ছাতা সুতপা ঘোষ

 


এই যে দেখছো কালচে লাল , আসমানী নীল, কলাপাতা সবুজ, গাঢ় বাদামী ; এই চারখান গিন্নির। তার পাশে মিশমিশে কালো এই যে তিনটে, এর একটা আমার, একটা ছেলের ; পড়ে রইল যে বাকি  একখান, সে বেটা অনাথ । কোথা থেকে এলো, কবেই বা এলো, খোদায় মালুম । ছেলের ব্যাগ, আমার ঝোলা, গিন্নির ৱ্যাক, আলামারির মাথা থেকে একে একে এসে সব জড়ো হয়েছে বারান্দায়। সবারই মোটামুটি একই সমস্যা। সকলেই শিকভাঙা। নিজেকে যথাযথ ভাবে মেলে ধরতে পারেনা  কেউই

আজ বেমক্কা একটা ছুটি পাওয়া গেছে। আজকাল এমন দুচারটে ছুটি হুটহাট জুটে যাচ্ছে কপালে। কপালের নাম গোপাল। সকালে আয়েস করে বসে খবরের কাগজটায় চোখ বুলোচ্ছি, এমন সময় বাইরে পরিচিত হাঁক। "ছা.. তা.. সা.. রা....ই......."

আমিও গলাটা কয়েক পর্দা চড়ালাম, "এদিকে এএএ...."

গোপাল আমার অনেককালের চেনা লোক। ফি বছর এই বসন্ত যাই যাই  সময়টাতে আমার মনে পড়বেই গোপালের কথা। অছেদ্দায় এখানে, সেখানে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা ছাতাগুলো গোপালের ভরসাতেই দিন গোনে। উল্টো করে ধরে, ভাঙা শিক পাল্টে, জোড়া দিয়ে, সুতোর ফোঁড় এদিক  থেকে ওদিকে টেনে দেড় থেকে মেরেকেটে দু ঘন্টার মধ্যে গন্ডা দুই নুয়ে পড়া ছাতাকে একদম সিঁধে দাঁড় করিয়ে দেয় গোপাল

প্রথম দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর, একে একে তোলা হবে সবাইকে অপারেশন টেবিলে। ইজিচেয়ারে খাড়া হয়ে বসে দেখতে লাগলাম গোপালের কাজ। আজকাল এই থ্রী ফোল্ড ছাতাগুলোয় যত বেশি কেরামতি, তত বেশি ঝামেলা। বড় কোন শিকের সঙ্গে, ছোট কোন শিকটাকে জুড়ে দিলে জুতসই, মন দিয়ে গোপাল এখন সে কাজেই রপ্ত


ভেবোনা, হাত চলছে বলে মুখ থেমে আছে। কথা চলছে টুকটাক। তেমন কিছু না, এই মামুলি কথাবার্তা, যেমন হয় আর কি । আগুন বাজার, জলবায়ুর চড়া পারদ, উত্তপ্ত রাজনৈতিক হালচাল নিয়ে কথা চলতে চলতে হঠাৎ আলোচনার মোড় গেল ঘুরে। গিন্নিকে আলতো করে দুকাপ চায়ের অর্ডার ছুঁড়ে দিয়ে আমি নেহাতই ফস করে ঢুকে পড়লাম গোপালের ব্যক্তিগত পরিসরে। গোপালের সাথে আমার চেনাজানা  যদিও বেশ কিছুকালের, ওর পরিবার নিয়ে, সংসার নিয়ে কখনো এর আগে কিছু জানতে চাইনি কোনোদিন

বুড়ো বাপ মা, বউ নিয়ে গোপালের সংসার। ভাইরা কাজের ধান্দায় এখানে, ওখানে ছড়িয়ে। আর ছেলে মেয়ে?

মন চাইছিল চা। তেপায়া টেবিলটার উপর  নামিয়ে রাখা ট্রে তে দেখছি টলটল করছে দু গ্লাস দইয়ের শরবত। একটা গ্লাস গোপালের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ঘোলে চুমুক দিতে দিতে ক্রমশ শান্ত হলো গোপালের রোদে পোড়া শরীর, তাতে পোড়া মন

বাইশ বছর বয়সে গোপালকে যখন বিয়ে দেওয়া হয়, ওর বউ সরস্বতী তখন সতেরো। ইস্কুলের চৌহোদ্দি থেকে সটান এসে পড়েছে সংসারের ঘেরাটোপে। এদিকে এইট ফেল গোপাল বেশ কবছর হলো ইস্কুলের পাট চুকিয়ে এক রাজমিস্ত্রির কাছে নাড়া বেঁধেছে, তার জোগাড়ে হয়ে। রোজগার পাতিও মন্দ নয়। সদর টাউনে একটার পর একটা হাউসিং কমপ্লেক্সে তখন কাজ চলছে ফুল ফেজে। টাকা উড়ছে ইমারতি কারবারে

সময় ও বসে থাকে না। দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেল ফুস করে। দিন কাটলো, ভাগ্যর চাকা ঘুরলো না। দশ বছর বাদেও গোপাল যে জোগাড়ে হয়ে কাজে ঢুকেছিল, সেই জোগাড়েই রয়ে গেল। ওদিকে সরস্বতীর এতদিনেও কোল ভরলো না। নড়েচড়ে বসলো মা- কাকির দল । বংশের বাতি কে দেবে! অতএব, আরো একবার টোপর পরে গোপাল চললো ছাদনা তলায়। গোপাল বড় সুবোধ ছেলে

-         আর সরস্বতী? সেই ইসকুল ছুট মেয়েটা? সে কিছু বলেনি?”

-         মুখ টিপে হেসেছিল শুধু

-         হেসেছিল! কি হলো তার এরপর?”

-        " কি আবার হবে! রইল, যেমন ছিল তেমন। আলাদা বলতে শুধু ওই সতীন এলে নিজের ঘরখান ছেড়ে দিতে হলো। ওই আর কি। তাই বলে কি মাথার উপর থেকে ছাদটাই চলে গেল নাকি! শাউড়ি, মানে গোপালের গব্বোধারিণী এসে হাত ধরে নিয়ে গেল না বৌমাকে নিজের ঘরে!"

-         তাই বলে, ঘরে এক বউ থাকতে আবার বিয়ে! এতো ঘোরতর....

হাসলো গোপাল, “ আইনের কথা যদি কন দাদা, ও সব আইন ফাইন গেরামের দেশে কজন জানে? আর কজনই বা মানে?”

বলে কি হবে বা! শরীরটা এলিয়ে দিলাম চেয়ারের কোলে। আইন, সুবিচার এ সবের কোন দাম নেই সরস্বতীদের জীবনে! এ সব কি ওদের কাছে শুধুই প্রহসন!

ছাতার কাজ সারা।  ফাইনাল চেক করে নিয়ে গোপাল একে একে সব সাজিয়ে রাখছে পাশের বেঞ্চটার উপর। মনটা আমার বড় দমে গেল আজ, তিতো হয়ে গেল দিনটা

হাতের কাজ মিটলে গোপাল নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে ফেললো, "নতুন বউ একমাস ও রইল না , কেটে পড়লো ।"

আমার আর কিছু শোনার ইচ্ছে নেই। তা বললে হবে কেন! গোপাল যে আজ হালকা হতে চায়, উগড়ে দিতে চায় ওর চেপে রাখা যন্ত্রনা

"নাতির মুখ দেখবে বলে মাডা আ..বার বিয়ে দিল আমার। কে আর জানেবাপ কেন, সোয়ামি হওয়ারও খ্যামতা নেই আমার। সতীন আনতে যাচ্ছি জেনেও পেথম পরিবার কি ঐ জন্নিই মুচকি হেসেছিল গো বাবু?”

ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। "সে এখন কোথায়? তোমার প্রথম বউ?"

বিষাদের ছায়া, অনুতাপের লেশ কাটিয়ে গোপালের চোখে মুখে ফুটে উঠলো টইটম্বুর কৃতজ্ঞতার আলো। "সেই তো এখনো আমার সংসারটাকে আগলে রেখেছে। ভারা থেকে পড়ে  জখম হলাম, বিল্ডিং এর কাজও আর আমায় দিয়ে চলে না।"

হুঁ, গোপাল বেশ খুঁড়িয়ে হাঁটে, সিধে দাঁড়াতেও পারেনা

"ঘরের বউ বার হলো বলে পাঁচজনে পাঁচকথা কয়। কান দিলে চলে না। খিদে আর কদ্দিন চাপা যায় বলুন দিকি! লোকে যাই বলুক বাবু, পরিবার আমার ঘরের নক্কি, মাথার উপর ছাতা।"




1 মন্তব্যসমূহ

  1. বহুদিন পর নিপাট অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম। খুব যত্ন করে বোনা একটা গল্প। লেখিকার আরও লেখা পড়ার ইচ্ছা রইলো। তবে একটা বানান 'ভাড়া' এখানে ভারা লেখা হয়েছে ওটা সংশোধন করে নেবেন...

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন