আরতির সাধনা শুরু হয়েছিল ছোট্টবেলা থেকে। অবশ্য তখন চ্যানেল জয় করা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার মতো বয়স তার ছিল না। ছিল সে মাতৃহারা। মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিল অবোধ শিশুটি। বাবা পাঁচুগোপাল সাহা চাকরি করতেন সেনা বিভাগে। মায়ের মৃত্যুর পর বোন ও দাদা মামারবাড়িতে চলে গেলেও ছোট্ট আরতি থেকে যায় ঠাকুমার কাছে, উত্তর কলকাতার সাহাবাড়িতে। তারপরেই শুরু হয় অনুশীলন, তবে তা নেহাতই সাঁতারকে ভালোবেসে। চার বছর বয়স থেকে কাকা বিশ্বনাথের সঙ্গে প্রতিদিন চাঁপাতলার ঘাটে স্নান করতে যেত সে। সাঁতারের প্রতি আগ্রহ তখন থেকেই

মেয়ের উৎসাহ দেখে বাবা তাকে হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে ভর্তি করে দিলেন। ঠিক এক বছর পর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১১০ গজ ফ্রিস্টাইল বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে সোনা জিতেছিল সেই পুঁচকে মেয়ে। জিতবে নাই বা কেন! ছোট্ট মেয়েটির অসাধারণ প্রতিভা, সঙ্গে ভারতের অন্যতম সেরা সাঁতারু শচীন নাগের প্রশিক্ষণ – এই সমন্বয় যে অপ্রতিরোধ্য! কোচ শচীন নাগের কোলে চেপেই পুরস্কার আনতে গিয়েছিল এই একরত্তি। দ্রুত ছোট্ট আরতির প্রতিভার খবর দেশের ক্রীড়মহলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শুরু হয় প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারের

এরপর ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত নানা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে  বিদেশের মাটিতেও আরতির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১০০ মি ফ্রিস্টাইল, ১০০ এবং ২০০ ব্রেস্ট  স্ট্রোকের মতো সাঁতারের ইভেন্টে ২২টি রাষ্ট্রস্তরের প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল এবং ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে তিনি একটি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। ১৯৫১ সালে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে সর্বভারতীয় রেকর্ড তৈরি করেন। একই বছর, ১০০ মি ফ্রিস্টাইল, ২০০ মি ফ্রিস্টাইল এবং ১০০ মি ব্যাক স্ট্রোকে নতুন রাজ্যস্তরের রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। সাঁতারু ডলি নাজিরের সঙ্গে ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধিও ছিলেন আরতি সাহা

না, পরিশ্রমের কোনো খামতি ছিল না। প্রতিভাও ছিল চোখে পড়ার মতো। আর ঠিক তখনই আসে ইংলিশ চ্যানেল জয়ের স্বপ্ন দেখার দ্বিতীয় ধাপ – টাকা, অনেক অনেক টাকা। সাঁতার কেটে ততদিনে বেশ নামডাক হলেও অতখানি অর্থসঞ্চয় আরতি তখনও করে উঠতে পারেননি। সাউথ ইস্টার্ন রেলে চাকরির সুবাদে তখন মাইনে পেতেন মাত্র ১৪৪ টাকা। দৈনন্দিন জীবনের খরচ সামলে সেই টাকা থেকে জমিয়ে কি আর চ্যানেল জয়ের স্বপ্ন দেখা যায়! এমন সময় অল ইন্ডিয়া স্পোর্টস কাউন্সিলারের সদস্য পঙ্কজ গুপ্ত তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য পাঠালেন। চ্যানেল পার হওয়ার কথা শুনে তিনি বলেছিলেন, “ইংলিশ চ্যানেল চোখে দেখেছ যে পার হবে বলছ?” পরে অবশ্য আরতির মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “সকালে টাকা পৌঁছে যাবে। হাসিমুখে ফিরতে পারবে তো মা?” 

তারপরেই আসে সেই দিন। ১৯৫৯ সালের ২৭শে অগাস্ট। ইংলিশ চ্যানেল জয় করার স্বপ্ন। ঘুমিয়ে নয়, একটার পর একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে এই স্বপ্ন দেখেছিলেন আরতি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রথমবারের প্রচেষ্টায় অসফল হন তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন এগিয়ে আসেন জওহরলাল নেহরু, মিহির সেন, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অতুল্য ঘোষ, সমাজসেবী শম্ভুনাথ মুখোপাধ্যায়, চিকিৎসক অরুণ গুপ্ত প্রমুখরা। তাঁদের ঐকান্তিক উৎসাহে একমাস কঠোর অনুশীলনের পর পুনরায় সেই ফ্রান্সের উপকূলে চ্যানেল জয়ের চ্যালেঞ্জ

২৯শে সেপ্টেম্বরের ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে আরতি জলে নামলেন কেপ গ্রিস নে থেকে। ৪২ মাইল পথ সাঁতরে অতিক্রম করে উঠতে হবে ইংল্যান্ডের ফকস্টোনে। এবারে তাঁর গাইড ছিলেন ক্যাপ্টেন হার্টিনসন। বিগত বিশ বছরে এই প্রথম তিনি কোন মহিলাকে পথ দেখাচ্ছিলেন। ফকস্টোন থেকে ৫ মাইল দূরে স্যান্ডগেটে বোট থেমে গেলেও নিয়মানুযায়ী আরও ১০ গজ যেতে হয় প্রতিযোগীদের। অবশেষে ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিটে চ্যানেল পেরিয়ে প্রথম এশীয় মহিলা হিসাবে রেকর্ড করলন কলকাতার বছর উনিশের আরতি সাহা

ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে আরতি সাহা 

জ্ঞানীগুণীদের মান রেখেছিলেন তিনি। ইংলিশ চ্যানেল জয়ের পর প্রথম শুভেচ্ছা আসে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের কাছ থেকে। চ্যানেল জয় করার পরেই চিকিৎসক অরুণ গুপ্তের সঙ্গে প্রথমে রেজিস্ট্রি ও পরে সামাজিক বিবাহ হয় আরতির। এই বিবাহের মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু  আরতিকে স্বামীসহ দিল্লির তিনমূর্তি ভবনে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান

 

আরতি সাহার সম্মানে ডাক টিকিট 

ক্রীড়া ইতিহাসে আরতি সাহার অবদান ও কাজ মনে রাখার মতো। ১৯৬০ সালে প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিতা হয়েছিলেন। তবে খুব বেশিদিন তিনি আমাদের মধ্যে থাকতে পারেননি। জন্ডিস ও এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে উনিশ দিন কলকাতার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ২৩শে অগাস্ট মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে অমৃতলোকে যাত্রা করেন। আরতি সাহাই ক্রীড়াজগতের প্রথম মহিলা যাঁর স্মরণে ১৯৯৯ সালে ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়।

 


শুধু তাই নয়, তাঁর ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে ডুডলের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানায় গুগল। সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল আমাদের তরফ থেকেও

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন