মিষ্টির নাম শুনলেই অধিকাংশ মানুষের জিভ জলে ভরে ওঠে। বঙ্গজীবনের সমস্ত পূজা পার্বণ অনুষ্ঠান উদযাপনে মিষ্টি অপরিহার্য বস্তু। মিষ্টি সাধারণত গুড় বা চিনির রসে ডোবানো ময়দা, বেসন বা ছানার মণ্ডকেই বোঝায়। যদিও বর্তমান যুগে স্বাস্থ্য সচেতন জনগোষ্ঠী চিনির বদলে স্টিভিয়া এবং ময়দা বা ছানার বদলে ওটের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনের অবদমিত ইচ্ছা বিশেষ পালা পার্বণে স্বাস্থ্যকে দুরে সরিয়ে রেখে জিভের স্বাদকে প্রাধান্য দিয়ে দেয়। উৎসব যদি হয় বর্ষবরণ, তাহলে তো মিষ্টির সাথে কোনোভাবেই আপস করা যায় না।
ভারত তথা বাংলা মিষ্টান্নাদির জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। প্রাচীন বাংলার বহু মিষ্টি আজ ব্যস্ততার আড়ালে হারিয়ে গেছে। প্রাচীন ভারতে মিষ্টির মধ্যে গুড় ছিল সর্বাগ্রগণ্য। গুড়ের মিষ্টত্বে মুগ্ধ রাজা শশাঙ্ক গুড়ের অনুপ্রেরনায় একটি প্রদেশের নামকরণই করেন “গৌড়”। প্রাচীন বাংলায় মিষ্টি বা মিষ্টান্নের প্রধান উপকরণ ছিল তিনটি। গুড়, দুধ আর ধান। গুড়ের সঙ্গেই ছিল শর্করা বা চিনি। বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া অসাধারণ মিষ্টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আনন্দনাড়ু, মোহনভোগ, ক্ষীরের পুলি এবং যোসি, পক্বান্ন, নমস, নারিকুলি, খাগড়াই মুরকি, মুকুন্দ, ছানামুখী, গঙ্গাজলি প্রভৃতি।
আসন্ন বর্ষবরণের উৎসব উদযাপনে শুভেচ্ছার সাথে তাই রইল ক’টি প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া মিষ্টির হদিশ।
গঙ্গাজলি বা পদ্মচিনিঃ
শ্রী শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী রচিত "চৈতন্যচরিতামৃত" এবং রূপরাম চক্রবর্তী রচিত "ধর্মমঙ্গল" গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, রথযাত্রার সময় মহাপ্রভু চৈতন্যদেব শ্রীক্ষেত্রে যাওয়ার আগে পানিহাটিতে ভাগবতাচার্য্য রাঘব পন্ডিতের বাড়িতে সেবা গ্রহণ করতেন। রাঘব পন্ডিতের বাল্যবিধবা ভগিনী দময়ন্তী মহাপ্রভুর যাত্রাপথের যে রসদ প্রস্তুত করতেন তার মধ্যে অন্যতম হল গঙ্গাজলি নাড়ু। আজও পানিহাটিতে চিঁড়া দধি দণ্ড মহোৎসবের দিনে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভক্তরা মহাপ্রভুর জন্য "রাঘবের ঝালি" প্রস্তুত করেন। এর অন্যতম উপাদান হল এই ‘গঙ্গাজলি’। এককালে কৃষ্ণনগরের গঙ্গাজলি সন্দেশের খ্যাতি ভারতবিখ্যাত ছিল। বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত এই অপূর্ব মিষ্টি কৃষ্ণনগর, মায়াপুরে। প্রণালী তো জানা গেল শুধু সময় করে বানিয়ে ফেললেই হল। মনে হয় মন্দ লাগবে না।
উপকরণঃ
- নারকেল বাটা – ১০০ গ্রাম
- চিনি – ১০০ গ্রাম
- জল – ৫০ মিলি
- ছোট এলাচ – ৪টে
- কর্পূর – এক চিমটি
প্রণালীঃ
- নারকেল প্রথমে জলে বেশ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে যাতে কোড়ানোর সময় নারকেলের শুধুমাত্র সাদা অংশই পাওয়া যায়। নারকেলের সাদা কোড়ানো অংশ বেটে নিতে হবে।
- ধীমে আঁচে চিনি ও জল দিয়ে তাতে এলাচ অল্প থেঁতো করে দিতে হবে। চিনির রস গাঢ় হলে এলাচ তুলে তাতে ধীরে ধীরে নারকেল বাটা দিয়ে নেড়ে নারকেলের সঙ্গে রস একেবারে মিশিয়ে দিতে হবে।
- লক্ষ্য রাখতে হবে যেন চিনির রস ক্যারামেলাইসড না হয়ে যায় বা নারকেল লাল না হয়ে যায়।
- এক চিমটে কর্পূর মিশিয়ে একটা বড় থালায় ঢেলে ঠান্ডা করতে হবে। আগুনের কম তাপে নারকেলের ধবধবে সাদা রং স্বচ্ছ হয়ে গঙ্গাজলের রূপ নেয়। সেই থেকেই এর নাম গঙ্গাজলি।
- এরপর শিলে বা মিক্সিতে বেটে মিহি গুঁড়ো করলেই তৈরী হবে গঙ্গাজলি। প্রাথমিকভাবে এইভাবেই পরিবেশন করার নিয়ম থাকলেও, পরবর্তীকালে এই গুঁড়ো করা নারকোলকে নাড়ু বা সন্দেশের আকার দেওয়া হয়।
- সেক্ষেত্রে হাতের সাহায্যে বা ছাঁচের সাহায্যে নাড়ু ও সন্দেশ বানানো হয়।
ছানামুখীঃ
মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির পছন্দের
মিষ্টির তালিকায় সব সময়
উল্লেখযোগ্য নাম হল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার 'ছানামুখী'। কয়েক শতক ধরে বাংলার অন্যতম
ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি বাঙালির মিষ্টান্নের তালিকা আলোকিত করে রেখেছে। এই মিষ্টি
তৈরিতে প্রচুর পরিমাণে দুধের প্রয়োজন হয় বলে বর্তমানে মিষ্টি বিক্রেতারা এই মিষ্টি
তৈরি করেন না।
কাশীধামের
মহাদেব পাঁড়ে কিশোর বয়সে বড় দাদা দুর্গা প্রসাদ পাঁড়ের সাথে প্রায় একশ বছর আগে
কলকাতায় চলে আসেন। দাদার মিষ্টির দোকানে কাজ করতে করতে হঠাৎ দাদার মৃত্যু হলে অনাথ
মহাদেব ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণবেড়িয়াতে চলে আসেন। মেড্ডায় তখন শিবরাম মোদকের একটি মিষ্টির দোকান ছিল। তিনি নিজের দোকানে
মহাদেবকে আশ্রয় দেন। মহাদেব আসার পর শিবরামের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
মহাদেব এখানে দুটি নতুন
মিষ্টি তৈরি করেন। একটি লেডি ক্যানিং বা লেডি কেনি এবং
অন্যটি ছানামুখী।
উপকরণঃ
- দুধ – ১ লিটার
- চিনি – ১৫০ গ্রাম
- এলাচ গুঁড়ো – ৪/৫ চামচ
- জল – ৫০ মিলি
- লেবুর রস – ৫০ মিলি
প্রণালীঃ
- সাধারণত ১০০ গ্রাম ছানামুখী তৈরি করতে ১ – ১.৫ লিটার দুধের সঙ্গে ১৫০ গ্রাম চিনি দিয়ে কয়েকটি ধাপে ছানামুখী বানানো হয়।
- প্রথমে দুধকে খুব ভালো করে জ্বাল দেওয়া হয়। গরম দুধ অল্প ঠান্ডা করে তাঁর মধ্যে লেবুর রস মিশিয়ে ছানায় পরিণত করতে হবে।
- অতিরিক্ত জল ঝরার জন্য একটি পরিচ্ছন্ন সুতির কাপড়ে ছানা রেখে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। দীর্ঘক্ষণ ছানা ঝুলিয়ে রাখার পর একটি ভারী বস্তু তার ওপরে চাপা দিয়ে সমস্ত জল বার করে ছানাকে শক্ত করতে হবে।
- শক্ত ছানাকে ছুরি দিয়ে ছোট ছোট চৌকো আকৃতির টুকরা করে নিতে হবে।
- কড়াইতে জল, চিনি ও এলাচ দিয়ে ফুটিয়ে দু’ তার বিশিষ্ট শিরা তৈরি করে তার মধ্যে ছানার টুকরোগুলো দিয়ে হালকা হাতে নাড়তে হবে।
- চিনির শিরা থেকে ছানার টুকরোগুলো তুলে একটি বড় পাত্রে খোলা জায়গা বা পাখার নিচে প্রতিটি টুকরো আলাদা করে ছড়িয়ে রেখে শুকাতে হবে। শুকিয়ে গেলে পরিবেশন করতে হবে।
চিঁড়ের পুলিঃ
নববর্ষের খাবারের কথা হবে অথচ কবিগুরুর নাম উচ্চারণ হবে না, তা কখনই সম্ভব নয়। নিত্যনতুন রান্না খেতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ—দইয়ের মালপো, পাকা আম দিয়ে তৈরি আমভাত, চিঁড়ের পুলি, মুগ শ্যামলী, রুটির মালপো প্রভৃতি বিচিত্র নাম, রূপ ও স্বাদের মিষ্টি কবিগুরুর অনুরোধে ঠাকুরবাড়িতে তৈরি করা হত। কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর তৈরি নববর্ষের জনপ্রিয় মিষ্টি ‘এলোঝেলো’। কবি এই মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করলেও, এর নামটা তেমন পছন্দ না হওয়ায়, এর নাম বদলে তার নতুন নাম দিলেন ‘পরিবন্ধ’। একবার বৈশাখের উৎসবে মৃণালিনী দেবীকে দিয়ে মানকচুর জিলিপিও তৈরি করিয়েছিলেন কবি। তবে ভাজা মিষ্টি হিসাবে চিঁড়ের পুলি বিশেষ সমাদৃত হত।
উপকরণঃ
- চিঁড়ে - ২০০ গ্রাম
- নুন - স্বাদ মতো
- হলুদ - এক চিমটি
- লঙ্কা গুঁড়ো - এক চিমটি
- ময়দা - ১ টেবিল চামচ
- ঘী – ২৫০ মিলি
- নারকেল – ১০০ গ্রাম
- খেজুর গুড় – ৫০ গ্রাম
- গুড় ও নারকোল একসাথে জ্বাল দিয়ে পুর তৈরি করে নিতে হবে। আরও সুস্বাদু করতে হলে নারকোলের পরিবর্তে ক্ষীর পুর হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
- প্রথমে চিঁড়ে ভাল করে ধুয়ে নিয়ে ঘণ্টা খানেক ভিজিয়ে রাখতে হবে। ভেজানো চিঁড়ের মধ্যে একে একে নুন, চিনি, হলুদ, লঙ্কা, ময়দা দিয়ে ভাল করে মেখে নিতে হবে। চাইলে ময়দার পরিবর্তে সুজিও দেওয়া যায়।
- এবার এই মণ্ড থেকে ছোট ছোট লেচি কেটে নিয়ে, পুলির আকারে গড়ে নিতে হবে। হালকা করে মাঝে গর্ত করে ভিতরে নারকেলের পুর দিতে হবে। (অনেকে সব্জির বদলে ঝাল তরকারির পুরও ভরে দিয়ে থাকেন।)
- এবার ঘিয়ে পুলি দিয়ে বাদামী রঙের করে ভেজে তুলে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে ভাজার সময়ে যেন পুলিগুলি ভেঙে না যায়।
- পাতলা গুড়ে ভাজা পুলি ডুবিয়ে খেতে হবে। অনেক সময় নারকেলের পুর দেওয়া পুলিগুলোকে দুধে ফেলে দুধ-চিঁড়ের পুলিও বানিয়ে নেওয়া যায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন