খবরটা কিছুদিন ধরেই হাওয়ায় ভাসছিল। কানে আসছিল ডি.এম সাহেবেরও। তবে তিনি গ্রাহ্য করছিলেন না। আর তাঁর অমন রাশভারী ব্যক্তিত্বের সামনে কথাটা খোলাখুলি বলার সাহসও দেখায়নি কেউ। কিন্তু আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে স্ত্রী সুদীপার মুখেও যখন একই কথা শুনলেন, তখন পছন্দের স্যান্ডুইচটা রীতিমতো বিস্বাদ লাগতে শুরু করল। জেলাশাসকোচিত গুরুগম্ভীর মুখটা হয়ে উঠল আরও থমথমে। চুয়ান্ন বছরের এই জীবনে নিজেকে এতটা খেলো, এতটা হীন এর আগে কখনও মনে হয়নি ডি.এম শঙ্কর কুমার সেনের। মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ সব মহলেই এস.কে.সেন এক সমীহ জাগানো নাম। এহেন মানুষটার মানসম্মান আজ ধুলোয় মিশতে বসেছে? তেতো মুখে প্রাতরাশ শেষ করে বললেন,
'বাবু কোথায়? এখনই ডাকো তাকে।'
'বাবু তো সাতসকালেই ইউনিভার্সিটি বেরিয়ে গেল। বলল নটা থেকে স্পেশাল প্র্যাকটিকাল ক্লাস আছে।'
আরও হতাশ হয়ে মাথা ঝাঁকালেন শঙ্কর সেন। তারপর তেমনই বিরক্ত আর ব্যাজার মুখে একটা বিজনেস জার্নালের পাতা ওল্টাতে লাগলেন। অফিসে বেরোতে এখনও দেরি আছে ঘন্টা খানেক।
'বাবু' অর্থাৎ তাঁর একমাত্র পুত্র প্রমিতকে নিয়েই যত সমস্যা। ছাত্র হিসেবে যথেষ্টই ভালো। ফিজিক্স অনার্স ফার্স্টক্লাস নিয়ে পাস করে এখন ভর্তি হয়েছে এম.এস.সিতে। কোনও খারাপ অভ্যেস বা নেশা নেই। পড়াশোনা নিয়েই থাকে। অবসর সময় কবিতা লেখে। কিছুদিন আগেই সদস্য হয়েছে স্থানীয় লাইব্রেরির। মাঝেমধ্যেই বিকেলের দিকে সেখানে যায়। কিন্তু কে জানত এই লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করেই অশান্তি ঘনিয়ে আসবে জাঁদরেল জেলাশাসকের পরিবারে? পাড়ার শরৎ পাঠাগারের বহু পুরনো সদস্য উদয় বাবু। উদয় ভানু মিত্র। স্থানীয় স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। প্রতিদিন বিকেলে লাইব্রেরি যান খবরের কাগজ আর পত্রপত্রিকায় চোখ বোলাতে। ভদ্রলোকের সঙ্গে এই রিডিং রুমেই আলাপ হয়েছিল প্রমিতের। প্রথম আলাপেই দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী উদয় বাবুর সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল স্বল্পবাক প্রমিত সেনের। একদিন কথায় কথায় প্রমিতের কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এলেন উদয় বাবু। 'দেখ, আমার মেয়ে মিষ্টু… টুয়েলভে পড়ে... ফিজিক্সে বড়ই পিছিয়ে পড়েছে… ব্যাচে মাস্টারমশাই যা পড়াচ্ছেন ঠিকমতো ধরতে পারছে না, তুমি বাবা একদিন করে এসে একটু দেখিয়ে দিয়ে যাও... অবশ্যই গুরুদক্ষিণা নিয়ে।'
উদয় বাবুর মুখের ওপরে 'না' বলতে পারেনি প্রমিত। ডি.এম সাহেব জানতে পেরে একচোট রাগারাগি করেছিলেন। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে অন্যের বাড়ি গিয়ে টিউশনি করবে, এটা একটা কথা হল? তবে মেনেও নিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন এলাকায় উদয় বাবুর রীতিমতো সুনাম আছে। পুরনো আমলের মূল্যবোধ নিয়েই এখনও শিক্ষকতাটা করেন তিনি। পিছিয়ে পড়া বা গরিব ছেলেমেয়েদের বাড়িতে ডেকে এনে ফ্রি কোচিং দেন। এছাড়া দরখাস্ত লিখে দেওয়া, ব্যাঙ্কের ফর্ম ফিল আপের মতো কাজ নিয়েও লোকে নির্দ্বিধায় কড়া নাড়তে পারে উদয় বাবুর দরজায়। এদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ ফাঁস করেছে চাঞ্চল্যকর খবরটা। যেটা গতকাল কাজের মেয়ে টুম্পার মুখে শুনেছেন ডি.এমের স্ত্রী সুদীপা দেবী। উদয় বাবুর বাড়িতে নাকি এক অদ্ভুত অবস্থায় দেখা যায় তাদের বাবুকে। মিষ্টুর নাচের শিক্ষক 'ববি দা'র কাছে নাচের তালিম নেয় প্রমিত। আর সেটা তুলিয়ে দেয় ছাত্রী মিষ্টুকে। বিষয়টা আজ শঙ্কর সেনের কাছে পেশ করলেন সুদীপা দেবী।
'হোয়াট দ্য হেল ইজ গোয়িং অন? সব জেনেও কিছু বললে না ইডিয়টটাকে?' গরগরে রাগে পাইপটা আরএকটু হলে পড়েই যাচ্ছিল ডি.এমের মুখ থেকে।
'না, আসলে বাবু আমায় বলল মিষ্টু মেয়েটা ছোটবেলা থেকে যার কাছে নাচ শিখত সেই মাস্টারমশাই নাকি একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বম্বে চলে গেছেন। এখন ববি নামে একটি ছেলের কাছে শিখছে। কিন্তু তার কাছে মেয়েটি একেবারেই ফ্রি নয়। নাচের থেকে আগ্রহই হারিয়ে ফেলছিল। তখন উদয় বাবুই আমাদের বাবুকে রিকোয়েস্ট করলেন ববির কাছে স্টেপিং গুলো শিখে যেন মিষ্টুকে তুলিয়ে দেয় । বাবু তো সায়েন্সের ছেলে। মাথা ভালো। আর নাচও তো অঙ্কের মতোই...'
'অসাধারণ! আমারই তো শুনে নাচতে ইচ্ছে করছে! হোয়াট ননসেন্স! আর মেয়েটাই বা এত ফ্রি কেন বাবুর কাছে? ঐ উদয় মাস্টারের ব্যবস্থা আমি করছি। ওর মতলব বোঝা হয়ে গেছে আমার।'
'আহা! অত মাথা গরম করছ কেন? বাবু তো ও বাড়িতে পড়াতেই যায়। পড়ানো হয়ে গেলে আধঘন্টা...'
'ধেইধেই করে নাচে।' স্ত্রীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন এস.কে.সেন। 'হোপলেস! রিডিকিউলাস! তুমি মাস্টারের বাড়িতে খবর পাঠাও। যেন সন্ধেবেলা দেখা করে আমার সঙ্গে।' হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল। সাহেবকে নিয়ে রওনা হল অফিসের পথে।
সাহেব ফিরলেন সন্ধে সাতটায়। ফিরেই বুলেটের মতো প্রশ্ন, 'খবর পাঠিয়েছিলে ও বাড়িতে? কখন আসবে বলেছে মাস্টার?'
'টুম্পাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম।' আমতা আমতা করে বললেন সুদীপা দেবী। 'কিন্তু উদয় বাবু আসতে চাইলেন না। বললেন, ডি.এম বাংলোর কেতার সঙ্গে উনি অভ্যস্ত নন। তোমাকে অনুরোধ করেছেন ওনার বাড়ি যেতে।'
'এত বড় অডাসিটি? ডি.এমকে ডেকে পাঠায়?'
ঘড়ঘড়ে গলায় ঘোঁতঘোঁত করে উঠলেন শঙ্কর সেন।
ডি.এম বাংলো থেকে গাড়িতে মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে উদয় বাবুর দোতলা সাবেকি বাড়ি। সদর দরজায় গাড়ি থামার শব্দ পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন উদয় বাবু। বছর পঞ্চাশ বয়স। সৌম্য দর্শন। পরনে ফতুয়া আর পাজামা। 'কী সৌভাগ্য! আসুন স্যার আসুন!' ডি.এম সাহেব জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন চারদিকে। তাঁর চোখে পড়ে গেছে দরজার কাছে ছাড়া ছেলের জুতোজোড়া। পুরনো আমলের বৈঠকখানার মতো একটা ঘরে ততোধিক পুরনো সেগুন কাঠের একটা চেয়ারে বসেছেন শঙ্কর সেন।
'বলুন স্যার কী জন্য ডেকেছিলেন আমাকে?'
'আমার ছেলের স্টেটাসটা জানতে এলাম। ও কি আপনার মেয়ের ফিজিক্সের টিচার? নাকি নাচের কোরিওগ্রাফার?'
'এখন তো ফিজিক্সই পড়াচ্ছে। ঐ ওপরের ঘরটায় বসেছে ওরা।' শান্ত গলায় বললেন উদয় বাবু।
'তবে মিথ্যে বলব না, নাচের ব্যাপারেও সে আমার মিষ্টুমাকে অনেক সাহায্য করে। এজন্য প্রমিতের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।'
'রাখুন মশাই আপনার কৃতজ্ঞতা!' গর্জে উঠলেন ডি.এম সাহেব।
'আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেয়েও পড়তে যায়নি। ফিজিক্স নিয়ে হায়ার স্টাডি করবে বলে। ফিজিক্স ওর প্রাণের সাবজেক্ট। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ আর লেকচারশিপের জন্যই ওর জন্ম। এর সঙ্গে ডান্স? আপনার মেয়েকে বলুন ওর ঘাড়ে না চেপে নাচের ব্যাপারে স্বাবলম্বী হতে। ওকে দিয়ে নাচ করিয়ে আপনি ওকে আর ওর সাবজেক্টকে অপমান করছেন। ফিজিক্স থেকে ওর ফোকাস সরিয়ে দিচ্ছেন। ওর ওপর মেন্টাল টর্চার করছেন। নিজে শিক্ষক হয়ে এ কাজ করাতে লজ্জা করে না আপনার?'
উদয় বাবুর মাথা নিচু। তবে লজ্জায় নয়। মাথা হেঁট করে কিছু একটা খুঁজছেন তিনি। পেয়েও গেলেন। একটা কাগজ।
'এটা চিনতে পারছেন স্যার?'
'না চেনার কী আছে? এতো ইলেকশন ডিউটির চিঠি।' অসহিষ্ণু গলায় বললেন শঙ্কর সেন। 'আমার অফিস থেকেই পাঠানো হয়েছে। আপনার ডিউটি এসেছে। ইউ হ্যাভ টু গো!' একটু বাঁকা হেসে বললেন ডি.এম সাহেব।
'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?' হঠাৎই যেন এক অদম্য শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলেন উদয় বাবু।
'আমি একজন শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষাটার বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়ার জন্যই আমার জন্ম। গন্ধমাদনের মতো গোদাগোদা ভোটের মেশিন বয়ে বুথে যাওয়ার জন্যে তো আমি শেক্সপিয়ার, বায়রন, কীটস পড়িনি। বি.এড ট্রেনিংটাও ভোট করানোর জন্য আমাদের দেওয়া হয়নি। শিক্ষকের পেশার সঙ্গে ভোটের ডিউটির সম্পর্কটা ফিজিক্স আর কত্থক নাচের মতোই হাস্যকর নয় কি? এটা মানসিক অত্যাচার নয়? ভোটের শমন পাওয়ার পর থেকেই আমাদের পড়ানো, খাতা দেখা এসব মাথায় ওঠে। আসল কাজ থেকেই ফোকাস চলে যায়। তাতে আখেরে ক্ষতিটা হয় ছাত্রছাত্রীদেরই। কোন সভ্য দেশে শিক্ষক সমাজকে ভোটের কাজে পাঠানো হয় আমাকে বলবেন? শিক্ষকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অনেক বছর তো হল। এবার একটা আলাদা ভোটবাহিনী তৈরি করুন। প্রশাসন একটু সাবলম্বী একটু সাবালক হোক।'
উদয় বাবুর স্ত্রী ঘরে ঢুকেছেন প্লেট ভর্তি নারকেল নাড়ু নিয়ে। উদয় বাবুর বাগ্মিতায় ডি.এম শঙ্কর সেন যেন বাকরুদ্ধ! বজ্রাহতের মতো বসে বসে একটার পর একটা নাড়ু মুখে পুরে চলেছেন বিনাবাক্যব্যয়ে। আর ওপরে মিষ্টুর পড়ার ঘর থেকে আওয়াজ কানে আসছে…
'ধা দেন তা তেটে তাকা গাদি ঘেনে ধা…'
রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সপাটে থাপ্পড় এই লেখা। অসাধারণ আজ পরপর দুটো গল্প পড়লাম দুটোই অনবদ্য। লেখকের কলমকে কুর্নিশ...
উত্তরমুছুননামকরণটাও অভিনব কায়দায়...
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন