কয়েকদিন আগেই নেট মাধ্যমে বিপুল
বিতর্কের সূত্রপাত করেন মডেল পুনম পান্ডে।
আমরা সকলেই কম বেশি জানি যে এই বিতর্কের নেপথ্যে ছিল তাঁর ভাইরাল হওয়া একটি পোস্ট,
যেখানে উল্লেখ করা হয় যে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর অকাল মৃত্যু
ঘটেছে। যদিও পরবর্তী কালে, স্বয়ং পুনম পান্ডে অন্য একটি পোস্টে দাবী করেন যে তাঁর
মৃত্যুর খবর একদমই সঠিক নয় এবং তিনিই ইচ্ছাকৃত ভাবে সারভাইক্যাল ক্যান্সারের প্রতি
সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এইরকম এক “ডেথ স্টান্ট” ঘটিয়েছেন। এর পরবর্তীতে পুনম পান্ডেকে নিয়ে ঠিক কতটা সমালোচনা
বা রাজনীতি হয়েছে, অথবা সমাজ মাধ্যমে
তাঁর এরকম পোস্ট করা কতটা সমীচীন হয়েছে, তা একেবারেই আজ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু
নয়। বরং এই ভাইরাল হওয়া পোস্টের পিছনে চাপা পরে যাওয়া
আসল ভাইরাসটি আজ আমাদের গল্পের নায়ক, অথবা বলা ভালো খলনায়ক।
সংখ্যাতত্ত্বঃ
পরিসংখ্যান বলছে, সমস্ত উলেখযোগ্য ক্যান্সারগুলোর মধ্যে সারভাইক্যাল ক্যান্সারের স্থান বিশ্বে পঞ্চম এবং বিশ্বব্যাপী মহিলাদের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ক্যান্সার। এমন কী, উন্নয়নশীল দেশে জরায়ুর এই মারণ রোগ ক্যান্সার-আক্রান্ত মৃত্যু তালিকার একদম শীর্ষে অবস্থান করছে। ভারতবর্ষের নিরিখে বিচার করলে এই অবস্থাটা তো আরও ভয়াবহ। প্রতিবছর প্রায় ১,৩২,০০০ মহিলা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তার মধ্যে ৭৪,০০০ জন মহিলার মৃত্যু ঘটছে যা বিশ্বব্যাপী সার্ভিকাল ক্যান্সারের মৃত্যুর প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
প্রিভেনশন ইস বেটার দ্যান কিওরঃ
প্রায় ৭০% সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারের অন্যতম কারণ এইচপিভি ভাইরাস বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ। এই ভাইরাসের কোন সেরোটাইপটি দ্বারা কোনো মহিলা আক্রান্ত হয়েছেন তার ওপর নির্ভর করে সার্ভিক্সের এই ক্যান্সারের গতিপ্রকৃতি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, এইচপিভি সেরোটাইপ ৬ এবং ১১, ৯০% ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের বিনাইন সক্রমণের কারণ, অর্থাৎ এই সেরোটাইপ দুটি এই ভাইরাসের নন-অংকোজেনিক টাইপ। আবার, ৫০-৬০% সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী এইচপিভি-সেরোটাইপ ১৬ এবং ১০-১২% ক্ষেত্রে এইচপিভি-সেরোটাইপ ১৮। তবে, এইচপিভি ভাইরাস সংক্রমণ সারভাইক্যাল ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হলেও, এ কথা অনস্বীকার্য যে শুধু এই ভাইরাস সংক্রমণই এই রোগের জন্য যথেষ্ট নয়। গর্ভ-নিরোধক ওষুধের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার, একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ, তামাক সেবন, দুর্বল অনাক্রম্যতা, নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি এবং খাদ্য, এছাড়াও কিছু অন্যান্য ভাইরাসের সংক্রমণ এই ক্যান্সারের গুরুত্বপূর্ণ কো-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।
যেহেতু, এইচপিভি ভাইরাস এক
ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে যৌন কার্যকলাপের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়, তাই এই
ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার এক এবং একমাত্র উপায় হলো যৌনতা থেকে বিরত থাকা এবং
সঙ্গীর সাথে পারস্পরিক একগামীতা। এছাড়া, এমন কোনো প্রামাণ্য গবেষণা লব্ধ ফলাফল
নেই, যা থেকে খুব নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, কন্ডোম বা অন্যান্য গর্ভ নিরোধক পদ্ধতি
ব্যবহার করে এই ভাইরাস সঞ্চারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে। আবার বহুক্ষেত্রে
সারভাইক্যাল ক্যান্সার প্রাথমিক ভাবে উপসর্গবিহীন হয়ে থাকে। প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট
এই ক্যান্সার নির্ধারণের প্রধান উপায় যা উন্নত দেশগুলিতে পর্যায়ক্রমিক ভাবে
স্ক্রিনিং করা হয়। সেখানেও আমাদের দেশে অবস্থাটা তথৈবচঃ। জনবিস্ফোরণই হোক, বা
সচেতনতা অথবা পরিকাঠামোগত অভাবই হোক, প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের মাধ্যমে এই ক্যান্সার
স্ক্রিনিং-এর চিএটা ভারতবর্ষে যথেষ্ট অসন্তোষজনক। ঠিক এইরকম একটি পরিস্থিতিতে
সম্প্রতি আবিষ্কৃত হওয়া ভ্যাকসিন সমগ্র বিশ্বের জন্য, বিশেষত ভারতবর্ষের মতো
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের এক বিরাট আশীর্বাদ।
এইচপিভি ভ্যাকসিন জেনিটাল ওয়ার্টস এবং বেশিরভাগ সারভাইক্যাল ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে। ভ্যাজাইনা, ভালভা, পেনিস অথবা শিশ্ন এবং পায়ুপ্রনালীর ক্যান্সার থেকেও রক্ষা করতে একইরকম ভাবে সক্ষম এই ভ্যাকসিন। এমনকী, মুখ, গলা এবং ঘাড়ের কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্য ।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে অনুমোদিত হওয়া এই ভ্যাকসিনটি গার্ডাসিল -৯ (Gardasil 9) নামে পরিচিত।
দ্য সেন্টার ফর ডিসিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এর পরামর্শ অনুযায়ী, ১১ থেকে ১২ বছর
বয়স এই ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার জন্য আদর্শ বয়স। কোনো ব্যক্তি যৌন ভাবে সক্রিয়
হত্যার আগেই এই ভ্যাকসিন নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে, এইচপিভি ভাইরাসে ইতিমধ্যেই আক্রান্ত কোনো
ব্যক্তি এই ভ্যাকসিন নিলে তা কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে বিদ্যমান সারভাইক্যাল
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে না। এই ভ্যাকসিনের মূল লক্ষ্যই হলো নতুন করে যাতে
এইচপিভি ভাইরাস দেহে প্রবেশ করে বংশ বিস্তার না করতে পারে। ১৫ বছরের কম বয়সী
ব্যক্তিদের বছরে ২ বার, অর্থাৎ ৬ মাস ব্যবধানে এই ভ্যাকসিনের ২টি ডোজ দেওয়া হয়।
এফডিএর অনুমোদন অনুযায়ী ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই টিকা নেওয়া যেতে পারে। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত
প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষের ওপর পরীক্ষা এবং
পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রাপ্ত ফলাফলের নিরিখে, এই ভ্যাক্সিনকে যথেষ্ট নিরাপদ বলে
অনুমোদন করা হয়েছে। অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতোই খুব স্বল্প কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
ছাড়া অন্য গুরুতর জীবন নাশক কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি।
মুদ্রার অপর পিঠঃ
বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা আছে। বিশেষত, এইচপিভি ভ্যাকসিন গর্ভাবস্থায় দেওয়া হয় না। এছাড়াও এই ভ্যাকসিন নেওয়া একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয় যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রথম এইচপিভি শট নেওয়ার পরে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হয়, বা যদি একজন ব্যক্তির গুরুতর, প্রাণনাশক অ্যালার্জি থাকে। এছাড়া নিদারুন অসুস্থ বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও এই টিকা নেওয়ার আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা উচিত।
এই ভ্যাকসিন সারভাইক্যাল
ক্যান্সার প্রতিহত করার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একথা যেমন ঠিক, তেমনই এ কথাও মনে
রাখতে হবে যে HPV ভ্যাকসিনের সমস্ত প্রস্তাবিত শট নেওয়ার পরেও মহিলাদের সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারের নির্ধারণের
জন্য স্ক্রীন করানো অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। কারণ এই ভ্যাকসিন সব ধরনের সার্ভিকাল
ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে না।
সচেতনতাই শেষ কথাঃ
সবশেষে একটাই কথা বলার যে এই ভ্যাকসিন কিন্তু কোনোভাবেই প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষাকে প্রতিস্থাপন করে না। ২১ বছর বয়স থেকে শুরু হওয়া নিয়মিত প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষার মাধ্যমে সার্ভিকাল ক্যান্সারের জন্য স্ক্রীনিং বর্তমানে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার একটি অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিত। যৌনতার পরে রক্তক্ষরণ, পিরিয়ডের মধ্যে বা মেনোপজের পরে যোনিপথে রক্তপাত; পেলভিক ব্যথা; বা সঙ্গমের সময় ব্যথা, এমন কিছু উপসর্গের সম্মুখীন হলে, এই ভ্যাকসিন দেওয়া থাকুক বা না থাকুক অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আর তা হলেই, অদূর ভবিষ্যতে পুনম পান্ডের ভাইরাল পোস্টের থেকে এই ভ্যাকসিনের দ্বারা অনেক বেশি মানুষ প্রভাবিত হবে বলে আশা করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ
1.
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/
2.
https://www.cdc.gov
3.
https://www.mayoclinic.org/
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন