বঙ্গদেশে রঘু ডাকাতের মতো বিখ্যাত ডাকাত বোধকরি আর দুটি নেই। ছোটোবেলায় ভয় দেখানোর গল্প থেকে শুরু করে মানুষ রঘু ডাকাত পর্যন্ত গল্পগুলো এতো বেশি জায়গা দখল করে আছে যে, রঘু ডাকাত বাঙালীর কৃষ্টির সাথে মিশে গেছে। প্রকৃতপক্ষে রঘু ডাকাত সম্পর্কিত গল্প এতো বেশি যে, সেখান থেকে আসল গল্পের খোঁজ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। রঘু ডাকাতের রঘু ডাকাতের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে দুশো বছর আগে। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো একসময়। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল রঘু ঘোষ। সেসময় বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে চলেছিলো ইংরেজ কোম্পানির শাসন। বাংলার ধানী– ফসলি তখন ইংরেজদের নীলচাষের অত্যাচার চলছে। এভাবেই দিন দিন নীলচাষের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বাংলার কৃষকদের ওপর। যারা কোম্পানির নির্ধারিত নীল চাষে আপত্তি করতো, তাদের পেয়াদা মোতায়েন করে তুলে এনে চলতো বেদম প্রহার। নীলকর আর তাদের পেয়াদারদের অত্যাচারে নাভিশ্বাস উঠে যেতো সাধারণ বাঙালি কৃষকদের। এমনি একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন রঘু ঘোষের বাবা। নীলচাষে অস্বীকৃতি জানানোয় পেয়াদারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বেদম প্রহার করে। নৃশংসভাবে প্রহার খেতে খেতে তিনি মারা যান। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে রঘু মরিয়া হয়ে ওঠেন। রঘু লাঠি খেলায় ভীষণ পারদর্শী ছিলেন। তার সেই খেলার লাঠিই হয়ে ওঠে নীলকর বধের অস্ত্র। সেই অস্ত্র তিনি নিজের হাতে তুলে নেন, সেই সাথে অত্যাচারিত আরো মানুষদের সংগঠিত করেন। গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় রঘু ঘোষের বাহিনী। দলবল নিয়ে নীলকুঠি গুলিতে লুটপাট চালান রঘু ঘোষ। এরপর জ্বালিয়ে দেন নীলকরদের আস্তানা। ধীরে ধীরে এলাকার অত্যাচারী ও সামন্তদের বাড়িঘর লুট শুরু করেন। তবে জমিদার ও নীলকরদের কাছে তিনি ছিলেন লুটতরাজকারী। নীলকরদের নৃশংস অত্যাচারকে কেন্দ্র করে রঘু ঘোষ অবতীর্ণ হন রঘু ডাকাত রূপে। রঘু ঘোষ কলকাতার মানুষ কলকাতার মানুষ না বাইরের, সেই বিতর্ক পাশে সরিয়ে রেখে কিছু দুর এগোলে দেখতে পাওয়া যায়, রঘু ডাকাতের নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করা এক গ্ৰামের। ইংরেজরা তখন রঘু ডাকাতের পিছনে মরিয়া হয়ে পড়ে আছে। কিছুতেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না তার। এদিকে রঘু ডাকাতও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পুলিশের থেকে। পান্ডুয়া নামের একটি গ্ৰামে আশ্রয় নেন। এরপর লোকালয় অনিরাপদ হয়ে উঠলে আশ্রয় নেন দেবীপুরের জঙ্গলে। রঘু ঘোষের ভাইয়ের নাম ছিল বিধুভূষণ ঘোষ। বিধুভূষনও ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। দুই ভাই মিলে যখন গা ঢাকা দেন দেবীপুরের ঘন জঙ্গলে, তখন অদ্ভূত এক বাসনা জাগে রঘুর মনে। এই জঙ্গলে তিনি গ্ৰাম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। রাতের অন্ধকারে তিনি পাঁচঘর ব্রাহ্মণ গ্ৰামে আনেন। এদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রঘু ডাকাতের গ্ৰাম। রাতের অন্ধকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে এই গ্ৰামের নাম হয় নিশিনগর। পরবর্তীতে গ্ৰামের নাম হয় নিশিরানগর। এভাবেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে রঘু ডাকাতও গড়ে তোলেন একটি গ্ৰাম। রঘু ডাকাতের প্রায় সব গল্পেই মা কালীর এক বিশেষ অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। কারণ, রঘু ডাকাত নিজেই ছিলেন কালির ভক্ত। কথিত আছে, একদিন তিনি পুকুরঘাট ধরে হাটছিলেন। হঠাৎ পুকুরের ধারে দুটি মাটির প্রতিমা দেখতে পান। একটি ছিল মহেশ্বরের, কিন্তু অপরটি তিনি চিনতে পারেননি। তবে নিশ্চিতভাবে সেটা ছিল কোনো দেবীমূর্তি। সেই রাতেই রঘু ডাকাত স্বপ্নে দেখেন কালীর দেবীমূর্তি তাকে আদেশ করছে প্রান প্রতিষ্ঠার জন্য। কালবিলম্ব না করে সেই মূর্তিতে প্রান প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকেই ভক্ত হয়ে যান মা কালীর। অমিয় শক্তির অধিকারী দেবী কালীকে পূজা করতেন নিয়মিত। পূজার ভোগ হিসেবে থাকতো ল্যাটা মাছ পোড়া। সেই মহাভোগ খেয়েই ডাকাতির জন্য বেরোতেন রঘু ডাকাত। পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানেই এখনও কালী পূজার ভোগ হিসেবে ল্যাটা মাছ পোড়ানো হয়। ডাকাতদের এই আশ্চর্য দেবীভক্তি দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কালী তো আদতে দেবী শক্তি, রবীন্দ্রনাথের “ বাল্মীকি প্রতিভা” তেও তো দস্যু রত্নাকরের কালীপূজা ও নরবলির প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন রঘু ডাকাতের গল্পের সাথে অবলীলায় জড়িয়ে গেছে সাধক কবি রামপ্রসাদের কাহিনী।
কার্তিকের অমাবস্যা তিথি । কিন্তু সেদিনই পথঘাট আশ্চর্য নিঝুম,
জনমানবশূন্য। রঘু পড়লেন মহা বিপাকে। মায়ের
বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়েছে, এদিকে বলির দেখা নেই। ঠিক সেদিনই নিজের বাড়ি হালিশহর
ফিরছিলেন সাধক শ্রেষ্ঠ রামপ্রসাদ। তাড়াতাড়ি ত্রিবেনীর গঙ্গাঘাটে যাওয়ার
উদ্দেশ্যে দৈব দুর্বিপাকে রঘু ডাকাতের কুখ্যাত জঙ্গলে পা রাখেন তিনি। বলি দেবার
উদ্দেশ্যে তাকেই বেধে মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে আসে রঘু ডাকাতের দল। তাকে বলির জন্য
প্রস্তুত করা হয়। তবে বলির আগে দেবী কালীর সন্মুখে একটি গান গাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ
করেন রামপ্রসাদ। এমন সময় রঘু ডাকাত বলিকাষ্ঠে রামপ্রসাদের বদলে দেবী কালীকে দেখতে
পান। এই ঘটনার ফলে রামপ্রসাদকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং পরদিন সন্মানের সাথে বাড়িতে
পৌঁছে দেয় তার লোকজন। এরপর থেকেই নরবলির প্রথা বন্ধ করে দেন রঘু ডাকাত। মানুষের
বদলে চালু করেন পাঠাবলি। প্রকৃতপক্ষে, রঘু ডাকাতকে ঘিরে কল্পকাহিনী এত বেশি যে তার
কিংবদন্তি তাকেই ছাড়িয়ে গেছে। কলকাতার পূর্নদাস রোডের কালীমন্দিরের কথাই ধরা
যাক। এই মন্দিরে এক ফুট উচ্চতার ছোটো একটি কালীমূর্তির পূজা করতেন মনোহর ডাকাত।
কিন্তু মনোহর ডাকাতের নামে নয়, লোক সেটাকে চেনে রঘু ডাকাতের কালীবাড়ি নামে। এরকম আরো
অসংখ্য রঘু ডাকাতের কালীবাড়ি আছে বর্ধমান মূর্শিদাবাদ বীরভূম আর হুগলি জেলায়।
এসবের প্রতিষ্ঠাতা অন্য কেউ হলেও লোক এগুলোকে চেনে রঘু ডাকাতের কালীমন্দির নামেই।
বর্ধমান জেলার কেতুগ্ৰামে রয়েছে একটি সতীপীঠ। যার নাম অট্টহাস সতীপীঠ। বলা হয়ে থাকে এখানে সতীর নিম্নোষ্ঠ পড়েছিল। প্রথমে এই সতীপীঠকে ওষ্ঠহাস সতীপীঠ বলা হতো। পরে সেটি নামান্তর হয় অট্টহাস সতীপীঠ। এই মন্দিরে আসল দেবীমূর্তি নেই রয়েছে নতুন একটি অষ্টধাতুর মূর্তি। এই সতীপীঠের পেছনের জঙ্গলেই ছিল রঘু ডাকাতের ডেরা। যার নাম লোককথায় বেশি পরিচিত। এই রঘু ডাকাতের নাম শুনলেই বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। শোনা যেত প্রতি অমাবস্যার রাতে নরবলি দিয়ে নাকি রঘু ডাকাত ডাকাতি করতে বেরোতেন। তিনি ছিলেন রটন্তী কালীর ভক্ত। প্রতি মাঘী অমাবস্যার দিন এই জঙ্গলে রটন্তী কালীর পূজা করতেন রঘু ডাকাত। তারপর নরবলি সেই বলির মুন্ড ত্রিশুলে বেধে রেখে ডাকাতি করতে বের হতেন রঘু ডাকাত।
প্রায় ৫০০ বছর আগে সিঙ্গুরের ডাকাত
কালীমন্দির ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। বৈদ্যবাটি তারকেশ্বর রোডের পাশে
পুরুষোত্তমপুর এলাকায় এই ডাকাত কালীমন্দির অবস্থিত।কথিত আছে,
দক্ষিনেশ্বর যাবার পথে রঘু ডাকাত ও গগন ডাকাত
সারদা দেবীর পথ আটকে দাড়ায় ডাকাতির উদ্দেশ্যে। তারা সারদা দেবীকে জোরজবরদস্তি
জঙ্গলে নিয়ে যেতে চাইলে সেই সময় রক্তচক্ষু মা কালীর দেখা পায় ডাকাতরা। ভুল
বুঝতে পেরে মা সারদার কাছে ক্ষমা চায়। সন্ধ্যা নামায় সেই রাতেই ডাকাতদের
আস্তানায় মা সারদার থাকার ব্যবস্থা করে ডাকাতরা। পরেরদিন সকালে ডাকাতরাই সারদা
দেবীকে সসম্মানে দক্ষিনেশ্বর পৌছে দিয়ে আসে। দিনকে দিন বাড়তে থাকে রঘু ডাকাতের
শক্তি। তিনি রীতিমতো ছেলেখেলা শুরু করেন অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে। একসময়
ডাকাতির পূর্বে তিনি জমিদারদের চিঠি দিতেন যে সেদিন তাদের বাড়িতে লুট হতে পারে।
রীতিমতো যাকে বলা হয় কয়ে ডাকাতি। রঘু ডাকাতের এই দুঃসাহসের নেপথ্যেও ছিল কালীর
অবদান। রঘু বিশ্বাস করতেন, পূজা দিয়ে ডাকাতি করতে গেলে কখনো ধরা পড়বেন
না তিনি। তবে, এক্ষেত্রে তার ভাগ্যকে সুপ্রসন্নই বলতে হয়।
সত্যি সত্যি কখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েননি রঘু ডাকাত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন