যুক্তরাষ্ট্রের মিউজিয়ামে প্রথম ভারতীয় পাইলট: জোয়া আগরওয়াল - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

 


বয়স মাত্র আটত্রিশ। তার মধ্যেই একের পর এক অভাবনীয় কাজের এবং বিশেষ বিশেষ স্বীকৃতির পালক গাঁথা হয়ে গিয়েছে এই ভারতীয় ললনার মুকুটে। নাম জোয়া আগরওয়াল। সান ফ্রান্সিসকোর এসএফও মিউজিয়ামে বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নমুনা সংরক্ষণ করা হলেও এতদিন পর্যন্ত কোনো মানুষকে সেখানে স্থান দেওয়া হয়নি। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন জোয়া, নিজের কাজের মধ্য দিয়ে

কিন্তু কীভাবে? এসএফও মিউজিয়ামে উড়ানশিল্পের ইতিহাস সম্পর্কিত দেড় লক্ষ বস্তু সংগ্রহে থাকলেও কোনও পাইলট এখানে জায়গা পাননি। এতকাল যাবৎ শুধুমাত্র নিদর্শনই সংগ্রহ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় মিউজিয়ামে নিজের জায়গা করে নেওয়ার অর্থ, নিশ্চয়ই কোনো দুরূহ কাজ সম্পন্ন করেছেন জোয়া যার জন্য এই উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি

কাজটি যে অত্যন্ত কঠিন ছিল সেবিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ২০২১ সালে মহিলা ক্রু-দের একটি দল নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়েন জোয়া। সান ফ্রান্সিসকো থেকে তাঁরা যাত্রা শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে উত্তরমেরু হয়ে ভারতের বেঙ্গালুরুতে গিয়ে তাঁদের সফর শেষ হয়। এখনও পর্যন্ত এটিই পৃথিবীর দীর্ঘতম আকাশপথ যেখানে বিমান উড়িয়েছেন জোয়াদের দল। প্রায় ১৬ হাজার কিলোমিটারের আকাশপথ বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং কঠিন বলে পরিচিত। সুমেরুর উপর দিয়ে বিমান উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সবসময় চ্যালেঞ্জের। এর মুখ্য কারণ চরম আবহাওয়া ও বরফে ঢাকা দিগন্ত। বিমান সংস্থাগুলি তাদের সেরা পাইলটদের এই দায়িত্ব দেয়। এয়ার ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন জোয়া আগরওয়াল তাঁর নেতৃত্ব দ্বারা সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে সমগ্র বিশ্বকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তার ফলস্বরূপ এমন স্বীকৃতি

যে মিউজিয়ামে নিজের স্থান করে নিয়েছেন জোয়া সেটি ১৯৮০ সালে প্রথম সান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার দরজা খুলেছিল। এসএফও মিউজিয়ামের উদ্দেশ্য হল বৈচিত্র্যময় প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের বিনোদন দেওয়া, জড়িত করা এবং অনুপ্রাণিত করা। বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের ইতিহাস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যা করা এবং সান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জনসাধারণের অভিজ্ঞতা বাড়ানো এর লক্ষ্য। শতসহস্র নিদর্শনের মাঝে নতুন সদস্যরূপে এই মিউজিয়ামে যুক্ত হলেন জোয়া

একমাত্র ভারতীয় হিসাবে বিদেশের মাটিতে এমন সম্মান পাওয়ায় তিনি আপ্লুত। তাঁর কথায়, ‘‘এই প্রাপ্তি যে কারও কাছেই সৌভাগ্যের। স্বপ্নের মতো লাগছে। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। দায়িত্ব বেড়ে গেল। নিজের সবটুকু দিয়ে অবশ্যই চেষ্টা করব।’’

বোয়িং ৭৭৭ বিমানের সিনিয়র এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট জোয়ার সাফল্য কিন্তু এই প্রথমবার নয়। এর আগে ২০১৩ সালেও একটি রেকর্ড গড়েন তিনি। সেবার সর্বকনিষ্ঠ মহিলা পাইলট হিসাবে বোয়িং ৭৭৭ বিমান উড়িয়েছিলেন। তিনিই প্রথম মহিলা কমান্ডার যিনি হিন্দুকুশ পর্বতমালার উপর দিয়ে একটি বোয়িং ৭৭৭ বিমান ওড়ান। মানতেই হবে, বিমানচালনার সঙ্গে এক সুগভীর বন্ধুত্ব জোয়ার, যার শুরুটা হয়েছিল অনেক আগে

জোয়ার জন্ম ১৯৮৬ সালে, দিল্লীতে। শৈশব থেকেই পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করে দিল্লীর সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে বিএসসি করেছিলেন। তারপর আরম্ভ হল বিমানচালনার জন্য পড়াশোনা। ২০০৪ সালের মে মাস থেকে জোয়া এয়ার ইন্ডিয়ার সাথে যুক্ত হন। প্রথম যখন তিনি চাকরির জন্য দরখাস্ত জমা করেন, শূন্যপদ ছিল মাত্র ১০টি এবং আবেদনকারী ৩০০০। তার মধ্যে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন জোয়া। তিনি বিশ্বাস করেন, যারা চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পায় না, সাফল্য তাদের কাছে আসবেই

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "আমি এই স্বপ্ন প্রথম দেখেছিলাম যখন আমার আট বছর বয়স ছিল, আমি তখন থেকেই তারাদের স্পর্শ করতে চাইতাম। এই সব নিয়ে বাড়িতে অনেক অশান্তি হয়েছে, কিন্তু আমি দমে যাইনি। কাজ শুরু করার পরেও আমাকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এই সব কিছুর পরও নিজের দেখা স্বপ্ন সত্যি করেছি। তাই সমাজের অন্য মেয়েদের উদ্দেশে বলব, স্বপ্ন দেখা খুব ভালো বিষয়। তবে তা বাস্তবায়নে বিশ্বাস রাখতে হবে। মনোযোগ দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, নিজের ১০০ শতাংশ দিতে হবে। তাহলেই একদিন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন!"

শুধু মিউজিয়ামে স্থান পাওয়াই নয়, আন্তর্জাতিক যুব দিবসে (International Youth Day) রাষ্ট্রসংঘ জোয়া আগরওয়ালকে জেনারেশন ইকুয়ালিটির (Generation Equality) মুখপাত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। জোয়া জানিয়েছেন, “আমি গর্বিত একজন মহিলা হিসেবে রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি। এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মী হিসেবেও নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।” সমগ্র বিশ্বের সামনে নিজেকে যোগ্য প্রতিপন্ন করার পাশাপাশি দৃঢ়চেতা জোয়া একের পর এক সাহসিকতার পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। কোভিড অতিমারীর সময় "বন্দে ভারত" মিশনে ৬৪টি বিমানে করে ১৪,৮০০ জন ভারতীয়কে তিনি নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন

জোয়ার সামনে এখন লম্বা জীবন, দীর্ঘ পথ। আশা রাখি এই পথে চলতে চলতে আরো অনেক অসামান্য কাজ করতে পারবেন তিনি। আরো অনেক স্বীকৃতি লাভ করবেন, যা গর্বিত করবে তাঁকে, গর্বিত করবে আমাদেরও। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁর এই অসামান্য ইচ্ছাশক্তি ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা আগামী প্রজন্মের মেয়েদের অনুপ্রাণিত করবে। নিজেদের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে হার না মানার মনোভাব তৈরি হবে সকল মেয়েদের মনে


 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন