কাল-নিধন - তুষার সরদার



সরকারী অফিসের উচ্চপদস্থ চেয়ারে বসা-অবস্থা থেকে তুলে দাঁড়-করিয়ে-দেওয়া কটাক্ষপাতে, গ্লাস-উপচানো জলের পিপাসা পাইয়ে দেবার দেহভঙ্গি নিয়ে সে বিপজ্জনক পদবিক্ষেপে এগিয়ে আসত বিহানের দিকে। কাছে এসে সে অপরূপ তরঙ্গে থমকে দাঁড়াত। চোখ, মুখ, গলা, দেহ সব কিছুর সাহায্যে অনিবার গলায় বলত -

‘আজ, দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোকাল -’

         জোরে একটা ধড়াস শব্দ হয়। শব্দটা শুধু বিহান একাই শুনতে পায়। কারণ শব্দটা হয় তার বুকের গভীরে কোথাও। তারপর সেই ধড়াস শব্দটার শতশত প্রতিধ্বনি রক্তের ছোটোবড়ো স্রোতের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে যেতে থাকে বিহানের শরীরের সবকটি কোণায় - আনাচে কানাচে। সে শুধু উচ্চারণ করে -

‘আচ্ছা। কোন বগি?’

‘পাঁচের শেষে - ছয়ের প্রথমে।’

        কথা শেষ করে সুষীম ছন্দে হেঁটে সে ঘর থেকে ছন্দা চলে যায়। অফিসের হলঘরে তার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। ছন্দা একজন সাধারণ করণিক। কিন্তু নারী-পুরুষের আকর্ষণ কবেই বা এইসব অসম পদাধিকার বা অন্যসব বাহ্যিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে? বিশেষত যে আকর্ষণ তখনও পর্যন্ত আদৌ জৈবিক হবার পথে এগোয়নি।


 ছন্দার কাছেই ক্রমশ বিহান শুনেছে ছন্দার চেনাজানা সমবয়সি মেয়েদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে, এমনকী তাদের কারো কারো বাচ্ছা-কাচ্চা হয়ে নার্সারিতে ভর্তিও হয়েছে। ছন্দার বিয়ের বেশ কিছু সম্বন্ধ আনাআনি চললেও এখনও পর্যন্ত তার কোনোটাই স্থির হয়নি। তাই বিয়েটা ঠিকমতো হয়ে ওঠেনি। অথচ সে একজন সুশিক্ষিতা সরকারী কর্মচারী। তবে ছন্দা কি তেমন জোরালো সুন্দরী নয়?

নারীর সৌন্দর্যের যথার্থ সংজ্ঞা কী?  সেটা কি শুধু নারীর দেহেই থাকে? নাকি মনেই থাকে? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বিহান। তবে ছন্দার আঁখিপাত, অধরোষ্ঠ, কণ্ঠস্বর, হাসির শব্দ, আর বিশেষ করে ছন্দার কবিতাপ্রিয়তা বড়ো টানে বিহানকে। ছন্দার সাধারণ রূপ তারই দু’একটি গুণের স্পর্শে বিহানের কাছে মধুর হয়ে উঠত।

খুব ধীরে গড়ে ওঠা তাদের দুজনের এই সম্পর্কের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে এইভাবে বলা যায় যে, ছন্দা বিহানের সঙ্গে এপর্যন্ত মধ্যমপ্রকার একান্ত সময় কাটিয়ে আসছে। তারা দুজনেই জানে কিছু পারিপার্শ্বিক কারণে তাদের বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।

তবুও ছন্দার সঙ্গে ওইরকম ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানোর ডাকে অবধারিত সাড়া দিতে বিহানের পাপবোধ হয় না। কেন হয় না কে জানে? ছন্দা সব বারে নিজেই তাকে ডাকে, তাহলে তার কি পাপবোধ হয়? পাপ ব্যাপারটা আসলে কীভাবে নির্ধারিত হয়? পাপের যথাযথ কোনো সংজ্ঞা থাকলে সেটা ঠিক কীরকম? তাহলে পুণ্যের সংজ্ঞাও কি এই একইরকম সন্দেহাকীর্ণ?


দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোক্যাল। পাঁচনম্বর বগির একেবারে পিছনের দিকের সারির জানালার ধারের সিটে ছন্দা বসেছে। পাশে খুব ঘেঁষে বিহান। একটু কম ঘেঁষে বসলেই সে বিহানকে বলে - ‘ওভাবে সাতমাইল দূরে বসে আছ কেন? আমি তোমার কাছে অস্পৃশ্য নাকি?’

এইভাবে বসে ওরা একে অন্যের দেহের উষ্ণতা দিতে নিতে শেওড়াফুলি স্টেশন পর্যন্ত যাবে। তারপর এই ট্রেনেই আবার একইভাবে দুজনে অফিসে ঢোকার জন্য হাওড়ায় ফিরে আসবে। এই গায়ে-গায়ে পাশাপাশি ট্রেনের সিটে বসে যাওয়া-আসাটাই হচ্ছে ওদের সেই ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানো।

            শেওড়াফুলি লোক্যালটার সঙ্গে যাওয়া-আসার পথে খোলা জানালা দিয়ে ওরা আধুত চৈত্রের উন্মন বাতাস ডেকে এনে গায়ে মাখে। লাল অথবা কমলা আগুন লাগা কৃষ্ণচূড়া দু’জোড়া চোখ দিয়ে আলিঙ্গনে ছুঁয়ে দেখে। পীতভূষণ রাধাচূড়ার অপরূপ রূপ দেখে ওরা একসঙ্গে বিমোহনে ডুব দেয়।

বিহানের গায়ে খুব গাঢ় হয়ে বসে থাকা ছন্দার শরীরের সুনিবিড় নারীগন্ধে বিভোর বিহানের উতল বুকে কত না কলরব জাগে। ছন্দা হয়তো সেসব শুনতেই পায় না। সেসময়ে ছন্দার নিজের ভিতরে কিছু কি হয়? কী হয়?

ছন্দা কমলালেবু খেতে খুব ভালোবাসে। চৈত্রের কমলালেবু ছোটো হয়। টকও হতে পারে। শেওড়াফুলি লোক্যালে কমলালেবুওলা উঠলে ছন্দা তাকে কলরব করে ডাকবেই। কীভাবে জানে না বিহান, কমলালেবুর ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে ঠিক মিষ্টি লেবুগুলোই ছন্দা বেছে নেয়। আর কিছুতেই কোনোদিন বিহানকে সে লেবুর দাম দিতে দেয় না। সব বারেই বলে -

‘আমি তোমাকে খাওয়াব।’

      কমলালেবুর কোয়াগুলো ছাড়িয়ে আঁশগুলো সযত্নে ফেলে দিয়ে একট্রেন লোকের জোড়া জোড়া চোখের মধ্যে সে নিজের হাতে বিহানের মুখে তুলে দিয়ে সত্যিই খাওয়ায় - নিজেও খায়।


ছন্দার বুক দেখতে বড়ো সুন্দর। বিহানের অসহায় চোখ সেদিকে তাকিয়ে ফেলে। সেসময় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছন্দা কিভাবে যেন সেটা ঠিক বুঝতে পারে। তখন ওর দিকে থাকা বিহানের হাতটা ছন্দা তার শাড়ির আঁচলের আড়াল করে টেনে নিয়ে ওর গাবলুগুবলু নরম বুকের নীচের দিকটাতে ছোঁয়ায়, ছুঁইয়ে ধরেই থাকে।


বিহানের নিতান্ত বোকাটে অপদার্থ হাত সেসময় উপযুক্ত গন্তব্যে গিয়ে ঘুরে দেখার জন্য বাসনাচঞ্চল হয়ে ওঠার বদলে প্রায় অবশ আর সমর্পিত হয়ে পড়ে। তখনও ছন্দাকে শারীরিকভাবে পাবার কোনোরকম ইচ্ছা বিহানকে দখল করে বসেনি। কারণ তখনও ঠিকমতো সে বুঝে উঠতে পারেনি ছন্দার বুক ভালোবাসার সুরভিতে পূর্ণ, নাকি শুধুই মাংসের গন্ধে ক্লিন্ন?

       

    শুধুমাত্র দুপুরের শেওড়াফুলি লোকালটাই ছিল তাদের নিভৃত কূজনের জায়গা। সিনেমা হলের আবছা আঁধারে, পার্কের একান্ত নিভৃতিতে ছন্দাকে সঙ্গিনী করার ইচ্ছা বিহানকে কখনও হাতছানি জানায়নি। ছন্দাও সেসব প্রস্তাব কখনও দেয়নি। শেওড়াফুলি লোক্যাল ছাড়া তারা দুজনে একদিন ছন্দার দৈনিক যাওয়া-আসার পথে মালিয়া নামের এক অনাদৃত স্টেশনে নেমে একটা গাছের তলায় তারা বেশ কিছুক্ষণ পাশপাশি বসেছিল।


            যাত্রীবিরল সেই স্টেশনের একদিকে একটা বড়ো গাছের তলায় বসে তারা সেদিন দীর্ঘক্ষণ অনেক কথা বলেছিল। সেসব কথার মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। সেসব কথা বলে যাওয়ার মধ্যে কোনো পরিকল্পনা ছিল না, ছিল না কোনো রকম পারম্পর্য। অদরকারী কত কথা বলে যাওয়া সেসময় হয়ে ওঠে ভীষণ দরকারী, অন্তত বিহানের কাছে।


        সেদিন অবশ্য বিহানের কাছে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। মাঝখানে সামান্য ফাঁক রেখে তারা দুজন মুখোমুখি বসেছিল। কথাবার্তার মাঝখানে গাছের উপর থেকে একটা কাঠপিঁপড়ে হঠাৎ খসে পড়ল ছন্দার ডানদিকের বুকে, শাড়ির উপরে। মাঝামাঝি পড়েই সেটা ছন্দার বুকের চড়াই বেয়ে গলার দিকে উঠে যেতে লাগল।


বিহান দারুণ খারাপভাবে জানে কাঠপিঁপড়ের কামড় খুবই যন্ত্রণাদায়ক। সঙ্গে সঙ্গে বিহান ছন্দার ডানবুকের চড়াই ব্যস্তভাবে ছুঁয়ে পিঁপড়েটাকে ধরে ফেলল। তারপর সাবধানে তুলে নিয়ে ফেলে দিল ... পিঁপড়ের বদলে বিহানের আঙুলরা শাড়ির উপর দিয়ে আলতো কামড় দিয়ে ফেলল ছন্দার ডানবুকে।


বিহান হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে তার ডানবুক থেকে ওভাবে কী ধরে নিয়ে ফেলে দিল সে ব্যাপারে একেবারেই কোনো কৌতূহল প্রকাশ না করে বিহানের দিকে তাকিয়ে অন্য সে একরকম করে হাসল ছন্দা... মুখে বলল -

‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ!’


কিছুদিন পর সেইরকম এক দুপুরে শেওড়াফুলি লোকালে তাদের একান্ত যাওয়া-আসার পথে ভিড়ের নির্জনতার মাঝে ছন্দা বরাবরের মতো খুব নীচু গলায় কথা বলতে বলতে কোনোরকম ভূমিকা না করে হঠাৎই বলল –

‘শোনো না গো, তোমাকে একটা দরকারী কথা বলি। তোমার সঙ্গ পাবার পর থেকে আমার মধ্যে বিয়ে করার চাহিদা আর নেই। কিন্তু মায়ের চাপে পড়ে একটা স্রেফ লোক-দেখানো বিয়ে করতে হচ্ছে আমাকে। তুমি তো জানোই, মা ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই। শুধু মায়ের কথার জন্য, মায়ের শান্তির জন্যই এই বিয়েটা আমাকে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। আমার এই ফালতু বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তুমি কিন্তু একদম মনখারাপ করবেই না। করবে না তো? আমাকে কথা দাও!’

       তখন বাতাসে শীতের প্রথম পরশ লেগেছে। ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে হালকা শীতের নরম পালক তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছন্দার বিয়ে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় ব্যাপার ছিল। সেটা যে একসময়ে নিশচয়ই হবে তা বিহান জানত। সেজন্য বিহানের তেমন মনখারাপের কোনো কথা ওঠেই না। তাছাড়া ছন্দা অবিবাহিতা থাকুক এমনটা বিহান কখনও চায়নি। শান্ত গলায় সে বলে -

‘তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে এটা আগে আমাকে তুমি বলেছিলে।’

‘বলেছিলাম বুঝি? তা হতে পারে। আমার সবই তো বলি তোমাকে। তা সে হোক গে –’ কথা অসমাপ্ত রেখে গায়ের হালকা চাদরটা টেনেটুনে নিজেকে আরো ভালো করে ঢাকলো ছন্দা। তারপর তার দিকে থাকা বিহানের হাতটা চাদরের নীচে টেনে নিয়ে তার দুই ঘন বুকের গায়ে ঘন করে চেপে ধরে রেখে গাঢ় গলায় বলল -

‘তুমিই আমার নারীজীবনে প্রথম পুরুষ। প্রথম তোমাকেই আমি মনের দরজা খুলে ভিতরে ডেকেছি। মন্ত্রপড়ে বিয়ে না হলেও তুমিই কিন্তু আমার আসল বর! এই যে পাত্র, সে থাকে সেই জলপাইগুড়িতে। সেখানেই তার চাকরি। বিয়ের পরেই আবার সেখানেই সে ফিরে যাবে। কিন্তু আমি যাব না। আমার চাকরি তো এখানে। আমার মাও এখানেই থাকবে। তাই বিয়ের পরও আমি মায়ের কাছেই থাকব। এইরকম কথাবার্তা আগেভাগেই পাত্রপক্ষের সঙ্গে বলেকয়ে তবেই বিয়েটা সেট্‌ল করা হয়েছে। বিয়ের পর আমি কিন্তু তোমার সঙ্গেই - মানে - আমার আসল বরের সঙ্গেই হানিমুনে যাব। হানিমুনে আমরা কিন্তু পুরীতে যাব না। ওখানে বড্ড বেশি রকমের বিশ্রী ভিড়। আমরা যাব - গোপালপুর-অন-সী! সেখানে গিয়ে নির্জন সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে আমার যা কিছু আছে তার সবটাই একেবারে উপুড় করে তোমাকে দিয়ে আমি নিঃস্ব হব। তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে গোপালপুর? আমায় কথা দাও - তুমি ঠিক যাবে!’ 

      

   ছন্দার বক্তব্যের শেষের দিকটার আকস্মিকতায়, ওজনে, অভিনবত্বে বিহান ঘাবড়ে গিয়ে এই বিষয়ে যথোচিত কিছুই বলে উঠতে পারল না। কিন্তু জবাব তো একটা দিতে হয়। একটু চুপ থাকার পর ছন্দার একেবারে শেষ কথাটুকুর জবাবে বিহান আস্তে বলল -

‘আমার মনে হয় এ ব্যাপারে এখন কিছু আলোচনা না করাই ভালো। তুমি যদি একান্তই তাই চাও, সেটা নাহয় পরে একসময় ভেবেটেবে দেখা যাবে। কিন্তু তোমার বিয়ের দিনটা কোন তারিখে ঠিক হয়েছে?’

‘ধুর্‌! তার এখনও বেশ দেরি আছে। কেন বলো তো?  - বিহানের হাতটা আরও জোরে নিজের বুকে ঠেসে ধরে ছন্দা ছদ্ম রাগত হয় বিহানের উপর -

‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমার খুব বেশি তাড়া আছে বুঝি? আচ্ছা, এবার বুঝলাম! তাহলে বিয়েটা হলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি আমাকে পর করে দিতে চাও?’

‘না, সে কথা নয়। এমনিই জিগ্যেস করছিলাম।’

        ‘এবার একটা দারুণ মজার কথা তোমায় বলি শোনো। আমি যে স্টেশনে নামি তার কাছে কয়েকটা দোকান আছে। পান বিড়ি বা চা-দোকান, তেলেভাজা এইসব আর কী। ওদের মধ্যে কয়েকটা দশ-বারোর বাচ্চা সপ্তাহে দু’তিনদিন শেওড়াফুলি আসে-যায়। ওরা আমাকে চেনে, মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে কথাও হয়। ওদের মধ্যে জনাতিনেক একদিন আমাদের শেওড়াফুলি লোকালে বসে থাকতে দেখেছে। আমি সেদিন স্টেশনে নামতে আমার দেখা পেয়েই ওরা এসে আমাকে বলে কী জানো? বলে কী না, আন্টি – তোমার পাশে বসা তোমার বরটাকে দেখলাম গো। কী সুন্দর বরটা গো তোমার! তোমাকে খুব আদরে যত্নে রাখবে দেখো। হি হি, আমার বিয়ের আগেই ওরা আমার বরটাকে দেখে নিল, হি হি... তা আমার বরমশাই, বিয়ের পর আমাকে খুব আদরে যত্নে সত্যি রাখবে তো!’

      

         বোধহয় মাসখানেক পরে ছন্দার সেই ‘বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে বিয়েটা’ হয়ে গেল। সে বিয়েতে বিহান যায়নি। কারণ ছন্দা বিশেষভাবে চেয়েছিল তার ওই ‘লোক-দেখানো বিয়েটা’তে বিহান যেন না যায়। অবশ্য বিহান নিজেও বিশেষ আগ্রহী ছিল না সেখানে যেতে।

          বিয়ের পর থেকে ছন্দা অফিসে আসছিল না। ছন্দার সহকর্মীদের মুখে শোনা গেল ছন্দা তার ‘নকল’ বরের সঙ্গে বেশি ভিড়ের বিশ্রী পুরীতেই লম্বা ও আসল হানিমুনে গেছে। হানিমুন সেরে বাড়িতে ফিরে এসে আরও কতদিন সে ছুটিতে কাটালো। তার পর একদিন বিয়ের শাড়ি-গয়নাসমেত অফিসের কাজে জয়েন করল ছন্দা।


‘নকল’ বরের সঙ্গে আসল হানিমুনের সময় তোলা দুজনের অগুনতি ঘনিষ্ট ফোটো ছন্দা দেখালো সহকর্মীদের। সলজ্জভাবে এও জানিয়েছিল যে আরও কয়েকটা ফোটো আছে হানিমুনের, কিন্তু সেগুলো অন্যদের দেখানো যাবে না। এসব কথা ছন্দার সহকর্মীদের মাধ্যমে বিহানের কানে এসেছিল। বিকেলের দিকে বিহানের চেম্বারে গিয়ে সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের একফাঁকে ছন্দা যথেষ্ট উদারতার সঙ্গে জানাল, বিহান ইচ্ছা করলে তাদের বিয়ের এবং হানিমুনের ফোটোগুলো দেখতে পারে... 




দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোকালটা এখন ওদের ছাড়া একাই যাওয়া-আসা করে। শেওড়াফুলি লোকালে একসঙ্গে সময় কাটাতে যাবার কথা আর তোলেই না ছন্দা। তাই যাওয়াও হয় না। শুধু ছন্দাই শেওড়াফুলি লোকালটার সঙ্গে যাবার জন্য বিহানের কাছে বায়না করত। বেশ কয়েকদিন পর বিহান নিজেই এক ফাঁকে ফোনে ছন্দাকে বলল -

‘তুমি যে গোপালপুর-অন-সী যাবার কথা বলেছিলে, আমার মনে হয় সেই ব্যাপারটা বরাবরের মতো বাদ দেওয়া উচিত।’

‘তুমি একদম ঠিক বলেছ গো! তুমি কী ভালো!’ - ফোনের ওপারে খুব হাসিখুশি গলা শোনা যায় ছন্দার - ‘অবশ্য তোমার ইচ্ছা না থাকলেও আমার এখনও কিন্তু গোপালপুরে যাবার ইচ্ছা আছে। কিন্তু হাজার ইচ্ছা থাকলেও এখন আর গোপালপুর-অন-সী যাওয়াই যাবে না। অবশ্য শুধু গোপালপুর বা বলি কেন, আমার তো এখন কোত্থাও যাওয়া একেবারেই বারণ! লং ট্রেন-জার্নি বা অন্য কোনো জার্নিও একদম চলবে না। এটা প্রথম মাস তো! তাই খুব সাবধানে থাকা উচিত। অবশ্য আমার গাইনির ডাক্তার বলেছে শুধু একমাস বা দুমাস নয়, পুরো দশটা মাসই আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।’

‘এই সুখবরের জন্য অভিনন্দন! তাহলে তুমি শেওড়াফুলি লোকালে বসে যেসব কথা আগে আমাকে বলতে বা বলেছিলে –’

‘ধুস্‌! কী যে সব অদ্ভুত আর আজগুবি কথা বলো না তুমি, তার কোনো মাথামুন্ডুই নেই। তুমি নিজের চোখেই তো দেখলে গো, আমার কত্তো লেট-ম্যারেজ হল। যতদিন সেটা না হচ্ছিল ততদিন আমার টাইম-পাস করাটাও তো যথেষ্ট জরুরি ছিল না কি? আর এই সাধারণ ব্যাপারটাকে তুমি কিনা বোকার মতো এতটা সিরিয়াস্‌লি ... আচ্ছা, তোমার কি হিউম্যান ফিলিংস বলে একেবারে কিছুই নেই!’


 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন