"আর কটা
ঝুড়ি তৈরি বাকি মা ?" রাজা তার
মাকে জিজ্ঞাসা করে।
"আর দুটো, তাহলেই তিরিশটা হয়ে যাবে ।উঠে
পড়েছিস যখন এই ঝুড়ি দুটো করে ফেল না বাবা, আমি ততক্ষণে বরং তোর খাবারটা দি।"
ছটা চল্লিশ এখন। ঠান্ডা হালকা হালকা আছে ।একটা পাতলা
চাদর গায়ে দিয়ে উঠোনে এসে বসে রাজা।
"ঝুড়িগুলো
তৈরি হয়ে গেলে আজই হাটে দিয়ে আসবে সে। যা টাকা আসবে সেই দিয়ে, আসার সময় হাট থেকে দুটো
সিঙ্গারা কিনে আনবে। অনেকদিন হলো সিঙ্গারা খাওয়া হয় না।" এইসব সাত পাঁচ
ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল রাজা, হঠাৎ মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সে।
"এখনো হলো না
? উফ বাবা, তোকে দিয়ে কোন কাজ হয় না
জানিস তো। চল সর এখন, ঝুড়ি দুটো
করে নি। আজই যাবি তো নাকি ?" রাজার মা
জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ আজই
যাব ,আসার সময়
দুটো সিঙ্গারাও বরং কিনে আনব। অনেকদিন খাওয়া হয়না।"
"না ,আর সিঙ্গারা খেয়ে কাজ নেই ।
সংসার চালানো দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বাবার ওষুধ কিনতে হবে, চোখের ড্রপ টাও শেষ হয়ে গেছে ,চাল কিনতে হবে, সবই তো জানিস বাবা তাও কেন এরকম
কথা বলিস?"
"আচ্ছা
মা" বলে চুপ করে যায় রাজা," তুমি বরং ঝুড়িগুলো সাইকেলে বেঁধে দিও ,আমি চানটা সেরে আসি।"
শান্তি কাকাদের টিউবয়েল থেকে দু বালতি জল এনে স্নান
করতে চলে যায় রাজা ।স্নান সেরে চা মুড়ি খেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোয় হাটের
উদ্দেশ্যে।
ঠিক কথাই তো বলেছে মা ,বাড়ির অবস্থা একদমই ভালো না ।সুগারে বাবার চোখটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে বাবার চোখ অপারেশন করা হয়, ড্রপটা না দিলে ভালো করে দেখতে পাবে না বাবা। সিঙ্গারা না হয় পরে খাওয়া যাবে। যা টাকা হবে, এসে মায়ের হাতে দিয়ে দেবে সে।
হাটে ঝুড়িগুলো দিয়ে টাকা মিলিয়ে নিয়ে সাইকেলে উঠতে যাবে এমন সময় ,নাকে এল তেলে ভাজার গন্ধ। হারু জেঠুর তেলেভাজা এ তল্লাটে বিখ্যাত বললেই চলে।চপ ,সিঙ্গারা, বেগুনি, ডাল বড়া সবই পাওয়া যায় তার দোকানে। নাকে যে গন্ধটা এল সেটা সিঙ্গারার ।চোখ ফিরিয়ে দেখল রাজা। অনেক কিছু ভাবতে থাকলো সে, কিছুই তো সে পায়নি জীবনে, পনেরো বছর বয়স তার। বাড়ির অবস্থা ভালো নয় বলে পড়াশোনা শিখতে পারেনি, সিক্স অবধি গিয়েছিল অবশ্য স্কুলে। তারপর আর ভর্তির টাকা দিতে না পারায় স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেয়। তারপর তো সেই একঘেয়ে জীবন এই ঝুড়ি তৈরি না হলে ভ্যান টানা।
হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় রাজার মাথায় ,একটা সিঙ্গারা কিনে এখানে খেয়ে
নিলে কেমন হয়? মা কি আর অত
বুঝতে পারবে নাকি ? বাড়ি গিয়ে
বরং বলে দেবে আজ এই টাকায় দিয়েছে।
এই ভেবেই ,পকেট থেকে ছয়টা টাকা বার করে, হারু জেঠুর দোকানের দিকে এক পা
এক পা করে এগোয় রাজা। দোকানের সামনে টা বেশ ভিড়, যদিও বা রোজই থাকে, দোকানের সামনে গিয়ে রাজা দেখে সিঙ্গারা ভাজা চলছে।
হারু জ্যেঠু তাকে দেখে একগাল হেসে বলে,"দাঁড়া বাবা, এদের দিয়ে তোকে দেবো, গরম গরম"
রাজা অপেক্ষা করছে ।কিন্তু একি এতদিন পর তার পছন্দের
খাবার খাবে সে ,কিন্তু তার
আনন্দ হচ্ছে না কেন ? যেন কেমন
বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে তাকে। সে কি ভুল কাজ করছে ? বাবার চোখের ড্রপটা যদি না হয় বাবা তো আর দেখতে পাবে
না । হঠাৎ রাজা চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার সেই ছোটবেলার কথা গুলো যেগুলো তার মা
তাকে বলত,
"বাবা কোনদিন
মিথ্যে কথা বলে কিছু করিস না, যা করবি সৎ পথে করিস, তা সে যত ছোট কাজই করিস,কোনদিন অসৎ পথে যাস না,"
রাজা বলে উঠলো," জেঠু থাক আজ নেব না। পরে এসে একদিন নোবো আসি
আজ।"
হারু জ্যেঠু বলল, "কেন ? দাঁড়া না ,এক্ষুনি হয়ে যাবে। বাবা তোর আবার এত তাড়া কিসের?"
"না জেঠু ,আজ কিনব না, টাকা নেই গো"
"ও, তা টাকা নেই তো কি হয়েছে ,একটা দিচ্ছি খেয়ে যা"
"না জ্যেঠু ,থাক, পরে কিনব, বাড়ি নিয়ে যাব। আসি গো
আজ।"
সাইকেলে উঠে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় রাজা, এবার কিন্তু বেশ আনন্দ হচ্ছে
তার। তা ঠিক যে ,সে তার
পছন্দের খাবার খেতে পারলো না ,কিন্তু তাও মাকে সে মিথ্যে কোনদিন বলবে না ,শুধু মাকে কেন কাউকেই না। যেদিন
সে নিজে রোজগার করবে, সেদিন
বাড়ির জন্য কিনে আনবে সে, সবাই মিলে
মিলেমিশে খাবে।
সূর্য এখন পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে ,পাখিরা নিজের বাসায় ফিরে
যাচ্ছে, নিরিবিলি
রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে রাজা বাড়ি ফিরছে এক আত্মতৃপ্তির হাসি নিয়ে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন