শিশুর জন্য শৃঙ্খলার পাঠ - পৌষালী ব্যানার্জী

 


একটি শিশুকে ভবিষ্যতের জন্য সঠিকভাবে গড়ে তুলতে গেলে শুধুমাত্র তার পড়াশোনার প্রতি যত্নশীল হওয়াই যথেষ্ট নয়। এর পাশাপাশি তার মধ্যে সঠিক স্বভাব, সহবত শিক্ষা এবং শৃঙ্খলাবোধ তৈরী করা সমানভাবে প্রয়োজন। শিশু মনোবিদদের মতে, চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবোধ অত্যন্ত জরুরী, আর তা শিশুকে শেখানো উচিত একেবারে প্রথম থেকে

 শৃঙ্খলাবোধ বা ডিসিপ্লিনের পাঠকে শিশু মনস্তত্ত্ববিদরা মূলত পাঁচ ভাগে ভাগ করে থাকেন

 ক) ইতিবাচক পাঠ – এক্ষেত্রে না-বাচক শব্দের তুলনায় হ্যাঁ-বাচক শব্দ অধিক প্রাধান্য পায়

 খ) পুরস্কারের শর্ত বাঁধা পাঠ – শিশু ভালো কাজ করলে সামান্য কিছু পুরস্কার পেতে পারে, অবশ্যই মূল্যবান কোনোকিছু নয়

 গ) শর্ত বাঁধা পাঠ – শিশুকে বোঝানো হয় যে সে ঠিকমতো কাজ না করলে তার পছন্দের জিনিস করা থেকে তাকে বিরত রাখা হবে

 ঘ) অনুভূতি কাজে লাগিয়ে শেখানো – এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো কাজ করতে তার ভালো না লাগলে তাকে বুঝিয়ে সেটি করানোর চেষ্টা করতে হবে

 ঙ) জেন্টাল ডিসিপ্লিন – যেখানে শিশুর অনুভূতির গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং তার ইচ্ছার সম্মান করা হয়

 দৈনন্দিন জীবনে শিশুকে শৃঙ্খলাবোধ শেখাতে কয়েকটি ব্যাপার খেয়াল রাখা জরুরী :

 ১) শৃঙ্খলার মূল লক্ষ্য হল ঠিক সময়ে ঠিক কাজ। একেবারে ছোট থেকে শিশুকে স্নান, খাওয়া, ঘুমানো এবং সে একটু বড় হওয়ার পর তার লেখাপড়া নির্দিষ্ট সময়ে অভ্যাস করানো প্রয়োজন। সে কখন কী করবে তার জন্য রুটিন বানিয়ে দিতে হবে। ছোট থেকে রুটিন মেনে চলার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে শিশুটি এমনিতেই শৃঙ্খলাবোধ শিখে যাবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা দরকার, শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলা করাও প্রয়োজন। সেই জন্য তার রুটিনে খেলাধূলাও অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে

২) সবসময় “না” বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। নিষিদ্ধ জিনিসের ওপর মানুষের কৌতূহল স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়। বাচ্চার কোনো কাজের বিরোধিতা বকে বা ধমকে করলে বা সরাসরি না বললে ওর জেদ আরও বেড়ে যাবে এবং সেটাই করতে চাইবে

৩) বাচ্চা একটু বড় হলে টিভি, ইন্টারনেট, মোবাইল নিয়ে সে সবসময় ব্যস্ত আছে কিনা নজরে রাখা একান্ত দরকার। অত্যধিক স্ক্রীন টাইমের প্রভাব কিন্তু আচরণে পড়বেই। তাই তার টিভি দেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে

৪) বাচ্চারা মাঝেমধ্যে কিছু কিছু আবদার করে যার দু'-একটা মেনে নেওয়াই যায়। এতে সে খুশিমনে নিজে থেকেই সুন্দরভাবে সব কাজ করে নেবে। তবে যে কাজগুলো করা অশোভন সেগুলো অবশ্যই মেনে নেওয়া যাবে না

৫) ছোটরা বড়দের দেখে শেখে। তাই একটি শিশুর আচরণে শৃঙ্খলাবোধ আনতে গেলে বাড়ির বড়দের আচরণও সুশৃঙ্খল হওয়া প্রয়োজন

৬) শিশু কোনও কারণে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে গেলে বা ভীষণ জেদ দেখাতে শুরু করলে তাকে সেই জায়গা বা পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে ওর মন কোনোভাবে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে

৭) সন্তানকে উন্নত করার আশায় অনেক সময়েই অভিভাবকরা তাকে ছোট করে অন্য বাচ্চাদের বেশি প্রশংসা করে। এটি সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি। এতে বাচ্চার মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি হয়, আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তাই সেরকমটি না করে সন্তানের সব কাজে উৎসাহ দিতে হবে। ঠিকমতো কাজ করে নিলে তাকে পুরষ্কার দিতে হবে। এর ফলে শিশুটি উৎসাহ পাবে

৮) শিশুরা মাঝে মাঝে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কিংবা কোনোকিছুর বায়না করে কান্নাকাটি বা ঘ্যানঘ্যান করতে পারে। সেসময় তাকে একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। নয়তো তার মনে এই ধারণা তৈরি হবে যে কাঁদলেই ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ হবে। প্রয়োজনে তাকে শাসন করতে হবে, যেমন ওর সাথে কথা বলা হবে না বা খেলা হবে না। যাতে সে বুঝতে পারে, বড়দের ইচ্ছারও সম্মান করা উচিত। তবে এই শাসন এবং মারধোর বকাবকির ফারাকটা অভিভাবকদের অবশ্যই মাথায় রাখা জরুরী

৯) বাচ্চারা রোবট নয়। এমন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে সে অবাধ্য হচ্ছে কিংবা শৃঙ্খলা রাখছে না। তখন তাকে বকাবকি না করে বুঝিয়ে বলতে হবে। বকা দিলে বা মারধোর করলে বাচ্চারা জেদি হয়ে যায়

একটি শিশুকে শৃঙ্খলাপরায়ণ করে তোলা নেহাতই সহজ কাজ নয়। কেউ দ্রুত সব শিখে যায়, আবার কেউ সময় নেয়। তাই ধৈর্য্য রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। পিতামাতা হিসেবে সন্তানকে আদর্শ শিক্ষা দিয়ে সুশৃঙ্খল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই হল সবচেয়ে বড় কর্তব্য। অনেক অভিভাবক শিশুকে সুশিক্ষা দিতে গিয়ে কড়া শাসন করে বসেন যেটি সম্পূর্ণভাবে ভুল। অতিরিক্ত শাসনে বাঁধতে গেলে বাচ্চার নিজস্বতা হারিয়ে যায়, শৃঙ্খলাবোধের নামে তার মনে ভীতি তৈরী হয়। তাই সেদিকে লক্ষ্য রেখেই শিশুকে শৃঙ্খলা ও সহবত শেখানোর কাজে যত্নশীল হতে হবে




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন