কালিন্দীর দুঃখকথা - সুদামকৃষ্ণ মন্ডল





- সেই কথাট বইলতে এলম ।  শাল পিয়াল বনে লাকড়ি  কুড়াইঞছি।  সেদিন দেখা হল শিবু পরামানিকের ব্যাটা দেবুর সঙ্গে । একা পাইয়ে ছল চাতুরি বুইঝতে লেগ্যে গেল দুঘন্টা । একবার পলাশ ফুল কুইড়ে লিয়ে দেখায় তো আর একবার চাঁপা ফুলের ডালি লিয়ে গায়ে পইড়ে মুখট হাসি মুখ দেখাঁয়ে কাছে ডাকে । হামি ত চোদ্দ  বছরের ভবকা ছুঁড়ি । সবে আগুনপারা  রঙ লেগেইঞছে।  গন্ধরাজের কুঁড়ির পারা  শরীলে আলো পাবার অধীর অপেক্ষাদু'চখে রঙিন স্বপ্নে মশগুল।  কখন যেন এক ঝামটায় হাতট ধইরে টান মাইরলেক।  লাজে আমর গা ছমছম করল বটে।  ধমক দিলম দুএক কথায় ।  ও শুনলেক লাই। বইললেক,  চল পঁলায়ে যাই।

কুথায় যাবি বল নাডঁর লাইগছে 

ক্যানহ  বিষ্টুফুরের ম্যাল্যাতে ।  খুশির লহর মনকে দিবি । কাঁচচের চুড়হি,  মহুলমোয়ার  মিষ্টি দুবব।  কাজল কিনি দুবব।  লাগরদোলায় চড়িঞ দুবব।  ভালোবাসার পরশ পাবি,  বৃষ্টি হলে দু'জন ভিজব।
       

- পাছে মদে মাতাল বাবাটর কথা মনে পড়লক। কী হবেক হামর সাজবার জিনিস। হামি যে গরীব বাপের বিটি। চেয়ে চিন্তে হাঁড়ির জল ফুটেক।  কালিন্দীর ঢেউতে না পা পিছলে ডুইবে মরেক বাপট।  মা মইরলেক বিনা ওষুদে।  তার লেইগ্যে ত বনে বাদাড়ে ক্ষেত খামারে শুয়ে থাকে।  বারহ মাস  আগুনে ফুটায় দি বনআলুট ভাত। কত কষ্টের বাপ-বেটির দীর্ঘশ্বাসের সংসার।  হামি কাঠ কুড়াঞতে  যাই উঅ ত জানে।  খুঁপায় জুর করি  গুঁইজে দিলেক লাল পলাশ ফুল। ফুল কি আমর মাথায় ভালহ দেখায় গ?  আমকে সাজান দিবক ক্যানে?  বইললেকঠায় দাঁড়া দেখি। চিবুকে আঙ্গুল দিয়া রাখ। একখানা তুঅর ছবি তুলব। হায় !  অকালে সকাল কথা। মুবাইলে ফটক তুইলে দেখাঞ দিলেক। আমর রূপ- নাকের নলক - জঙলি ছিটের ঘটি হাতা ফরক। লাজের মাথা খাইয়েঞ দেখলেক আমর বুকের গড়ন।ঘুইর‍্যে ফিইর‍্যে নিজেই দেখলেক ম্যায়া মাইনষের আরহ কত কি!  নাইবা তুদের বললাম।  বইললেক তু আমর হৃদয় রানী।  আবার রানী?  সে তো রাজার থাকে,  শিবুর ব্যাটা দেবু কি রাজা?  হাতি -ঘোড়া- সৈন্য -সামন্ত - পারিষদ - রাজ বাড়ি- দরবার- হীরা- মণি- মুক্তা এগুলান তো লাই। তাহলে কিসের রাজা?  হৃদয় মানেমনের আবার রাজা হয় নাকিমাত্তর দু'ক্লাশ পড়া ম্যায়া আমি। মনট আমর জুড়াই গেলেক।  লুভ সামলাতে পারলম লায়। রূপ -যৈবনের মোহে পাগল বটে।  যৈবন গন্ধে পাগল।  ফুলের গন্ধে যেমন পেরজাপতি আইসে।  এই ত সেই রঙিন ডানা মেলা পেরজাপতি। গায়ে উঅর রঙিন ছিটের পিরাণ।  টেরি বাগাইঞছে উত্তম কুমারের পারা।  মুখট  হাসি হাসি কইরে বইললেকতুরে আমি ভালোবাসি রে কালিন্দী বিহা করব আমি। এই দ্যাখ - পলাশ রাঙা শাড়ি আনছি। সিঁদুর শাঁখা।  শুনেই  হাসিই আর থামেনা।  কতক্ষণ হাসলম!  হাসতে হাসতে বুকে খিল ধইরে গেলেক।হৃদয় রাজা আমকে বিহা করবেক!  ঢাল লাই তরয়াল  লাই  নিজের ঠিক  লাই নিধিরাম সরদার।  নিজের থাইকবার ঠাঁই আছে কিনা ঠিক লাই  শংকরাকে ডাকে?  হা--হা--হা---হা !  হাসিও পায়।  ম্যায়া মাইনষের রূপ যৈবন রাজা হয়ে যায় ?

তারপরতারপর  দিনকতক শুকনা পাতার 'পরে  আরাম সাজাই লিয়ে সে কি চেইটেপুইটে খাওয়া?  হৃদয় রাজা কি যৈবন খেলায় মাতে?  সে ত কৃষ্ণ,  রাখাল রাজা।  শিবুর ব্যাটা দেবু আবার রাখাল রাজা না হুঁইয়ে কাম-পাগল- রাজা হইতে চায়। শালা পুরুষ মাইনষের এই স্বভাবট গেল না।  উই যে ভদ্দর বইলে যে লোকট চুপ থেকেছে - উঅ ত কম ঢ্যামনা নয় গো। রাত্তির বেলায় ম্যায়ামনকের কাছে রাজা হয়। রাজত্ব তো ওই খাটের চৌহদ্দিটুকু। জমিভূমি- সোনা- দানা  বিশেষ  থাক আর লাইবা থাক।  শরীলের তেজে বুকে মুখ গুঁইজে  হাঁসফাঁস  করে।  ঝাঁটা মারি অমন পুরুষ মাইনষের কপালে কি গো বাবু, ভদ্দরজনেরা ও মা-বুনেরা সপাটে শরীলের মাংস পায়েঞ কি করে?  ধূপ ধুনা দেয়?

বাপট আমর কুথায় চইলে গেল  ? পেলম না ।  আমকে খুঁইজতে খুঁইজতে দেশ দেশান্তর হইল ।  কারণ আমি যে না বইলে দেবুর হাত ধইরে বন পাহাড়ের সবুজ গাছের আড়ালে ছিলাম কতদিন ।  লুকাই লিছে অঙ্গের স্বাদ  । পাখপাখলি দেইখে মজা লুটছে ।  আমর ভরা যৈবন ছিল আজও আছে । পানা পুকুরে মাটির ঢেলা মাইরলে আবার পানায় এসে বুঝাই যায়। যৌবনট কি পানাপুকুর বাবুরা ও ভদ্দরজনেরা বলহ না গ। ট্যাঁকে কড়ি লাই  -খাব কি -পরব কি -কে দিবে মাথর ছায়া-  কে দিবে সান্ত্বনা- কে করবে পেরতিবাদ -আমি ত নিচু জাইতের ম্যায়া গ ?  বাপ -হারা মা- মরা কালিন্দী  । এখানকার নদীর নাম গ।

দেইখতে কালহ -  মুখর গড়ন চাইয়ে দেবু আমর প্যাটে বাচ্চা দিলেক।  ইখন যাব কুথায় নিজে থাইকব কুথায় যাকে প্যাটে রাখছি দু'দিন পর তো পিরথিমীর আলো দ্যাখবেক।  তখন ???  দেবু ইখন লুকাই লুকাই থাকে ।  উআর বাপে হুমকি দিছে যদি আমি উআর  সঙ্গে ব্যাটার বউ হঁয়ে যাই দেবুকে ত্যজ্য পুত্র  করবেক। হুম্ --ম-নে-র রাজা !  এত সুঁদর মন বলে যে গরব ছিল সে মোকে ছেইড়ে কুথায় গেল বইলবেক কেউ ?  আমর কথা শুনে তুমরা পাগল বইলছ ?  পাগলী আমি  ?  না --  ওই লেখ্যাপড়া জানা সাদা রঙিন পোশাকের ভদ্দর শিক্ষিতরা  ?  যারা আমকে সাহায্য করলেক না ?   যারা পেরতিবাদ করলেক না যারা শিবু-দেবুর মতো আগাপাছতলা খায় আর নিঃস্ব  সহায়- সম্বলহীন মানুষদের দাপিয়ে রাখে ভয় দেখায় ?  তুরা জাইতে বলিস নিচু যৈবনটা নিচু হয় না রে ,তাই না  ? রূপবতী ছুঁড়ি দেইখলে হামলে পড়িস  !  ছিঃ -ছিঃ -ছিঃ -ছিঃ- তুদের মুখে থুতু দিলম । যা পারিস কর যদি কিছু করার থাকে । জাত ধর্ম বলি ষাঁড়ের  পারা চেঁচাচ্ছিস ,  যৈবন কি রাজভোগ  যে হাতের কাছে পালেই হাঁ কইরে গিলে খাবি ??   কি মনে করিস মা-বুনের শরীলট মাগনা সাত মাসের বাচ্চা প্যাটে ইখন আমি কুথায় একটু মাথা গুঁজতে  পারি বলতে পারহ ?  ও দিদি -ও মাসি - দিবেক তোমার দাওয়ায়  একটু  আশ্রয়  ? সারাদিন ভিক্ষা করিঞ চ্যালাঞ দুবব।  শুধু রাতটুকু গো শকুন গুলানের ডরে একা একা ভয় করে । উরা পেরাণে মাইরবেক বইলছে । বাপের ঘরে শতেক ফুটা । ভাঙা ঘর।  উলুখাগড়া চাপাই  লাই । ময়লা অগোছলো। একা সাপকোপের  ডর লাগে । যে আইসছে শুধু তার লেগে গো ।  উকে আমর যে বড় চাই গ।  সে-ই পিরথিমীর আলো দেখুক তাকে আমি চাই গ উকে আমি মানুষ করবক।  ব্যাটা হল্যে আদালতের বিচারক ম্যায়া  হল্যেও বিচারক বানাবক।  তুমরা ত কেউ বিচার কইরলেক না  । আমর প্যাটে যে আসছে সেই হবেক বিচারক । আমি দেখাঞ দুবব  শিবুর ব্যাটা দেবুকে ।  তুমরা কেউ তেখন  লুকাইঞতে পারবক লাই । আমি বেঁইচে থাকবক  অনন্তকাল ।  উকে কুনওদিন লুকাইঞতে পারবক লাই গ।

আমর মায়ে লদীর নামে নাম দিছে কালিন্দী । চিরকাল বইব আমি  কেউ মারিঞ ফেলবেক লায়। প্যাটের ছানার নাম কি দুববভারত ?? 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন