বই – দেখি বাংলার মুখ
লেখক
– তমোঘ্ন নস্কর
প্রকাশনী – জয়ঢাক
প্রকাশকাল
– ২০২২
প্রচ্ছদ
– জয়ঢাক গ্রাফিক্স
পৃষ্ঠা
- ১৫১
মুদ্রিত মূল্য – ₹২৭৫/-
“দেখি
বাংলার মুখ” বইটিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি,
ও লোকায়ত রীতির দর্পণ বলা যেতে পারে | লেখক
তাঁর নিজের প্রত্যক্ষ তথা পরোক্ষ অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থনের সরণি বেয়ে পাঠককে
নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন কখনও তাঁর শৈশবের স্বর্ণালি স্মৃতির মাঝে, কখনও বা বিজন প্রকৃতির অভ্যন্তরে, আবার কখনও
বা কোনো লৌকিক উৎসবের মধ্যে | পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাংলার
নানা লৌকিক দেব-দেবীর সাথে, যারা মূলত বেদ-পুরাণের
দেব-দেবী হলেও বাংলার মানুষের লৌকিক আচারের মধ্যে দিয়ে তাঁদের সংস্কৃতির ধারক ও
বাহকের প্রতীক হয়ে গিয়েছেন |
বইটি
পড়ে আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র | একদিকে
লেখকের এই প্রয়াসকে আমি সাধুবাদ জানাই যে তিনি অতীতবিলাসী বাঙালির জন্য এক হারিয়ে
যাওয়া তথা হারিয়ে-যেতে-বসা সংস্কৃতির অমূল্য মণিমাণিক্য তুলে এনেছেন তাঁর লেখনীতে |
“দেখি বাংলার মুখ”এ এমন অনেক কিছুর সাথে পরিচিত হলাম যা সম্পর্কে
আমার বিশেষ বা কোন ধারণাই ছিল না- যেমন নক্সীকাঁথার বাইশা, সন্ধ্যা হাঁড়ি, উলুটি নকশা, খসলা, কুড়নো ছাতু, কাঁদুনে
মা, মাদানা মা, পাঁচু ঠাকুরের
পার্বণ, ঘেঁটু পুজো, ভাদু উৎসব,
ইত্যাদি | এর জন্য লেখকের একটি আন্তরিক
ধন্যবাদ যে অবশ্যপ্রাপ্য তা অনস্বীকার্য |এছাড়া কিছু
বিশেষ উদ্ধৃতি/উক্তিও মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো | যেমন
“বিস্মৃত ধূসর ঈশ্বরেরা” প্রবন্ধের শুরুতে ওলেগ কোরাবেলনিকভের “পক্ষীমিনার”এর
উদ্ধৃতি-
“নিজেদের
শেকড় খুঁজতে তুই ইদানিং পুবপশ্চিম-ঈশান-নৈঋত তোলপাড় চালাচ্ছিস বলে খবর পাই |
খোঁজ
না কিন্তু কোত্থাও পাবি না এই বলে দিলাম | কেন জানিস? তোদের শেকড় পোঁতা আছে এইখানে |”
হয়তো
সমগ্র বাঙালির জন্য কথাটা প্রযোজ্য নয়, কিন্তু আমি নিশ্চিত অনেক বাঙালিই আজ তাঁদের শেকড়বিস্মৃত | বিশ্বায়ন মানুষে-মানুষে বৈশ্বিক বিভেদ হয়তো ঘুচিয়ে দিয়েছে কিন্তু
মাঝে-মধ্যে আশঙ্কা হয়, নিজের সংস্কৃতির মূলকে ভুলে গেলে
বাঙালির অবস্থা কবিগুরুর ভাষায় “আপনি কেটেছে আপনার মূল; না
জানে সাঁতার, নাহি পায় কুল”এর মতো সঙ্গীন হয়ে উঠবে না তো?
কেউ কী তাঁর নিজের সত্তাকে ভুলে সত্যিই ভাল থাকতে পারে? কে জানে!
আবার
“জাঁতা” প্রবন্ধের পুরুত ঠাকুরের বলা কথাগুলো ভারী সুন্দর- “মা,
তোমার কাছে সমর্পণ হোক বৃন্তচ্যুত জবাটির মতো | তোমার দারুণ পদাঘাতে ভেঙে দাও আমার বক্ষস্থল | কামনা, বাসনা, দর্প,
অহংকার, গ্লানি সব গুড়িয়ে দাও | বদলে এঁকে দিয়ে যাও পদচিহ্ন | তাকে লালন করতে
পারি যেন আজীবন |”
একমাত্র
নিখাদ প্রেমেই কি মানুষ এমনভাবে আত্মসমর্পণ করে না?
কিন্তু
অন্যদিকে লেখকের লেখনী নিয়ে আমি যে কিছুটা হতাশ সেটাও স্বীকার করা সমীচীন |
“দেখি বাংলার মুখ” বইটি লেখা হয়েছে ছোট ছোট প্রবন্ধের সংকলন
হিসেবে| এক-একটি প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার
রীতি-সংস্কৃতি-প্রকৃতির এক-একটি দিক | কিন্তু সবকটি
প্রবন্ধ সমান যত্ন নিয়ে লেখা নয় | কিছু জায়গায় লেখনী এত
সুন্দর যে কল্পনায় মানসচক্ষে সবকিছু যেন আপন স্মৃতির মতই ফুটে উঠে | লেখকের নস্টালজিয়ার পরশ লাগে নিজের মনেও | কিন্তু
কিছু-কিছু জায়গায় গিয়ে আবার সব যেন কেমন শুকনো বর্ণনায় পরিণত হয় | পড়তে একঘেয়ে লাগে | সেইসাথে জায়গায়-জায়গায়
বিসদৃশ বাক্য গঠন ও পুনরাবৃত্তি সম্পাদনায় যত্নের অভাবের ইঙ্গিত দেয় | অনেক জায়গায় কিছু অপ্রচলিত শব্দের অর্থ আরেকটু স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন
মনে হয়েছে কিন্তু তার পরিবর্তে পাঠকের উপরেই আন্দাজ করে নেওয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া
হয়েছে (যেমন “মেজলা”)| শব্দের অর্থ না বুঝলে যে পাঠকের
কল্পনা বাধাপ্রাপ্ত হয় আর কল্পনা বাধা পেলে যে লেখার রসাস্বাদনও বাধা পায় এইটুকু
সম্পর্কে লেখকের একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল হয়তো |
এছাড়া
বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের শেষে লেখকের নস্টালজিক দীর্ঘশ্বাসও একটা সময়ের পর একটু গতে
বাঁধা মনে হয়েছে | হয়তো স্বতন্ত্র
প্রবন্ধ বলেই একই আবেগের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে | কিন্তু এতে
করে কেমন একটা ধারণা হয় বাংলার সংস্কৃতি-রীতি-প্রকৃতি সবই যেন অতীতের বস্তু,
হয় হারিয়ে গিয়েছে নয়তো হারিয়ে যেতে বসেছে | মনে প্রশ্ন জাগে-কিছুই কী তবে আর নেই বাকি? এটা
সম্ভবত সত্যি নয় | বা কবিগুরুর ভাষায় বললে “রাতের সব
তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে” |
তার
চেয়েও বড় কথা, লেখক শেষের দিকে একাধিক
প্রবন্ধে দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন অথচ ভারতীয় দর্শনের মূল
শিক্ষা যেটা-পরিবর্তনই জগতের নিয়ম-সেটাই অনুধাবন করলেন না? শুধুমাত্র পুরোনোকে আঁকড়ে বাঁচার নামই কী “বাংলার সংস্কৃতি”? সংস্কৃতির বিবর্তন নেই?
যাই
হোক,
সম্পাদনার কিছু ত্রুটিকে ক্ষমা করলে আর লেখকের অতীতবিলাসিতার
আতিশায্যকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে “দেখি বাংলার মুখ” একটি ভাল বই-ই বলব |
আমার তরফ থেকে পড়ে দেখার পরামর্শ অবশ্যই রইল |
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন