পাপের ঘড়া - সবুজ পরিমল


হাওড়া জেলার প্রত্যন্ত কৃষিপ্রধান একটা ব্লক উদয় নারায়ণপুর। ফি বছর দামোদরের জল ঢুকে বন্যায় যার নাম শিরোনামে উঠে আসে। সেই এলাকায় ছোট্ট একটা গ্রামে টিনের একটা দোচালায় পুলক কর্মকারের বাস। কারো সাতেপাঁচে না থাকা এই মানুষটার সংসারে আপন বলতে কেউ নেই। আছে বলতে বাজারে এ গ্রামের একমাত্র ভরসার তার কামারশালটা। সেদিন কাজ মিটিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেলো বেশ। সামনের পুকুর ঘাটে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকেই তার চোখে পড়লো তক্তাপোশের উপর রাখা একটা চটি বই__চিত্তগুপ্তের 'পাপের ঘড়া'...

 শুরু হচ্ছে একটা মেয়ের গল্প দিয়ে__

গ্রামের ইঁটের রাস্তা দিয়ে রোজ কলেজ যায় মেয়েটা, লেখাপড়াতেও খুব মন তার। কলেজে আসা-যাওয়ার পথে রোজ কেউ একটা লক্ষ্য করে তাকে। সে বুঝতে পারে, কিন্তু কিছু বলে না। বেশ কিছুদিন পর একটা বাদলা দিনে ফাঁকা রাস্তায় ওর সামনে এলো ছেলেটা, মনের সব কথাগুলো বললো ভীষণ এক বুক সাহস নিয়ে। শুনে বিদ্রুপের হাসি হাসলো মেয়েটা। একে তো বেজাত, তার উপর আবার ক্লাস এইট ফেল, সাহস হয় কি করে তাকে প্রেম প্রস্তাব দেওয়ার__এই ভেবে যা নয় তাই বলে সে অপমান করলো ছেলেটাকে। লজ্জায়, রাগে ছেলেটা ভিতর ভিতর পুড়লো বটে কিন্তু প্রকাশ করলো না। কিন্তু মুখের উপর এই সরাসরি 'না'-টা কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না সে। পরদিন সকালে রূপসার নগ্ন লাশটার সাক্ষী হয়েছিলো গোটা গ্রাম...

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে ছোট্ট একটা ছেলে। রোজকার মতো আজও সে মায়ের কাছে সমানে বায়না করে যাচ্ছে চিপস্-এর প্যাকেটটার জন্য। শেষমেশ মাকেই হার মানতে হয়। পরের দিন বিশেষ কারণে তাড়াতাড়িই ছুটি হয়ে গেলো স্কুল। বন্ধুদের সাথে কিছু রাস্তা আসার পর বাকি রাস্তা একাই ফিরছিলো সে। ফাঁকা গলির মুখে তার চোখে পড়লো একটা লোক__ কালো-গাট্টাসোট্টা, হাতে একটা চিপস্-এর প্যাকেট। হাতছানি দিয়ে সে ওকে ডাকছে চিপস্-এর প্যাকেটটা দেখিয়ে। ঋষভ জানে অচেনা লোকের থেকে কিছু নিতে নেই, ওর মা ওকে বার বার বলেছে। কিন্তু লোকটা যে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে, কী করবে এবার! দৌড়ে অন্য পারে যেতে চাইলো সে। কিন্তু ভাগ্যের ফের! দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা একটা চারচাকা পিষে দিলো তাকে__কিছুটা ছটফট, তারপর সব শেষ...

নতুন একটা ব্রিজ তৈরি হচ্ছে এলাকায়। ঠিকাদার এসে তার সহকারীকে জানালো পাঁচটা মাথা লাগবে ব্রিজ নির্মাণের জন্য। শীত শেষ হয়ে এসেছে। ভিন গাঁ থেকে খেঁজুর গুড়ের ব্যবসা করতে আসা শিউলিরা মাস দুই এই মাঠের পাশেই ছিলো। খেঁজুর রসের সিজনও প্রায় শেষ। রাত্রে মদন বাউরির পাঁচজনের গোটা পরিবারটাই খেঁজুর পাতার ঝুপড়ি থেকে সমস্ত জিনিসপত্র সহ বেপাত্তা। কেউ এতটুকু সন্দেহও করলো না...

প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ভোরের আলোয় ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে একটু তাজা শ্বাস নিচ্ছেন। আশপাশের চৌহদ্দির মধ্যে কেউ কোত্থাও নেই। মনটা একেবারেই ভালো নেই তাঁর, ছেলে-বৌমা মিলে সম্পত্তি নিয়ে যেভাবে পড়েছে! কিছুই ভালো লাগছে না, বার বার তাঁর একটা কথাই মনে হচ্ছে বিষয় না বিষ! অশীতিপর নিখিলেশ বাবুর হঠাৎ মনে হলো পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ, পিছনে ঘুরে কিছু দেখে উঠবার আগেই সপাটে একটা ধাক্কা!! ‘ঝুপ করে শুধু একটা শব্দ হলো নিচের জলে...

নদীর পারে একটা শ্মশান। সেই কারণেই এদিকটা লোকজন বড় একটা আসে না। মদের নেশায় দুজনের পুরোনো যত গল্প উঠে আসছে প্রতিটা ঢেঁকুড়ের সাথে। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন শুনছে ওদের কথা। একটু খোঁজাখুঁজি করতেই বেরিয়ে এলো বছর চোদ্দো-পনেরোর দুটি ছেলে-মেয়ে। দুই মদ্যপের সমস্ত কৃতকর্মের বৃত্তান্ত শুনে ফেলেছে ওরা। অতঃপর 'কাউকে কিছু বলবো না' বললেও চিড়ে ভেজে না। সামনেই বর্ষায় ভরা নদী__ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে দুই করাল মূর্তি। চুলের মুঠি ধরে চুবিয়ে ধরে চেপে ধরে থাকে তারা, ছটফট করাটা থেমে না যাওয়া পর্যন্ত। নদীর স্রোতেই ভেসে যায় রোহিত-শিঞ্জিনী, অজ্ঞাত লাশ হয়ে...

পুলক কর্মকার ততক্ষণে ঘামতে শুরু করেছে। ধরা পড়ে যাবে সে। এতদিনের মুখোশটা এবার খসে পড়তে চলেছে। তার দিন শেষ হয়ে এসেছে। বইয়ের একটা লেখাও তো গল্প নয়, প্রতিটাই তার কৃত একেকটা অপরাধের নিখুঁত বর্ণনা। কিন্তু সে তো একটা কাজও একজনকেও সাক্ষী রেখে করেনি। তাহলে কে দেখেছে তাকে! এমন কেউ; যে আড়ালে থেকে ছায়ার মতো সমস্ত কিছুর উপর লক্ষ্য রেখে গিয়েছে সারাক্ষণ। তার উপর শেষের লেখা ঘটনাটা তো আবার আজ সন্ধের...

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন