দিনটা ছিল ১৯৫৯ সালের ১৭ই জুলাই। আগ্রা
প্যারাট্রুপার্স ট্রেনিং স্কুলের মাঠ লোকে লোকারণ্য। সবাই বলাবলি করছে, আজকে নাকি প্লেন থেকে চারজন
ঝাঁপ দেবে! অমনি উৎসাহী জনতার ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠলো, এদের মধ্যে আবার একটা মেয়েও
রয়েছে! সে নাকি আবার ডাক্তার! এমন অদ্ভুত ঘটনা কেউ কখনো শুনেছে না দেখেছে! সকলের
চোখ আকাশের দিকে। অবশেষে বেলা এগারোটা নাগাদ গোঁ গোঁ শব্দ করে মাঠের উত্তর-পূর্ব
কোণ থেকে উড়ে এলো একটা ডাকোটা বিমান। বার দুই চক্কর কেটে নেমে এলো হাজার ফুট
উচ্চতায়। খোলা হল বিমানের দরজা। চারজন প্যারাট্রুপার দরজার পাশে সারিবদ্ধভাবে
দাঁড়িয়ে। বিমান থেকে লাফ দেওয়ার জন্য সকলে প্রস্তুত।
দরজার মাথায় সবুজ আলো জ্বলে উঠতেই পর পর তিনজন
শূন্যে ঝাঁপ দিলেন। এগিয়ে এলেন চতুর্থ জন। প্রথম তিনজন নাহয় প্রশিক্ষক, এই চতুর্থজন কিন্তু নেহাতই একজন
শিক্ষানবিশ। সবুজ আলো জ্বলে উঠতেই উড়ন্ত বিমান থেকে শূন্যে ঝাঁপ দিলেন তিনি এবং
সেই সঙ্গে নিজের নাম লিখে দিলেন ইতিহাসের পাতায়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী
প্যারাট্রুপার – গীতা চন্দ। ওদিকে উদগ্রীব জনতার মধ্যে কৌতূহল ও বিভ্রান্তি। কোনটা
মেয়ে বোঝা গেল না তো! বুঝতে পারার কথাও নয়। সাহসের রং তো ছেলে বা মেয়ে সকলের
ক্ষেত্রেই এক।
জীবনে প্রথমবার অন্য পথে পা বাড়ানো, প্রথমবার এতো উচ্চতায় বিমানের
খোলা দরজায় পা রাখা, প্রথমবার
শূন্যে ঝাঁপ! ভয় লাগছিল কি! বুকের ভেতর প্রবল হৃদকম্পন অনুভূত হচ্ছিল! হয়তো
হচ্ছিল, ভয়ও
লাগছিল। তা সত্ত্বেও ভয়ডরকে হাতের মুঠোয় পুরে গীতা নিজ লক্ষ্যে অবিচল থেকেছিলেন।
সংকেত পেয়ে লাফ দেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরেই পিছনের দিকে একটি টান অনুভব করলেন।
উপরে তাকাতেই দেখলেন তাঁর প্যারাসুটটি ততক্ষণে একটি বিশাল রঙিন ছাতার মতো স্ফীত
হয়ে গিয়েছে, গতি কমে গেল
অবতরণের। কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে নীচের জমি দৃশ্যমান হল এবং চল্লিশ সেকেন্ডের
মাথায় নিরাপদে অবতরণ করলেন ভূমিতে।
ভয়কে জয় করা নিয়ে যেমন নিজের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে, ঠিক সেভাবেই প্যারাট্রুপিংয়ের অনুমতি পাওয়াটাও কিন্তু খুব একটা সহজে হয়নি। সেসময় বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এক সার্কুলার জারি করে ডাক্তারদের প্যারাশুট ট্রেনিংয়ের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। কোনো পুরুষ ডাক্তার স্বেচ্ছায় সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, বরং বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করে আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। কারণ তাঁদের মতে, প্যারাট্রুপিং একটি বিপজ্জনক কাজ যেটি শুধুমাত্র সৈন্যদের জন্যই প্রযোজ্য। এদিকে গীতা তো অংশগ্রহণ করতে প্রবল আগ্রহী। কিন্তু বায়ুসেনা ভবন থেকে তাঁর আবেদন Not Applicable ছাপ মেরে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ডাক্তার ম্যাডাম তো রেগে অগ্নিশর্মা! অন্যদের আহ্বান জানানো হচ্ছে, আর তাঁকে কিনা অনুমতি দেওয়া যাবে না! সোজা হাজির হলেন ইস্টার্ন কমান্ডের বায়ু সেনাধ্যক্ষের অফিসে। মহিলা হওয়ার অপরাধে তিনি যদি বাদ পড়েন, তবে তাঁকে ফৌজে ডাক্তার হিসাবেই বা নেওয়া হয়েছিল কেন! শেষমেশ এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জির হস্তক্ষেপে মে মাস নাগাদ গীতাকে পাঠানো হলো P.T.S আগ্রায়।
উত্তর ভারতের তীব্র গরমে শুরু হলো ট্রেনিং। সে ট্রেনিং আবার বড়ই কঠোর। প্রত্যেকদিন পিটি, প্যারেড, দৌড়ানো এবং অন্যান্য শারীরিক কসরত করতে হতো গীতাকে। প্রতিদিন সকালে পাঁচ মাইল দৌড়াতে হতো। ওদিকে আবার বর্ষার সময়ে প্যারাট্রুপার স্কুলের ট্রেনিং চালানো যায় না বলে সেই সময়ে প্রতি বছর স্কুল বন্ধ থাকে। কিন্তু সেবার ব্যতিক্রম হলো। একজন মাত্র মহিলা শিক্ষার্থীকে নিয়ে চালু থাকলো স্কুল। এই কঠোর পরিশ্রম করতে গিয়ে প্রথম প্রথম গীতা বিধ্বস্ত হয়ে পড়তেন। আগে তো কখনও দৈনন্দিন জীবনে এতসব কসরতের অভ্যাস ছিল না। নিজের মনে সন্দেহ জাগতো, আদৌ তিনি পারবেন তো! শেষপর্যন্ত ট্রেনারদের উৎসাহ এবং নিজের মধ্যে থাকা দৃঢ় সংকল্প দিয়ে সেই অনিশ্চয়তাকে জয় করে ফেললেন তিনি।
এই সাহসিনী, উপমহাদেশের প্রথম নারী প্যারাট্রুপার একজন বঙ্গললনা। জন্ম কুমিল্লায়। শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে রংপুরে। পিতা হরেন চন্দ ছিলেন কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক। ছোটবেলা থেকেই গীতা ভীষণ ডানপিটে। গাছে ওঠা, সাইকেল চালানো, সবরকমের খেলাধূলা নখদর্পণে। বলা যায় একজন পাক্কা স্পোর্টস পারসন ছিলেন। দেশভাগের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ার আগেই পুরো পরিবার চলে আসে কলকাতায়। প্রথমে বেথুন স্কুল, তারপর নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ থেকে এলএমএফ ও কনডেন্সড কোর্স করে মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস। ১৯৫৭ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দেন ডাক্তার হিসবে। কমিশন পাওয়ার পর পোস্টিং হয় কলাইকুন্ডায়।
১৯৫৯ সালের ১৭ই জুলাইয়ের পর মাত্র কয়েকদিনের মাথায় ২৫ জুলাই জীবনের দ্বিতীয় প্যারাট্রুপিং ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন গীতা। সেটা আবার ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ মেননের সামনে৷ প্রথমবার নিখুঁত ল্যান্ডিং হলেও সেদিন কিন্তু গীতার অন্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল৷ বিমান থেকে লাফ দেওয়ার পরেই পেঁচিয়ে যায় প্যারাসুটটি। গিঁটের মধ্যে জট লেগে যাওয়ার ফলে প্যারাসুটটি ঠিকমত স্ফীত হতে পারে না। সেই মুহূর্তে গীতা ঠান্ডা মাথায় প্রশিক্ষকদের বলা কথাগুলি স্মরণ করেছিলেন এবং লক্ষ্যে অবিচল থেকে নিপুণ দক্ষতায় প্যারাসুটটি চালিয়ে গিয়েছিলেন। অবশেষে একসময় নিরাপদে পা রাখলেন মাটিতে।
প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে গীতা চন্দ সাতবার জাম্প দিয়েছিলেন যার মধ্যে একবার ছিল রাতের সফর। সফলভাবে সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণটি সম্পন্ন করার পর এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জি ১৮ই অগাস্ট তাঁকে প্যারাট্রুপারের ব্যাজ দিয়ে সম্মানিত করেন। অবসর নেওয়ার সময় তিনি ছিলেন বিমানবাহিনীর একজন উইং কমান্ডার। সত্তরের দশকে বিখ্যাত FEMINA পত্রিকা উপমহাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে "প্রথমা"দের একখানি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেখানে দ্বিতীয় নামটি ছিল গীতা চন্দের। আর প্রথম স্থানটি? সেটিও দখলে ছিলো এক বঙ্গললনার, উপমহাদেশের প্রথম ইংলিশ চ্যানেল জয়ী মেয়ে আরতি সাহার যাঁর জীবনকাহিনী ও কৃতিত্বের আখ্যান আমরা গত সংখ্যাতেই লিপিবদ্ধ করেছি। এভাবেই এগিয়ে চলুক বাঙালি মেয়েরা, জয় করে নিক গোটা বিশ্বকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন