মোবাইলটা বেজেই যাচ্ছে। রজত একবার আড় চোখে দেখল। যা ভেবেছে
তাই। অলিপা। এই সাত সকালে মেজাজ গরম। রাগও হল খুব। কাল রাত থেকে জ্বালাচ্ছে।
বারোটা পর্যন্ত ডেড লাইন ছিল। কিন্তু রজত সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি। আরে বাবা, বিয়ে বলে কথা! এত সহজে
সিদ্ধান্ত নেয়া যায়! সারা জীবনের প্রশ্ন। ও বুঝছে না কিছুতেই।
পরশু অফিস ছুটির পর নির্দিষ্ট ক্যাফেতে যেতে বলেছিল।
রজত সরল মনে গিয়েছিল। আর গিয়েই ফেঁসেছে। মুখটা কেমন গম্ভীর করে রেখেছিল ও। এর
আগে ঝগড়া বা মতান্তর যে হয়নি তা নয়। তবে তা সহজে মিটেও গিয়েছিল। এবার তেমন কোন
আবহ নেই। মনে পড়ছে না অভিমান করার
মত কিছু কথা বলেছিল কিনা। বা কোন কাজ। তবু আকাশ থমথমে। মনে দুশ্চিন্তা নিয়ে সাহস
করে পাশে না, সামনের
চেয়ারে বসল। স্বগতোক্তির মত বলল, "যা গরম পড়েছে। বৃষ্টিও নেই। পার্ক স্ট্রিট থেকে এই
গোল পার্কে আসতেই দম শেষ।" উল্টো দিকের মুখে কোন ভাবান্তর নেই। অগত্যা বোতল
খুলে একটু ঠাণ্ডাজল গলায় ঢেলে আবার মিহিসুরে বলল, "কী ব্যাপার। জরুরি তলব?"
"কেন আসতে
বলে অন্যায় করেছি।"
"ন্যায়
অন্যায়ের প্রশ্ন উঠছে কেন? শনিবার তো
দেখা হল। মাঝে আবার ডাকলে, তাই।"
"এগ্রিমেন্ট
আছে, শনিবার
ছাড়া ডাকা যাবে না।"
পারদ চড়ছে। রজত সতর্ক হয়। ঝড়ের পূর্বাভাস। কিন্তু ঝড়টা
কোন দিক দিয়ে আসবে! বা কেমন ঝড়, গতিবেগ কত তার কোন আগাম আন্দাজ নেই। বুঝে উঠতে পারছে
না কেমন ভাবে সামলাবে।
"না, না, তা নয়। আচ্ছা, তুমি বল। আমি শুনছি।"
"আমাদের
সম্পর্ক কতদিনের?"
গভীর তলদেশ বুড়বুড়ি কাটছে। কোন গোপন সংকেত!---
"তা ছ' সাত বছর হবে।"
"পরস্পরকে
জানার জন্য এ সময়টা কি যথেষ্ট নয়?"
"অবশ্যই
যথেষ্ট।"
"তাহলে এবার
একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়।"
"বল, কী সিদ্ধান্ত নেব।" রজত
বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নাড়ে।
ওয়েটার ছেলেটি এদিকে আসছে দেখে অলিপা একটু থামে। ও
অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই বলে, "আমাদের বিয়ের ব্যাপারে এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাবা আর সময় দিতে চাইছে না।"
বিষম খেল রজত। কাশি আটকে গেল গলায়। সেই ভয়টার সামনে
আবার তাকে দাঁড় করিয়ে দিল অলিপা। এই বিয়ে ব্যাপারটা তার না-পসন্দ। বিয়ে করলে
মানুষ আর স্বাধীন থাকে না। এটাই তার ধারণা। কত দায়িত্বের বোঝা চাপে ঘাড়ে। কত
দুশ্চিন্তা। প্ল্যান পরিকল্পনা। কী হবে তখন রজতের কবিতা লেখা। কবিসভা। এখন কেমন
মুক্ত পাখির মত উড়ছে। অবাধ
বিচরণ। হুটহাট বেরিয়ে পড়া। সামনেই বর্ষা। শান্তিনিকেতনে একটা জম্পেস কবিসম্মেলন
আছে। ডাক পেয়েছে। পানাহারের ব্যবস্থা ভালোই। এরপর আবার পুজো সংখ্যার জন্য কবিতা
লেখা। খুব চাপ। এমন সময় এই ফ্যাচাং। সব বন্ধ হয়ে যাবে। বিয়ে হলে জীবন কয়লা। তার উপর
বড় একটা খরচ। সেভিংস তো
খুব পুওর। কী করবে সে! সাবধানে পা ফ্যালে।
"জীবনের
ভবিষ্যৎ। তবে বলছিলাম
কি, আর একটু
সময় নিলে ভালো হতো না। সব দিক গুছিয়ে নিতাম। আসলে একটা বড় খরচ…"
"ঠিক আছে, আমরা কম খরচে শুধু রেজিস্ট্রি
ম্যারেজ করব। একান্ত পরিজনদের নিয়ে একটা ছোট পার্টি দেব। আর সংসার করতে যা
প্রয়োজন সবই আছে বাড়িতে। তাহলে তো খরচ কম হবে।" অলিপা ঝুঁকে পড়ে টেবিলে।
স্থির দৃষ্টি।
ঝামেলায় পড়ে রজত। এবার সে কী বলবে? কোন্ অজুহাত খাড়া করবে। পাশ
কাটাতে পারবে কি! শেষে মরিয়া হয়ে বলে, "আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও।"
"সময় দেব।
তবে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা।''
কফি খুব বিস্বাদ লেগেছিল। এমনকি বাড়ি ফিরে রাতে ঠিকমতো খায়ওনি। সারারাত ভেবে গেছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে? তাহলে মা একা হয়ে যাবে। ছোট বোনটার কী হবে! অলিপা, বন্ধুরা সব কাওয়ার্ড ভাববে। বিয়ে ব্যাপারটা এমন বিশ্রি।
যাদবপুরে যখন পড়ত, ক্লাসের মধ্যে ওই ছিল খুব মুখচোরা। বুকে সাহস খুব কম। নিজে থেকে এগিয়ে কারও সাথে আলাপ করতে পারত না। অনেকটা ভাবুক প্রকৃতির। ক্লাসের পর অন্য বন্ধুরা যখন ক্যান্টিনে বা কাছের কফিহাউসে গিয়ে আড্ডা মারত, রজত তখন পিঠের ব্যাগে কবিতা নিয়ে পত্রিকার দপ্তরে দপ্তরে ঘুরত। সেমেস্টারে ভালো নম্বরও তুলতে পারেনি। তবু কেন জানি সেই মাঝারি মানের ছেলেকে এক ভ্যালেনটাইন ডে-তে প্রপোজ করে বসল অলিপা। বন্ধুরা একটু অবাক হলেও শেষ পর্যন্ত অপ্রস্তুত রজত রাজি হয়েছিল। আর বুঝতে পেরেছিল তার মত এলোমেলো ছেলের জন্য এই মেয়েই ঠিক। কিন্তু আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, সেদিনের সিদ্ধান্তটা আসলে ভুল ছিল। নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে এনেছে।
রাত বারোটার ডেড লাইন পেরিয়ে গ্যাছে গত কাল। সারারাত
দু'চোখের পাতা
এক হয়নি। আজ
সকালেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সে। বুকের মধ্যে যে
ভয়টা ছিল, তেমনই
রয়েছে। বরং আরও জড়িয়ে ধরেছে। অলিপাকে সে হারাতেও চায় না।
অসহায় রজত মোবাইল সুইচড অফ করে ওয়াশ রুমে গেল।
স্নান করে শরীর মন একটু শান্ত হল বটে। কিন্তু টেনশন যাচ্ছে না।
বেরিয়ে ভাবল আজ সে অফিস যাবে না। কিন্তু ফোন করে তো
জানাতে হবে। সুইচড অন করতেই হোয়াটসঅ্যাপে একগাদা মেসেজ ঢুকল। রজত আগে অফিসে ফোন
করল। তারপর অলিপার মেসেজগুলো পড়ল। "তুমি খুব ভিতু জানতাম, কিন্তু এতটা কাওয়ার্ড জানতাম
না। ফোনটা ধরারও সাহস নেই? বেশ, তোমার এড়িয়ে যাওয়া, তোমার নীরবতাই, তোমার সিদ্ধান্ত ধরে নিলাম। তবে তোমাকে একটা সুখবর
দিই। তুমি নিশ্চয়ই জানতে, আমাদের
সঙ্গে পড়ত অভিষেক আমাকে খুব পছন্দ করত। তুমি যখন বিয়ে করবে না, আর বাড়িতে বাবার খুব চাপ, তাই শেষে আমি বাধ্য হয়ে ওকে
ফোন করি। ও আমাকে বিয়ে করতে রাজি। পরশু আমাদের এনগেজমেন্ট। নিচে কার্ড পাঠালাম, পারলে এসো। কি
ট্যাপ করে কার্ডটা পুরো দেখল রজত। মাথাভর্তি আগুন। ঘর
অন্ধকার হয়ে গেল। মোবাইল ছুঁড়ে ফেলে দিল। নিজের চুল নিজেই ছুঁড়ছে। অলিপা এটা কী
করে করল? ওতো বিয়ে
করবে না একথা অবলেনি। শুধু একটু সময় চেয়েছিল নিজেকে প্রস্তুত করতে। নিজেকে
গুছিয়ে নিতে। তবে হ্যাঁ, ওর দোষ নেই।
অনেক সময় ও দিয়েছে। বুকের মধ্যেটা হু-হু করছে। অলিপাকে সে হারাতে পারবে না। কোন
কিছুর বিনিময়ে না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয়। শেষ বারের মত চেষ্টা করবে অলিপার
এনগেজমেন্ট আটকাতে। ভাবল, অভিষেককে
একবার ফোন করে অনুরোধ করে, ও যেন রাজি
না হয়। তারপর ভাবল, না। ছোট
হয়ে যাবে বন্ধুর কাছে। তবে বাড়িতে বসে থাকলে চলবে না। ছোট বোনকে বলে সে দ্রুত
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
বাবা মেয়ে ড্রয়িংয়ে বসে চা খাচ্ছিল। আর মাঝে মাঝে দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। যেন কারও আসার কথা। ওরা অপেক্ষায় আছে।
"কিরে, মেসেজ আর কার্ডটা
পাঠিয়েছিলিস।" সৌমেনবাবু মেয়ের মুখের দিকে তাকান।
"হ্যাঁ বাপি, পাঠিয়েছি।"
"কোন উত্তর?"
"না।"
"আসবে, আসবে। একটু দাঁড়া। যে চাল
চেলেছি, বাছাধন ছুটে
আসতে বাধ্য।"
"কিন্তু বাপি, আমার ঠিক ভরসা হচ্ছে না। ও খুব
ভিতু। বিশেষ করে বিয়ের ব্যাপারে।" অলিপার মনে দুশ্চিন্তা।
"সেটা বুঝতে
পারছি। আমি তো জানতাম বিয়ের ব্যাপারে মেয়েরা সময় টপ
নেয়।
দ্বিধা করে। তোর মা-ই আমাকে কম ভুগিয়েছে! এখানে তো ব্যাপারটা উল্টো। রজতই ভয়
পাচ্ছে। এড়িয়ে যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক ও কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসে।"
কলিং বেল বেজে উঠল। অলিপা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল।
ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল উদ্ভ্রান্ত রজত। চিৎকার করে বলতে লাগল, "কী ব্যাপার মেসোমশাই! কী করছেন
আপনারা? এই ফালতু
এনগেজমেন্ট…এসব কী?"
"বসো বসো।
আমার পাশে বসো।" সৌমেনবাবু হাত ধরে সোফাতে বসায় রজতকে। মেয়েকে বলেন, "ওকে একটু ঠান্ডা জল দে। আর কিছু
খাবার আন।"
রজত বাধা দেয়। "কিচ্ছু আনতে হবে না। আমি ওই
ভদ্রমহিলার হাতের কিছুই খাব না। আগে বলুন, আমি কী অপরাধ করেছি? আমাকে একটু সময় দেওয়া গেল না? আপনারা এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে
ফেললেন?"
"আমরা তো
বাধ্য হয়েছি। আমার শরীর ভালো নেই। আমি চেয়েছি তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে
চিন্তামুক্ত হতে। ওর মাও তো বেঁচে নেই…।"
অলিপা মুখ টিপে হাসছে। সৌমেনবাবুও হাসি চেপে রজতের
মুখের দিকে তাকিয়ে।
"কিছুতেই কি
এই এনগেজমেন্ট বাতিল করা যাবে না?" রজত আলিপার সামনে গিয়ে আকুল হল।
"না।"
অলিপা নির্দয়।
রজত মাথা নিচু করে বলল, "আমি রাজি। ওই দিনই এনগেজমেন্ট হবে।"
যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল সে, তেমন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।
বাবা-মেয়ে ততক্ষণে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে।
"তুমি গ্রেট।
জিনিয়াস বাবা। তোমার প্ল্যান খুব সাকসেসফুল। এতদিন আমি ওর মন থেকে যে বিয়ের
ভয়টা তাড়াতে পারিনি, তুমি একটা
মিথ্যে এনগেজমেন্ট কার্ড আর মেসেজ বানিয়ে তা করে দিলে।" বাবাকে জড়িয়ে ধরে
অলিপা।
"তবে, তোর ওই বন্ধু অভিষেককে একটা
ধন্যবাদ জানাস, ওই তো
ফোটোশপে কার্ডটা বানিয়ে দিয়েছিল।"
রজতের কী দশা তা আমরা জানি না, তবে অলিপা অনেক দিন পর আজ
ব্যালকনিতে গিয়ে নিজের পছন্দের রবীন্দ্র সংগীত গাইছে।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সুন্দর সংখ্যা হয়েছে।
উত্তরমুছুনচেনা ছকে বেশ ভালো লাগলো...
উত্তরমুছুনআন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন